Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website.
The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

লকডাউনে বিশ্বজুড়ে বেড়ে যাচ্ছে পারিবারিক সহিংসতা

করোনা ভাইরাসের সংক্রমণের পর থেকে নিত্যনতুন ভালো-মন্দ সব ধরনের পরিবর্তন দেখা যাচ্ছে বিশ্বজুড়ে। মানুষের জীবনে একদিকে যেমন ধ্বংস নেমে আসছে, সেখানে আরেকদিকে প্রকৃতি ফিরে পাচ্ছে তার সজীবতা। তবে একটি বিষয়ে কোনো পরিবর্তন নেই। আর তা হলো পারিবারিক সহিংসতা।

ঘরের বাইরে এখন তীব্র উত্তেজনা কাজ করছে। কখন, কে, কীভাবে সংক্রমিত হতে পারে তার কোনো ঠিকঠিকানা নেই। কীভাবে এই পরিস্থিতি থেকে বাঁচা যাবে তার কোনো সঠিক উত্তর কারো কাছে নেই। সঠিক চিকিৎসা নেই, চিকিৎসা থাকলেও পর্যাপ্ত সামগ্রী নেই, সেগুলো থাকলেও অনেক ক্ষেত্রে বাঁচার পথ নেই অনেকের কাছেই। এরকম হাহাকারেও ওঁত পেতে রয়েছে কিছু মানুষরূপী নিকৃষ্ট প্রাণী। জরুরি ভিত্তিতে দেওয়া ছুটির সময়টুকু তারা কাজে লাগাচ্ছে নির্যাতন ও অত্যাচার করার তাগিদে। কোনো পরিস্থিতি বা কোনো শিক্ষাই যেন তাদের সঠিক পথে আর আনতে পারছে না। আসলে এ ধরনের মানুষেরা শক্তি ও প্রভাব দেখানোর লালসায় নির্যাতন করার একটি অদ্ভুত মানসিকতা ছাড়তে পারে না। এর ফলে এই দুর্দিনেও বেড়ে চলেছে পারিবারিক সহিংসতা।

এই দুর্দিনেও বেড়ে চলেছে পারিবারিক সহিংসতা; Image source: coillaw.com

সকলকে লকডাউনে রাখা বা নিজ নিজ বাসায় থাকার পরামর্শ দেওয়া হচ্ছে যেন করোনা ভাইরাসের সংক্রমণের হার না বাড়ে, অকালে কিছু মূল্যবান প্রাণ যেন ঝরে না পড়ে। তবে বিশ্বজুড়ে যেভাবে নারীর প্রতি সহিংসতা বেড়ে চলেছে তা আরেকটি ধ্বংসকে আহ্বান জানাচ্ছে। প্রতিনিয়ত বিশ্বজুড়ে করোনা ভাইরাসে মানুষ মারা যাচ্ছে। এমন পরিস্থিতিতে খুব পরিচিত একটি সমস্যা নিয়ে কথা বলা অনেকের কাছে অযৌক্তিক মনে হতে পারে। তবে বিষয়টি ভিত্তিহীন নয়। ২০১৮ সালের একটি রিপোর্ট মোতাবেক, ২০১৭ সালে বিশ্বব্যাপী ৫০,০০০ নারী পারিবারিক সহিংসতার কারণে মারা গিয়েছেন। সম্প্রতি প্রকাশিত কিছু রিপোর্টে যেভাবে সহিংসতা হার বাড়ার বিষয়টি ফুটে উঠছে তা ভবিষ্যতের একটি ভয়ংকর পরিস্থিতির দিকে ইঙ্গিত দিচ্ছে।

বিশ্বজুড়ে যেভাবে নারীর প্রতি সহিংসতা বেড়ে চলেছে তা আরেকটি ধ্বংসকে আহ্বান জানাচ্ছে; Image source: wexnermedical.osu.edu

চীন

চীনে শুধুমাত্র হুবেই প্রদেশে এক মাসে সহিংসতার পরিমাণ বেড়ে যায় তিন গুণ। ফেব্রুয়ারিতে সহিংসতার অভিযোগ পাওয়া যায় ১৬২টি যা গত বছরের ফেব্রুয়ারি মাসে ছিল ৪৭টি। হুবেই প্রদেশের একটি শহরের অবসরপ্রাপ্ত পুলিশ অফিসার এবং একটি সহিংসতা বিরোধী প্রতিষ্ঠানের উদ্যোক্তা ওয়ান ফেই বলেন, “আমাদের পরিসংখ্যান অনুসারে, এখানে ৯০% সহিংসতার ঘটনার জন্য দায়ী কোভিড-১৯ মহামারি।

স্পেন

স্পেনে লকডাউনের প্রথম দুই সপ্তাহে নারীর প্রতি সহিংসতা বেড়ে যায় ১৪%। সেই দেশে লকডাউন ভঙ্গ করে কেউ বাইরে গেলে জরিমানা দেওয়ার কঠোর নিয়ম জারি করা হয়। কিন্তু নির্যাতনের কারণে অনেক নারী ঘর থেকে বেরিয়ে আসতে শুরু করলে সরকার করোনা ভাইরাসের পাশাপাশি আরেকটি জাতীয় সমস্যা সম্পর্কে সচেতন হন এবং এই আইন নির্যাতিতাদের জন্য শিথিল করেন। তাছাড়া এসব সহিংসতা বন্ধ করতে আরো কঠোর পদক্ষেপ নেওয়া শুরু করে। স্পেনে লকডাউনের সময় এক ব্যক্তি পারিবারিক কলহের জেরে তার স্ত্রীকে নিজের সন্তানদের সামনে খুন করলে সহিংসতার ব্যাপারে সরকার কঠোরভাবে সতর্কতা অবলম্বন করতে শুরু করে।

ফ্রান্স

ফ্রান্সে লকডাউনের পর থেকে পারিবারিক সহিংসতা ৩২% এবং রাজধানী প্যারিসে ৩৬% বেড়ে গেছে। হটলাইন ছাড়াও লকডাউনে খোলা থাকা ফার্মেসিতে সহায়তা চাওয়ার বিশেষ ব্যবস্থা রয়েছে সেই দেশে। কেননা, নির্যাতনকারীর সাথে একই বাসায় সারাদিন থাকার কারণে অনেকেই সহায়তার জন্য হেল্পলাইনে ফোন করতে পারে না। তাছাড়া পারিবারিক নির্যাতন থেকে বাঁচতে বিভিন্ন হোটেলে ভাড়া করে থাকতে হলে নির্যাতিতদের খরচের দায়ভার সরকার নেবে বলেও আশ্বাস দেওয়া হয়।

নির্যাতনকারীর সাথে একই বাসায় সারাদিন থাকার কারণে অনেকেই সহায়তার জন্য হেল্পলাইনে ফোন করতে পারে না; Image source: thoughtco.com

ইতালি

সহায়তা চাওয়ার অক্ষমতা বা সুযোগের অভাবের ব্যাপারটা চলে আসায় ইতালির একটি প্রতিষ্ঠান ‘টেলিফোনে রোজা’-এর একটি আশংকার কথা বলা যাক। এই প্রতিষ্ঠানের তথ্য মোতাবেক মার্চের প্রথম দুই সপ্তাহে ইতালির হেল্পলাইনে আসা ফোনের সংখ্যা গত বছরের একই সময়ের প্রেক্ষিতে ৫৫.১% কমে গেছে। অন্য কোনো সময় হলে এটা বিশাল বড় একটি অর্জন হিসেবেই দেখা হত। কিন্তু বর্তমান পরিস্থিতিই আসলে সন্দেহ করার কারণ। হঠাৎ করে সংখ্যাটা এত কমে গেল কেন? করোনা ভাইরাসের ভীতির কারণে? নাকি নির্যাতনের শিকার হলেও কি কোনো নির্যাতিতা যোগাযোগের সুযোগ পাচ্ছে না? কিছু সহিংসতার ঘটনা সামনে আসলে এবং অনেকদিন ধরে অত্যাচার সহ্য করা সত্ত্বেও যোগাযোগ করার অক্ষমতা নির্যাতিতাদের কাছ থেকে শোনার পর থেকে এই প্রশ্নগুলো এবং সম্ভাবনাগুলো আরো বাড়িয়ে দিচ্ছে। লকডাউনে গৃহবন্দী অবস্থায় অনেকের পক্ষে বাইরে এসেও সাহায্য চাওয়া সম্ভব হয় না। যা এসব ফোনের সংখ্যা কমে যাওয়ার জন্য দায়ী বলে মনে করা হচ্ছে।

নির্যাতনের শিকার হলেও কি কোনো নির্যাতিতা যোগাযোগের সুযোগ পাচ্ছে না?; Image source: groesbeckjournal.com

ইউক্রেন

ইউক্রেনে লকডাউনের প্রথম দুই সপ্তাহে এর আগের দুই সপ্তাহের তুলনায় ৩৬% বেশি পারিবারিক সহিংসতা দেখা যায়। হিসাবটি করা হয় জাতীয় হটলাইনে সহায়তা চাইতে ফোন করা নারীদের সংখ্যার ভিত্তিতে। এপ্রিলের শুরুতে সহিংসতার পরিমাণ বেড়ে গেছে ১১৩%।

বিশ্বজুড়ে

যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, জার্মানি থেকে শুরু করে ব্রাজিল, দক্ষিণ আফ্রিকা তথা পুরো বিশ্বজুড়েই পারিবারিক সহিংসতা ও নির্যাতনের পরিমাণ এই লকডাউনে বেড়েই চলেছে। সামনের দিনগুলোতে প্রকৃত পরিস্থিতি বুঝার জন্য আরেকটু বিস্তারিত ও নির্দিষ্ট পরিসংখ্যান পাওয়া যাবে বলে আশা করা যায়। তবে এখন পর্যন্ত পাওয়া তথ্যগুলো ও বিচ্ছিন্ন সকল ঘটনা একত্রিত করলে একটি ভয়ানক চিত্র আমাদের চোখের সামনে এসে দাঁড়ায়। মনুষ্যত্ব কোথায় গিয়ে দাঁড়াচ্ছে যে এই মহামারিতেও কিছু মানুষ আপনজনদের উপরই অত্যাচার করে যাচ্ছে?

বাংলাদেশ

বাংলাদেশে বেসরকারি সংগঠন ‘মানুষের জন্য ফাউন্ডেশন’ (এমজেএফ)-এর একটি প্রতিবেদনের তথ্য মোতাবেক, শুধুমাত্র গত মার্চ মাসে বগুড়া, জামালপুর এবং কক্সবাজার এই তিনটি জেলায় ৩৬টি ধর্ষণ এবং ৩০০টির বেশি পারিবারিক সহিংসতার ঘটনা ঘটেছে। পুরো দেশে এই পরিসংখ্যান কয়েক হাজার হবে বলেও দাবি করে সংগঠনটি। তাছাড়া মার্চ ও এপ্রিলের এই সময় পর্যন্ত শুধুমাত্র ঢাকায় ১৫টি ধর্ষণ ও সংঘবদ্ধ ধর্ষণের ঘটনা ঘটে। যৌন হয়রানিরও বেশকিছু অভিযোগ পাওয়া গেছে। পারিবারিক সহিংসতার শিকার হচ্ছে এমন অনেকেই লকডাউন থাকার কারণে এ থেকে মুক্তি পাচ্ছে না বা অভিযোগ করার সুযোগ পাচ্ছে না। এমজেএফ-এর নির্বাহী পরিচালক শাহীন আনাম তার এক বিবৃতিতে জানান, দেশের বিভিন্ন স্থানে বহু নারী ও শিশু সহিংসতার শিকার হলেও ঘরবন্দী থাকায় আইনি পদক্ষেপ নেওয়া তাদের পক্ষে সম্ভব হচ্ছে না।

সমাজের অনেক নারী তার সাথে ঘটে যাওয়া সহিংসতার কথা কাউকে বলতে পারে না বা আইনি সহায়তা চাইতে দ্বিধা বোধ করে; Image source: justiceclearinghouse.com

এছাড়াও আরো কিছু সমস্যা রয়েছে যার কারণে পারিবারিক সহিংসতার প্রকৃত ছবি কেমন তা এখনো আমরা উদঘাটন করতে পারছি না। আমাদের সমাজে এখনো পারিবারিক সহিংসতাকে ‘পারিবারিক বিষয়’ হিসেবে বিবেচনা করা যায় যা কাউকে জানানো যাবে না। এ কারণে এখনো এই সমাজের অনেক নারী তার সাথে ঘটে যাওয়া সহিংসতার কথা কাউকে বলতে পারে না বা আইনি সহায়তা চাইতে দ্বিধা বোধ করে। লকডাউনের কারণে সহিংসতা বেড়ে যাওয়ার সত্যতা পাওয়া গেলেও সঠিক পরিসংখ্যান এখনো জানা যায়নি।

সাবান বা হ্যান্ড স্যানিটাইজার দিয়ে যেভাবে ভাইরাস ধ্বংস করছেন সেভাবে নিজের কাণ্ডজ্ঞান দিয়ে পারিবারিক সহিংসতাও দূর করুন; Image source: ywcagenesee.org

এই লেখাটিতে এমন কোনো দাবি করা হচ্ছে না যে, লকডাউন বা কোয়ারেন্টিনই যখন পারিবারিক সহিংসতার হার বাড়িয়ে দিচ্ছে, তাহলে লকডাউন তুলে দেওয়া এই পরিস্থিতির সমাধান হতে পারে। একদমই নয়। ভাইরাসের সংক্রমণ থেকে বাঁচতে সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখা অত্যন্ত জরুরি। তবে আমাদের মধ্যে সচেতনতা গড়ে তোলা প্রয়োজন। উক্ত তথ্য ও পরিসংখ্যানই বলে দিচ্ছে আমাদের মাঝেই এমন অনেক মানুষ রয়েছে যারা নারীদের প্রতি সহিংসপূর্ণ আচরণ করে যাচ্ছে। এটা সবার অবশ্যই উপলব্ধি করতে হবে যে, নির্যাতন সহ্য করার মধ্যে কোনো বীরত্ব নেই। বরং প্রতিবাদ করাই একটি আদর্শ মানুষের লক্ষণ। আর এটা বলা বাহুল্য, অত্যাচার করে যেসকল ব্যক্তি পৈশাচিক আনন্দ পায় তাদের মানসিকতা অবশ্যই ঠিক করতে হবে। এরকম কোনো নিকৃষ্ট ব্যক্তি তা নিজে করতে ব্যর্থ হলে বাকিদের সেই দায়িত্ব নিতে হবে। এজন্য প্রয়োজন হলে আইনি সহায়তা নিন। অথবা অন্য কাউকে আইনি সহায়তার ব্যবস্থা করে দিন। সাবান বা হ্যান্ড স্যানিটাইজার দিয়ে যেভাবে ভাইরাস ধ্বংস করছেন, সেভাবে নিজের কাণ্ডজ্ঞান দিয়ে পারিবারিক সহিংসতাও দূর করুন। এমন যেন না হয় যে, ভাইরাসের চেয়ে বেশি সহিংসতাই ছিন্ন-ভিন্ন করে দেয় বিশ্বটিকে।

This article is in Bangla language. It's about how domestic violence is increasing worldwide during lockdown. Sources have been hyperlinked in this article.
Featured image: coillaw.com

Related Articles