সভ্যতার সূচনালগ্ন থেকেই ইরান (পারস্য) বিশ্বের এক অন্যতম ক্ষমতাধর অঞ্চল হিসেবে প্রতিষ্ঠা পায়। মধ্যযুগের শেষদিকে দেশটি কিছুটা পিছিয়ে পড়লেও, আধুনিক যুগের শুরুর পর তারা আবার বিশ্বরাজনীতির আলোচনার বিষয় হয়ে দাঁড়ায়। ভৌগোলিক অবস্থানের জন্য আন্তর্জাতিক ভূ-রাজনীতিতে দেশটি সবসময় সক্রিয় ও আলোচনায় থাকে। ইরানের অর্থনৈতিক অবস্থা যেরূপই থাকুক না কেন, তারা তাদের সামরিক খাতে সবসময়ই প্রচুর অর্থ ব্যয় করে। বিশ্বের বিভিন্ন সংগঠনের সাথে তাদের যোগাযোগ এবং বিভিন্ন স্থানে তারা ছায়াযুদ্ধে লিপ্ত বলেও অভিযোগ আছে। অভিযোগ রয়েছে ইরানের পরমাণু সক্ষমতা অর্জনের বিষয় নিয়েও। পশ্চিমাদের এসব উৎকণ্ঠা উপেক্ষা করে তেহরান পরমাণু চুল্লিতে ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধকরণের কাজ করছে। বিশ্বের বিভিন্ন স্থানে প্রক্সি যুদ্ধও চালিয়ে যাচ্ছে। বিশ্বরাজনীতিতে অনেকটা প্রকাশ্যেই পাশ্চাত্যের দেশগুলো ইরানের এসব কর্মকাণ্ডের বিরুদ্ধে কথা বলছে। কিন্তু ইরানও দমবার পাত্র নয়, তারা বরং দিনকে দিন বিশ্বমোড়লদের সাথে পাল্লা দেয়ার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছে।
ইরানের পারমাণবিক শক্তিধর হওয়ার বাসনা বেশ পুরনো। তাদের এই পরমাণু কর্মসূচি নিয়ে পাশ্চাত্যের দেশগুলোতে অনেক আলোচনা সমালোচনা হয়। পশ্চিমাদের কথার পিঠে ইরান বলে যাচ্ছে— তাদের পারমাণবিক চুল্লি শুধুমাত্র বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতে শান্তিপূর্ণভাবে ব্যবহার করার জন্য। কিন্তু এরকম স্বীকারোক্তির সাথে পশ্চিমা দেশগুলো একমত হতে পারে না। ইরানের এই পারমাণবিক বিষয় নিয়ে বিশ্ব মিডিয়া মাঝে মধ্যেই সরগরম হয়ে ওঠে।
প্রারম্ভিক কর্মকাণ্ড
ইরান প্রাথমিকভাবে ১৯৫০ সালে যুক্তরাষ্ট্রের সহায়তায় পারমাণবিক কর্মসূচির সূচনা করে। পরবর্তীতে ১৯৫৭ সালে শান্তিপূর্ণ পারমাণবিক জ্বালানি ব্যবহার বিষয়ক একটি চুক্তিতে দুই দেশ সম্মত হয়। এর ফলশ্রুতিতে ইরান ১৯৫৯ সালে তেহরান বিশ্ববিদ্যালয় নিউক্লিয়ার রিসার্চ সেন্টার প্রতিষ্ঠা করে। মজার বিষয় হলো, ইরানের নানা খাতে বাধ সাধা যুক্তরাষ্ট্রই এতে ১৯৬৭ সালে ৫ মেগাওয়াটের নিউক্লিয়ার সরবরাহ করে। পরের বছর ১৯৬৮ সালে ইরান নিউক্লিয়ার নন-প্রলিফারেশন চুক্তিতে স্বাক্ষর করে।
১৯৭৫ সালে ইরান পারমাণবিক কেন্দ্র বুশেহর প্রতিষ্ঠা করে। ইসরায়েলের সাথে ইরানের একসময় ঘনিষ্ঠ বন্ধুত্ব ছিল। পশ্চিমা সংস্কৃতি আর তৎকালীন হাল ফ্যাশনের দেশ ইরানকে ইসরায়েল পারমাণবিক ওয়ারহেড স্থাপনযোগ্য ক্ষেপণাস্ত্র দিতে চেয়েছিল। কিন্তু সেই ক্ষেপণাস্ত্র ইরানে পৌঁছার পূর্বে দেশটিতে ইসলামিক বিপ্লব ঘটে যায়। ১৯৭৯ সালে ইরানে ইসলামী বিপ্লব সংঘটিত হয়। ইরানের মডারেট সরকারপ্রধান রেজা শাহ পাহলভী পালিয়ে বাঁচেন। ক্ষমতায় বসেন সর্বোচ্চ নেতা আয়াতুল্লাহ খামেনি। রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ পর্যায় থেকে ঘোষণা আসে- ইসলামে পারমাণবিক কর্মসূচির বৈধতা নেই, দেশটির সকল পারমাণবিক চুল্লি ধ্বংস করা হয়।
পুনরায় শুরু
ইরানে ইসলামী বিপ্লবের পর থেকেই দেশটির সাথে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্কের অবনতি ঘটতে থাকে। ১৯৮০ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মদদে সাদ্দাম হোসেন ইরান আক্রমণ করে বসেন। যুদ্ধে সাদ্দাম হোসেন ইরানিদের উপর বিষাক্ত গ্যাস প্রয়োগ করেন। পক্ষান্তরে, ইরান তাদের নিজেদের অস্ত্রশস্ত্রে ইরাকিদের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলে। শেষে আলজিয়ার্স চুক্তির মাধ্যমে যুদ্ধের অবসান ঘটে। ইরানের নীতি-নির্ধারকরা তখন নিজেদের অস্ত্র-গোলাবারুদ নিয়ে চিন্তায় পড়ে যান। অপরদিকে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ইরানবিরোধী নীতি অব্যাহত রেখে চলছে। এই পরিস্থিতিতে ইরানের পক্ষ থেকে ঘোষণা আসে যে ইহুদিবাদী ইসরায়েল তাদের প্রধান শত্রু। ধর্মীয় নেতাদের নতুন করে ফতোয়া আসে আত্মরক্ষার্থে পারমাণবিক অস্ত্র তৈরি করা যাবে। এরপর থেকেই ইরান পুনরায় পারমাণবিক কর্মসূচি শুরু করে।
ইরান নিউক্লিয়ার নন-প্রলিফারেশন চুক্তিতে স্বাক্ষরকারী দেশ হয়েও ১৯৮৪ সালে চীন ও পাকিস্তানের সহায়তায় ইসফাহান নগরীতে পারমাণবিক গবেষণা কেন্দ্র চালু করে। দুবাই শহরে একটি গোপন সভায় (তিনজন ইরানি, দুজন পাকিস্তানি, তিনজন ইউরোপীয়) মিলিত হয়। কথিত আছে, এই গোপন সভায় পাকিস্তানের পারমাণবিক বোমার জনক ড. আব্দুল কাদির খান উপস্থিত ছিলেন। ইরান ইউরেনিয়াম সেন্ট্রিফিউজ এবং অন্যান্য যন্ত্রাংশ সংগ্রহেও নেমে পড়ে এবং সেই অনুযায়ী তাদের গতিপথ তৈরি শুরু করে।
পরমাণু প্রযুক্তি
ইরান নিজেদের চেষ্টায় তাদের কৌশলগত প্রযুক্তি খাতগুলোকে এগিয়ে নিয়ে গেছে। বিশেষ করে ইসলামি বিপ্লব ও পশ্চিমা নিষেধাজ্ঞার পর থেকে ইরান চেয়েছে স্বাবলম্বী হতে। তারা সেই পথে অনেক দূর এগিয়েও আছে। অস্ত্র, অস্ত্রের উপকরণ, ড্রোন তৈরির মতো বিষয়ে ইরান সাফল্য দেখাচ্ছে। পারমাণবিক প্রযুক্তির ক্ষেত্রেও ইরান তাদের নিজেদের বিজ্ঞানীদের কাজে লাগাচ্ছে, নিচ্ছে গোপনীয়তার নীতি। তবে নব্বইয়ের দশকে ইরানের দুটি খবর খুব আলোচিত ও সমালোচিত হয় এবং তা বিশ্ব মিডিয়ার বদৌলতে সবদিকে ছড়িয়ে পড়ে। একটি হলো রাশিয়ার সাথে ইরানের বুশেহর পারমাণবিক চুল্লি নির্মাণের চুক্তি; অপরটি চীনের সাথে দুটি ছোট চুল্লি নির্মাণের চুক্তি। ১৯৯৮ ও ২০০২ সালে ইরানের পরমাণু কর্মসূচির এই গোপন খবর সেন্ট্রাল ইন্টেলিজেন্স এজেন্সির (সিআইএ) মাধ্যমে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কাছে চলে যায়। সবাই ধারণা করতে থাকে, ইরান পারমাণবিক অস্ত্র তৈরির রাসায়নিক প্রভাবক হিসেবে পরিচিত পোলোনিয়াম-২১০ উৎপাদন করছে এবং রাশিয়ার কাছ থেকে পারমাণবিক বোমা তৈরির অনুঘটক ডিউটেরিয়ামের ক্রয়ের চেষ্টা করছে। পশ্চিমা বিশ্ব তখন বলতে থাকে, ইরান পাকিস্তানের পরমাণু বিজ্ঞানী ড. আবদুল কাদির খানের কাছ থেকে চীনের বোমা তৈরির পরিকল্পনা সদৃশ এক ডিজাইন ও গাইডলাইন পেয়েছে এবং সেই অনুযায়ী তাদের কার্যক্রম পরিচালনা করছে।
বিশ্বশক্তির প্রতিবন্ধকতা
ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচিতে কিছুদিন পরপরই দফায় দফায় হামলা হয়। ইরান বেশিরভাগ সময়ই সেজন্য ইসরাইলকে দায়ী করে থাকে, এবং বলে যে উপযুক্ত সময়ে তার জবাব দেয়া হবে। কিছুদিন পূর্বে যুক্তরাষ্ট্র ইরানি সমরনায়ক কাশেম সোলাইমানিকে এক ড্রোন হামলার মাধ্যমে হত্যা করে। কাজেই ইরানের সকল কর্মকাণ্ডই পশ্চিমারা নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করে চলেছে।
যখন ইরানের পরমাণু কর্মসূচি অনেক দূর এগিয়ে যেতে লাগল তখনই যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরাইল নড়েচড়ে বসে। জর্জ ডব্লিউ বুশ ইরানকে ‘শয়তানের অক্ষশক্তির অংশ’ বলে আখ্যা দিয়ে বসেন। তারা তাদের লক্ষ্য ঠিক করে, ইরানকে কোনোভাবেই পারমাণবিক শক্তিধর দেশ হতে দেয়া যাবে না। তারা যুদ্ধ এড়িয়ে গোপন মিশনে নামে। ২০০৬ সালে ইরানের পারমাণবিক কেন্দ্রে একের পর এক বিস্ফোরণ ঘটতে থাকে। এই ঘটনার জন্য ইরান আমেরিকা ও ইসরাইলকে দায়ী করে। সেদিন ইরানের কেন্দ্রীয় পারমাণবিক কেন্দ্র সম্পূর্ণ ধ্বংস হয়। পুনরায় ইরান যখন সবকিছু গোছাচ্ছিল, তখনই তাদের সেন্ট্রিফিউজ বিস্ফোরণের খবর বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে পড়ে। ড. আরশাদি নামক এক বিজ্ঞানীকে বিষ প্রয়োগ করে হত্যা করা হয়। তিনি ইরানের ইসফাহান পারমাণবিক কেন্দ্রের নামকরা বিজ্ঞানী ছিলেন। গবেষণার জন্য পেয়েছিলেন ইরানের সর্বোচ্চ রাষ্ট্রীয় খেতাব। এছাড়া ২০০৮ সালে যান্ত্রিক ত্রুটি ও বিস্ফোরণে বুশেহর, আরাক, ইসফাহান পারমাণবিক কেন্দ্র ক্ষতিগ্রস্ত হয়। ফলে ইরানের পারমাণবিক কার্যক্রম বিলম্বিত হতে থাকে।
ইরান তাদের পবিত্র নগরী কোমের মাটির নিচে পারমাণবিক অবকাঠামো নির্মাণ করতে থাকে। একসময় সেই খবরও গোপন থাকে না। ২০১০ সালে ইরানের পরমাণু কর্মসূচিতে ব্যাপক ধস নামে। বিভিন্ন চুল্লীতে যন্ত্রাংশ বিকল হওয়া, সেন্ট্রিফিউজ ধ্বংস হওয়াসহ বিভিন্ন বিপর্যয় নেমে আসে। ইরান এই ঘটনার জন্য ইসরায়েলকে দায়ী করে। এক বছর পর আমরা জানতে পারি, এই বিপর্যয়ের পেছনে ছিল বিশ্বের অন্যতম সাইবার হামলা।
এছাড়া ওই সময় পরমাণু প্রকল্পের প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ড. মজিদ শাহরিয়ারকে গুলি করে হত্যা করা হয়। গাড়িবোমা বিস্ফোরণে নিহত হন আরো দুজন বিজ্ঞানী। ইরানের দাবি- তাদের সব পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র শান্তিপূর্ণ জ্বালানি ও বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য ব্যবহার করা হবে। যদিও পশ্চিমাবিশ্ব ও ইসরায়েল বারবার বলছে, শান্তিপূর্ণ পারমাণবিক কর্মসূচির কথা বলে ইরান গোপনে পারমাণবিক বোমা তৈরি করছে, কিন্তু এ কথা অস্বীকার করে আসছে ইরান।
পশ্চিমাদের ভয়ের কারণ
ইরান তার পরমাণু কর্মসূচির বিষয়ে সবসময় বলে আসছে যে তারা শান্তিপূর্ণ বেসামরিক কাজে ব্যবহার করবে। তাদের পারমাণবিক অস্ত্রে সজ্জিত হওয়ার কোনো আকাঙ্ক্ষা নেই। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্র, ইসরায়েলসহ সমমনা দেশগুলো তা বিশ্বাস করতে পারে না। কারণ, মধ্যপ্রাচ্যের সকল সংকটপূর্ণ এলাকায় ইরানের অস্তিত্ব পাওয়া যায়। বিভিন্ন সশস্ত্র গোষ্ঠীর পেছনেও তাদের নাম আছে বলে অভিযোগ রয়েছে। ইরান চায় তার চারপাশ শত্রুর বলয় থেকে মুক্ত থাকুক। আর পশ্চিমারা এই এলাকায় তাদের প্রভাব বাড়াতে চায়। কারণ এই অঞ্চল তেল সমৃদ্ধ। ওদিকে আবার ইসরায়েল-ইরানের ক্রমাগত প্রকাশ্য বৈরিতাতে পশ্চিমারা সদা সতর্ক থাকে।
পশ্চিমা শক্তির অভিভাবক যুক্তরাষ্ট্র অনেক দেন-দরবার করে ইরানের সাথে অন্য পাঁচ জাতিকে নিয়ে এক সমঝোতা চুক্তিতে পৌঁছায়। সমঝোতা চুক্তিসহ ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচির বাকি কথা থাকছে এই সিরিজের দ্বিতীয় পর্বে।