.jpg?w=1200)
পানির নিচে দীর্ঘ সময়ের জন্য হারিয়ে যাওয়ার পর আবার সেই জনপদের ভেসে ওঠা- শুনতে বেশ রুপকথার মতো মনে হলেও সত্যি এমনটাই ঘটেছে আর্জেন্টিনার এক লোকালয়ে। ভিলা এপিকিউয়েন (Villa Epecuen) নামের এই ছোট শহরটি এর পার্শ্ববর্তী লেকের পানিতে তলিয়ে ছিল প্রায় ২৫ বছর।
আর্জেন্টিনার রাজধানী বুয়েনস আইরেস থেকে বেশ কিছুটা দক্ষিণ-পশ্চিমে ভিলা এপিকিউয়েনের অবস্থান। যদিও একে বুয়েনস আইরেস প্রদেশের ভেতরেই ধরা হয়। মূলত লেক এপিকিউয়েনের কোল ঘেঁষে গড়ে ওঠা ছোট এক শহর ছিল এটি। লেকের তীর ঘেঁষে গড়ে ওঠা এই লোকালয়ের মূল ব্যবসা ছিল লেক এপিকিউয়েনকেন্দ্রিক। সেখানের পানিতে বিভিন্ন খনিজের উপস্থিতির কারণে স্নান করতে আসা মানুষের বিভিন্ন রোগের উপশম হতো। বিশেষ করে বাতের ব্যথা, ডায়াবেটিস এ ধরনের রোগাক্রান্তদের কাছে লেক এপিকিউয়েনের স্নানে ভালো কাজ হবার খবর স্থানীয় ভাবে ছড়িয়ে পড়তে থাকলে ধীরে ধীরে পর্যটকদের কাছে বিশ্রাম, বিনোদন আর স্বাস্থ্যোদ্ধারের অন্যতম স্থান হয়ে ওঠে ভিলা এপিকিউয়েন।

‘এপিকিউয়েন’ শব্দটি এসেছে লেভুস (Levuche) ভাষা থেকে। লেকটি নিয়ে স্থানীয়ভাবে প্রচলিত আছে নানা ধরনের লোককাহিনী। সেসবের মাঝে অন্যতম হচ্ছে, একবার ভয়াবহ দাবানলে জঙ্গল পুড়ে যাবার পর সেখান থেকে একটি শিশুকে জীবিত উদ্ধার করে লেভুস ইন্ডিয়ান গোত্রের একটি দল। বিস্ময়করভাবে বেঁচে যাওয়া শিশুটির নাম রাখে তারা এপিকিউয়েন, যার অর্থ ‘প্রায় পুড়ে যাওয়া’। ধীরে ধীরে সে হয়ে ওঠে গোত্রের শক্তিশালী এক যোদ্ধা।
যুবা বয়সে আওঞ্চলিক এক যুদ্ধে বিপক্ষ ইন্ডিয়ান দল নেতার কন্যা ত্রিপান্তুকে বন্দি করে এপিকিউয়েন। ত্রিপান্তু (স্থানীয় ভাষায় যার অর্থ বসন্ত) আর এপিকিউয়েনের মাঝে গড়ে ওঠে ভালোবাসার সম্পর্ক। কিন্তু কিছুদিন পরেই এপিকিউয়েন যুদ্ধে বন্দি করা অন্য বন্দিনীদের সাথে সম্পর্কে জড়িয়ে পড়ে। ত্রিপান্তু গভীর বিষাদ থেকে কান্না শুরু করে, আর সেই অশ্রুজল থেকেই সৃষ্টি হয় লেক এপিকিউয়েনের। লোককাহিনীর শেষ হয় এই অশ্রুজলে এপিকিউয়েন এবং তার সাথে সম্পর্ক গড়ে তোলা বন্দিনীদের ডুবে যাওয়ার মাধ্যমে।
বিংশ শতাব্দীর শুরুর দিক থেকেই ভিলা এপিকিউয়েনে জনসমাগম শুরু হয়। খনিজ আকরিক পূর্ণ লেকের পানি থেকে বিভিন্ন আকরিক সংগ্রহ করার কাজ শুরু হয় সেসময় থেকেই। লেক থেকে পাওয়া আকরিকগুলো সংগ্রহ করত বিভিন্ন ঔষধ প্রস্তুতকারক প্রতিষ্ঠান। আবার বিভিন্ন খনিজ দ্রব্য ব্যাগে ভরে শহরতলীতে বিক্রিও হত, যাতে করে সেখানকার মানুষ নিজের ঘরে বসে খনিজ জলের উষ্ণ স্নান বা স্পা বাথ উপভোগ করতে পারে।
সরকারিভাবে স্বাস্থ্যকর এই লেক বিষয়ে পরীক্ষানিরীক্ষা শুরু হয় ১৯০৯ সালে। লেকের পানি পরীক্ষা করে সেখানে তারা খুঁজে পায় নানা আকরিক, যা একই স্থানে পাওয়া সত্যি বিরল। এরপর ১৯২১ সালের দিকে মূলত পর্যটকদের জন্য একটি পর্যটন শহর হিসেবে গড়ে উঠতে শুরু করে ভিলা এপিকিউয়েন। সেই বছরই লেকের পাশে প্রথম রিসোর্ট তৈরির কাজও শুরু হয়। ত্রিশের দশকে এই লেক পরিণত হয় বিশ্বের দ্বিতীয় লবণাক্ততম জলাশয়ে। ধীরে ধীরে লেককে কেন্দ্র করে গড়ে উঠতে থাকে হোটেল, জাদুঘর, সরাইখানা, স্পাসহ বিভিন্ন স্থাপনা। ষাট এবং সত্তরের দশকে প্রচুর পর্যটকের সমাগম শুরু হয় ভিলা এপিকিউয়েনে। এর অন্যতম কারণ ছিল ১৯৭২ সালে রেল যোগাযোগ চালু হওয়া। মূলত গ্রীষ্মের সময় উষ্ণ লবণাক্ত পানিতে নিজেদের চিকিৎসা আর সেই সাথে ভ্রমণের জন্যে বেশি পর্যটক আসত ভিলা এপিকিউয়েনে। অনেক বছর সেই পর্যটকের সংখ্যা বিশ হাজার বা তার বেশিও হত।

সবকিছুই চলছিল স্বাভাবিক ছন্দে। প্রাকৃতিক দুর্যোগ যে আঘাত হানতো না একেবারে এমনটাও নয়। কারণ সুবিশাল এই লেকের পারে গড়ে ওঠা পযটন শহরে দুর্যোগের সম্ভাবনা থাকবেই। তবে উল্লেখ করার মতো কোনো ধ্বংসযজ্ঞ সেখানে ঘটেনি আশির দশকের মাঝামাঝি সময় পর্যন্ত। বরাবরের মতো ১৯৮৫ সালেও বর্ষাকাল শুরু হয় ভিলা এপিকিউয়েন অঞ্চলে। কিন্তু নভেম্বর মাসে বৃষ্টিপাতের মাত্রা স্বাভাবিক থেকে অনেক বেশি হতে থাকে। প্রবল বৃষ্টির ফলে শহরের জলনিষ্কাশন ব্যবস্থা অকার্যকর হয়ে পড়ে। লেক এপিকিউয়েনের জলসীমা সাধারণ উচ্চতা থেকে অনেক বেশি বেড়ে ওঠে। ভিলা এপিকিউয়েন শহরকে এ ধরনের দুর্যোগ থেকে রক্ষা করতে ১৯৭৮ সালে যে বাধ তারা নির্মাণ করেছিল সেটিও বিপুল জলস্রোত ঠেকাতে অক্ষম হয়ে যায়।

৬ নভেম্বর প্রথম একটি বাঁধ ভেঙে যায়। তীব্র বেগে পানি ঢুকতে শুরু করে ছোট্ট শহর ভিলা এপিকিউয়েনে। ১০ নভেম্বর পানির তোড়ে ভেঙে যায় শহর সুরক্ষার জন্য নির্মাণ করা প্রাচীরটিও। শহরের ভেতরে পানির উচ্চতা প্রতি ঘন্টায় প্রায় এক সেন্টিমিটার করে বাড়তে শুরু করে। স্থায়ীভাবে বসবাস করা মানুষ বিস্ময়ের সাথে দেখতে থাকে প্রিয় শহর ধীরে ধীরে ডুবে যেতে শুরু করেছে লেক এপিকিউয়েনে। দুই সপ্তাহের মাঝে সেই পানির উচ্চতা শহরের মাঝে হয়ে দাঁড়ায় প্রায় তিন মিটার। সেখানে বসবাসকারীরা ধীরে ধীরে এপিকিউয়েন এলাকা ছেড়ে চলে যেতে শুরু করে। কারণ, রাজধানীর সাথে তাদের যোগাযোগের একমাত্র ব্যবস্থা ছিল রেললাইন। পানির তোড়ে একসময় সেই রেললাইন ভেসে যাওয়ায় ভিলা এপিকিউয়েনের সাথে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে বুয়েনস আইরেসের। বিস্ময়কর হলেও সত্যি যে, দুর্যোগে পুরো শহর পানিতে তলিয়ে গেলেও প্রাণহানীর কোনো সংবাদ সেখান থেকে পাওয়া যায়নি। তবে স্থানীয় মানুষের জীবনে এর প্রভাব ছিল ভয়ংকর।

তাদের আয়ের মূল উৎস লেক এপিকিউয়েন থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়া, নিজেদের স্থাবর-অস্থাবর সব কিছু পানিতে ডুবে যাওয়া- এগুলো ছিল সবচেয়ে ভয়াবহ। অনেকে বাধ্য হয়ে কাছের লোকালোয় কাহ্যুয়েতে আশ্রয় নেয়। সেখানে আশ্রয় নেয়া কিঙবা মানিয়ে নেয়াটা এপিকিউয়েনবাসীদের জন্য ছিল দুর্যোগের মতোই। কারণ ভিলা এপিকিউয়েন এবং কাহ্যুয়ে অঞ্চলের মধ্যে অনেক আগে থেকেই ছিল শীতল সম্পর্ক। এই শীতলতার মূল কারণ ভিলা এপিকিউয়েনবাসীরা লেক থেকে কাছে থাকায় অর্থনৈতিকভাবে কাহ্যুয়ে থেকে বেশি লাভবান হত। সেই কারণে কাহ্যুয়ে বাসীরা নিজেদের বঞ্চিত মনে করত এবং সেখান থেকে এই শীতল সম্পর্কের সৃষ্টি।
১৯৯৩ সালে প্রকাশিত এক রিপোর্ট থেকে জানা যায়, ভিলা এপিকিউয়েন তখনও ১০ মিটার পানির নিচে নিমজ্জিত অবস্থায় ছিল। সবার মন থেকে মুছে যাওয়া স্মৃতিতেই পরিণত হয়ে পড়ছিল এই পর্যটন শহরটি।
দীর্ঘ ২৫ বছর পর আবার আকস্মিকভাবেই যেন ধীরে ধীরে ভেসে উঠতে শুরু করে ভিলা এপিকিউয়েন। যেমন সবাইকে বিস্মিত করে দিয়ে কয়েকদিনের ব্যবধানে পানির নিচে তলিয়ে গিয়েছিল শহরটি, তেমনি কয়েকদিনের মাঝে আবার লেকের পানি সরে গিয়ে ২০০৯ সালের শেষের দিকে জেগে ওঠে এক সময়ের নিশ্চিহ্ন হয়ে যাওয়া শহর ভিলা এপিকিউয়েন। কিন্তু একে শহর না বলে পুরোনো শহরের ভুতুড়ে কঙ্কাল বললে বরং ভালো বোঝা যাবে। দীর্ঘ সময় লবণ আর খনিজ মেশানো পানিতে ডুবে থাকার কারণে আক্ষরিকভাবেই ব্যবহারের অনুপযগী হয়ে গেছে পুরো শহর!

বেশ কিছুটা দুর্গম পথ পাড়ি দিয়ে পৌঁছানো যায় সেখানে। প্রথমেই চোখে পড়বে শীলায় পরিণত হওয়া গাছ, তাদের নিস্প্রাণ ডালপালা আর নোনা পানির রেখে যাওয়া চিহ্ন। ভেঙে ধ্বংস হয়ে যাওয়া সব স্থাপনা, শহরের রাস্তাঘাট, যানবাহন আর সব ধরনের যন্ত্রাংশের উপর জমে আছে সাদা লবণের অদ্ভুত এক আস্তরণ। বিখ্যাত আর্জেন্টাইন স্থপতির নকশা করা নির্মাণশৈলীর অনন্য নিদর্শন হিসেবে একটি কসাইখানা দাঁড়িয়ে আছে শহরে ঢোকার মুখেই। পানির নিচে এতগুলো বছর ডুবে থাকার পর যে কয়টি স্থাপনা এখনও সেখানে মাথা তুলে দাঁড়িয়ে আছে সেসবের মাঝে এটি অন্যতম।
ভিলা এপিকিউয়েনের ইতিহাস আর হারিয়ে যাওয়া স্মৃতিগুলো সংরক্ষণ করতে এখন সেখানে তৈরি করা হয়েছে একটি জাদুঘর। এককালে সেই স্থাপনাটি ছিল ভিলা এপিকিউয়েনের রেলস্টেশন। সেই জাদুঘরের প্রদর্শনীতে রাখা আছে দীর্ঘ সময় শহরের সাথে লেকের পানিতে ডুবে থাকা রেকর্ড প্লেয়ার, লামার পশমের তৈরি জাম্পারসহ আরও অনেক কিছু। শহরের মূল রাস্তা ধরে সামনে তাকালে যত দূর চোখ যায় সবকিছুই নীরব আর প্রাণহীন। খেলার মাঠের মর্চে পড়া অবয়বগুলো ঠিকভাবে আর চেনাও যায় না, সুইমিং পুল কমপ্লেক্সের ভাঙা দেয়ালের টুকরোগুলো কেবল জানান দিয়ে চলেছে একসময়ে সেখানে লেগে থাকত মানুষের ভিড়।

নতুন করে জেগে ওঠা শহরে প্রাচীন অধিবাসীদের প্রায় কেউই ফিরে আসেনি। তারপরও সময়ের সাথে আবারো বদলাতে শুরু করেছে ভিলা এপিকিউয়েন। পানির নিচে দীর্ঘ সময় নীরব থাকার পর আবারো প্রাণের আনাগোনা দেখছে শহরটি। চিকিৎসার জন্য ব্যবহৃত উষ্ণ জল লরিতে করে পোঁছে যাচ্ছে স্থানীয়ভাবে গড়ে ওঠা হোটেলগুলোতে। লেকের পানিতে এখন খনিজ পদার্থের ঘনত্ব আগের চেয়েও বেশি। আর লবণাক্ততা সমুদ্রের চেয়েও প্রায় ১০ গুণ। স্থানীয় সরকার পরিবেশের সাথে মিলিয়ে লেকের তীর ঘেঁষে নির্মাণ করেছে রিসোর্ট, যেখানে বিদ্যুতের জন্য ব্যবহার করা হচ্ছে সোলার প্যানেল। হয়তো একদিন আবারও পুরোনো জৌলুস ফিরে পাবে অতলে ডুবে যাওয়া আর সেখান থেকে ফিরে আসা শহর ভিলা এপিকিউয়েন।