ভারতের এক ব্যস্ততম শহর মুম্বাই। অর্থনৈতিক প্রাণকেন্দ্র হিসেবে শহরটির সুনাম রয়েছে। খুবই জনবহুল এই শহরের গলিগুলো নানা কারণে প্রসিদ্ধ। কিংবদন্তী রয়েছে, মুম্বাই শহরে কারো যদি কিছু হারিয়ে যায় বা চুরি যায়, তাহলে তিনি চোরবাজার থেকে হুবহু সেই জিনিস পেতে পারেন। অদ্ভুত শোনালেও আসলে বাজারটির নাম ছিল শোর বাজার। বাজারে প্রচুর শোরগোল হতো বলে বাজারের এই নামকরণ। কিন্তু ব্রিটিশদের উচ্চারণ বিভ্রান্তির কারণে শোরবাজার হয়ে যায় চোর বাজার। দেড়শো বছরের পুরনো মুম্বাইয়ের এই বিখ্যাত বাজারটি পর্যটকদের কাছে কেনাকাটার এক আদর্শ স্থান।
এখানে আপনি কয়েকশো বছরের পুরনো সামগ্রী থেকে শুরু করে হাল আমলের অটোমোবাইলের নানা যন্ত্রাংশ থেকে শুরু করে নিত্য প্রয়োজনীয় নানা জিনিসপত্র সাশ্রয়ী মূল্যে পেতে পারেন। তাই স্থানীয় থেকে ভ্রমণকারী সকলের কাছেই এই বাজার এক নামে পরিচিত।
মুম্বাই শহরের এক গলি জুড়ে এই বাজারটি অবস্থিত। শুধু শোর বাজারই মুম্বাইয়ের একমাত্র ব্যবসায়িক গলি নয় এখানে এমন অনেক গলি রয়েছে যেসব গলি নানা কারণে বিশ্বের মানুষের কাছে বিখ্যাত। যেমন- ‘খাও গলি’ নামে এক গলি আছে যেখানে রসনাযুক্ত খাবারের পসরা বসে। আবার চপ্পল গলিতে জুতো, স্যান্ডেলের বিশাল বাজার বসে। মুম্বাই শহরের এমনই এক ব্যতিক্রমী গলির গল্প বলবো আজ যেখানে গলিটি ক্রেতা-বিক্রেতার কোলাহলে নয় পড়ুয়াদের গুঞ্জনে মুখর থাকে। এই গলির নাম অভ্যাস গলি।
বিকেল পেরিয়ে সূর্য যখন আরব সাগরে ধীরে ধীরে ডুবতে শুরু করে তখন শহর মুম্বাইয়ের গলিগুলো হ্যালোজেনের আলোয় আলোকিত হতে থাকে। পোদ্দার হাসপাতালের ঠিক পেছনে ব্যস্ত ওয়ারলি নাকা রাস্তা থেকে কিছুটা দূরে ছোট এক গলিও হ্যালোজেনের আলোয় উদ্ভাসিত হতে থাকে। এ আলোয় পথ চলতি মানুষ যেমন পথ চিনে নেয়, ঠিক তেমনি পড়ুয়ার দলও তাদের জায়গা ঠিক খুঁজে নেয়। অভ্যাস গলির পথ, পথের ধারের বেঞ্চ গত দুই প্রজন্ম ধরে পড়ুয়াদের দখলে।
কারো হয়তো সামনে বোর্ড পরীক্ষা, কেউ বা চাকুরি পরীক্ষার প্রস্তুতিতে ব্যস্ত, কেউ বা জয়েন্ট পরীক্ষার প্রস্তুতি নিচ্ছে- এমন সব পড়ুয়ারা কখনও একাকী, আবার কখনো দল বেঁধে পড়তে এই গলিতে চলে আসে। গলির কথা বললে অনেকেই হয়তো ভয়ে নাক সিটকোতে পারেন। অনেকে আবার বিভিন্ন গলির উদাহরণ দিয়ে বলতে পারেন- গলি বলতে শুধু চুরি, ছিনতাই আর নানা ঝামেলার জায়গা। কিন্তু এ গলির চরিত্র অন্য সব গলি থেকে কিছুটা ভিন্ন। একটু সন্ধ্যে হলেই অনেকে যেখানে তার মেয়েকে পাঠাতে ভয় পান সেখানে এ অভ্যাস গলিতে পড়ুয়া ছেলেমেয়েদের কোনো কমতি নেই।
অভ্যাস গলির এমনই ছবি বছরের পর বছর ধরে পাড়াপ্রতিবেশীরা প্রত্যক্ষ করে আসছেন। বড় যৌথ পরিবারের ছোট পরিসরের ঘরগুলোতে যেখান দম ফেলারই জায়গা হয় না সেখানে এই অভ্যাস গলি পড়ুয়াদের জন্য পরিপূর্ণ মুক্তির বাতাস। সন্ধ্যে হলেই বাড়ির বয়স্করা যখন টিভিতে নানা সিরিয়াল দেখায় ব্যস্ত, কিংবা ঘিঞ্জি বাড়িগুলোর প্রতিবেশীরা পরস্পরের সাথে নানা ছোটখাট বিষয় নিয়ে ঝগড়াতে ব্যস্ত, সেসব কোলাহল থেকে নিজেদের বিযুক্ত রাখতে বই-খাতা-কলম নিয়ে ছাত্রছাত্রীরা হাজির হয় এ গলিতে। একটু নির্জনে পড়াশোনা করার জন্য পড়ুয়ারা এখানে আসতে থাকে।
রাস্তার উজ্জ্বল আলোয় এ গলি পুরোপুরি আলোকিত। পথের ধারে একটু পর পর পরিষ্কার বেঞ্চ পাতা রয়েছে। বেঞ্চ খালি না থাকলে পথের ওপরেই শতরঞ্জি কিংবা বাড়ি থেকে আনা পুরনো চাদর বা খবরের কাগজ বিছিয়ে ছাত্ররা পড়তে বসে পড়ে। বাইকে করে আসা কেউ কেউ গলির কাছাকাছি তার বাইকটি পার্ক করে বাইকের উপরেই পড়াশোনা করতে থাকে। ছাত্রছাত্রীদের সুযোগ-সুবিধার কথা বিবেচনা করে গলিটি সংস্কার করা হয়েছে। চমৎকার সব চিত্রশিল্প আর মনীষীদের উদ্দীপ্ত করা বাণী দিয়ে সাজানো হয়েছে গলির দেয়ালগুলো। ফলে গলিটি এক নতুন মাত্রা পেয়েছে। গলিটি এমন এক বর্ণিল রুপ পেয়েছে যাতে পড়াশোনাতে একাগ্রতা আরো বেড়ে যায়। পড়ায় সহজে মন বসে যায়।
এই গলি বহু পড়ুয়ার শিক্ষাজীবনে আশীর্বাদ হয়ে এসেছে। একসময় এই রাস্তাটি ছিল সুদাম কালি আহিরে মার্গের একটি অংশ। অনেকদিন ধরে এখানে পড়ুয়াদের ভিড় দেখেই এলাকার অধিবাসীরা পৌরসভার কাছে সরকারি নামটি পাল্টে এই রাস্তার নাম ‘অভ্যাস গলি’ করার জন্য দাবী জানান। এলাকার অধিবাসীদের দাবীকে মান্যতা দিয়ে চার বছর আগে পুরো রাস্তার নতুন নামকরণ হয় ‘অভ্যাস গলি’।
পড়ুয়াদের কথা বিবেচনা করে বৃহনমুম্বাই ইলেকট্রিক সাপ্লাই এন্ড ট্রান্সপোর্টের পক্ষ থেকে রাস্তায় উজ্জ্বল আলোর ব্যবস্থা করা হয়েছে। একাকী শুধু নয়, গ্রুপ স্টাডির জন্যও এ গলি বিখ্যাত। একসাথে পড়াশোনা করে অনেকেই তাদের পড়াশোনার বেশ উন্নতি করেছে। এই গলিতে পড়াশোনা করা প্রাক্তনরাও মাঝে মাঝে এসে জুনিয়রদের পড়াশোনায় সাহায্য করে থাকে।
দেড়শো-দু’শ বর্গ ফুটের পায়রার খোপের মতো দেখতে বাড়িগুলোতে যারা থাকে তারা জানায় যে, কীভাবে এই গলি তাদের পড়াশোনায় সহযোগিতা করেছে। লাইব্রেরিগুলো অনেক আগেই বন্ধ হয়ে যায়। গলির উন্মুক্ত নিরিবিলি পরিবেশে পড়াশোনা করা বাড়ির বা লাইব্রেরির বদ্ধ পরিবেশের চেয়ে অনেকগুণ ভালো। যদি ‘অভ্যাস গলি’ না থাকতো অনেক ছাত্রছাত্রীরই পড়াশোনা সেভাবে হতো না। বিডিডি চওলের ছোট ছোট বাড়ির ছেলেমেয়েদের কাছে এই রাস্তা তাই পড়াশোনার এক আদর্শ স্থান হিসেবে পরিচিতি পেয়েছে।
সাধারণত ১২-২৮ বছরের বয়সী ছেলেমেয়েদেরকে এখানে পড়াশোনা করতে দেখা যায়। সন্ধ্যা সাতটা থেকে ছাত্রছাত্রীরা এখানে জড়ো হতে থাকে। কোনো কোনো ছাত্র সারারাত ধরে পড়াশোনা করে। তবে সন্ধ্যা সাতটা থেকে রাত দশটা পর্যন্ত সবচেয়ে বেশি ছাত্রছাত্রীদের আনাগোনা থকে। রাস্তা দিয়ে ছুটন্ত গাড়ির আওয়াজ কিংবা মশার উপদ্রব তাদের পড়াশোনায় কোনো বিঘ্ন ঘটাতে পারে না। একনাগাড়ে অনেকক্ষণ পড়াশোনার পর কিছুক্ষণের বিরতিতে পাশের চায়ের দোকান থেকে বিস্কুট আর এক কাপ চায়ে গলা ভিজিয়ে নেয়া আবার কেউ কেউ গান শুনে বা একটুখানি হাঁটাচলার মাঝে সামান্য বিশ্রাম নিয়ে নেয়।
একাডেমিক বছরের শুরুতে, বিশেষ করে জুন মাসে, ফাইনাল পরীক্ষা শেষ হয়ে গেলে ভিড়টা একটু কমে যায়। এ সময় ছোট ছোট দলে শিক্ষার্থীদের পড়াশোনা করতে দেখা যায়। বেশিরভাগ ছাত্রছাত্রী তখন সিভিল সার্ভিস, ব্যাংক, বীমা এবং বড় বড় বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের বিভিন্ন নিয়োগ পরীক্ষার প্রস্তুতি নিতে থাকে। তবে এপ্রিল, ডিসেম্বরের দিকে পড়ুয়াদের সবচেয়ে বেশি ভিড় চোখে পড়ে।বর্ষার সময়টাতে এ গলিতে ছাত্রদের ভিড় খুব একটা থাকে না বললেই চলে। তখন বেশিরভাগ ছাত্রই সরকারি লাইব্রেরিগুলোতে কিংবা নিজের স্টাডিরুমে ব্যস্ত থাকে।
এ গলিতে পড়তে আসা বেশিরভাগ ছাত্রই একে অপরের নাম জানে। ফলে একই স্কুল বা কলেজ কিংবা সমবয়সী না হয়েও পরস্পরের মধ্যে বন্ধুত্ব গড়ে উঠে। পড়াশোনায় একে অপরকে সহযোগিতার মানসিকতা তৈরি হয়। সমবয়সীরা একে অপরকে নোট কিংবা রেফারেন্স বই দিয়ে সাহায্য করে। এভাবে তারা একে অপরের লেখাপড়ায় উন্নতি ঘটাতে ভূমিকা রাখে। এখানে পড়াশোনা করে অনেকেই ব্যারিস্টার, ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, অধ্যাপক ও নানা সম্মানজনক পেশায় প্রতিষ্ঠিত হয়েছেন। তাই এ পথটি অনেকের সুশৃঙ্খল ও উন্নত জীবনের পাথেয় হয়ে রয়েছে।
এবার শোনা যাক কিছু সাফল্যের গল্প। এ গলি থেকে বেশ কয়েকজন ছাত্র ডাক্তার, প্রকৌশলী, উদ্যোক্তা এবং এমনকি পুলিশ কর্মকর্তা হয়েছেন। এমনই এক ছাত্র রাজনাগম।
২০০৩ সালের কথা। ক্রিকেট বিশ্বকাপ জ্বরে ভারত তখন উন্মাতাল। বহু বছর পর বিশ্বকাপ ভারতে আসার অপেক্ষায়। বাড়ি, অফিস, পাড়া কিংবা লাইব্রেরি সবখানেই এক আলোচনা। বিশ্বকাপে ভারতের সম্ভাবনা কতটুকু তা নিয়ে চায়ের কাপে তুমুল ঝড়। সে সময়টায় বাসায় পড়াশোনা করা রাজনাগমের পক্ষে সম্ভব হচ্ছিল না। ১৫ বছর বয়সী এসএসসি ছাত্রদের মধ্যে সে এবং কয়েকজন নিরিবিলিতে পড়াশোনার জন্য বেছে নিল অভ্যাস গলিকে। গলিতে চলতে লাগলো তাদের নিয়মিত লেখাপড়া। সেই পরিশ্রমের পুরস্কারও পায় রাজনাগম। চূড়ান্ত পরীক্ষায় ৮৬ শতাংশ নম্বর নিয়ে সে উত্তীর্ণ হয়।
একইভাবে, অমিতেশ মিশ্র আট বছর ধরে গালিতে পড়াশোনা করে পলিটেকনিক্যাল প্রকৌশলী হয়েছেন। পরে তিনি রেনু সিস্টেম এন্ড সলিউশন নামে এক ওয়েব ডেভালেপমেন্ট কোম্পানি শুরু করেন। তার প্রতিষ্ঠান বড় বড় কোম্পানির ওয়েবসাইটের দায়িত্বে নিয়োজিত রয়েছে। এভাবে আরও হাজারো সফল ছাত্রছাত্রীর সাফল্যে উদ্ভাসিত হয়ে আছে অভ্যাস গলির চিরচেনা পরিবেশ। গলিতে পড়ুয়ারা যাতে নির্বিঘ্নে পড়াশোনা করতে পারে তাই টহল পুলিশের দল প্রতিনিয়ত গলির চারপাশে নজরদারি করে থাকেন। সকলেরই প্রত্যাশা এভাবে বিশ্বের সব গলিই নিরাপদ ও আনন্দমুখর হয়ে উঠুক।