যুক্তরাষ্ট্র বর্তমান পৃথিবীর সবচেয়ে শক্তিধর দেশ। সামরিক খাতে যুক্তরাষ্ট্রের বরাদ্দ সবচেয়ে বেশি। বরাদ্দের দিক দিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের একার বরাদ্দই প্রথম ১০টি দেশের বাকি সবগুলোর মোট বরাদ্দের চেয়ে বেশি। পারমাণবিক বোমার মজুদের দিক দিয়েও যুক্তরাষ্ট্র পৃথিবীর প্রায় সকল দেশ থেকে যোজন যোজন এগিয়ে। এক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্রের সামনে আছে কেবল রাশিয়া। যেখানে অন্যান্য পারমাণবিক শক্তিধর দেশগুলোর মাত্র কয়েকশো নিউক্লিয়ার ওয়ারহেড মজুদ আছে সেখানে যুক্তরাষ্ট্রের একারই মজুদ আছে প্রায় সাত হাজার নিউক্লিয়ার ওয়ারহেড। রাশিয়ার মজুদ তার চেয়ে কিছু বেশি।
যুক্তরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে সাধারণ যুদ্ধে জয়ের সম্ভাবনা নেই বললেই চলে। কয়েকটি দেশ একজোট হলেও যুক্তরাষ্ট্রকে পুরোপুরি হারাতে পারার সম্ভাবনা ক্ষীণ। তবে যুদ্ধটি যদি হয় পারমাণবিক যুদ্ধ, সে যুদ্ধের জয়ী নির্ধারণ করা মুশকিল।
যুক্তরাষ্ট্রের সাথে পারমাণবিক যুদ্ধে জড়িয়ে পড়লে কে জিতবে সে প্রশ্নের উত্তর করার আগে দেখে নেওয়া যাক পারমাণবিক হামলা চালানো হলে যুক্তরাষ্ট্র কীভাবে সেটির জবাব দেবে।
কেউ যুক্তরাষ্ট্রে পারমাণবিক বোমা হামলা চালাতে চাইলে সবার আগে তারা যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থাকে ভেঙ্গে দেবার চেষ্টা করবে। সেজন্য সর্বপ্রথম তারা কাছাকাছি যেসব মিত্র দেশে যুক্তরাষ্ট্রের সেনাবাহিনী ও মিসাইল মোতায়েন করা আছে সেগুলো ধ্বংসের চেষ্টা করবে। যেমন, উত্তর কোরিয়া যদি যুক্তরাষ্ট্রে পারমাণবিক হামলা চালাতে চায় তাহলে সর্বপ্রথম তারা দক্ষিণ কোরিয়া ও জাপানে মোতায়েন করা যুক্তরাষ্ট্রের সেনাঘাঁটিগুলোতে হামলা চালাবে। একে প্রি-এমটিভ অ্যাটাক বলে।
প্রি-অ্যাটাক হচ্ছে শত্রু যেন পাল্টা জবাব দিতে না পারে সেজন্য আগে থেকেই তাকে দুর্বল করে দেওয়া। এক্ষেত্রে মিত্র দেশগুলোতে অবস্থিত যুক্তরাষ্ট্রের বিমানঘাঁটি, সেনাঘাঁটি ও নৌঘাঁটিগুলোতেও আক্রমণ করা হতে পারে।
কাছাকাছি অবস্থিত যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা গুঁড়িয়ে দেবার পর আক্রমণকারী দেশটি যুক্তরাষ্ট্রের মূলভূমিতে পারমাণবিক বোমা নিক্ষেপের উদ্যোগ নেবে।
পৃথিবীর যেকোনো স্থান থেকে পারমাণবিক বোমা নিক্ষেপ করা হলে সেটি যুক্তরাষ্ট্রের মূলভূমিতে পৌঁছাতে কিছুটা সময় নেবে। এই সময়ের মধ্যে যুক্তরাষ্ট্রের সেনাবাহিনীকে তাদের করণীয় নির্ধারণ করতে হবে। যদিও মিসাইল ছোঁড়ার পর বহনকৃত বোমা বিস্ফোরিত না হওয়া পর্যন্ত জানার উপায় নেই নিক্ষিপ্ত মিসাইল প্রকৃতপক্ষে কী বহন করছে- এটি কি রাসায়নিক বোমা, না জৈব বোমা, নাকি পারমাণবিক বোমা। সেক্ষেত্রে আন্তঃমহাদেশীয় ব্যালাস্টিক মিসাইল ছুটে এলে সর্বোচ্চ সতর্কতা হিসেবে সেটিকে পারমাণবিক বোমা হিসেবেই বিবেচনা করা হবে।
পৃথিবীর যেকোনো অংশ থেকে ব্যালাস্টিক মিসাইল উৎক্ষেপণের এক মিনিটের মধ্যে যুক্তরাষ্ট্র মিসাইলের অবস্থান সম্পর্কে জেনে যাবে। জেনে যাবার সে প্রযুক্তি যুক্তরাষ্ট্রের আছে। মহাশূন্যে মোতায়েন করা যুক্তরাষ্ট্রের স্যাটেলাইটগুলো তাপ সেন্সরের মাধ্যমে মিসাইলকে চিহ্নিত করে মূহুর্তের মধ্যে সে তথ্য যুক্তরাষ্ট্রের কলোরাডো ও নেবরাস্কাতে অবস্থিত প্রাথমিক সতর্কতা দলের কাছে স্বয়ংক্রিয়ভাবে পৌঁছে দেবে। আলাস্কাতে অবস্থিত গ্রাউন্ড রেইডার দলও একইসাথে কলোরাডো ও নেবরাস্কার প্রাথমিক সতর্কতা দলের কাছে মিসাইল উৎক্ষেপণের তথ্য পৌঁছে দেবে। এসব তথ্য পর্যালোচনা করে প্রাথমিক সতর্কতা দল মিসাইলের গতিপথ নির্ণয় করবে। পুরো প্রক্রিয়াটি সমাপ্ত হবে মিসাইল উৎক্ষেপণের দুই মিনিটের মধ্যে।
মিসাইল উৎক্ষেপণের তিন মিনিটের মধ্যে যুক্তরাষ্ট্রের কর্তাব্যক্তিরা চূড়ান্ত সিদ্ধান্তে উপনীত হবেন যে প্রকৃতপক্ষে হামলা যুক্তরাষ্ট্রেই করা হচ্ছে কিনা কিংবা নিক্ষিপ্ত মিসাইলটি যুক্তরাষ্ট্রের দিকেই আসছে কিনা। যুক্তরাষ্ট্রে হামলা করা হচ্ছে নিশ্চিত হবার পর সেনা সদরদপ্তর (পেন্টাগন) ও স্ট্রাটেজিক কমান্ডকে সম্ভাব্য হামলা বিষয়ে অবহিত করবে। সংবাদ পাওয়ামাত্র পেন্টাগন ও স্ট্রাটেজিক কমান্ড দল প্রেসিডেন্ট ও অ্যাডভাইজরদের সাথে জরুরী ফোনালাপে বসবে। এ ফোনালাপে অংশ নেবে প্রেসিডেন্ট, সেক্রেটারি অব স্টেইট, সেক্রেটারি অব ডিফেন্স ও ন্যাশানাল সিকিউরিটি অ্যাডভাইজর।
স্ট্র্যাটেজিক কমান্ড দল থেকে একজন ফোর-স্টার জেনারেল প্রেসিডেন্টকে সম্ভাব্য হুমকি ও প্রেসিডেন্টের হাতে কি কি পথ খোলা আছে সে বিষয়ে ব্রিফিং করবে। ব্রিফিং শেষে প্রেসিডেন্টের হাতে ছয় মিনিট সময় থাকবে করণীয়ের ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেবার।
প্রেসিডেন্টের সিদ্ধান্ত সম্পন্ন হলে অফিসারদের সেটি জানাবেন। প্রেসিডেন্ট যদি পাল্টা পারমাণবিক বোমা হামলার সিদ্ধান্ত নেন তাহলে সে নির্দেশ দেওয়ার আগে প্রেসিডেন্টকে তার পরিচয়ের প্রমাণ দিতে হবে। এজন্য প্রেসিডেন্টকে কয়েকটি চ্যালেঞ্জ দেবে পেন্টাগন ও ‘দ্য ওয়ার রুম’। এই চ্যালেঞ্জগুলোর সঠিক উত্তর করতে পারলে কেবল তখনই নিশ্চিতভাবে জানা যাবে পারমাণবিক হামলার নির্দেশ প্রকৃতপক্ষেই স্বয়ং প্রেসিডেন্টের কাছ থেকে এসেছে।
পরিচয় নিশ্চিত করার জন্য প্রেসিডেন্টকে একটি স্পেশাল কোড বলতে হবে। প্রেসিডেন্ট কোডটি সঠিকভাবে বলতে পারলে ভূগর্ভস্থ রক্ষণাগার ও জলগর্ভস্থ সাবমেরিনের কাছে প্রেসিডেন্টের নির্দেশ ও অথেনটিকেশন কোড পৌঁছে যাবে।
প্রেসিডেন্টের কাছ থেকে নির্দেশ পাবার এক মিনিটের মাথায় গোপন অবস্থান থেকে পারমাণবিক ক্ষেপণাস্ত্র বহনকারী মিসাইলগুলো ছুটবে গন্তব্যের দিকে। তবে শত্রুপক্ষ যদি সাবমেরিন থেকে মিসাইল উৎক্ষেপণ করে সেক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিক্রিয়া দেখানোর সময় নেমে আসবে অর্ধেকের নিচে।
এগুলো হচ্ছে যুক্তরাষ্ট্রের প্রতি পারমাণবিক মিসাইল নিক্ষেপ করা হলে যুক্তরাষ্ট্র পাল্টা পারমাণবিক হামলা চালানোর হিসেব। কিন্তু ইতোমধ্যে যুক্তরাষ্ট্রের দিকে যে মিসাইল ধেয়ে আসছে সেগুলোকে তো প্রতিহত করতে হবে!
ধাবমান মিসাইলকে প্রতিহত করার জন্য যুক্তরাষ্ট্রের ক্যালিফোর্নিয়া ও আলাস্কায় ৪৪টি মিসাইল ইন্টারসেপ্টর আছে। এগুলো অগ্রসরমান মিসাইলকে প্রতিহত করে দিতে পারে। যদিও এই ইন্টারসেপ্টরগুলো সফলভাবে মিসাইল প্রতিহত করার নিশ্চয়তা দেয় না। এই অনিশ্চয়তার পেছনে কয়েকটি কারণ আছে।
প্রথমত, মিসাইলের গতি তীব্র হওয়ায় ইন্টারসেপ্টর দিয়ে এদেরকে নির্ভুলভাবে আঘাত করতে পারার সম্ভাবনা ক্ষীণ। দ্বিতীয়ত, একটি মিসাইলকে প্রথমবারেই আঘাত করতে ব্যর্থ হলে দ্বিতীয়বার আঘাত করার সুযোগ পাবার সম্ভাবনা ক্ষীণ। তাই প্রথম প্রচেষ্টাতেই সফল হতে একসাথে অনেকগুলো ইন্টারসেপ্টর মিসাইল উৎক্ষেপণ করতে হবে।
তৃতীয়ত, পারমাণবিক বোমা হামলার ক্ষেত্রে প্রতিপক্ষ দেশ শুধুমাত্র একটি মিসাইল নিক্ষেপ করবে না। একসাথে অনেকগুলো মিসাইল নিক্ষেপ করবে। এগুলোর মধ্যে শুধুমাত্র একটিতে পারমাণবিক ওয়ারহেড থাকবে। বাকিগুলো নিক্ষেপ করা হবে প্রতিরক্ষাব্যবস্থাকে বিভ্রান্ত করার জন্য। মূল মিসাইলের সাথে বিভ্রান্ত করার জন্য নিক্ষিপ্ত এসব মিসাইলকে বলে ‘ডিকয়’।
তাই আগুয়ান একটি পারমাণবিক বোমা প্রতিহত করতেই উৎক্ষেপণ করতে হবে অসংখ্য ইন্টারসেপ্টর মিসাইল। পাশাপাশি, এফ-৩৫ ফাইটার জেট থেকে আগুয়ান মিসাইল ধ্বংসের চেষ্টা করা হবে। এতকিছুর পরও সাফল্য আসার সম্ভাবনা খুব একটা বেশি নয়।
শত্রুরাষ্ট্রের হামলার জবাবে যুক্তরাষ্ট্র নিজেও পারমাণবিক হামলা চালানোর পাশাপাশি স্থল, জল ও আকাশপথেও হামলা চালাবে। সাধারণ যুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রকে হারানো কঠিন হলেও পারমাণবিক শক্তিধর দেশের সাথে যুদ্ধ বাঁধলে তার ফলাফল সবার জন্য হবে ভয়াবহ। যেসব দেশে পারমাণবিক বোমা নিক্ষেপ করা হবে সেসব দেশ তো ধ্বংস হবেই, পাশাপাশি নিক্ষিপ্ত বোমাগুলো যে পরিমাণ বিকিরণ, ধুলা ও ধোঁয়া উৎপন্ন করবে তাতে পুরো পৃথিবী ক্ষতিগ্রস্ত হবে।
এক গবেষণায় দেখা গেছে, পৃথিবীতে কয়েকশো পারমাণবিক বোমার বিস্ফোরণ ঘটালে তা থেকে উৎপন্ন ধুলো ও ধোঁয়া সূর্যকে এমনভাবে ঢেকে দেবে যে এই আবরণ ভেদ করে সূর্যালোক পৃথিবীতে প্রবেশ করতে পারবে না। আলো প্রবেশ করতে না পারলে গাছপালা তৈরি করতে পারবে না নিজের খাদ্য। গাছপালার ভূমিকা চলে গেলে বিপন্ন হবে সভ্যতা। ৬৫ মিলিয়ন বছর আগে গ্রহাণুর আঘাতে একবার পৃথিবীতে এমন পরিস্থিতির উদ্ভব হয়েছিল। প্রাণীজগতের নব্বই শতাংশ চিরতরে নিশ্চিহ্ন হয়ে গিয়েছিলো তাতে।
যেকোন মূল্যে পারমাণবিক যুদ্ধ প্রতিহত করাই হওয়া উচিত মানবজাতির একমাত্র লক্ষ্য। যুক্তরাষ্ট্রে যারাই পারমাণবিক হামলা করুক, যুক্তরাষ্ট্র যেভাবেই তার আঘাত প্রতিহত করুক আর যেভাবেই তার জবাব দেবার প্রক্রিয়া প্রস্তুত রাখুক পারমাণবিক যুদ্ধ এমন এক যুদ্ধ, যে যুদ্ধ কেউ জয়ী হবে না।