যুক্তরাষ্ট্রের হাউজ স্পিকার ন্যান্সি পেলোসির তাইওয়ান সফরের পর থেকে চীনের তাইওয়ান নিয়ে এযাবৎকালে সবচেয়ে বেশি উদ্বেগ বেড়েছে, বারংবার চীনা যুদ্ধবিমান প্রবেশ করেছে দেশটির আকাশসীমায়। তাইওয়ান সীমান্তে চীন যুদ্ধের প্রস্তুতিস্বরুপ শুরু করেছে সামরিক মহড়া, চালাচ্ছে সাইবার হামলা, দিচ্ছে অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা। তাইওয়ানও শক্ত করছে তার পাল্টা প্রতিরক্ষাব্যবস্থা। চীনের নাগরিকদের বিশ্বাস- তাইওয়ান ঐতিহাসিকভাবে চীনের অংশ। তাইওয়ানের ভূখন্ড চীনের জন্য বিভিন্ন দিক থেকে গুরুত্বপূর্ণ, তাইওয়ান পুনঃএকত্রীকরণ হয়ে উঠেছে চীনা জাতীয়তাবাদের জন্যও গুরুত্বপূর্ণ। ‘শি জিনপিং চিন্তাধারা’ অনুযায়ী- তাইওয়ান পুনঃএকত্রীকরণ চীনের ‘জাতীয় পুনরুজ্জীবন’ পরিকল্পনার অংশ। বিভিন্ন কারণে তাইওয়ান ভূখন্ড নিয়ে চরম উত্তেজনা চতুর্দিক থেকে শি জিনপিংকে বাধ্য করবে তাইওয়ান আক্রমণ করতে। প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং এমন এক অবস্থানে আছেন, আক্রমণ করলেও বিপদ, না করলেও শি-কে হারাতে হবে অনেক কিছু। তাহলে তাইওয়ানে নতুন করে শুরু হওয়া উত্তেজনা কি প্রেসিডেন্ট শি জিনপিংয়ের জন্য বিপদের আশঙ্কা, শাঁখের করাত হয়ে দাঁড়াবে? তাইওয়ান ইস্যু প্রেসিডেন্ট শি-র জন্য শাঁখের করাত হওয়ার কারণ চীনা কমিউনিস্ট পার্টির কংগ্রেস, তার আজীবন রাষ্ট্রপতি থাকা না থাকার প্রশ্ন, এবং তাইওয়ান আক্রমণের পক্ষে জনমত।
আসন্ন চীনা সমাজতান্ত্রিক দলের ২০তম কংগ্রেস
সমাজতান্ত্রিক চীনের একমাত্র রাজনৈতিক দল কমিউনিস্ট পার্টি অব চায়না (সিপিসি)। ১৯২১ সালে প্রতিষ্ঠা পায় সিপিসি। সেই বছরই অনুষ্ঠিত হয় দলটির প্রথম কংগ্রেস। প্রতি পাঁচ বছর অন্তর আয়োজন করা হয় এই পঞ্চবার্ষিকী কংগ্রেস। পঞ্চবার্ষিকী কংগ্রেসে বিগত পাঁচ বছরের কাজের পর্যালোচনা হবে, নির্ধারিত হবে ভবিষ্যতের জন্য পরিকল্পনা, এবং নির্বাচিত হবে নতুন কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব। চলতি বছরের নভেম্বরে অনুষ্ঠিত হতে পারে সিপিসির ২০ তম কংগ্রেস। চীনের বর্তমান ও আজীবন প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং টানা দ্বিতীয় মেয়াদে চীনা কমিউনিস্ট পার্টির সাধারণ সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব পালন করে আসছেন।
প্রেসিডেন্ট শি জিনপিংয়ের জন্য আসন্ন পার্টি কংগ্রেসে নেতৃত্ব ঠিকিয়ে রাখা যেমন জরুরি, তেমনই চ্যালেঞ্জিং। শি পার্টির অভ্যন্তরীণ এলিট শ্রেণীকে হাত করে চীনা জনসাধারণের তার বিরুদ্ধে যেকোনো পদক্ষেপের মূল্য বাড়িয়ে এমন পর্যায়ে নিয়ে গেছেন যে, তাকে চ্যালেঞ্জ করা সিপিসি-কে চ্যালেঞ্জ করা, হয়ে উঠেছেন দেশের অপ্রতিরোধ্য কর্তৃপক্ষ। ২০১২ সালে শি দায়িত্ব গ্রহণ করার পর তাইওয়ান নিয়ে পূর্বসূরি হু জিনতাওর মত পলিসি নেন শি। ২০১৭ সালে কমিউনিস্ট পার্টির ১৯তম কংগ্রেসে শি তার “চায়না ড্রীম” প্রকাশ করেন। যার অন্তর্ভুক্ত তাইওয়ান পুনঃএকত্রীকরণসহ চীনের ঐতিহাসিক গৌরবকে পুনরুজ্জীবিত করা। তাই তাইওয়ানের পুনর্মিলন নিয়ে শি কট্টরপন্থী দৃষ্টিভঙ্গি বজায় রাখেন। তাইওয়ান পুনঃএকত্রীকরণ নিয়ে শি বক্তব্য, লক্ষ্য নিয়ে এতদিন পার্টির জুনিয়র কর্মকর্তারা তার উপর যে আস্থা রেখেছিল, তাইওয়ান উত্তেজনায় তার ভূমিকার প্রশ্নে তা এখন কমতে শুরু করেছে। প্রশ্ন উঠেছে তাইওয়ান নিয়ে চীনের নীতিতে শির প্রভাব নিয়ে। তাইওয়ান ইস্যু নিয়ে পার্টিতে কমতে পারে তার জনপ্রিয়তা। শিকে আক্রমণ এবং চ্যালেঞ্জ করার জন্য চীনা প্রধানমন্ত্রী লি কেকিয়াং ও ‘সাংহাই গ্যাং’-এর মতো পার্টির মধ্যে শির বিরোধীরা ঘরোয়া সমস্যা ব্যবহার করছে। তাইওয়ান প্রণালীতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রভাব বৃদ্ধি না রুখতে পারলে শি-কে মানতে হবে ‘চায়না ড্রীম’-এর ব্যর্থতা, হারাতে হবে জনপ্রিয়তা যা তাকে তৃতীয় ধাপে নির্বাচিত করতে বাধা হয়ে দাঁড়াতে পারে।
পুনরায় রাষ্ট্রপতি হিসেবে শির নির্বাচিত হওয়া
২০১৩ সালে শি জিনপিং চীনের প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন, ২০১৮ সালে পুনরায় দ্বিতীয় মেয়াদে দায়িত্ব নেন প্রেসিডেন্ট হিসেবে। শি দ্বিতীয় মেয়াদে ক্ষমতায় থাকাকালীন অর্জন করেন চূড়ান্ত ক্ষমতা, তুলে দেন প্রেসিডেন্ট হিসেবে সর্বোচ্চ দশ বছর দায়িত্ব পালনের সীমারেখা। চীনের প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন চীনের পার্লামেন্ট ‘ন্যাশনাল পিপলস কংগ্রেস (এনপিসি)’ দ্বারা। এর থাকে রাষ্ট্রপতি ও অন্যান্য রাষ্ট্রীয় শীর্ষ কর্মকর্তাদের নির্বাচনের পাশাপাশি অপসারণেরও ক্ষমতা। এনপিসির বিধিবিধান অনুযায়ী, রাষ্ট্রপতি মনোনীত হন এনপিসি প্রেসিডিয়াম দ্বারা। কিন্তু বাস্তবে, ১৯৯০ সালের পর থেকে চীনা সমাজতান্ত্রিক দলের সাধারণ সম্পাদকই মনোনীত হন রাষ্ট্রপতি পদে। কংগ্রেস দ্বারা নির্বাচিত রাজ্যের সমস্ত কর্মকর্তাদের মতো রাষ্ট্রপতিও এক নামের ব্যালট থেকে নির্বাচিত হয়ে থাকেন। যেহেতু চীনের রাষ্ট্রপতির পদটি চীনা সমাজতান্ত্রিক দলের সাধারণ সম্পাদকের জন্য সংরক্ষিত থাকে, সেহেতু রাষ্ট্রপতি হতে হলে যে কাউকে হতে হবে পার্টির সাধারণ সম্পাদক। তাই শির রাষ্ট্রপতি থাকা নিয়ে দেখা দিয়েছে শঙ্কা। একটু আগেই আলোচিত হয়েছে যে প্রেসিডেন্ট শির জন্য পার্টির সাধারণ সম্পাদক হিসেবে টিকে থাকা সংকটপূর্ণ করে দিয়েছে তাইওয়ান ইস্যু।
তাইওয়ান আক্রমণের পক্ষে জনমত
তাইওয়ান প্রথম পুরো চীনের নিয়ন্ত্রণে আসে সতের শতাব্দীতে, যখন চিং রাজবংশের শাসনামল চলছিল। ১৮৯৫ সালে প্রথম চীন-জাপান যুদ্ধে হেরে যাবার পর চীনকে এ দ্বীপ তুলে দিতে হয় জাপানের হাতে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে হেরে যাবার পর ১৯৪৫ সালে চীন আবার জাপানের কাছ থেকে দ্বীপটি নিয়ে নেয়। ১৯৪৯ সালে মাও সে তুংয়ের লাল বাহিনীর নেতৃত্বে চীনে ঘটে যায় সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব। তৎকালীন চিয়াং কাইশেকের নেতৃত্বাধীন কুয়োমিনটাং পার্টির সরকার পালিয়ে আশ্রয় নেয় তাইওয়ান দ্বীপে, গঠন করে ‘রিপাবলিক অব চায়না’। ১৯৫০ সালের কোরীয় যুদ্ধের পর তাইওয়ানে যুক্তরাষ্ট্রের প্রভাব বাড়তে থাকে, বিকশিত হতে থাকে গণতন্ত্র। কিন্তু চীনের নাগরিকরা মনে করে- তাইওয়ান চীনের অংশ। চীনা জাতীয়তাবাদ গড়ে উঠেছে শি জিনপিংয়ের চিন্তাধারা অনুযায়ী। ‘জাতীয় পুনরুজ্জীবন’ পরিকল্পনা অনুযায়ী চীনের নাগরিকরা চায় যেকোনোভাবে তাইওয়ানের পুনঃএকত্রীকরণ। ২০১৬ সালে দুটি চীনা প্রতিষ্ঠান কতৃক অনুষ্ঠিত একটি অনলাইন সমীক্ষায় দেখা গেছে, ৮৫% চীনা নাগরিক তাইওয়ানের সশস্ত্র পুনর্মিলন সমর্থন করেন। ২০১৯ সালে নয়টি প্রধান চীনা শহরের চালানো আরেকটি জরিপে ৫৩% চীনা নাগরিক তাইওয়ান পুনঃএকত্রীকরণের পক্ষে সমর্থন দিয়েছে।
সুতরাং, তাইওয়ান আক্রমণের পক্ষে গড়ে উঠেছে চীনা জনমত। রাষ্ট্রপতি শি-র এখন তাইওয়ান আক্রমণ জনসম্মতি পেলেও রয়েছে প্রতিকূলতাও। পার্টির অভ্যন্তরে শি-বিরোধী পক্ষ নিতে পারে সুযোগ, হাতছাড়া হতে পারে তার দলীয় ক্ষমতা। শি-র বিরোধী দল এখন পেলোসির তাইওয়ান সফরকে হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করতে চাচ্ছে, চাচ্ছে চীনা জাতীয়তাবাদী মনোভাব কাজে লাগাতে। এভাবে তাকে ফাঁদে ফেলতে পারলে তাকে যুক্তরাষ্ট্র-চীন সম্পর্ক নষ্টের দায়ে অভিযুক্ত করা যাবে, সরানো যাবে ক্ষমতা থেকে। এদিক থেকেও শি আছেন উভয় সংকটে। দুই ধরনের পদক্ষেপই তার জন্য বয়ে আনবে বিপদ।
আন্তর্জাতিক রাজনীতির ‘রিলেটিভ গেইন’ তত্ত্ব অনুসরণ করে এখন যদি শি তাইওয়ান আক্রমণ না করেন তাকে পড়তে হবে পার্টির অভ্যন্তরীণ বিরোধীদের কোন্দলে, আবার আক্রমণ করলেও মোকাবেলা করতে হবে অভ্যন্তরীণ ও বাহ্যিক বিরোধী শক্তিকে। রাষ্ট্রপতি শি-র জন্য এখন তাইওয়ান ইস্যু তাই হয়ে উঠেছে শাঁখের করাত।