জাপানের নাম শুনলে প্রথমেই মাথায় আসে হিরোশিমা, নাগাসাকি, মাউন্ট ফুজি, সুশি কিংবা বুলেট ট্রেনের কথা। কিন্তু এসব ছাড়াও জাপানে রয়েছে একটি দ্বীপ, যা বেশ বিখ্যাত। আর সেটি তা হলো খরগোশের দ্বীপ।
হিরোশিমা থেকে মাত্র ৫০ কিলোমিটার দূরে অবস্থান ওকুনোশিমা দ্বীপের। স্থানীয় ভাষায় একে বলা হয় উসাগি শিমা, যার অর্থ খরগোশের দ্বীপ (Rabbit Island)। সমুদ্রবেষ্টিত দ্বীপটিতে যেদিকেই চোখ যাবে শুধু খরগোশ আর খরগোশ। মনে হবে ভুল করে কোনো খরগোশের দেশে চলে এসেছেন।
ইতিহাস
রুশ-জাপানি যুদ্ধের পূর্ব পর্যন্ত ওকুনোশিমা দ্বীপটি ছিল কৃষিভূমি। যুদ্ধ চলাকালে নিরাপত্তা বাড়াতে জাপান এই দ্বীপে ১০টি দুর্গ নির্মাণ করে। তখন থেকেই দ্বীপটি সামরিক কাজে ব্যবহৃত হতে থাকে।
তবে এই দ্বীপের একটি অন্ধকারাচ্ছন্ন ইতিহাস রয়েছে। ১৯২৫ সালে জাপান সব ধরনের রাসায়নিক অস্ত্রের ব্যবহার বন্ধে জেনেভা চুক্তিতে স্বাক্ষর করে। কিন্তু চীনের সাথে যুদ্ধ অবশ্যম্ভাবী হওয়ায় জাপানের উন্নত রাসায়নিক অস্ত্রের প্রয়োজন ছিল। সেজন্য জাপানের সামরিক বাহিনীর প্রকৌশল ও গবেষণা বিভাগ এমন একটি জায়গা খুঁজছিল যেখানে গোপনে রাসায়নিক অস্ত্রের গবেষণা ও প্রয়োগ কেন্দ্র গড়ে তোলা যায়। ওকুনোশিমা দ্বীপটি ছিল এজন্য আদর্শ একটি স্থান। কারণ টোকিও শহর থেকে দ্বীপটি ছিল অনেক দূরে এবং আশেপাশে কোনো জনবসতি ছিল না। কেন্দ্রটির নির্মাণকাজ চলে ১৯২৭ থেকে ১৯২৯ সাল পর্যন্ত। এরপর অতি গোপনীয়তার সাথে এখানে চলে ক্ষতিকারক গ্যাসের পরীক্ষা।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষের দিকে ১৯৪৫ সালে মিত্রশক্তি দ্বীপটি দখল করে নেয় এবং রাসায়নিক কারখানাগুলোর সন্ধান পায়। এরপর তারা সব বিষাক্ত গ্যাস নষ্ট করে ফেলে। যুদ্ধে এই দ্বীপে উৎপন্ন গ্যাসের ব্যবহারে প্রায় ৮০ হাজার মানুষ মারা যায়। ১৯৮৮ সালে এখানে একটি জাদুঘর বানানো হয় যেখানে ওই সময়ে রাসায়নিক অস্ত্র তৈরিতে ব্যবহৃত বিভিন্ন সরঞ্জাম রাখা আছে। জাদুঘরে দেখতে পাবেন রাসায়নিক গ্যাসের সাথে জড়িত বিভিন্ন ঐতিহাসিক জিনিস। পেয়ে যাবেন দ্বীপের অন্ধকার ইতিহাসের এক ঝলক।
দ্বীপে খরগোশ এলো কীভাবে?
ওকুনোশিমা দ্বীপে কীভাবে এত খরগোশ এলো এটা নিয়ে বিভিন্ন মতবাদ প্রচলিত আছে। সবচেয়ে বিশ্বাসযোগ্য মতবাদটি হলো, তখন গ্যাস কারখানার গবেষণা কাজে ব্যবহৃত হত খরগোশ। গবেষণামূলক কাজে তখনকার সময়ে ইঁদুর এবং খরগোশের উপর বিষাক্ত গ্যাসের প্রয়োগ করা হত। আবার অনেক সময় ঘোড়ার উপরও প্রয়োগ চালান হত। যখন মিত্রবাহিনী দ্বীপের দখল নেয় তখন খরগোশগুলোকে দ্বীপে ছেড়ে দেয়। আবার অনেকে বলে, খরগোশগুলো কারখানা বন্ধ হওয়ার পর দ্বীপের ভেতরে পালিয়ে যায়। সেই পালিয়ে যাওয়া খরগোশ থেকেই আজ দ্বীপভর্তি খরগোশ। আরেকটি মতবাদ হলো, ১৯৭১ সালে দ্বীপটিতে ঘুরতে আসা কিছু স্কুলের বাচ্চা কয়েকটি খরগোশ ছেড়ে দেয় দ্বীপে। সেখান থেকেই এত খরগোশের জন্ম।
যে কারণেই দ্বীপটিতে খরগোশ আসুক, বর্তমানে তাদের সংখ্যা প্রায় এক হাজার। টুরিস্টরা প্রচুর পরিমাণে খাবার সরবরাহ করে, তাই খরগোশ এই দ্বীপে নির্দ্বিধায় ঘুরে বেড়ায়। খরগোশের যেহেতু প্রজনন ক্ষমতা বেশি এবং দ্বীপে কোনো শিকারি প্রাণী নেই, তাই তারা অনিয়ন্ত্রিত হারে বংশবিস্তার করতে পারছে।
বন্য খরগোশ এত বন্ধুত্বপূর্ণ আচরণ করে কেন?
খরগোশ খুবই নিরীহ গোছের প্রাণী। শিকারি প্রাণীর কাছে লোভনীয় খাবারও বটে। বিপদ থেকে বাঁচতে এর একটি মাত্র আত্মরক্ষার উপায় আছে, আর তা হলো দ্রুতগতি। বিপদের গন্ধ পেলেই দ্রুত পালিয়ে যেতে সক্ষম খরগোশ। মানুষের সামনে বুনো খরগোশ মাত্র কয়েক সেকেন্ডই থাকে। কিন্তু ওকুনোশিমা দ্বীপের খরগোশরা অন্যান্য বন্য খরগোশের মতো না। এই দ্বীপের খরগোশরা যেন মানুষের সাথে থাকতেই বেশি স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করে।
অনেকেই মনে করে, দ্বীপে কোনো শিকারি প্রাণী না থাকাই এই ব্যতিক্রমী বৈশিষ্ট্যের কারণ। এর ফলে খরগোশেরা স্বাচ্ছন্দ্যে দ্বীপে ঘুরে বেড়ায়। আর মানুষের সাথে সখ্যের কারণ হলো টুরিস্টরা খরগোশের জন্য প্রচুর পরিমাণে খাবার নিয়ে যায়। দ্বীপে যেহেতু খরগোশের সংখ্যা অনেক এবং বনে জঙ্গলে খাবার সন্ধান করার থেকে মানুষের খাবার খাওয়া বেশি সুবিধাজনক, তাই দ্বীপে খরগোশ এবং টুরিস্টদের মধ্যে এরকম সম্পর্ক গড়ে উঠেছে।
দ্বীপে ঘুরতে যাওয়া টুরিস্টদের প্রায় সকলেই প্যাকেটজাত খাবার বা গাজর নিয়ে যায় খরগোশের জন্য। বছরের পর বছর এভাবে চলতে থাকায় খরগোশও বুঝে গেছে কার কাছে গেলে খাবার পাওয়া যাবে। আপনি একটি প্যাকেট হাতে নিয়ে যাবেন। কিছুক্ষণের মধ্যেই আপনার চারপাশে ৩০-৪০টি খরগোশ জমা হয়ে যাবে। এরপর আপনি এই আদুরে প্রাণীগুলোকে কোলে তুলে হাতে ধরে খাওয়াতেও পারবেন। আপনার হাতে খাবার নেই। কিন্তু আদুরে প্রাণীগুলোকে খাওয়াতে ইচ্ছা করছে। চিন্তা নেই। আশেপাশে কারো কাছে বললেই দুই-তিনটা গাজর পেয়ে যাবেন। ব্যাস, আপনারও সখ মিটে গেল!
দ্বীপে ঘুরতে যাওয়া শিশু থেকে বৃদ্ধ সবাই পশুপ্রেমী। আর জাপানের মানুষ বন্য পশুপাখিদের সাথে সহাবস্থানে বিশ্বাসী। তাই মানুষের হাতেও খরগোশদের ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার কোনো সুযোগ নেই। জাপানের বন্যপ্রাণী অধিদপ্তর এই দ্বীপের খরগোশদের সুরক্ষায় কাজ করে। খরগোশেরাও মহা আনন্দে টুরিস্টদের সাথে খেলে দিন কাটাচ্ছে। যদিও তাদের সংখ্যার দ্রুত বৃদ্ধি অদূর ভবিষ্যতে সমস্যার কারণ হতে পারে। কিন্তু এই আদুরে প্রাণীগুলোকে দেখলে আপনিও এসব ভুলে গিয়ে খাবারের প্যাকেট হাতে বসে যাবেন খরগোশ ভর্তি ওকুনোশিমা দ্বীপের কোনো রাস্তায়।