(পর্ব ২ এর পর থেকে)
৫
সিতি কুয়ালালামপুরে পতিতাবৃত্তিতে জড়ানোর আগে লম্বা একটা পথ পাড়ি দেন। তিনি ১৯৯২ সালে বিশ্বের সবচেয়ে বেশি মুসলিম জনসংখ্যার দেশ ইন্দোনেশিয়ার রাঙ্কা সুমুর গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। রাঙ্কা সুমুরের প্রায় ৫০০ অধিবাসী ধান চাষ আর মহিষ পালনের কাজ করত। সিতির ছোটবেলা কাটে গ্রামের পাশের জঙ্গল থেকে কাঠ সংগ্রহ করে, নদীতে গোসল করে আর ঝিঁঝিঁ পোকা সংগ্রহ করে। তার প্রতিবেশীরা তার স্মৃতি মনে করতে গিয়ে বলেন, তিনি একজন শান্ত ধার্মিক মেয়ে ছিলেন। তিনি সাধারণত আজানের ১০-২০ মিনিট আগে গ্রামের পোড়ামাটির মসজিদে কাজ করতে যেতেন, কারণ তার বাবা প্রায়ই সেখানে আজান দিতেন। ৯ বছর বয়সে তিনি শহরে নতুন চালু হওয়া ধর্মীয় স্কুলে যাওয়া শুরু করেন। বর্তমানে সেটা কট্টরপন্থী এক ইসলামী সংস্থা দ্বারা পরিচালিত হয়, যাকে অনেক বিশেষজ্ঞই সন্ত্রাসী সংগঠন মনে করেন।
ষষ্ঠ শ্রেণিতে সিতির পড়াশোনার ইতি ঘটে। কারণ সুমুরে কোনো মাধ্যমিক বিদ্যালয় ছিল না। তখন তার বাবা আসরিয়া নূর হোসেনকে আদা আর হলুদ কাটতে সাহায্য করেন স্থানীয় বাজারে বিক্রি করার জন্য। সিতির হয়তো তার বাড়ির আশেপাশের সামুদ্রিক ধান ছাড়া কিছুই দেখা হতো না, যদি না দেশটির রাজধানী জাকার্তা ৩ কোটি অধিবাসীর মহানগরে পরিণত না হতো। গ্রামবাসীরা শহুরে জীবনকে অনৈসলামিক আর বিপজ্জনক মনে করত। কিন্তু সিতির কাছে বিষয়টা এমন ছিল না। তিনি টেলিভিশনে শহুরে জীবন যতটা দেখেছেন, সেটা তাকে মুগ্ধ করত। জাকার্তার প্রতি তার অপ্রতিরোধ্য আকর্ষণ ছিল।
সিতির যখন ১৪ বছর বয়স, তার এক আত্মীয় জাকার্তার এক বস্তি এলাকার ছোট এক দোকানে কাজের ব্যবস্থা করে দেন। তার পৃথিবী তখন সেলাই মেশিন আর কাপড়ের পাহাড়ের মাঝে সীমাবদ্ধ হয়ে গেল। দৈনিক ১৩ ঘণ্টা কাজ করে মাসে সেখানে ৫০ মার্কিন ডলার আয় করতেন। দোকানে তাকে বদ্ধ পরিবেশে কাজ করতে হতো। দোকানের মালিকরা দরজায় তালা দিয়ে যেত। তাই তার খুব একটা বাইরে যাওয়া হতো না।
দোকান থেকে এক মাইলেরও কম দূরত্বে একটা গগনচুম্বী শপিং মল ছিল। সেখানে জার্কার্তার বড়লোকরা স্টারবাকসের কফি চুমুক দিত। শহরে গিয়ে কাজ করে আর্থিকভাবে সচ্ছল হওয়া খুব কঠিন। খুব দ্রুতই সিতি উপলব্ধি করতে পারলেন শহরের জীবন টেলিভিশনে যতটা সুন্দর দেখায়, বাস্তবে ততটা সুন্দর নয়।
সিতি একটু লাজুক স্বভাবের ছিলেন। কিন্তু একসময় দোকানের মালিকের ছেলে গুনাওয়ান হাশিমের সাথে তার ভাব হয়ে গেল। তারা একসাথে বাজারে যেতেন। সিতির বয়স যখন ১৬, তখন তারা বিয়ে করে ফেলেন। তাদের একটা ছেলে সন্তানও হয়।
২০১১ সালে সেই দোকানের লোকসান হতে থাকলে গুনাওয়ান ভাগ্য বদলের আশায় মালয়েশিয়ায় পাড়ি জমান। সেখানে তিনি রেস্টুরেন্টে খাবার পরিবেশনা করতেন, আর সিতি একটা দোকানে কাজ করতেন। সিতির কাছে কুয়ালালামপুরকে জাকার্তার অবাস্তব সংস্করণ মনে হয়। সেখানকার মানুষের ভাষা ও সংস্কৃতি জাকার্তার মতোই, কিন্তু অর্থনৈতিক দিক দিয়ে তুলনামূলকভাবে উন্নত এবং অভিবাসীদের ওপর নির্ভরশীল। প্রতি বছর মালয়েশিয়ায় প্রায় চার লক্ষ ইন্দোনেশিয়ান বৈধভাবে প্রবেশ করে। এর সাথে আরো ছয় লক্ষ আসে অবৈধভাবে।
২০১২ সালে এই তরুণ দম্পতির বিচ্ছেদ হয়ে যায়। গুনাওয়ান সিতির ওপর বিশ্বাসঘাতকতার অভিযোগ আনেন। সিতি তখন ছেলেকে নিয়ে রাঙ্কা সুমুরে চলে যান। কিন্তু সেখান থেকে আবার মালয়েশিয়ার নিকটবর্তী এক দ্বীপ বাতামে একটা মহিলাদের কাপড়ের দোকানে কাজ করতে চলে যান। সিতিকে এখন তার নিজের পরিবারের দেখাশোনা করতে হয়। ছোটবেলার মতো গ্রামের জীবনে তার মানিয়ে নেওয়াও সম্ভব হচ্ছিল না। সিতি চাচ্ছিলেন তার ছেলে যেন আধুনিকভাবে গড়ে উঠতে পারে। তাই ছেলের দেখাশোনার ভার জাকার্তায় গুনাওয়ানের কাছে দিয়ে দেন, যেন ছেলে শহরে বড় হতে পারে।
গ্রেপ্তার হওয়ার চার বছর আগে থেক তার ফেসবুক পোস্টগুলো দেখলে তার জীবনযাত্রার পরিবর্তন টের পাওয়া যায়। প্রথম দিকে তিনি বিভিন্ন ধরনের পোশাক পরতেন, এগুলোর মধ্যে বোরকাও ছিল। ধীরে ধীরে তার পোশাকে পরিবর্তন চলে আসে। অন্যান্য মেয়ে বন্ধুদের সাথে কফি শপে আড্ডার ছবি দেখা যায়। আগের চেয়ে শরীরের মেদ ঝড়িয়ে ফেলেন। মেকআপও করা শুরু করেন।
২০১৫ সালে তিনি আবার কুয়ালালামপুরে চলে আসেন। শুরুতে হোটেল গ্র্যান্ড কন্টিনেন্টাল নামে একটা হোটেলে স্পায়ের কাজ করেন। হোটলের নাম শুনলে অভিজাত শ্রেণির মনে হলেও আদতে এটা একটা সস্তা হোটেল। তবে সেখানে ইন্দোনেশিয়া থেকে ভালো আয়ের সুযোগ ছিল। কয়েক মাস কাজ করার পর সিতি হোটেল ফ্ল্যামিঙ্গোতে চলে আসেন, যেখানে তার পারিশ্রমিক কিছুটা বাড়ে। সেখানে তার নতুন পেশার কাজও শুরু করেন। তিনি ফেসবুকে দিনের বেলার হাসিখুশি ছবি পোস্ট দিলেও ২০১৭ এর শুরুর দিকে এসে তার রাতের জীবন নিয়ে হতাশায় ভুগছিলেন। তার কাজে যাওয়ার আগে তখন মিথাম্ফিটামিন ড্রাগ নেওয়া শুরু করেন।
মাঝে মাঝে যখন বাড়ি যেতেন, প্রতিবেশী বাচ্চাদের জন্য খাবার নিয়ে যেতেন। বাবা-মাকে ছুটিতে ঘুরতে নিয়ে যেতেন। কিন্তু কখনো তার আয়ের উৎস বলতে পারতেন না। ৩০ দিন পর পর তার ট্যুরিস্ট ভিসার মেয়াদ শেষ হয়ে গেলে মালয়েশিয়া থেকে বের হয়ে যেতেন। এরপর আবার ফিরে আসতেন নতুন ভিসা নিয়ে। এ কারণে মালয়েশিয়াই তার ঠিকানা হয়ে যায়।
৬
জেমস সিতিকে প্রলুব্ধ করার পর তারা ৫-৯ জানুয়ারি কুয়ালালামপুরের বিলাসবহুল হোটেল আর শপিং মলগুলো ঘুরে বেড়ান। সিতি সেখানে চীনা অবয়বের লোকদের মুখে তেল আর গরম সস মাখিয়ে দেন। প্রতিটি ‘প্র্যাঙ্ক’ সম্পন্ন করার জন্য সিতিকে পুরস্কৃত করা হয়। সিতি তখন জেমসকে তার বর্তমান পেশা নিয়ে হতাশার কথা জানান। তিনি একজন তারকা হওয়ার আকাঙ্ক্ষার কথাও জানিয়ে রাখেন। জেমসও তাকে আশ্বাস দিতে থাকেন। তখন পরিচিতদের কাছে বলে বেড়াচ্ছিলেন তিনি বিনোদন জগতের তারকা হতে যাচ্ছেন। তার এক বান্ধবী ভিডিও কলে জন্মদিনের শুভেচ্ছা জানানোর সময় মজা করে বলেন, মালয়েশিয়ার প্রতিষ্ঠিত এক নায়িকাকে তিনি ছাড়িয়ে যাবেন। সিতিও হাসতে হাসতে সেটা মেনে নেন।
সিতি অন্তত এক বার জেমসের কাছে প্র্যাঙ্কের ভিডিওর রেকর্ড দেখতে চান। কিন্তু জেমস তাকে বলেন, সেগুলোর তখনো সম্পাদনার কাজ চলছে। ২১ জানুয়ারি তারা কম্বোডিয়ায় যান আরো ভিডিও শ্যুট করার জন্য। যখন বিদেশ ভ্রমণে গেলেন, তখন সিতি সত্যিই বিশ্বাস করা শুরু করেন, তার আগের জীবন ফেলে আসছেন। জেমস তাকে আশ্বাস দেন, তারা আমেরিকাতেও প্র্যাঙ্ক ভিডিও করতে যেতে পারেন।
কম্বোডিয়ার রাজধানী নম পেনে গিয়ে জেমস সিতিকে জানান, তার জায়গায় এখন চ্যাং নামে এক চীনা লোক কাজ করবেন। ৩৪ বছর বয়সী এই চীনা লোক স্পষ্ট বাহাসা ভাষায় কথা বলতে পারতেন। চ্যাং সিতিকে নিয়ে বিমানবন্দরে তিনটা প্রস্তুতি সেশন করেন।
সিতি মাসের শেষের দিকে রাঙ্কা সুমুরে তার পরিবারের কাছে চলে আসেন। সেখানে থাকা অবস্থাতেই চ্যাং তাকে ফোন করে কুয়ালালামপুরে ফিরে আসতে বলেন। জাকার্তা থেকে কুয়ালালামপুরে যাওয়ার আগে তার ছেলেকে শেষ বারের মতো দেখে যান।
ফেব্রুয়ারির ৩, ৪ ও ৭ তারিখে চ্যাংয়ের তত্ত্বাবধানে সিতি কুয়ালালামপুরের বিমানবন্দরে আসা লোকদের নোংরা করতে থাকেন। তার পারিশ্রমিক তখন মালয়েশিয়ার রিঙ্গিত থেকে আমেরিকান ডলারে দেওয়া হতে থাকে প্রতি পারফরম্যান্সের জন্য। ৮ ফেব্রুয়ারি চ্যাং তাকে ৮,০০০ মার্কিন ডলার দেন ম্যাকাওতে কিম জং ন্যামের বাড়িতে যাওয়ার জন্য। কিন্তু পরের দিন চ্যান সেই ভ্রমণ বাতিল করেন। কারণ জং ন্যাম ইতোমধ্যে মালয়েশিয়ায় চলে এসেছেন।
দুই দিন পর সিতি বিমানবন্দরে আবার অনুশীলন করেন। সেদিন ছিল সিতির ২৫তম জন্মদিন। তাদের কাজ শেষ হলে চ্যাং তাকে একটা ট্যাক্সি টিকিট দেন জন্মদিনের উপহার হিসাবে। তিনি বলেন, তাদের পরবর্তী প্র্যাঙ্ক হবে ১৩ ফেব্রুয়ারি।
ওইদিন সকাল ৮টায় সিতি চ্যাংয়ের সাথে একটা কফিহাউজে বসে কফি পান করছিলেন, যেখান থেকে বিমানবন্দরের টার্মিনাল খুব ভালোভাবে দৃষ্টিগোচর হয়। এরপর চ্যাং তাকে এয়ারএশিয়ার চেকইনের কাছে একটা স্তম্ভের পেছনে নিয়ে যান। চ্যাং তাকে বলেন, সেখানে দ্বিতীয় আরেকজন মহিলা তার সাথে প্র্যাঙ্কে যোগ দেবেন। চ্যাং তাকে নির্দেশ দেন, দ্বিতীয় মহিলা আঘাত হানার পরপরই তিনি যেন এগিয়ে যান।
জং ন্যাম যখন টার্মিনালে চলে আসেন, চ্যাং সিতিকে ধূসর ব্লেজার আর কালো ব্যাকপ্যাক পরা লোক দিয়ে শনাক্ত করতে বলেন। চ্যাং এরপর তাকে অন্যদিকে তাকাতে বলেন। তারপর নিজের ব্যাকপ্যাক থেকে একটা সাদা প্লাস্টিকের ব্যাগ বের করে সেটা থেকে একটা তৈলাক্ত পদার্থ তার হাতে ঢালেন। সিতি লক্ষ করেন, এই তরল থেকে মেশিনের তেলের গন্ধ আসছে। আগের তরলগুলো গন্ধহীন ছিল। চ্যাং তাকে বলেন, তিনি যেন তরলটি জং ন্যামের মুখে মাখানোর সাথে সাথে ক্ষমা চান এবং দ্রুত স্থান ত্যাগ করেন। কারণ তাদের শিকার দেখতে ‘বড়লোকদের মতো’।
জং ন্যাম যখন সামনে আসতে থাকেন, চ্যাং হঠাৎ করে উধাও হয়ে যান। সিতি তখন জং ন্যামের দিকে অগ্রসর হতে থাকেন। তার মুখে তরলটি মাখানোর পর সিতি পালিয়ে যান। শৌচাগারের কাছে আসলে তাকে নির্দেশনা দেওয়া হয় হাত ধুয়ে ফেলার জন্য। এরপর তিনি একটা মধ্যম মানের শপিং মলে যান কেনাকাটা করার জন্য। সন্ধ্যার পর তিনি স্পাতে কাজে যান। তিনি অপেক্ষা করছিলেন পরবর্তী প্র্যাঙ্কের জন্য যা তার স্বপ্ন পূরণে আরো এগিয়ে যেতে সাহায্য করবে।
(এরপর দেখুন শেষ পর্বে)