আফ্রিকার মানচিত্রের দিকে তাকালে চোখে পড়বে এক অদ্ভুত দৃশ্য। দক্ষিণ আফ্রিকার মাঝখান থেকে কিছু অংশ জুড়ে রয়েছে সম্পূর্ণ আরেকটি দেশ, নাম লেসোথো। এরকম ছিদ্রিত দেশের তালিকায় দ্বিতীয় নামটি হলো ইতালি, যার মধ্যে রয়েছে ভ্যাটিক্যান সিটি এবং স্যান ম্যারিনো। তবে দক্ষিণ আফ্রিকার মাঝখানে এরকম দেশ থাকার কারণ কী? লেসোথোও বা কীভাবে বিশাল দেশটির মাঝে নিজেদের স্বাধীনতা টিকিয়ে রেখেছে?
এর শুরুটা হয়েছিল নেপোলিয়নের যুগে। নেপোলিয়ন নেদারল্যান্ডস দখল করে ফরাসি সাম্রাজ্যের সাথে যুক্ত করে নেওয়ার পর এর উপনিবেশগুলোও দখলে নিয়ে নেন। এদিকে ওলন্দাজদের সাথে ইংরেজরা চুক্তি করে নেপোলিয়নকে হারানোর আগপর্যন্ত তাদের উপনিবেশগুলো ইংরেজরা ফরাসিদের হাত থেকে রক্ষা করার চেষ্টা করবে, এবং নেপোলিয়ন হারার পর আবার ওলন্দাজদের কাছে উপনিবেশগুলো ফিরিয়ে দেওয়া হবে। তবে নেপোলিয়ন হারার পর সব উপনিবেশ ফিরিয়ে দেয়নি ইংরেজরা, দক্ষিণ আফ্রিকার কেপ কলোনি নিজেদের করে নেয়। দলে দলে কেপ কলোনিতে ইংরেজদের বসতি গড়ে তোলা হয়।
এদিকে দক্ষিণ আফ্রিকায় আগে থেকেই থাকা ওলন্দাজ, যারা ‘বোয়ার’ নামে পরিচিত, তারা ইংরেজদের শাসনে বিরক্ত হয়ে ইংরেজদের এলাকা ছেড়ে উত্তরে চলে যাওয়া শুরু করে। সেখানেই বোয়ারদের সাথে সেখানকার স্থানীয় বাসোটো (বর্তমান লেসোথো অঞ্চলে থাকা জনগোষ্ঠী) জনগোষ্ঠীর সাথে বোয়ারদের উর্বর জমি নিয়ে সংঘর্ষ হয় এবং বেশ কয়েকটি যুদ্ধ হয়। এদিকে বোয়ারদের সাথে না পেরে বাসোটোদের রাজা প্রথম মাশোয়াশোয়া ১৮৬৫ সালে ইংরেজদের সাহায্য চেয়ে বসেন।
ইংরেজরাও সাহায্য করার অনুরোধ রক্ষা করে, তবে এর বিনিময়ে ইংরেজরা ভেবেছিল বাসোটোর সার্বভৌমত্ব ইংরেজদের হাতে চলে যাবে। ছয় বছর বাসোটোদেরকে ওলন্দাজদের কাছ থেকে রক্ষার পর ইংরেজরা ঘোষণা দেয় বাসোটোল্যান্ড কেপ কলোনির সাথে অন্তর্ভুক্ত করতে হবে, সেখানে ইংরেজরা বসতি গাড়বে এবং একইসাথে বাসোটোদের হাতে কোনো অস্ত্র থাকতে পারবে না যাতে কোনো বিদ্রোহ না হয়।
তবে বেশ কিছুদিন এভাবে চলার পর বাসোটোল্যান্ডে বিদ্রোহ হয় এবং আবারো বাসোটোল্যান্ডের ‘ব্রিটিশ প্রোটেক্টরেট’ অবস্থা ফিরিয়ে আনা হয়। দক্ষিণ আফ্রিকার বাকি অংশও কিছুদিনের মধ্যে ইংরেজদের অধীনে চলে আসে, এবং মাঝখানের বাসোটোল্যান্ড অংশটুকু বাদ দিয়ে পুরোটুকুই কেপ কলোনির অধীনে চলে যায়। ১৯৬০ সাল পর্যন্ত এভাবেই চলতে থাকে এবং ব্রিটিশ সাম্রাজ্য ভেঙে পড়া শুরু হলে ১৯৬৬ সালে তারা নিজেদের স্বাধীনতা লাভ করে, সাংবিধানিক নাম হয় ‘কিংডম অব লেসোথো’। সংসদীয় গণতন্ত্র প্রণয়ন করে বাসোথো ন্যাশনাল পার্টি ক্ষমতা অধিগ্রহণ করলেও পরের নির্বাচনেই সামরিক অভ্যত্থান হয় এবং ক্ষমতার রাজনৈতিক টানাপোড়েন চলতে থাকে।
লেসোথো অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী হওয়ায় এর প্রতিবেশি দক্ষিণ আফ্রিকার ওপর পুরোপুরি নির্ভরশীল হতে হয়নি, যে কারণে দক্ষিণ আফ্রিকাও একে দখল করে নিতে পারেনি। এছাড়াও দখল করে নিলে আন্তর্জাতিক চাপের শিকার হতে হতো, এবং একইসাথে বাসোথোদের বিদ্রোহের শিকার হতে হতো। দক্ষিণ আফ্রিকার জনগণ তখন ‘অ্যাপার্টহেইড’ বা বর্ণবৈষম্যপূর্ণ দক্ষিণ আফ্রিকার সরকারের ওপর এমনিতেই ক্ষোভে ফুঁসছে, তার ওপর বাসোটোল্যান্ড অধিগ্রহণ আরও ভয়াবহ রূপ নিতে পারতো।
তবে দক্ষিণ আফ্রিকার সাথে সদ্ভাব বজায় রাখার জন্য তাদের প্ররোচনায় সেনাশাসক মেজর জেনারেল জাস্টিন মেটসিঙকে ক্ষমতায় বসানো হয়। তবে দক্ষিণ আফ্রিকার অ্যাপার্টহেইড সরকারের পতন ঘটলে তারও পতন হয় এবং দুই দেশের সম্পর্ক স্বাভাবিক হয়। ফলে লেসোথোর সার্বভৌমত্বের পথে হুমকিও ‘নেই’ হয়ে যায়। পরবর্তীতে লেসোথোর রাজনীতিতে টানাপোড়েন চললেও দেশটির সার্বভৌমত্ব ঠিকঠাকই রয়েছে।