করোনাভাইরাস, বিশ্বমন্দা, ঘূর্ণিঝড় আম্পানের পর এখন আমাদের সামনে পঙ্গপালের আস্ফালন। গত কয়েকমাস ধরেই এর ভয় ক্রমশ বাড়লেও যে মুহূর্তে ভারতে হানা দিয়েছে এই পঙ্গপাল, সে-ই থেকে প্রশ্ন চলে আসছে- কতটা ভয়ংকর এই পঙ্গপাল? কী ক্ষতি তারা করতে পারে? এর বিরুদ্ধে আমরাই বা কী করতে পারি?
পঙ্গপাল বা লোকাস্ট (Locust) নামে যে পোকাকে আমরা জানি, তা মূলত ঘাসফড়িং বলে মনে করা হলেও আদতে সেটা ঘাসফড়িং নয়। কেউ কেউ একে ঝিঁঝিঁ পোকা বলেও ধারণা করেন। সেটাও সত্যি নয়। সমগোত্রীয় হলেও বাকি দুটি পতঙ্গের চেয়ে লোকাস্টের কিছু পার্থক্য রয়েছে।
লোকাস্ট মূলত মরু এলাকার পতঙ্গ। তবে যে জিনিসটি সবচেয়ে স্পষ্টভাবে তাদের অন্য পতঙ্গ থেকে আলাদা করেছে তা হলো এর জীবনের দুটি পর্ব। সাধারণ অবস্থায় এটি যে অবস্থায় থাকে একে বলা হয় সলিটারি ফেইজ। এই অবস্থায় এরা একা একা বাস করে। কিন্তু পরিবেশ অনুকূলে থাকলে, অর্থাৎ খাবারের প্রাচুর্য, জলবায়ুতে আর্দ্রতার পরিমাণ আর তাপমাত্রা ভারসাম্যপূর্ণ হলে এরা গ্রেগারিয়াস ফেইজ নামের পরের ধাপে যায়। এই অবস্থায় লোকাস্ট যেন সম্পূর্ণ ভিন্ন এক প্রাণীতে পরিণত হয়। তাদের মস্তিষ্কের আকার বাড়ে, গাঠনিক বড় ধরনের পরিবর্তন তো হয়ই, উপরন্ত এদের আচরণ ও খাদ্যাভ্যাসের আমূল পরিবর্তন ঘটে। কার্টুন পকেমোনের চরিত্রগুলোর নিজেদের বদলে নেয়ার মতোই চমকপ্রদ লোকাস্টের এই পরিবর্তন।
সলিটারে ফেইজে লোকাস্ট আমাদের দুশ্চিন্তার কারণ না হলেও গ্রেগারিয়াস পর্বে এরা দলবদ্ধভাবে চলাচল করে। এই সময়ে এদের মধ্যে খাবারের রুচি এবং চাহিদাও বাড়ে। একইসাথে তাদের ক্ষিপ্রতা বাড়ে এবং সহনশক্তির বিশাল পরিবর্তন দেখা যায়। ঠিক কবে তাদের এই পর্ব পরিবর্তন হয়, সেটা সঠিকভাবে বলা কঠিন। অনুকূল পরিবেশে যেকোনো সময় এই পরিবর্তন দেখা যায়। অনুকূল পরিবেশ বলতে যখন বৃষ্টিস্নাত পরিবেশ থাকে, আশেপাশে প্রচুর সবুজ গাছ থাকে এবং মাটিতে পানির পরিমাণ বৃদ্ধি পায়, তখন এই পরিবর্তন খুব দ্রুত হয়। একেকটি লোকাস্ট একত্রে মিলে সোয়ার্ম নামের গ্রুপ গঠন করে এবং তার চলার পথের সবকিছুকে তছনছ করে দিতে সক্ষম। এই সময়ে এরা গাছের পাতা, কান্ড, ফুল, ফল, বীজ থেকে শুরু করে সকল ধরনের ফসল সাবাড় করে দিতে পারে। [1]
কিন্তু কত বড় হতে পারে এমন লোকাস্ট সোয়ার্ম? অবাক করা ব্যাপার হলো, ২০২০ সালে কেনিয়াতে যে সোয়ার্ম পাওয়া গিয়েছে তার আয়তন ২,৪০০ বর্গ কিলোমিটার! প্রতি বর্গ কিলোমিটারে ১৫০ মিলিয়নেরও বেশি এমন লোকাস্ট থাকতে পারে। একেকটি সোয়ার্ম একদিনে প্রায় ২,৫০০ মানুষের খাবার গ্রাস করে নিতে সক্ষম। এবং সঙ্গত কারণেই একে বলা হয় পৃথিবীর অর্থনীতিতে সবচেয়ে ক্ষতিকর প্রভাব ফেলা প্রাণী। মূলত আফ্রিকা মহাদেশ, এশিয়ার মধ্যপ্রাচ্য, পাকিস্তান ও ভারতের পশ্চিমের মরু অঞ্চলে এর প্রভাব সবচেয়ে বেশি। [2]
তবে এই পঙ্গপালের আক্রমণ এবারই নতুন নয়। হাজার হাজার বছর ধরে অনেক সভ্যতাতেই এর আক্রমণের নজির পাওয়া গেছে। এমনকি খ্রিস্টপূর্ব ২৪০০ সালে মিশরীয় সভ্যতায় পাথরের গায়ে খোদাই করে লোকাস্টের ছবি আঁকা পাওয়া গেছে যা দ্বারা আদিকালেও এর আক্রমণের ধারণা পাওয়া যায়। বিভিন্ন ধর্মগ্রন্থেও এই আক্রমণের কথা স্থান পেয়েছে। [3]
কিন্তু হুট করে বিগত যেকোনো সময়ের চেয়ে এবার এর আক্রমণ অনেক বেশি বিস্তৃত। এর কারণ হিসেবে পরোক্ষভাবে জলবায়ু পরিবর্তনকে ধরা যেতে পারে। বৈশ্বিক উষ্ণতার কারণে ভারত মহাসাগরের পানি ক্রমশ গরম হয়েছে এবং ফলশ্রুতিতে পূর্ব আফ্রিকারে বৃষ্টি হয়েছে এবার তীব্রভাবে। এতই তীব্র যে খা খা মরুর পূর্ব আফ্রিকার দেশ উগান্ডা, সোমালিয়া, ইথিওপিয়া ও কেনিয়াতে ২০১৯ সালের শেষের দিকে বন্যা দেখা দেয়। এবং এই বন্যা এই এলাকাতে এই পতঙ্গের জন্য যেন স্বর্গীয় পরিবেশ তৈরি করে ফেলে। [5]
দুর্দান্তরকম সংখ্যাবৃদ্ধির পর সেখানে পতঙ্গগুলোর গ্রেগারিয়াস পর্ব শুরু হয় এবং পুরো পূর্ব আফ্রিকা জুড়ে তোলপাড় করে, বাতাসের বেগের কারণে পূর্ব দিকে উড়ে গিয়ে ইরান, পাকিস্তান ও ভারত পর্যন্ত পৌঁছে গেছে এই ত্রাস। [6]
এই সমস্যা আরো দুশ্চিন্তার কারণ হয়ে গেছে ঘূর্ণিঝড় আম্পানের কারণে। আম্পানের বাতাসের গতি এই লোকাস্ট সোয়ার্মকে আরো পূর্ব দিকে নিয়ে আসছে। [7] এবং এরই মধ্যে ভারতের মধ্য প্রদেশ, উত্তর প্রদেশ, হারিয়ানা ও দিল্লিতেও এই সংক্রমণ দেখা গেছে। [4]
এই সমস্যার সমাধান হিসেবে প্রথমত যেটি সামনে আসে সেটি হলো কীটনাশক ছিটিয়ে দেয়া। হোক সেটা মাটিতে বা হেলিকপ্টার বা ড্রোনের মাধ্যমে আকাশে। কিন্তু এখানে যে অসুবিধাটি রয়েছে সেটি হলো- কীটনাশক প্রচন্ড বিষাক্ত হওয়ায় পতঙ্গ দমন হলেও পরিবেশগত ও স্বাস্থ্যগত ঝুঁকির সম্ভাবনা থেকে যায়। এর চেয়েও বড় সমস্যা হলো এখানে কীটনাশকের মাত্রা অনেক বাড়িয়ে দিতে হয় যার কারণে ক্ষতির সম্ভাবনা আরো বাড়তে শুরু করতে পারে। দ্বিতীয়ত, প্রাকৃতিক যেসকল অক্ষতিকর কীটনাশক রয়েছে, সেগুলো প্রকৃতিতে ক্ষতিকর প্রভাব না ফেললেও এই পতঙ্গের উপর দ্রুত কোনো কার্যকরী ফলাফল আনতে পারে না। [8] তবে এই পতঙ্গ জোরালো শব্দ এড়িয়ে চলে, তাই মুখের চিৎকার হোক কিংবা স্পিকারের গানের আওয়াজ, তাদের সেই এলাকা থেকে দূরে রাখতে পারে।
এতে আপাতত সরে গেলেও এটি কোনো স্থায়ী সমাধান হতে পারে না। [9] চীন এই সমস্যার সমাধান হিসেবে পাকিস্তানকে পাঠিয়েছে হাঁস। হাঁসবাহিনী একটু ধীরে হলেও এই পঙ্গপালের ভালো রকমের ক্ষতিসাধন করে ফেলতে পারে। কিন্তু ক্ষিপ্রতার কারণে পঙ্গপালের করা ক্ষতি পুষিয়ে ওঠা ঠিক সম্ভব হচ্ছিল না।
গা গুলিয়ে ওঠার মতো হলেও অনেক দেশ এই লোকাস্টকে খেয়ে এই সমস্যার সমাধান করে আসছে। বিশেষত মধ্যপ্রাচ্য ও আফ্রিকায় পঙ্গপাল দারুণ জনপ্রিয় খাবার। ঐতিহাসিকভাবে এসকল দেশে অনেক সময় এই পঙ্গপাল সম্পূর্ণ ফসল ধ্বংস করে দিয়েছে। তবে পঙ্গপাল পুষ্টির হিসেবে কিন্তু মোটেও পিছিয়ে নেই। মুরগী, মাছ আর ডিম-দুধের চেয়েও প্রোটিনের হিসেবে যোজন যোজন এগিয়ে আছে এই লোকাস্ট। ইসলাম ধর্মে পঙ্গপালকে হালাল এবং ইহুদি ধর্মে একে ‘কোশের’ বা বৈধ বলে ধরা হয়, যার কারণে এই দুই ধর্মে ধর্মীয়ভাবেও এটি খেতে কোনো বাধা নেই। তবে খাওয়ার মাধ্যমেও আসলে একে নির্মূল বাস্তবে সম্ভব নয়। এরা সংখ্যায় এত বেশি যে আপনি কতটুকু খেয়ে এর বিস্তার রোধ করবেন সেটি একটি জটিল হিসেব। এছাড়া অনেক অঞ্চলে এদের ওপর কীটনাশক ছিটিয়ে দেয়া হয়েছে, যার কারণে স্বাস্থ্যগত ঝুঁকিও থেকে যায়। [13]
এমন অবস্থায় মোহাম্মদ খুরশিদ নামের এক পাকিস্তানি সরকারি কর্মকর্তা ও জোহার আলি নামের একজন বায়োটেকনোলজিস্ট মাথায় একটি যুগান্তকারী আইডিয়া চলে আসলো। পাকিস্তানের ওকারা শহরে প্রথমত টেস্ট হিসেবে এই আইডিয়ার সুফল পাওয়া গেলে দেশব্যাপী বড় পরিসরে এর বাস্তবায়ন শুরু হয়। কী ছিল এই আইডিয়া?
পাকিস্তান সরকার কৃষকদের, যারা মূলত প্রধানত ক্ষতিগ্রস্ত এই হামলায়, তাদেরকে বলা হয় এই পতঙ্গগুলোকে ধরে আনতে, এবং প্রতি কেজি এমন লোকাস্টের জন্য তারা ২০ পাকিস্তানি রুপি করে পাবেন। এই পতঙ্গগুলোকে রাতের বেলায় জাল দিয়ে ধরা খুবই সহজ। লোকাস্ট সাধারণত দিনের বেলায় ওড়ে এবং রাতে নিস্তেজ হয়ে ভূমিতে বিশ্রাম নেয়। ঘোষণার প্রথম দিনে ওকারা জেলাতে ৭ টন এমন লোকাস্ট সংগ্রহ করেন কৃষকরা, এবং অনেক কৃষক একরাতেই বিশ হাজার রুপি পর্যন্ত আয় করেছেন। [10]
এই পঙ্গপালকে পরবর্তীতে প্রক্রিয়াজাত করে পোল্ট্রি ফার্মে চিকেন ফিড বা মুরগীর খাবার হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে। পাকিস্তানের পোল্ট্রি শিল্পের জন্য এই ঘটনা হয়ে গেছে শাপে বর। সাধারণ অবস্থায় সয়াবিন দিয়ে চিকেন ফিডের প্রোটিন অংশ পূরণ করা হয় যা মূলত আমদানী নির্ভর। সয়াবিনে প্রোটিন রয়েছে এর ওজনের ৫০%। অপরদিকে লোকাস্ট সম্পূর্ণভাবে পাকিস্তান সরকার এসব পোল্ট্রি ফার্মকে দিচ্ছে কয়েকগুন কম দামে। আবার লোকাস্টে প্রোটিন রয়েছে এর ওজনের ৭০%। বৈদেশিক মুদ্রা নিয়ে তীব্র হাহাকার চলা পাকিস্তান সরকারের কাছেও এই প্রকল্পটি অত্যন্ত লাভজনক, কারণ আগের মতো সয়াবিন আমদানি করে পাকিস্তানকে তার বৈদেশিক মুদ্রা খরচ করতে হচ্ছে না। [11]
এই অভাবনীয় সমাধান শুধু পাকিস্তান নয়, বিশ্বজুড়ে অত্যন্ত সাদরে গ্রহণ করা হচ্ছে। এমনকি পাকিস্তানের ভারতের আরএসএসও পাকিস্তানের এই কাজের প্রশংসা করে ভারতেও অনুরূপ প্রকল্পের জন্য সরকারকে আহ্বান করেছে। [12] বিশ্বব্যপী স্মরণকালের সবচেয়ে ভয়াবহ এই পঙ্গপালের হামলা মোকাবেলায় এই আইডিয়ার কার্যকারিতা কেমন তা প্রমাণ এখন সময়ই করতে পারে।