
তোমরা আমার মাকে মেরো না
পৃথিবীর সবচেয়ে নিষ্ঠুরতম দৃশ্য বোধহয় নিজের মাকে চোখের সামনে মরে যেতে দেখা। ছোট্ট মিরেও সেটা বুঝে সেনাবাহিনীর সামনে মাকে বাঁচাতে দাঁড়িয়ে গিয়েছিল। কোরিয়ান চলচ্চিত্র ‘দ্য ফ্লু’-র দৃশ্য এটি।
মা; পৃথিবীর সবচেয়ে মধুর, আস্থার এক অবিচল শক্তি, হাজারটা বিষণ্নতার দিনে এক স্বস্তির নাম যেন মা। ছোট্ট আমি, আপনি, আমাদের সবাই যখন পৃথিবীতে আসার অপেক্ষায়, ঠিক তখন থেকেই আমাদের পরম মায়ায়, পরম মমতায় আগলে রাখার নিরন্তর চেষ্টা শুরু হয় একেকজন মায়ের। আজীবন বোধহয় এই মায়ার মাঝেই আমরা বেঁচে থাকি।

প্রতিবছর ‘মে মাসের দ্বিতীয় রবিবার’ বিশ্বব্যাপী পালিত হয় মা দিবস। সেই ধারাবাহিকতায় এ বছর ১০ই মে পালিত হচ্ছে মায়েদের জন্য বিশেষ এই দিন।
একটুখানি ইতিহাস
মা দিবসের সূচনা ১৯০৮ সালে। এর আগে যুক্তরাষ্ট্রের ফিলাডেলফিয়ার এক স্কুলশিক্ষিকা অ্যানা জারভিস সেখানকার পারিবারিক বিচ্ছিন্নতা দেখে মর্মাহত হয়ে মায়েদের জন্য বিশেষ দিন পালনের মাধ্যমে সচেতনতা সৃষ্টির কথা ভেবেছিলেন। তার সেই ভাবনা বাস্তবায়নের আগেই ১৯০৫ সালের ৯ মে তিনি মারা যান। তার মৃত্যুর পর মেয়ে অ্যানা এম জারভিস মায়ের শেষ ইচ্ছা পূরণের উদ্দেশ্যে কাজ শুরু করেন। বন্ধুবান্ধবদের নিয়ে ১৯০৮ সালে তার মা পশ্চিম ভার্জিনিয়ার গ্রাফটনে যে গির্জায় উপাসনা করতেন, সেখানে সব মাকে নিয়ে একটি অনুষ্ঠানের মাধ্যমে মা দিবসের সূচনা করেন। ১৯১৪ সালে যুক্তরাষ্ট্রের তৎকালীন প্রেসিডেন্ট উড্রো উইলসনের অনুমোদনক্রমে আনুষ্ঠানিকভাবে মে মাসের দ্বিতীয় রবিবারকে মায়েদের জন্য উৎসর্গ করে সরকারি ছুটির দিন ঘোষণা করা হয়।
মা দিবসে আসুন আমাদের চিরায়ত কিছু অভ্যেস বদলে ফেলি, সহজ করি মায়েদের প্রতিদিনকার ক্লান্তিহীন কাজগুলো।
১. ফিরিয়ে দেই ভালোবাসা
আচ্ছা, পৃৃৃৃৃথিবী জুড়ে এত এত যে ভালোবাসার গল্প, তার মাঝে আমরা ক’জন পারি মাকে ভালোবাসতে? ছোটবেলাতে কিন্তু মা-ই আমাদের প্রথম ভালোবাসা দিয়ে পরম যত্নে বেড়ে উঠতে সাহায্য করেন। মায়ের হাত ধরেই আমরা হাঁটতে শিখি। আধো আধো বুলিতে প্রথম শব্দটাও মায়ের কাছ থেকেই শেখা। সেই ভালোবাসা বড়বেলায় এসে আমরা কতটা ফিরিয়ে দিতে পারছি? মাকে তাই ভালোবাসতে শিখুন। নিয়ম করে মায়ের খোঁজ নিন প্রতিদিন। তার কোনোকিছুর প্রয়োজন আছে কি না খেয়াল রাখুন। আজীবন আমাদের চাহিদা মিটিয়ে আসা মায়ের নিজেরও তো কিছু চাহিদা থাকতে পারে, শুনুন সেসব। চেষ্টা করুন পূরণের। তবে ভালোবাসার প্রকাশ সম্ভবত একেকজনের কাছে একেকরকম। সেটা যেমনই হোক, মায়েদের মুখে একটুখানি হাসিই তো বোধহয় সব সন্তানের পরম আরাধ্য। সেই হাসিটা আপনার ভালোবাসার মাধ্যমেই আসুক না হয়।
২. রান্নাঘরের গরমের আঁচে আপনিও হোন সঙ্গী
আমাদের জীবনের নিয়মিত দৃশ্য যখন ভীষণ অসুস্থতার মধ্যেও “তোমরা তো কিছু শিখ নাই, তোমরা একটু কাজ করলে তো কষ্ট কমতো আমার” বলে পরিবারের সব কাজ একজন মা একাই সামলান।

কিন্তু যখন সাহায্য করতে যাবেন তখন “হয়েছে, যাও, লাগবে না, নিজের কাজ করো গিয়ে!” বলে দৌড়ানি খাওয়ার সম্ভাবনা বোধহয় অনেকেই সত্যি হতে দেখেছেন। মায়েরা এমনই। নিজ হাতে একাই রান্নাঘরের গরম আঁচে ঘামে ভেজা শরীরে ঘণ্টার পর ঘণ্টা কাজ করে যেতে পারেন অনায়াসে। মাঝে মাঝে আমাদের সকলের মনেই বোধহয় এই প্রশ্নটা উঁকি দেয়, একজন মানুষ কীভাবে পারে এত সব কিছু সবচেয়ে সুন্দরভাবে একাই করতে? এটাই বোধহয় সবচেয়ে বিস্ময়ের। যে যা-ই বলুক, রান্নাঘরের কাজে মাকে চেষ্টা করুন যতটা সম্ভব সাহায্য করতে।
শুধু রান্নাঘরেই আটকে না থেকে ঘর পরিষ্কারের মতো অন্যান্য কাজের দায়িত্ব নিজেই নিয়ে নিতে পারেন। এতে করে মায়েদের যে সময়টা বাঁচবে সে সময়টা তারা কিছুটা বিশ্রাম নিতে পারবেন।
৩. ভালোলাগা কিংবা শখ তাদেরও আছে
আমি আমার মায়ের কথাই বলি। রবীন্দ্রসঙ্গীত কিংবা আমাদের প্রয়াত সালমান শাহর চলচ্চিত্র- টেলিভিশনে এসব থাকলেই হলো! সাংসারিক নানা কাজের ভীড়েও এসব দেখা চাই-ই তার। এমন অনেক ভালো লাগা কিংবা শখের জায়গা আছে আমাদের মায়েদের। তাদের কাছ থেকে জেনে নিতে পারেন সেসব। সংসারের নানা চাপের মাঝে এই ভালো লাগাগুলো কিছুটা হলেও মানসিক প্রশান্তি দেয় তাদের।
৪. মা মানেই যেন অসম্মান নয়
আমরা প্রায়ই ঝগড়া করে মায়েদের নাম তুলে গালি দেই, নানা খারাপ ভাষা ব্যবহার করি। সেসব হয়তো মায়েদের কান অব্দি পৌঁছায় না, কিন্তু ভাবুন তো একবার, যদি মায়েরা শুনত সেসব? একজন মা কি পারে আরেকজন মাকে নিয়ে খারাপ ভাষায় কথা বলাটা মেনে নিতে? কিংবা আমরা প্রায়ই মতের অমিল হলে বা অন্যান্য কারণে মায়েদের সাথে উঁচু গলায় কথা বলি। এমনকি খারাপ ব্যবহার করেও ফেলি রাগ নিয়ন্ত্রণ করতে না পেরে। ছোটবেলা থেকে একজন মা আপনাকে যে শিক্ষায় বড় করে আজকের পর্যায়ে নিয়ে এসেছেন সেই শিক্ষা ভুলে আপনার-আমার এমন ব্যবহার একজন মায়ের মনে কতটা কষ্ট দেয় ভেবেছেন কখনও? মা দিবসে তাই মায়েদের জড়িয়ে খারাপ ভাষার ব্যবহার পরিহারে আসুন শপথ করি। পৃথিবীর সকল মাকেই রাখি সম্মানের স্থানে।
৫. মায়েদের সিদ্ধান্তে থাকুক আস্থা
অনেক সময়ই এমন হয়, জীবনের এগিয়ে যাওয়ার ক্ষেত্রে আমাদের কিছু সিদ্ধান্ত মায়েদের সাথে মেলে না বা আমরা মায়েদের মতামতটাকে সেকেলে ভেবে অগ্রাহ্য করি। তবে এটুকু বোধহয় বিশ্বাস রাখা উচিত, একজন মা-ই বোধহয় তার সন্তানকে সবচেয়ে ভালো চেনেন, জানেন। তাই সন্তানের ভবিষ্যত ভাবনার যেকোনো সিদ্ধান্তে মায়েদেরই সবচেয়ে বেশি চিন্তা থাকে। তাই তাদের মতামতকে গুরুত্ব দিন। মতের অমিলে রাগারাগি না করে ঠান্ডা মাথায় বসে আলোচনা করুন, আপনার মতামতের বিপরীতে যুক্তি তুলে ধরুন। দুজনই যেহেতু ভালোটাই চাচ্ছেন, আলোচনার মাধ্যমে অবশ্যই ভালো সিদ্ধান্তটাই আসবে।

৬. বিষণ্নতায় তারাই যেন হয় অনুপ্রেরণা
আমি-আপনি হয়তো ভীষণ রকমের ভাগ্যবান, আমাদের মায়েরা বেঁচে আছেন। তাদের ছায়ায় আমরা এখনও শান্তির পরশ পাই। কিন্তু যাদের মা চলে গেছেন পরপারে, তাদের কথা কখনও ভেবে দেখেছেন? সামান্য কিছু সমস্যায় পড়েই আজকাল আমরা যে বিষণ্নতার কৃত্রিমতা দেখিয়ে বেড়াই, কখনও মনে হয়েছে সেই মানুষগুলোর কথা, যারা মাথার ঘাম পায়ে ফেলে বিষণ্নতা দমিয়ে রেখে আপনার মুখে একটু হাসি দেখবে বলে নিরন্তর শ্রম দিয়ে যায়। জীবনে বেঁচে থাকার আর কোনো আশাও যদি খুঁজে না পান, শুধু তাদের মুখের দিকে তাকিয়ে অনুপ্রেরণা খুঁজুন, বাঁচুন তাদের জন্যই। প্রার্থনায় এই মানুষগুলোকেই রাখুন, যারা কোনোরকম স্বার্থ ছাড়াই আপনাকে জীবনভর ভালোবেসে যায়।
পৃথিবীর সব সুখেদের গল্পজুড়ে থাকুক মায়েদের ছোঁয়া, দুঃখের নোনা স্রোত থেকে মায়েদের দূরে রাখার চেষ্টা চলুক নিরন্তর। পৃথিবীর সকলে মায়েরা ভালোয় বাঁচুক।
মায়ের ভালোবাসার গল্প পড়ুন সাহিত্যিকের বিভিন্ন বইয়ে। সেসব বই কিনতে ক্লিক করুন নিচে লিংকে