দেশ-বিদেশে পরিবেশ দূষণের পরিমাণ অস্বাভাবিকভাবে বেড়েই চলেছে। উন্নতির শিখরে উঠতে গিয়ে এক ভয়াবহ বিপদের শিখরেও পৌঁছে গিয়েছি আমরা । তবে তা নিয়ে বেশিরভাগ মানুষেরই কোনো ভ্রূক্ষেপ নেই। সীমিত সম্পদ বাড়ছে আর বাড়ছে, কিন্তু অসীমিত সম্পদ অসীমিত থেকেও কোনো কাজে দিচ্ছে না। অর্থাৎ টাকা-পয়সা ও অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি অর্জনের সুযোগ লুফে নেওয়া দেশগুলো দিন দিন অভাবে পড়ছে পরিচ্ছন্ন বায়ুর। উন্নতির বেড়াজালে আটকে আজ মানুষ স্বস্তির শ্বাসটুকু নিতে পারছে না। আসলে দোষটা উন্নতিরও নয়, দোষটা আমাদের। অতিরিক্ত লোভ এবং অপরিকল্পিত পদক্ষেপই আমাদের ঠেলে দিচ্ছে বিপদের দিকে। এসব নিয়ে আলোচনার কোনো শেষ নেই। তবে এই লেখাটি এত বড় পরিসরের কোনো বিষয় নিয়ে নয়, বরং খুবই ছোট পরিসরের কিন্তু লেখাটি পরিবেশে একটু স্বস্তি দেওয়ার মতো একটি উদ্যোগ নিয়ে লেখা। ‘অক্সি পিউর’, আমাদের পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতের রাজধানী, নয়া দিল্লির একটি অক্সিজেন বার নিয়েই আজকের এই লেখাটি।
অক্সি পিউর বার
দিন দিন নয়া দিল্লির বায়ু দূষিত হয়ে চলছে। অবস্থা এতটাই করুণ যে, শহরটি বসবাসের প্রায় অনুপযোগী হয়ে উঠেছে। আর এজন্যই অক্সি পিউর বারের আবির্ভাব। নবগঠিত বার, অক্সি পিউরকে প্রথমে নাম দিয়েই একটু বিশ্লেষণ করা যাক। এখানে দুটি শব্দ সমন্বয় করা হয়েছে। ‘অক্সিজেন’ এবং ‘পিউর’।
অর্থাৎ বিশুদ্ধ অক্সিজেনের বিষয়টি এখানে আছে। এই অক্সি পিউর বার অক্সিজেনকে বিশুদ্ধ করে না। পরিবেশে কোনো ইতিবাচক বা নেতিবাচক প্রভাবও ফেলে না। এটি শুধু মানুষদের স্বল্প সময়ের জন্য বিশুদ্ধ অক্সিজেন বা বায়ু গ্রহণে সহায়তা করে। এটি নয়া দিল্লির প্রথম অক্সিজেন বার, যা প্রতিষ্ঠা করেন আর্যবীর কুমার এবং মার্গারিতা কুরিতসিয়ানা। এখানে মাত্র ১৫ মিনিট ৮০%-৯০% অক্সিজেনসহ বিশুদ্ধ ও স্বস্তির বায়ুর স্বাদ নিতে খরচ করতে হবে ৩০০ রুপি বা এর চেয়ে বেশি। কোন ফ্লেভারের অক্সিজেন নিচ্ছেন সেটার উপর নির্ভর করে দাম রাখা হয়।
বারটির বয়স খুব বেশি নয়। এই বছরের মে মাসেই যাত্রা শুরু হয় অক্সি পিউর বারের। অবশ্য অল্প সময় ভালোই খ্যাতি অর্জন করেছে বারটি। আরেকটি বিষয় হলো, আপনি যে এই বারে বসে বসে শুধু স্বাদহীন অক্সিজেন নিবেন সেরকম কিন্তু নয়। আপনি চাইলে এই অক্সিজেনে যুক্ত করতে পারেন বিভিন্ন স্বাদ বা ফ্লেভার। ইন্ডিয়া টুডে নামক ভারতীয় পত্রিকার তথ্য মোতাবেক, এই বারে সাতটি ফ্লেভারের অক্সিজেন বিক্রি করা হয়। যেমন- চেরি, লেমনগ্রাস, ইউক্যালিপটাস, পুদিনা, মেন্থল, কমলা, দারচিনি।
আপনি যদি মনে করেন, যত টাকাই খরচ হোক না কেন আপনি সারাদিনই এই বিশুদ্ধ অক্সিজেন নিবেন, তাহলে তা কখনই সম্ভব নয়। আপনার আর্থিক সামর্থ্য থাকলেও প্রকৃতি আপনার শরীরকে এই কৃত্রিম প্রক্রিয়ায় অতিরিক্ত অক্সিজেন নেওয়ার সামর্থ্য দেয়নি। ১৫ মিনিটের হিসাব আপনাকে নিজের মঙ্গলের জন্যই মানতে হবে। একদিনে এর থেকে অধিক সময় এই অক্সিজেন নেওয়া যাবে না। বারটির কর্মচারীদের প্রধান বনি ইরেংবাম বলেন, “আমরা পারিপার্শ্বিক পরিবেশের চাপ নিয়ন্ত্রণ করে ১৫ মিনিটের জন্য বিভিন্ন ফ্লেভারের অক্সিজেন সরবরাহ করে। এর অনেক উপকারিতাও রয়েছে। একজন ক্রেতাকে একটি টিউব দেওয়া হয় যার মাধ্যমে সেই ক্রেতা ফ্লেভারযুক্ত অক্সিজেন গ্রহণ করে”। বারটির নিয়মিত ক্রেতা থাকা সত্ত্বেও তারা নিয়মিত এই অক্সিজেন নেওয়াকে সমর্থন করে না। কারণ শরীরে অতিরিক্ত অক্সিজেন সরবরাহ করলে ঐ ব্যক্তির মাথা ঘুরাতে পারে কিংবা সে দুর্বল অনুভব করতে পারে।
প্রতি মাসে এক বা দুইবার এই অক্সিজেন নেওয়ার জন্য উপদেশ দেওয়া হয়। তবে এর থেকে বেশি নয়। অনেকেরই প্রশ্ন থাকতে পারে যে, শ্বাস তো আমরা সবসময়ই নিচ্ছি, এর সুবাদে অক্সিজেনও নিচ্ছি। তাহলে এই বারের অক্সিজেন নেয়ার ক্ষেত্রে সময়সীমার ব্যাপার আছে। এর একটি উত্তর হিসেবে বলা যায় যে, কৃত্রিম ও প্রাকৃতিক প্রক্রিয়ায় ঢের পার্থক্য রয়েছে। কৃত্রিম প্রক্রিয়ায় শ্বাস নেওয়ার কুফল থাকবে সেটা খুবই স্বাভাবিক একটি বিষয়।
উপকারিতা
অক্সি পিউরে বিশুদ্ধ অক্সিজেন গ্রহণ করার উপকারিতা পরিবেশ থেকে গৃহীত বিশুদ্ধ অক্সিজেনের উপকারিতার মতোই। শুধু পার্থক্য হলো অক্সি পিউরের ক্ষেত্রে আপনি টাকা খরচ করে পরিষ্কার অক্সিজেন নিচ্ছেন, কারণ এই টাকা উপার্জন করতে গিয়েই আজ প্রকৃতির ফ্রি বিমল অক্সিজেনের অভাব দেখা গিয়েছে। জীবনের ক্ষতি হওয়া সত্ত্বেও আমরা উপার্জনের সুখেই বিমোহিত হয়ে আছি।
অক্সি পিউরে গৃহীত বিশুদ্ধ অক্সিজেনের ফলে শারীরিক ও মানসিক সুস্থতা পুনরায় ফিরিয়ে আনা সম্ভব হবে। দূষিত বাতাসের ফলে যেসব চর্মরোগ দেখা যায় সেগুলোও দূর করা সম্ভব হবে। অতিরিক্ত দূষণ বিষণ্ণতা সৃষ্টি করে। আর সেই সাথে ছোটখাটো রোগবালাই তো নিত্যদিনের সঙ্গী হয়ে দাঁড়ায়। যেমন- অ্যালার্জি, মাথা ব্যথা, বমি বমি ভাব, হজমে সমস্যা, ঠাণ্ডা-কাশি, নাক দিয়ে পানি পড়া ইত্যাদি। এসব সমস্যা খুব অল্প মনে হলেও নিত্যদিনের জীবনে এগুলোর জন্যই সর্বদা অস্বস্তি লাগে, ভোগান্তি পোহাতে হয়। এতে করে কাজ করার সক্ষমতা ও গতিও কমে যায়। ঘুমের ক্ষেত্রেও সমস্যার সৃষ্টি হয়। সব মিলে বিষণ্ণতা ও মানসিক সমস্যা সৃষ্টি হওয়া খুবই স্বাভাবিক একটি বিষয়। অক্সি পিউর বারের বিশুদ্ধ অক্সিজেন এসব সমস্যা সমাধানে যথাসম্ভব সহায়তা করে। তাছাড়া এর ফ্লেভারের কারণে মানসিক স্বস্তিও পাওয়া যায়। নয়া দিল্লিতে বসবাসরত ইউক্রেনের এক নাগরিক লিজা দিভেদির মতে, তিনি এই বারে নিয়মিত আসেন কারণ তিনি চোখের চুলকানি, নাক থেকে পানি পড়া এবং গলা ব্যথার কারণে বিরক্ত হয়ে গেছেন। বলা বাহুল্য যে, এসবের পেছনে দূষিত বায়ু দায়ী। তিনি বারে অক্সিজেন নেওয়া সম্পর্কে বলেন, “আমি জানি না যে এটা কোনো মনস্তাত্ত্বিক বিষয় নাকি অন্য কিছু। কিন্তু এটা ভেবেই ভালো লাগে যে আমি বিশুদ্ধ বায়ু গ্রহণ করছি। তা ১৫ মিনিটের জন্যই হোক না কেন”। এই বারে আসা অন্যান্য ক্রেতারাও এই একই কারণে এখানে আসে। একটু স্বস্তি, একটু বিশুদ্ধতার আশায়।
টাকা দিয়ে বিশুদ্ধ অক্সিজেন কেন কিনবো?
এই প্রশ্নটির যৌক্তিকতা থাকলেও আমাদের আচরণের যৌক্তিকতা নেই। আর সেজন্যই আজ আমাদের এই দশা। অফুরন্ত বায়ু তো আছে। কিন্তু এতে কোনো বিশুদ্ধতা নেই। “অক্সিজেন কেনো কিনবো বা অক্সি পিউর বারে কেনো আসবো?” এসব প্রশ্নের প্রায়ই সম্মুখীন হন বারটির প্রতিষ্ঠাতা আর্যবীর এবং মার্গারিতা। এই সম্পর্কে আর্যবীর বলেন, “ক্রেতারা আমাকে জিজ্ঞেস করে এখন কেন তাদের বিশুদ্ধ বাতাসও কিনতে হবে। আমি তাদের বলি আজকাল তো বিশুদ্ধ পানিও কিনতে হয়, যা আজ থেকে ২০ বছর আগে কেনা লাগত না”। নিজেদের ভালো জীবনের জন্য হোক কিংবা ভাগ্যের পরিহাসের জন্য হোক বিশুদ্ধ বায়ু কেনা একটি দরকার হয়ে দাঁড়িয়েছে। তবে এত খরচের কারণে তা সবার কাছে পৌঁছাতে পারবে নাকি তা একটি ভাবার বিষয়। অক্সি পিউর এর আরেকটি ব্রাঞ্চ দিল্লি এয়ারপোর্টে এই বছরের ডিসেম্বরে চালু করতে যাচ্ছে।
ব্যাপারটা আসলে চিন্তা করা খুবই কষ্টদায়ক যে, যেই জিনিস প্রকৃতি আমাদেরকে অফুরন্ত ভাবে দিয়েছে তা আমরা এমনভাবে নষ্ট করে দিয়েছি যে, তা কিনতে টাকা গুণতে হচ্ছে। অক্সি পিউর বারের উদ্যোগটি স্বল্প সময়ে স্বস্তি লাভের জন্য ভালো হলেও দীর্ঘতর সময়ে এর কার্যকারিতা তেমন নেই।
বিশ্বের চমৎকার, জানা-অজানা সব বিষয় নিয়ে আমাদের সাথে লিখতে আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন এই লিঙ্কে: https://roar.media/contribute/