[২য় পর্ব পড়ুন]
রুশ–ইউক্রেনীয় যুদ্ধ শুরুর পর ইউক্রেনীয়রা ২৭-২৮ ফেব্রুয়ারির মধ্যে এবং ৭-১৪ মার্চের মধ্যে রুশদের বিরুদ্ধে ব্যাপকভাবে তুর্কি–নির্মিত বায়রাক্তার টিবি–২ কমব্যাট ড্রোন ব্যবহার করে, এবং এই দুই পর্যায়ে ইউক্রেনীয় বায়রাক্তার টিবি–২ ড্রোন স্ট্রাইকের ফলে বেশ কিছু রুশ সামরিক সরঞ্জাম ধ্বংস হয়। কিন্তু ১৪ মার্চের পর থেকে এপ্রিলের শেষভাগ পর্যন্ত ইউক্রেনীয়রা রুশ লক্ষ্যবস্তুর ওপর বায়রাক্তার টিবি–২ ড্রোন স্ট্রাইকের কোনো ভিডিও ফুটেজ প্রকাশ করেনি। এর অর্থ এই নয় যে, এ সময় ইউক্রেনীয়রা বায়রাক্তার টিবি–২ ড্রোন ব্যবহার করা বন্ধ করে দিয়েছিল। বরং প্রতীয়মান হয় যে, এ সময় ইউক্রেনীয় বায়রাক্তার টিবি–২ ড্রোনবহর রুশদের বিরুদ্ধে উল্লেখযোগ্য কোনো সাফল্য অর্জন করতে পারেনি। এই পর্যায়ে ইউক্রেনীয়রা তাদের বায়রাক্তার টিবি–২ ড্রোনগুলোকে প্রধানত রুশ সৈন্যদের গতিবিধি পর্যবেক্ষণের জন্য ব্যবহার করে। অর্থাৎ, যুদ্ধের এই পর্যায়ে ইউক্রেনীয় বায়রাক্তার টিবি–২ ড্রোনগুলো কমব্যাট ড্রোনের পরিবর্তে রিকনিস্যান্স ড্রোন হিসেবে কাজ করতে থাকে।
রুশ প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের প্রদত্ত তথ্যানুসারে, ২৪-২৬ ফেব্রুয়ারির মধ্যে রুশ ক্ষেপণাস্ত্র আক্রমণের ফলে ৩৫টি ইউক্রেনীয় বায়রাক্তার টিবি–২ ড্রোন ভূমিতে থাকাবস্থায় ধ্বংস হয়, এবং ২৪ ফেব্রুয়ারি থেকে ৩১ মার্চের মধ্যে রুশ/দনেৎস্ক/লুগানস্ক সৈন্যরা ৩৯টি ইউক্রেনীয় বায়রাক্তার টিবি–২ ড্রোন ভূপাতিত করে। অর্থাৎ, রুশ প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের ভাষ্যমতে, ২৪ ফেব্রুয়ারি থেকে ৩১ মার্চের মধ্যে রুশরা মোট ৭৪টি ইউক্রেনীয় বায়রাক্তার টিবি–২ ড্রোন ধ্বংস করে। স্বাভাবিকভাবেই ইউক্রেনীয়রা ও ইউক্রেন সমর্থকরা রুশ প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের এই দাবির সত্যতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে। বস্তুত, রুশদের এই দাবির সত্যতা নিরূপণ করা দুরূহ ব্যাপার, কারণ রুশরা তাদের দাবি প্রমাণের জন্য প্রয়োজনীয় প্রমাণ প্রদান করেনি।
কিন্তু রুশদের এই দাবিকে পুরোপুরি ভিত্তিহীন হিসেবেও আখ্যায়িত করা যায় না। ইতিপূর্বে উল্লেখ করা হয়েছে যে, যুদ্ধের প্রথম দুই সপ্তাহের মধ্যেই তুরস্ক দুই বা তিন দফায় ইউক্রেনকে বায়রাক্তার টিবি–২ ড্রোনের নতুন চালান সরবরাহ করে। ২৫ মার্চ একটি ইউক্রেনীয় ‘আন্তোনভ আন–১২৪’ পরিবহন বিমান তুরস্কে পৌঁছায় এবং বায়রাক্তার টিবি–২ ড্রোনের আরেকটি চালান নিয়ে প্রত্যাবর্তন করে। প্রতিটি চালানে তুরস্ক ইউক্রেনকে কয়টি করে বায়রাক্তার টিবি–২ ড্রোন সরবরাহ করেছে, সেটি অজ্ঞাত। কিন্তু এটি স্পষ্ট যে, ২০২২ সালের মার্চের শেষভাগ নাগাদ ইউক্রেন উল্লেখযোগ্য সংখ্যক বায়রাক্তার টিবি–২ ড্রোন হস্তগত করে। এর পাশাপাশি এটাও স্পষ্ট যে, রুশরা প্রতিনিয়ত ইউক্রেনীয় বায়রাক্তার টিবি–২ ড্রোন ভূপাতিত করছিল, কারণ ইউক্রেন যদি নিয়মিতভাবে উক্ত ড্রোনগুলো না হারাত, সেক্ষেত্রে তাদের কিছু দিন পর পরই তুরস্ক থেকে ড্রোনের নতুন চালান নেয়ার প্রয়োজন হতো না।
রুশ প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের বক্তব্য অনুসারে, ১-৩০ এপ্রিলের মধ্যে রুশ সৈন্যরা মোট ১৬টি ইউক্রেনীয় বায়রাক্তার টিবি–২ ড্রোন ভূপাতিত করে। ২৪ এপ্রিল ইউক্রেনীয় রাষ্ট্রপতি ভলোদিমির জেলেনস্কি খোলাখুলিভাবে মন্তব্য করেন, বায়রাক্তার টিবি–২ বা অন্য ধরনের ড্রোনগুলো ইউক্রেনকে সাহায্য করতে পারে, কিন্তু যুদ্ধের ফলাফলের ক্ষেত্রে এগুলোর ভূমিকা নগণ্য। স্বাভাবিকভাবেই, জেলেনস্কির এই বক্তব্য তুর্কিদের ও তুরস্ক সমর্থকদের ক্ষিপ্ত করে। কিন্তু জেলেনস্কির এই বক্তব্য থেকে স্পষ্ট হয়ে ওঠে যে, যুদ্ধের প্রথমদিকে রুশদের বিরুদ্ধে বায়রাক্তার টিবি–২ ড্রোনের কার্যকারিতা নিয়ে ইউক্রেনীয়দের মধ্যে যে মাত্রাতিরিক্ত উচ্ছ্বাস ছিল, এপ্রিলের শেষ নাগাদ সেটি আর অবশিষ্ট ছিল না।
অবশ্য এর অর্থ এমন নয় যে, বায়রাক্তার টিবি–২ ড্রোন সম্পূর্ণরূপে অকার্যকর। বস্তুত রুশ–ইউক্রেনীয় যুদ্ধের বিভিন্ন পর্যায়ে ইউক্রেনীয় বায়রাক্তার টিবি–২ ড্রোনগুলো তাদের কার্যকারিতার স্বাক্ষর রেখেছে। কিন্তু রুশ–ইউক্রেনীয় যুদ্ধ একটি বৃহৎ মাত্রার পূর্ণাঙ্গ আন্তঃরাষ্ট্রীয় ‘কম্বাইন্ড আর্মস’ যুদ্ধ, এবং এই ধরনের যুদ্ধে কোনো একটি একক সামরিক সরঞ্জাম ‘গেম–চেঞ্জার’ বা ‘যুদ্ধের মোড় পরিবর্তনকারী’ হয়ে উঠতে পারে না। স্বাভাবিকভাবেই বায়রাক্তার টিবি–২ ড্রোন রুশ–ইউক্রেনীয় যুদ্ধের মোড় ঘুরিয়ে দিতে পারেনি।
অবশ্য জেলেনস্কির এই বক্তব্যের পরেও ইউক্রেন বায়রাক্তার টিবি–২ ড্রোনের ব্যবহার অব্যাহত রাখে। ২৫-২৭ এপ্রিলের মধ্যে ইউক্রেনীয়রা রাশিয়ার অভ্যন্তরে বায়রাক্তার টিবি–২ ড্রোন প্রেরণ করে এবং সেখানকার বিভিন্ন লক্ষ্যবস্তুর ওপর আক্রমণ পরিচালনার চেষ্টা চালায়। কিন্তু অবস্থাদৃষ্টে প্রতীয়মান হয় যে, রাশিয়ার অভ্যন্তরে ড্রোন স্ট্রাইক পরিচালনার ইউক্রেনীয় প্রচেষ্টা বিশেষ সাফল্যমণ্ডিত হয়নি। ২৫ এপ্রিল রুশ সৈন্যরা রাশিয়ার কুরস্ক প্রদেশে একটি ইউক্রেনীয় বায়রাক্তার টিবি–২ ড্রোন ভূপাতিত করে। ২৭ এপ্রিল রুশ সৈন্যরা রাশিয়ার কুরস্ক ও বেলগরোদ প্রদেশে ২টি ইউক্রেনীয় বায়রাক্তার টিবি–২ ড্রোন ভূপাতিত করে। ইউক্রেনপন্থী বিভিন্ন সূত্রের বক্তব্য অনুসারে, ২৫ এপ্রিল ইউক্রেনীয় বায়রাক্তার টিবি–২ ড্রোন স্ট্রাইকের ফলে রাশিয়ার ব্রিয়ানস্ক প্রদেশের দুটি তেলের গুদাম বিস্ফোরিত হয়। কিন্তু এই বিস্ফোরণ প্রকৃতপক্ষে বায়রাক্তার টিবি–২ ড্রোন স্ট্রাইকের ফলে ঘটেছিল কিনা বা এই আক্রমণে বায়রাক্তার টিবি–২ ড্রোন আদৌ অংশ নিয়েছিল কিনা, সেই সম্পর্কে স্পষ্ট কোনো প্রমাণ নেই। ইউক্রেনীয় সরকারও এই ব্যাপারে কোনো বক্তব্য প্রদান করেনি।
৩০ এপ্রিল থেকে ৮ মের মধ্যে ইউক্রেনীয় বায়রাক্তার টিবি–২ ড্রোনবহর রুশদের বিরুদ্ধে কিছু উল্লেখযোগ্য সাফল্য অর্জন করতে সক্ষম হয়। ৩০ এপ্রিলে প্রকাশিত একটি ভিডিও ফুটেজে দেখা যায়, ইউক্রেনীয় বায়রাক্তার টিবি–২ ড্রোন কৃষ্ণসাগরে অবস্থিত ইউক্রেনের ওদেসা প্রদেশের অন্তর্গত (কিন্তু রুশ নিয়ন্ত্রণাধীন) জমেইনি দ্বীপে একটি রুশ ‘৯কে৩৫ স্ত্রেলা–১০’ শর্ট–রেঞ্জ সারফেস–টু–এয়ার মিসাইল সিস্টেমের ওপর বোমাবর্ষণ করছে। একই দিনে প্রকাশিত আরেকটি ভিডিও ফুটেজে দেখা যায়, ইউক্রেনীয় বায়রাক্তার টিবি–২ ড্রোন জমেইনি দ্বীপে একটি রুশ ‘জেডইউ–২৩–২’ অ্যান্টি–এয়ারক্রাফট অটোক্যাননের ওপর বোমাবর্ষণ করছে। ২ মে ইউক্রেনীয় সশস্ত্রবাহিনীর জেনারেল স্টাফ তাদের ফেসবুক পেজে একটি ভিডিও ফুটেজ প্রকাশ করে, এবং সেটিতে দেখা যায় যে, ইউক্রেনীয় বায়রাক্তার টিবি–২ ড্রোন জমেইনি দ্বীপের কাছে দুটি রুশ ‘রাপ্তর’–ক্লাস প্যাট্রোল বোটের ওপর বোমাবর্ষণ করছে।
৬ মে ইউক্রেনীয় সশস্ত্রবাহিনীর ‘অপারেশনাল কমান্ড সাউথ’ তাদের ফেসবুক পেজে একটি ভিডিও ফুটেজ প্রকাশ করে, এবং সেটিতে দেখা যায়, ইউক্রেনীয় বায়রাক্তার টিবি–২ ড্রোন জমেইনি দ্বীপে একটি রুশ ‘তর’ সারফেস–টু–এয়ার মিসাইল সিস্টেমের ওপর বোমাবর্ষণ করছে। ৭ মে ‘অপারেশনাল কমান্ড সাউথ’ তাদের ফেসবুক পেজ ও ইউটিউব চ্যানেলে একটি ভিডিও ফুটেজ প্রকাশ করে, এবং সেটিতে দেখা যায়, ইউক্রেনীয় বায়রাক্তার টিবি–২ ড্রোন জমেইনি দ্বীপের কাছে একটি রুশ ‘সেরনা’–ক্লাস ল্যান্ডিং ক্রাফটের ওপর বোমাবর্ষণ করছে। ৮ মে ‘অপারেশনাল কমান্ড সাউথ’ তাদের ফেসবুক পেজে একটি ভিডিও ফুটেজ প্রকাশ করে, এবং সেটিতে দেখা যায়, ইউক্রেনীয় বায়রাক্তার টিবি–২ ড্রোন জমেইনি দ্বীপের ভূখণ্ডে অবস্থানরত একটি রুশ ‘মি–৮এএমটিএসএইচ’ হেলিকপ্টারের ওপর বোমাবর্ষণ করছে। একই দিনে ইউক্রেনীয় নৌবাহিনী তাদের ফেসবুক পেজে একটি ভিডিও ফুটেজ প্রকাশ করে এবং সেটিতে দেখা যায় যে, ইউক্রেনীয় বায়রাক্তার টিবি–২ ড্রোন জমেইনি দ্বীপের কাছে দুটি রুশ ‘রাপ্তর’–ক্লাস প্যাট্রোল বোটের ওপর বোমাবর্ষণ করছে।
অন্যদিকে, রুশ প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের প্রদত্ত তথ্য অনুসারে, ১-৯ মের মধ্যে জমেইনি দ্বীপের আশেপাশে রুশ সৈন্যরা ১৪টি ইউক্রেনীয় বায়রাক্তার টিবি–২ ড্রোন ভূপাতিত করে। তদুপরি, ৩ মে রুশরা ইউক্রেনের ওদেসায় অবস্থিত একটি লজিস্টিক্স সেন্টারের ওপর ক্ষেপণাস্ত্র আক্রমণ পরিচালনা করে, এবং এর ফলে সেখানে মোতায়েনকৃত কতিপয় ইউক্রেনীয় বায়রাক্তার টিবি–২ ড্রোন ধ্বংস হয়। উল্লেখ্য, ৯ মে তুরস্ক ইউক্রেনকে বায়রাক্তার টিবি–২ ড্রোনের আরেকটি চালান সরবরাহ করে, যার মধ্য দিয়ে এটি স্পষ্ট হয়ে ওঠে যে, জমেইনি দ্বীপের আশেপাশে সংঘটিত লড়াইয়ে ইউক্রেনীয়রা উল্লেখযোগ্য সংখ্যক বায়রাক্তার টিবি–২ ড্রোন হারিয়েছিল, এবং এজন্য তাদের নতুন বায়রাক্তার টিবি–২ ড্রোন প্রয়োজন ছিল।
৮ মের পর থেকে এখন পর্যন্ত ইউক্রেনীয়রা রুশ লক্ষ্যবস্তুর ওপর বায়রাক্তার টিবি–২ ড্রোন স্ট্রাইকের আর কোনো ভিডিও ফুটেজ প্রকাশ করেনি। সুতরাং, ধরে নেয়া যেতে পারে যে, এই সময়ের মধ্যে ইউক্রেনীয় বায়রাক্তার টিবি–২ ড্রোনবহর রুশদের বিরুদ্ধে কোনো সাফল্যজনক আক্রমণ পরিচালনা করতে সক্ষম হয়নি। ইউক্রেনীয়রা এখন তাদের বায়রাক্তার টিবি–২ ড্রোনগুলোকে মূলত রিকনিস্যান্স ড্রোন হিসেবে ব্যবহার করছে। এদিকে রুশ প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের প্রদত্ত তথ্যানুসারে, ২০২২ সালের মে মাসে রুশ সৈন্যরা সব মিলিয়ে অন্তত ২৪টি ইউক্রেনীয় বায়রাক্তার টিবি–২ ড্রোন ধ্বংস করেছে এবং ১-২৫ জুনের মধ্যে রুশ সৈন্যরা ৭টি ইউক্রেনীয় বায়রাক্তার টিবি–২ ড্রোন ভূপাতিত করেছে।
সামগ্রিকভাবে, রুশ–ইউক্রেনীয় যুদ্ধ চলাকালে ২০২২ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারি থেকে ২৫ জুনের মধ্যে ইউক্রেনীয় বায়রাক্তার টিবি–২ ড্রোনবহর নিম্নলিখিত রুশ সামরিক সরঞ্জাম ধ্বংস করেছে:
- ১টি আর্মার্ড ফাইটিং ভেহিকল;
- ১টি বিএমডি–২ এয়ারবোর্ন ইনফ্যান্ট্রি ফাইটিং ভেহিকল;
- ২টি সাঁজোয়া যান;
- ১টি বুক–এম২ ৯এ৩১৬ ট্রান্সপোর্টার ইরেক্টর লঞ্চার;
- ৩টি বুক–এম২ ৯এ৩১৭ ট্রান্সপোর্টার ইরেক্টর লঞ্চার অ্যান্ড রাডার;
- ১টি বুক–এম১–২ ৯এ৩১০এম১–২ ট্রান্সপোর্টার ইরেক্টর লঞ্চার অ্যান্ড রাডার;
- ২টি তর সারফেস–টু–এয়ার মিসাইল সিস্টেম;
- ১টি পান্তসির–এস১ সারফেস–টু–এয়ার মিসাইল সিস্টেম;
- ১টি ৯কে৩৫ স্ত্রেলা–১০ শর্ট–রেঞ্জ সারফেস–টু–এয়ার মিসাইল সিস্টেম;
- ১টি জেডইউ–২৩–২ অ্যান্টি–এয়ারক্রাফট অটোক্যানন;
- ১টি বিএম–২৭ উরাগান মাল্টিপল লঞ্চ রকেট সিস্টেম;
- ১টি আর্টিলারি কমান্ড পোস্ট;
- ৩টি কামাজ ট্রাক;
- ৩টি উরাল–৪৩২০ ট্রাক;
- ১টি বিশেষায়িত উরাল ট্রাক;
- কতিপয় রসদবাহী ট্রাক;
- ১টি জ্বালানিবাহী ট্রেন (ক্ষতিগ্রস্ত);
- ১টি যোগাযোগ স্টেশন;
- ৪টি রাপ্তর–ক্লাস প্যাট্রোল বোট;
- ১টি সেরনা–ক্লাস ল্যান্ডিং ক্রাফট এবং
- ১টি মি–৮এএমটিএসএইচ হেলিকপ্টার।
স্বাভাবিকভাবেই, উল্লিখিত প্রতিটি সামরিক সরঞ্জাম নির্দিষ্ট সংখ্যক ক্রু দ্বারা পরিচালিত হয়, এবং সেই হিসেবে ধরে নেয়া যায় যে, ইউক্রেনীয় বায়রাক্তার টিবি–২ ড্রোন স্ট্রাইকের ফলে সব মিলিয়ে অন্তত শতাধিক রুশ সৈন্য হতাহত হয়েছে।
অন্যদিকে, রুশ প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের প্রদত্ত তথ্যানুসারে, রুশ–ইউক্রেনীয় যুদ্ধ চলাকালে ২০২২ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারি থেকে ২৫ জুনের মধ্যে রুশ সৈন্যরা অন্তত ১২১টি ইউক্রেনীয় বায়রাক্তার টিবি–২ ড্রোন ধ্বংস করেছে।
সামগ্রিকভাবে বিচার করলে, রুশ–ইউক্রেনীয় যুদ্ধ চলাকালে ইউক্রেনীয়রা রুশদের বিরুদ্ধে বায়রাক্তার টিবি–২ কমব্যাট ড্রোন ব্যবহার করে বেশ কিছু উল্লেখযোগ্য সাফল্য অর্জন করতে সক্ষম হয়েছে। কিন্তু উক্ত সাফল্যগুলো যুদ্ধের মোড় ইউক্রেনের পক্ষে ঘুরিয়ে দেয়ার জন্য পর্যাপ্ত ছিল না। তদুপরি, একদিকে ইউক্রেনীয় বায়রাক্তার টিবি–২ ড্রোনবহর রুশদের উল্লেখযোগ্য পরিমাণ ক্ষয়ক্ষতি সাধন করেছে, অন্যদিকে রুশরা বহুসংখ্যক ইউক্রেনীয় বায়রাক্তার টিবি–২ ড্রোন ভূপাতিত করতে সক্ষম হয়েছে। এর ফলে শেষ পর্যন্ত ইউক্রেনীয়রা বায়রাক্তার টিবি–২ ড্রোনগুলোকে স্ট্রাইক ড্রোন হিসেবে ব্যবহার করা বন্ধ রেখেছে, এবং রিকনিস্যান্স ড্রোন হিসেবে ব্যবহার করতে শুরু করেছে।
ইউক্রেনীয়রা প্রধানত তিন দফায় রুশদের বিরুদ্ধে ব্যাপক হারে বায়রাক্তার টিবি–২ ড্রোন স্ট্রাইক পরিচালনা করেছে: ২৭–২৮ ফেব্রুয়ারি, ৭–১৪ মার্চ এবং ৩০ এপ্রিল–৮ মে। প্রথম দুই দফায় ইউক্রেনীয়রা যুদ্ধক্ষেত্রের সবখানে রুশদের বিরুদ্ধে বায়রাক্তার টিবি–২ ড্রোন ব্যবহার করে আক্রমণ চালিয়েছে। বস্তুত, প্রথম দুই দফায় ইউক্রেনীয়দের উদ্দেশ্য ছিল বায়রাক্তার টিবি–২ ড্রোন ব্যবহার করে যুদ্ধের মোড় রুশদের বিরুদ্ধে ঘুরিয়ে দেয়া। এ সময় রুশ এয়ার ডিফেন্স সিস্টেমগুলোও তুলনামূলকভাবে দুর্বলতার পরিচয় দেয়, এবং সেজন্য যুদ্ধক্ষেত্রের সর্বত্র ইউক্রেনীয়রা আক্রমণাত্মকভাবে বায়রাক্তার টিবি–২ ড্রোন ব্যবহারের সুযোগ পায়। কিন্তু এই দুই দফায় ইউক্রেনীয়রা বহু সংখ্যক বায়রাক্তার টিবি–২ ড্রোন হারায়, এবং এর ফলে তারা ১৫ মার্চ থেকে ২৯ এপ্রিল পর্যন্ত বায়রাক্তার টিবি–২ ড্রোন ব্যবহার করে রুশদের ওপর আক্রমণ পরিচালনা বন্ধ রাখে।
তৃতীয় দফায় ইউক্রেনীয়রা কেবল একটি নির্দিষ্ট অঞ্চলে রুশদের বিরুদ্ধে বায়রাক্তার টিবি–২ ড্রোন ব্যবহার করে আক্রমণ চালিয়েছে, এবং সেই অঞ্চলটি হচ্ছে জমেইনি দ্বীপ ও তার আশেপাশের সমুদ্র। বস্তুত, এই পর্যায়ে এসে ইউক্রেনীয়রা আর বায়রাক্তার টিবি–২ ড্রোনকে ‘গেম–চেঞ্জার’ হিসেবে বিবেচনা করছিল না। এ সময় তারা জমেইনি দ্বীপ ও তার আশেপাশে রুশ লক্ষ্যবস্তুর ওপর বায়রাক্তার টিবি–২ ড্রোনের আক্রমণ কেন্দ্রীভূত করেছিল, কারণ তাদের উদ্দেশ্য ছিল ৯ মের মধ্যে জমেইনি দ্বীপ পুনর্দখল করে নেয়া, এবং এর মধ্য দিয়ে রাশিয়ার বিরুদ্ধে একটি প্রচারণামূলক বিজয় অর্জন করা। ৯ মে রাশিয়ার বিজয় দিবস, এবং এই সময়ে ইউক্রেনীয়রা জমেইনি দ্বীপ পুনর্দখল করে নিতে সক্ষম হলে সেটি হতো রুশদের জন্য অবমাননাকর। এজন্য এই দফায় ইউক্রেনীয়রা বায়রাক্তার টিবি–২ ড্রোন ব্যবহারের ঝুঁকি সম্পর্কে অবগত থাকা সত্ত্বেও ব্যাপকভাবে উক্ত ড্রোনটি ব্যবহার করে রুশদের ওপর আক্রমণ চালায়।
ইউক্রেনীয় বায়রাক্তার টিবি–২ ড্রোনবহর জমেইনি দ্বীপ ও তার আশেপাশে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক রুশ সামরিক সরঞ্জাম ধ্বংস করতে সক্ষম হয়, কিন্তু একই সময়ে রুশরা সেখানে বহুসংখ্যক ইউক্রেনীয় বায়রাক্তার টিবি–২ ড্রোন ভূপাতিত করে। শেষ পর্যন্ত জমেইনি দ্বীপের ওপর ইউক্রেনীয় আক্রমণ ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়, এবং এর ফলে ইউক্রেনের পক্ষে তাদের বহুল আলোচিত প্রচারণামূলক বিজয় অর্জন করা সম্ভব হয়নি। এই ঘটনার পর থেকে ইউক্রেনীয়রা আবার বায়রাক্তার টিবি–২ ড্রোন ব্যবহার করে রুশদের ওপর আক্রমণ পরিচালনা স্থগিত রেখেছে, এবং মূলত রিকনিস্যান্সের জন্য উক্ত ড্রোনগুলো ব্যবহার করছে।
স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন উঠতে পারে যে, ২০২০ সালের আর্মেনীয়–আজারবাইজানি যুদ্ধে তুর্কি–নির্মিত বায়রাক্তার টিবি–২ ড্রোনবহর যেভাবে যুদ্ধের মোড় আজারবাইজানের পক্ষে ঘুরিয়ে দিয়েছিল, তেমনটা রুশ–ইউক্রেনীয় যুদ্ধের ক্ষেত্রে কেন সম্ভব হলো না? এর উত্তর হচ্ছে: বায়রাক্তার টিবি–২ বা অনুরূপ ড্রোনগুলো এমন ধরনের সৈন্যদলের বিরুদ্ধে কার্যকর, যাদের কাছে পর্যাপ্ত পরিমাণে আধুনিক এয়ার ডিফেন্স সিস্টেম ও ইলেক্ট্রনিক ওয়ারফেয়ার সিস্টেম নেই। কিন্তু রুশ সশস্ত্রবাহিনীর কাছে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক উন্নত এয়ার ডিফেন্স সিস্টেম ও ইলেক্ট্রনিক ওয়ারফেয়ার সিস্টেম রয়েছে, এবং এর ফলে বায়রাক্তার টিবি–২ ড্রোনের পক্ষে রুশ–ইউক্রেনীয় যুদ্ধের মোড় ঘুরিয়ে দেয়া সম্ভব হয়নি।
তদুপরি, ড্রোনযুদ্ধ সম্পর্কে তুর্কি সশস্ত্রবাহিনীর নিজস্ব ‘কনসেপ্ট অব অপারেশন্স’ রয়েছে, এবং পশ্চিম লিবিয়া, ইদলিব ও নাগর্নো–কারাবাখে তুর্কি ও আজারবাইজানি ড্রোনযুদ্ধের সাফল্যের পশ্চাতে এর গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল। ইউক্রেনীয়রা তুরস্কের কাছ থেকে বায়রাক্তার টিবি–২ ড্রোন ক্রয় করেছে বটে, কিন্তু তুর্কি ড্রোনযুদ্ধের ডকট্রিন পুরোপুরি আত্মস্থ করতে পারেনি, অর্থাৎ তুর্কি সশস্ত্রবাহিনীতে তাদের ড্রোনগুলো যেভাবে অঙ্গীভূত, ইউক্রেনীয় সশস্ত্রবাহিনীতে ড্রোনগুলো সেভাবে অঙ্গীভূত ছিল না। এর ফলে রুশদের বিরুদ্ধে ইউক্রেনীয়দের বায়রাক্তার টিবি–২ ড্রোনের ব্যবহার ছিল তুলনামূলকভাবে অসংগঠিত, এবং দীর্ঘ মেয়াদে এই কৌশল ফলপ্রসূ হয়নি।
সর্বোপরি, রুশ–ইউক্রেনীয় যুদ্ধের প্রাথমিক পর্যায়ে রুশ এয়ার ডিফেন্স ইউনিটগুলো অপ্রস্তুত ছিল, এবং ক্ষেত্রবিশেষে তারা অকর্মণ্যতার পরিচয় দিয়েছে। যেমন: ইউক্রেনীয় বায়রাক্তার টিবি–২ ড্রোন স্ট্রাইকের ফলে যেসব রুশ এয়ার ডিফেন্স সিস্টেম ধ্বংস হয়েছে, দেখা গেছে যে, সিংহভাগ ক্ষেত্রেই সেগুলো সক্রিয় অবস্থায় ছিল না। এর ফলে যুদ্ধের প্রাথমিক পর্যায়ে ইউক্রেনীয়রা বায়রাক্তার টিবি–২ ড্রোন ব্যবহার করে রুশদের উল্লেখযোগ্য ক্ষয়ক্ষতি সাধন করতে সক্ষম হয়। কিন্তু পরবর্তীতে রুশরা অধিকতর দক্ষতার সঙ্গে তাদের এয়ার ডিফেন্স সিস্টেমগুলো ব্যবহার করতে শুরু করে, এবং এর ফলে ইউক্রেনীয়রা বায়রাক্তার টিবি–২ ড্রোনগুলোকে স্ট্রাইক ড্রোন হিসেবে ব্যবহার করা থেকে বিরত থাকতে বাধ্য হয়। বস্তুত, জুনে প্রদত্ত এক সাক্ষাৎকারে ইউক্রেনীয় বিমানবাহিনীর একজন কর্মকর্তা খোলাখুলিই মন্তব্য করেছেন যে, রুশরা এখন ভালো এয়ার ডিফেন্স গড়ে তুলেছে, ফলে তুর্কি বায়রাক্তার ড্রোনগুলো এখন প্রায় অকার্যকর।
সামগ্রিকভাবে, রুশ–ইউক্রেনীয় যুদ্ধে তুর্কি–নির্মিত বায়রাক্তার টিবি–২ ড্রোনগুলো ইউক্রেনকে বেশ কিছু সাফল্য এনে দিয়েছে, কিন্তু যুদ্ধের মোড় ইউক্রেনের পক্ষে ঘুরিয়ে দেয়ার মতো সামর্থ্য উক্ত ড্রোনগুলোর ছিল না, এবং যুদ্ধের প্রথম তিন সপ্তাহের মধ্যে ব্যাপারটি ইউক্রেনীয়দের নিকট স্পষ্ট হয়ে ওঠে। ইউক্রেনীয়রা এই বাস্তবতা স্বীকার করে নিয়েছে, এবং এখন তারা তাদের বায়রাক্তার টিবি–২ ড্রোনগুলো রিকনিস্যান্স ড্রোন হিসেবে ব্যবহার করছে। রুশ–ইউক্রেনীয় যুদ্ধে ইউক্রেনীয় বায়রাক্তার টিবি–২ ড্রোনের ভূমিকা থেকে একটি বিষয় স্পষ্ট হয়ে উঠেছে- এই ড্রোনগুলো ক্ষুদ্রাকৃতির ও পর্যাপ্ত এয়ার ডিফেন্স সিস্টেমবিহীন সামরিক বাহিনীগুলোর বিরুদ্ধে যতই কার্যকর হোক না কেন, বৃহদাকৃতির ও পর্যাপ্ত এয়ার ডিফেন্স সিস্টেম সজ্জিত সামরিক বাহিনীগুলোর জন্য এগুলো গুরুতর হুমকি নয়।
কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে, বর্তমান বিশ্বের সিংহভাগ সামরিক বাহিনীই ক্ষুদ্রাকৃতির ও পর্যাপ্ত এয়ার ডিফেন্স সিস্টেমবিহীন। তদুপরি, এই বিষয়টি উপেক্ষা করা যায় না যে, আধুনিক এয়ার ডিফেন্স সিস্টেম বা ইলেক্ট্রনিক ওয়ারফেয়ার সিস্টেমের তুলনায় বায়রাক্তার টিবি–২ ড্রোন বেশ স্বল্পমূল্যের, সহজে ব্যবহারযোগ্য, ও সহজে প্রতিস্থাপনযোগ্য। সুতরাং, রুশ–ইউক্রেনীয় যুদ্ধে বায়রাক্তার টিবি–২ ড্রোনের ভূমিকা যেমনই হোক না কেন, আন্তর্জাতিক অস্ত্রের বাজারে বায়রাক্তার টিবি–২ ড্রোনের চাহিদা অব্যাহত থাকবে বলেই প্রতীয়মান হয়।