২০২০ সালের ২২ মে রুশ বন্দরনগরী পেভেকের পার্শ্ববর্তী চাউনস্কায়া উপসাগরে রুশ জাহাজ ‘আকাদেমিক লমোনোসভ’ পূর্ণমাত্রায় সক্রিয় হয়। জাহাজটির নামকরণ করা হয়েছে প্রখ্যাত রুশ বিজ্ঞানী মিখাইল লমোনোসভের নামানুসারে। এর বিশেষত্ব হচ্ছে, এটি বর্তমান বিশ্বের একমাত্র ভাসমান পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র! রুশ ভাষায় এ ধরনের বিদ্যুৎকেন্দ্রকে বলা হয় ‘плавучая атомная теплоэлектростанция малой мощности’ (প্লাভুচায়া আতমনায়া তেপ্লোএলেক্ত্রোস্তান্তৎসিয়া মালোয় মোশ্চনোস্তি), যেটির বাংলা অর্থ দাঁড়ায় ‘ভাসমান সমন্বিত তাপ ও বিদ্যুৎ স্বল্পশক্তির পারমাণবিক স্টেশন’।
প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, পেভেক আর্কটিক মহাসাগরের অন্তর্গত পূর্ব সাইবেরীয় সাগরের চাউনস্কায়া উপসাগরের তীরে অবস্থিত একটি সমুদ্রবন্দর। প্রশাসনিকভাবে, শহরটি রাশিয়ার চুকোৎকা স্বায়ত্তশাসিত অঞ্চলের চাউনস্কি জেলার রাজধানী। ‘আর্কটিক বৃত্তে’ অবস্থিত এই শহরটি চুকোৎকা স্বায়ত্তশাসিত জেলার রাজধানী আনাদির থেকে প্রায় ৬৪০ কি.মি. উত্তর–পশ্চিমে অবস্থিত। পেভেক শহরটিকে স্থলে অবস্থিত যে বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে বিদ্যুৎ সরবরাহ করা হতো, সেটি বন্ধ করে দেয়া হবে। এই প্রক্রিয়ার অংশ হিসেবে বন্দরনগরীটিতে বিদ্যুৎ সরবরাহের জন্য সেখানে রাশিয়ার প্রথম ভাসমান পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপন করা হয়েছে। এটি পরিচালনা করছে রুশ রাষ্ট্রীয় পরমাণু শক্তি কর্পোরেশন ‘রোসাতম’ (রুশ: Росатом)।
অবশ্য নৌযান পরিচালনার ক্ষেত্রে পারমাণবিক শক্তির ব্যবহার এটিই প্রথম নয়। পারমাণবিক শক্তিচালিত নৌযানগুলো অন্যান্য নৌযানের তুলনায় বেশি স্বয়ংসম্পূর্ণ হয়, কারণ তাদেরকে জ্বালানির জন্য সমুদ্রবন্দর বা সরবরাহ জাহাজের ওপর নির্ভর করতে হয় না। স্নায়ুযুদ্ধের চলাকালে এই প্রযুক্তির ব্যাপক বিস্তৃতি ঘটে, এবং পারমাণবিক শক্তিচালিত জাহাজগুলো উভয় পরাশক্তিকে (মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও তদানীন্তন সোভিয়েত ইউনিয়ন) ব্যাপক কৌশলগত সুবিধা প্রদান করে।
মার্কিন–নির্মিত ‘ইউএসএস নটিলাস’ ছিল বিশ্বের প্রথম পারমাণবিক শক্তিচালিত সাবমেরিন। অনুরূপভাবে, সোভিয়েত নির্মিত কিরভ শ্রেণির ভারী ব্যাটলক্রুজারগুলো ছিল পারমাণবিক শক্তিচালিত। সোভিয়েত–নির্মিত ‘আকুলা’ সাবমেরিনগুলোও ছিল পারমাণবিক শক্তিচালিত, এবং এগুলো টানা কয়েক মাস পানির নিচে থাকতে পারত। বর্তমানে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সম্পূর্ণ এয়ারক্রাফট ক্যারিয়ার বহর এবং ফ্রান্সের একমাত্র এয়ারক্রাফট ক্যারিয়ার ‘শার্ল দ্য গল’ও পারমাণবিক শক্তিচালিত। চীন যে ‘শানদং’ নামক একটি এয়ারক্রাফট ক্যারিয়ার নির্মাণ করেছে, সেটিতেও পারমাণবিক শক্তি ব্যবহার করার পরিকল্পনা চলছে।
অবশ্য কেবল সামরিক নৌযানেই নয়, বেসামরিক নৌযানেও পারমাণবিক শক্তি ব্যবহার করা হয়ে থাকে। উদাহরণস্বরূপ, রাশিয়ার রয়েছে বিশ্বের বৃহত্তম বরফভাঙা জাহাজের (icebreaker) বহর। এই জাহাজগুলোকে ব্যবহার করে রুশরা তাদের বরফাচ্ছন্ন সমুদ্রপথকে নৌযান চলাচলের উপযোগী করে থাকে। এই বরফভাঙা জাহাজগুলোও পারমাণবিক শক্তিচালিত। বস্তুত রাশিয়াই বর্তমান বিশ্বের একমাত্র রাষ্ট্র, যারা পারমাণবিক শক্তিচালিত বরফভাঙা জাহাজ ব্যবহার করে থাকে।
আকাদেমিক লমোনোসভও কোনো সামরিক নৌযান নয়। এবং অন্যান্য পারমাণবিক শক্তিচালিত নৌযানের সঙ্গে এটির পার্থক্য হচ্ছে – এটি পারমাণবিক শক্তি দ্বারা চালিত হয় না। এটিকে কোথাও স্থানান্তর করতে হলে অন্য কোনো জাহাজ দিয়ে ‘টো’ (tow) করে নিয়ে যাওয়ার প্রয়োজন হয়। আকাদেমিক লমোনোসভে যে পারমাণবিক রিঅ্যাক্টর রয়েছে, সেটির মূল কাজ বিদ্যুৎ উৎপাদন করা। প্রায় দুই লক্ষ মানুষের জন্য প্রয়োজনীয় বিদ্যুৎ এই জাহাজটি উৎপাদন করতে পারে।
প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, ভাসমান পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের উদাহরণ এটিই প্রথম নয়। স্নায়ুযুদ্ধ চলাকালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের আমলের একটি মালবাহী জাহাজকে ভাসমান পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রে পরিণত করেছিল। ‘এমএইচ –১এ’ নামক এই ভাসমান বিদ্যুৎকেন্দ্রটি পানামা খাল অঞ্চলে মার্কিন সেনাবাহিনীর জন্য স্থাপন করা হয়েছিল। এটি ছিল একটি ‘প্রোটোটাইপ’ বা ‘পরীক্ষামূলক সংস্করণ’। মার্কিনিদের পরিকল্পনা ছিল, তারা ভাসমান পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দের পুরো একটি বহর তৈরি করবে। কিন্তু ১৯৭৬ সালে এমএইচ–১এ ‘অবসর গ্রহণ’ করে, এবং মার্কিন প্রকল্পটি পরিত্যক্ত হয়।
এখন রুশরা অনুরূপ একটি প্রকল্প হাতে নিয়েছে। ২০০৭ সালের এপ্রিলে রুশ সরকার ভাসমান পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের পরিকল্পনা গ্রহণ করে। ২০১০ সালে প্রথম রুশ ভাসমান পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র ‘আকাদেমিক লমোনোসভ’ নির্মাণের কাজ শুরু হয়।
২১,৫০০ টন ওজনবিশিষ্ট আকাদেমিক লমোনোসভে ‘রূপান্তরিত কেএলটি–৪০এস’ মডেলের দুইটি পারমাণবিক রিঅ্যাক্টর ব্যবহার করা হয়েছে। সাধারণত রুশ বরফভাঙা জাহাজগুলোতেও একই ধরনের রিঅ্যাক্টর ব্যবহার করা হয়। জাহাজটি ১৪৪.৪ মিটার দীর্ঘ এবং ৩০ মিটার প্রশস্ত। জাহাজের পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রটি ৭০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ (অথবা ৩০০ মেগাওয়াট তাপশক্তি) উৎপাদন করতে সক্ষম। জাহাজটির নিজস্ব কোনো চালিকাশক্তি নেই, এজন্য এটির স্থানান্তরের প্রয়োজন হলে এটিকে অন্য জাহাজ দিয়ে ‘টো’ করে গন্তব্যস্থলে নিয়ে যেতে হয়। জাহাজটির নির্মাণব্যয় ছিল প্রায় ৬০০ কোটি (বা ৬ বিলিয়ন) রুবল, বা মার্কিন মুদ্রায় প্রায় ২৩ কোটি ২০ লক্ষ (বা ২৩২ মিলিয়ন) মার্কিন ডলার।
সেন্ট পিটার্সবার্গের ভাসিলিয়েভস্কি দ্বীপে অবস্থিত বাল্টিক শিপইয়ার্ডে ‘আকাদেমিক লমোনোসভ’ জাহাজটিকে নির্মাণ করা হয়। এরপর সেটিকে সেখান থেকে ‘টো’ করে মুর্মানস্কে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে জাহাজটিকে পারমাণবিক জ্বালানিতে ‘সজ্জিত’ করা হয়, নতুন করে রং করা হয়, এবং এরপর আবার ‘টো’ করে আর্কটিক বৃত্তের উত্তরভাগে অবস্থিত পেভেক শহরে নিয়ে যাওয়া হয়। ভাসমান বিদ্যুৎকেন্দ্রটি বর্তমানে এই বন্দরনগরীটিকে বিদ্যুৎ সরবরাহ করছে। এটির আয়ু প্রায় ৪০ বছর। প্রতি তিন বছরে জাহাজটিতে অন্য জাহাজ থেকে জ্বালানি সরবরাহ করা হবে, এবং প্রতি ১২ বছর পর পর জাহাজটিকে ‘টো’ করে বন্দরে নিয়ে যাওয়া হবে। সেখানে জাহাজটির প্রয়োজনীয় মেরামতকার্য সম্পন্ন করা হবে এবং জাহাজটি থেকে পারমাণবিক বর্জ্য অপসারণ করা হবে।
এটি রাশিয়ার প্রথম ভাসমান পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র, কিন্তু অদূর ভবিষ্যতে তারা এ রকম আরো ভাসমান পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ করবে। প্রশ্ন হচ্ছে, বিশ্বের বৃহত্তম রাষ্ট্র রাশিয়ায় জায়গার নিশ্চয়ই অভাব নেই। তাহলে তারা স্থল ছেড়ে কেন পানিতে ভাসমান পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ করছে? এই সিদ্ধান্ত গ্রহণের পিছনে নানাবিধ কারণ রয়েছে।
প্রথমত, রুশদের জন্য স্থলে স্থাপিত পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রেের তুলনায় পানিতে ভাসমান পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ করা তুলনামূলকভাবে কম ব্যয়বহুল। কারণ স্থলে পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনের চেয়ে শিপইয়ার্ডের অ্যাসেম্বলি লাইন তথা উৎপাদন ব্যবস্থা অধিকতর কার্যকরী ও কম সময়সাপেক্ষ। এর ফলে রুশরা যত সহজে ও দ্রুতগতিতে তাদের জাহাজ নির্মাণ কেন্দ্রগুলোতে ভাসমান পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ করতে পারবে, তত সহজে ও দ্রুতগতিতে স্থলভিত্তিক পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ করতে পারবে না।
শুধু তাই নয়, ‘আকাদেমিক লমোনোসভ’ ভাসমান পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের ফলে রাশিয়ায় প্রতি বছর প্রায় দুই লক্ষ টন কয়লা ও এক লক্ষ টন জ্বালানি তেলের সাশ্রয় হবে। এজন্য বিশুদ্ধ অর্থনৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকে ভাসমান পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ রুশদের জন্য লাভজনক।
দ্বিতীয়ত, সাম্প্রতিক সময়ে রাশিয়ার বিভিন্ন অঞ্চলের জনমত নতুন পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনের বিরোধী হয়ে উঠেছে। পরিবেশগত ক্ষয়ক্ষতি ও পারমাণবিক দুর্ঘটনার আশঙ্কা এই মনোভাবের প্রধান কারণ। এজন্য রুশ সরকার ভাসমান পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণে মনোনিবেশ করেছে। ভাসমান পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র সহজেই স্থানান্তর করা সম্ভব। এজন্য এগুলো স্থলভিত্তিক পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রে তুলনায় জনসাধারণের কাছে বেশি গ্রহণযোগ্য, এবং ঘটনাচক্রে জনমত যদি এগুলোরও বিরোধী হয়ে ওঠে, সেক্ষেত্রে রুশ সরকার সহজেই ভাসমান বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোকে অন্যত্র সরিয়ে নিতে পারবে।
তৃতীয়ত, ভাসমান পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো অপেক্ষাকৃত নমনীয়ভাবে ব্যবহার করা সম্ভব। যেসব সমুদ্র তীরবর্তী অঞ্চলে কাঠামোগত পরিবর্তন চলছে, সেসব অঞ্চলে পরিবর্তনকালীন সময় হ্রাস করার ক্ষেত্রে ভাসমান পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র ভূমিকা রাখতে পারে। ধরা যাক, রুশ সরকার আর্কটিক মহাসাগরের তীরে নতুন কোনো বন্দর নির্মাণের সিদ্ধান্ত নিল, কিংবা পুরনো কোনো বন্দরের ব্যাপক সম্প্রসারণ বা আধুনিকায়নের প্রকল্প হাতে নিল। সেক্ষেত্রে অঞ্চলটিতে বিদ্যুৎ সরবরাহের জন্য তাদেরকে নতুন বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ করতে হবে, যেটি ব্যয়বহুল ও সময়সাপেক্ষ। কিন্তু যদি রুশ সরকারের হাতে একটি অতিরিক্ত ভাসমান পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র থাকে, তারা সহজেই সেটিকে ঐ বন্দরে প্রেরণ করতে পারবে এবং সেখানকার বিদ্যুতের চাহিদা পূরণ করতে পারবে।
চতুর্থত, ভাসমান পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র উপকূলীয় শহরগুলোর পাশাপাশি উপকূলবর্তী বৃহৎ নির্মাণ প্রকল্প ও অন্যান্য স্থাপনাগুলোর (যেমন: তেল ও গ্যাস উত্তোলন ক্ষেত্র) বিদ্যুতের চাহিদাও পূরণ করতে সক্ষম। এক্ষেত্রেও নতুন বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের তুলনায় ভাসমান বিদ্যুৎকেন্দ্রের ব্যবহার অধিকতর সাশ্রয়ী ও লাভজনক। ইতোমধ্যে রুশ রাষ্ট্রীয় গ্যাস কোম্পানি ‘গাজপ্রম’ কোলা ও ইয়ামাল উপদ্বীপদ্বয়ে অবস্থিত তাদের স্থাপনাগুলোর জ্বালানির চাহিদা পূরণের জন্য কমপক্ষে ৫টি ভাসমান পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র ব্যবহার করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে।
পঞ্চমত, বিশাল রাশিয়ার যেসব প্রান্তিক অঞ্চলে বিদ্যুৎ সরবরাহ করা কঠিন, সেসব অঞ্চলের বিদ্যুতের চাহিদা পূরণের ক্ষেত্রে ভাসমান পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে। ভাসমান পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র খুব খারাপ আবহাওয়াতেও কাজ চালিয়ে যেতে সক্ষম, এজন্য বিশেষত রুশ দূরপ্রাচ্যের উন্নয়নের জন্য রুশ সরকার যে বিস্তৃত পরিকল্পনা গ্রহণ করেছে, ভাসমান পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র তার অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে ওঠছে।
সর্বোপরি, রুশ সরকার কর্তৃক ভাসমান পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ আর্কটিক বা উত্তর মেরু অঞ্চলে রুশ ভূরাজনৈতিক ও ভূকৌশলগত আধিপত্য বিস্তারের প্রকল্পের সঙ্গে অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত। বৈশ্বিক উষ্ণায়নের ফলে আর্কটিক অঞ্চলের বরফ গলে যাচ্ছে, এবং এর ফলে বরফাচ্ছন্ন আর্কটিক মহাসাগর ক্রমশ জাহাজ চলাচলের উপযুক্ত হয়ে উঠেছে। একই সঙ্গে আর্কটিকের বিপুল হাইড্রোকার্বন সম্পদ উত্তোলনের সুযোগও সৃষ্টি হয়েছে।
রুশ সরকার এই প্রক্রিয়াটিকে নিজেদের ভূরাজনৈতিক স্বার্থে ব্যবহারের জন্য বিস্তৃত পরিকল্পনা গ্রহণ করেছে। তারা আর্কটিকের বিপুল হাইড্রোকার্বন সম্পদের ওপরে নিজেদের কর্তৃত্ব স্থাপন করতে আগ্রহী। একই সঙ্গে তারা ‘উত্তরাঞ্চলীয় সমুদ্রপথ’কে (Northern Sea Route) জনপ্রিয় করে তোলার প্রচেষ্টা চালাচ্ছে। উল্লেখ্য, আর্কটিক মহাসাগরের মধ্য দিয়ে অপেক্ষাকৃত স্বল্প সময়ে এশিয়া থেকে ইউরোপে পৌঁছানো সম্ভব। এই সমুদ্রপথটি পুরোপুরি ব্যবহারোপযোগী হয়ে উঠলে সেখান দিয়ে বিভিন্ন রাষ্ট্রের যে বিপুল সংখ্যক জাহাজ যাতায়াত করতে পারবে, সেগুলোর কাছ থেকে রুশরা বিপুল পরিমাণ শুল্ক আদায় করতে সমর্থ হবে।
২০২০ সালের ৬ মার্চ রুশ সরকার তাদের আনুষ্ঠানিক ‘আর্কটিক কৌশলপত্র’ প্রকাশ করেছে। এই কৌশলপত্রে বর্ণিত মূল লক্ষ্যবস্তুগুলো হলো– রাশিয়ার অপেক্ষাকৃত পশ্চাৎপদ আর্কটিক অঞ্চলের আর্থ–সামাজিক উন্নয়ন, উত্তরাঞ্চলীয় সমুদ্রপথের সর্বোচ্চ ব্যবহার নিশ্চিতকরণ এবং আর্কটিক অঞ্চলে তেল ও গ্যাস উত্তোলন প্রকল্পসমূহ বর্ধিতকরণ। এই লক্ষ্যবস্তুগুলোর বাস্তবায়নে ভাসমান পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোর গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে। কারণ, ভাসমান পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের মাধ্যমে রুশরা সহজেই তাদের আর্কটিক অঞ্চলে বিদ্যুৎ সরবরাহ করতে পারবে এবং উপকূলবর্তী স্থাপনাগুলোর বিদ্যুতের চাহিদা পূরণ করতে পারবে।
অবশ্য ভাসমান পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো কতটা নিরাপদ, সেটি নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে। বিশেষত ১৯৮৬ সালে সংঘটিত প্রাক্তন সোভিয়েত ইউনিয়নের চেরনোবিল পারমাণবিক বিপর্যয় ও ২০১১ সালে সংঘটিত জাপানের ফুকুশিমা পারমাণবিক বিপর্যয় পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোর কারণে সৃষ্ট নিরাপত্তা ঝুঁকিকে প্রকট করে তুলেছে। ‘গ্রিনপিস’ ও ‘বেলোনা ফাউন্ডেশন’সহ বিভিন্ন পরিবেশবাদী সংগঠন আশঙ্কা প্রকাশ করেছে যে, ভাসমান পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র সহজেই প্রাকৃতিক দুর্যোগে (যেমন: সুনামি) মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে, এবং পরিবেশগত বিপর্যয় ঘটাতে পারে। এজন্য তারা এই প্রকল্পের তীব্র বিরোধী। ২০১১ সালে একটি রুশ বরফভাঙা জাহাজ থেকে পারমাণবিক নিঃসরণের ঘটনা তাদের আশঙ্কাকে আরো বাড়িয়ে দিয়েছে।
কিন্তু রুশ কর্মকর্তাদের মতে, অতীতের অভিজ্ঞতা বিবেচনায় রেখেই ভাসমান পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ করা হচ্ছে, এবং প্রয়োজনীয় নিরাপত্তামূলক ব্যবস্থাও গ্রহণ করা হয়েছে। তদুপরি, তাদের কয়েক দশক ধরে আর্কটিক মহাসাগরে পারমাণবিক শক্তিচালিত বরফভাঙা জাহাজ পরিচালনার অভিজ্ঞতা রয়েছে। তাদের মতে, ভাসমান পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো অর্থনৈতিক উন্নয়ন ও জ্বালানি নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণের পাশাপাশি পরিবেশ দূষণও রোধ করবে, কারণ এগুলো থেকে কার্বন নিঃসরণ ঘটবে না।
সামগ্রিকভাবে, রুশরা তাদের আর্কটিক নীতি বাস্তবায়নের অংশ হিসেবে ভাসমান পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের একটি বহর নির্মাণ করছে, এবং তাদের এই প্রকল্প সাফল্যমণ্ডিত হলে ভবিষ্যতে ভাসমান পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র বৈশ্বিক জ্বালানি নিরাপত্তার একটি গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গে পরিণত হবে। প্রাপ্ত তথ্যমতে, চীনও তাদের ক্রমবর্ধমান জ্বালানির চাহিদা পূরণের উদ্দেশ্যে অনুরূপ ভাসমান পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের পরিকল্পনা করছে। রোসাতমের প্রদত্ত তথ্যানুযায়ী, ইন্দোনেশিয়া, মালয়েশিয়া, আলজেরিয়া, সুদান ও আর্জেন্টিনাসহ ১৫টি রাষ্ট্র রাশিয়ার কাছ থেকে অনুরূপ ভাসমান বিদ্যুৎকেন্দ্র সংগ্রহ করার আগ্রহ প্রকাশ করেছে।