করোনাভাইরাসের ঘাত-অভিঘাত কোথায় গিয়ে থামবে কেউ বলতে পারছেন না, বলা সম্ভবও নয়। শত কোটি মানুষের অর্থনৈতিক পঙ্গুত্ব কিংবা শুধুমাত্র পারিবারিক-সামাজিক অস্থিরতাই নয়, এর সাথে যোগ হচ্ছে ভাইরাসটিতে আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা এবং দীর্ঘ হচ্ছে আত্মহত্যার সারি। ভয়ানক এই বিষয়টির দিকে এখনই নজর দেয়া প্রয়োজন জরুরি ভিত্তিতে।
করোনাভাইরাসের সংক্রমণ রোধে লকডাউনই প্রথম শর্ত বলে জানাচ্ছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা। জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এই মুহূর্তে সামাজিকভাবে বিচ্ছিন্ন থাকার বিকল্প কিছু নেই। পুরো পৃথিবীর দুই থেকে তিনশো কোটি মানুষ ঘরে বন্দী। বিচ্ছিন্ন এক রাষ্ট্র থেকে আরেক রাষ্ট্র। জরুরি অবস্থা দেশে দেশে। স্থবির পুরো বিশ্ব। গত ২৪ মার্চ মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প দ্রুত জরুরি অবস্থা তুলে ব্যবসা বাণিজ্যে স্বাভাবিক অবস্থা ফিরিয়ে আনার উদ্যোগের কথা জানান। কারণ করোনাভাইরাসের মৃত্যুর মিছিলের চেয়ে তিনি ভয় পাচ্ছিলেন আত্মহত্যার মৃত্যুর মিছিলকে।
ফক্স নিউজকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে ট্রাম্প জানান, বিশ্ব যে ভয়ানক আর্থিক মন্দার মধ্যে পড়তে যাচ্ছে তার নানামুখী প্রভাবে আমেরিকার অসংখ্য মানুষ আত্মহত্যার পথে পা বাড়াবে এবং এরই মধ্যে অনেকে আত্মহত্যা করেছেনও। ভবিষ্যতে আত্মহত্যায় মৃতের সংখ্যা নভেল করোনাভাইরাসে মৃতের সংখ্যাকেও ছাড়িয়ে যাবে কয়েক গুন। এ অবস্থা সামাল দিতে তার প্রশাসন ব্যবসা-বাণিজ্যে গতি আনাটাকেই গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করছে।
যুক্তরাষ্ট্রের ন্যাশনাল অ্যালায়েন্স অন মেন্টাল ইলনেস-এর ব্যবস্থাপক ক্রিস্টিনা ব্র্যাডলি বলছেন, করোনাভাইরাসের বৈশ্বিক এই দুর্যোগে আত্মহত্যার সংখ্যাটা যেভাবে বৃদ্ধি পাচ্ছে তা রীতিমতো ভয়ানক।
পৃথিবীতে বেঁচে থাকাটা যখন ভীতিকর এবং চরম অনিশ্চয়তায় ভরে ওঠে, তখনই মানুষের মাঝে নিজেকে শেষ করে ফেলার প্রবণতা তৈরি হয়। বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, শুধু অর্থনৈতিক নিরাপত্তাহীনতাই নয়, করোনা-কেন্দ্রিক বৈশ্বিক দুর্যোগে বেশ কিছু কারণে আত্মহত্যার প্রবণতা বাড়ছে দেশে দেশে। তারা বলছেন, বিশ্বব্যাপী এই মহামারিতে কত মানুষ আত্মহত্যা করবে তা অনুমান করাটাও কষ্টসাধ্য। ভাইরাসটির আক্রমণাত্মক প্রকৃতি কোয়ারেন্টিন বা আইসোলেশনে মানুষকে নিঃসঙ্গ করে তোলে। নিজের দেহ থেকে পরিবারের অন্যান্যদের মাঝে ছড়িয়ে পড়ার আতঙ্ক, মাদকাসক্তি, একাকিত্ব এবং সর্বোপরি অর্থনৈতিক নিরাপত্তাহীনতায় বাড়ছে আত্মহত্যার প্রবণতা। এছাড়া করোনাভাইরাসের আগ্রাসন পূর্ণমাত্রায় থেমে গেলেও এর সামাজিক এবং অর্থনৈতিক বিপর্যয়ের দীর্ঘ প্রভাব আত্মহত্যার মিছিলকে আরও বড় করবে বলে আশঙ্কা বিশেষজ্ঞদের। করোনাভাইরাসকে কেন্দ্র করে ভিন্ন ভিন্ন কারণে আত্মহত্যার কয়েকটি উদাহরণ দেয়া যেতে পারে।
গত ২৯ মার্চ জার্মানির হোকহাইম শহরে রেললাইনের ওপর থেকে উদ্ধার করা হয় দেশটির হেসে প্রদেশের অর্থমন্ত্রী টমাস শাফের-এর মৃতদেহ। প্রাদেশিক মুখ্যমন্ত্রী ভলকার বুফের জানিয়েছেন, করোনাভাইরাসের পরিণতিতে অর্থনৈতিক চাপ কীভাবে সামাল দেওয়া যাবে, তা নিয়ে মন্ত্রী শেফার খুবই উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েছিলেন। অর্থনৈতিক সহযোগিতা নিয়ে মানুষের মধ্যে যে প্রবল চাহিদা তৈরি হয়েছে, সেটা তিনি পূরণ করতে পারবেন কি না তা নিয়ে সৃষ্ট হতাশা থেকেই অর্থমন্ত্রী আত্মহত্যা করেন।
দেশে দেশে লকডাউনের ঘটনায় কর্মহীন হয়ে পড়েছেন খেটে খাওয়া অসংখ্য মানুষ। সংসার কীভাবে চলবে তা নিয়ে উৎকণ্ঠায় আত্মহত্যার পথ বেছে নিচ্ছেন অনেকে। গত ২৭ মার্চ ভারত সঞ্চার নিগম লিমিটেডের (বিএসএনএল) চুক্তিভিত্তিক দুই কর্মী সুজয় ঘোষ ও অনুকূল রায় সংসার চালানোর চরম অনিশ্চয়তা আর হতাশা থেকে আলিঙ্গন করেন স্বেচ্ছামৃত্যুকে।
নিজে করোনাভাইরাসে আক্রান্ত, এমন ভাবনা থেকে ভাইরাসটি থেকে সন্তানদের রক্ষায় গত ১২ ফেব্রুয়ারি ভারতের অন্ধ্রপ্রদেশে গলায় ফাঁস দিয়ে আত্মহত্যা করেছেন বালা কৃষ্ণ নামে ৫০ বছর বয়সী এক ব্যক্তি। করোনা সংক্রমিত রোগীর চিকিৎসা দিতে গিয়ে তাতে নিজেই আক্রান্ত হন ইতালির ৩৪ বছর বয়সী এক নার্স। সংক্রমণ থেকে নিজের পরিবারকে রক্ষা করতে ড্যানিয়েল তেরেজ্জি নামে ঐ নার্স আত্মহত্যা করেন গত ২৬ মার্চ।
করোনা সন্দেহে সৌদি আরবে চীনের এক ছাত্রীকে আইসোলেশেনে রাখা হলে ভয় আর আতঙ্কে হাসপাতালের ছাদ থেকে লাফিয়ে আত্মহত্যা করেন। যদিও তার মৃত্যুর পর চূড়ান্ত রিপোর্টে জানা যায় যে, তিনি আসলে করোনাভাইরাসে আক্রান্ত ছিলেন না। গত ২ মার্চ ইন্দোনেশিয়ায় বসবাসকারী কোরিয়ার এক নারীও হোটেল রুমে গলায় ফাঁস দিয়ে আত্মহত্যা করেন। হোটেল রুম থেকে উদ্ধার করা তার লেখা সুইসাইড নোট থেকে জানা যায়, করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হওয়ায় আর কখনোই সুস্থ হওয়া যাবে না, এমন সন্দেহে ক্লান্তি আর অবসাদ তাকে নিয়ে যাচ্ছিল ঘোরের মধ্যে।
কোভিড-১৯ এ আক্রান্ত হওয়ার পর চিকিৎসায় অবহেলার কারণে মৃত্যুর ভয়েই গলায় ফাঁস লাগিয়ে আত্মহত্যার ঘটনা ঘটেছে চীনে। চারদিন ধরে জ্বরে ভুগছিলেন বাংলাদেশের মাগুরা জেলার আসলাম হোসেন নামে এক কৃষক। প্রতিবেশীরা ‘করোনা রোগী’ বলে রসিকতা করায় আতঙ্কিত হয়ে গেলে ২৪ মার্চ গলায় ফাঁস দিয়ে আত্মহত্যার পথ বেছে নেন তিনি।
ইমোরি ইউনিভার্সিটি স্কুল অব মেডিসিন-এর অধ্যাপক নাডাইন ক্যাসলো বলছেন,
যারা আগে থেকেই ভঙ্গুর মানসিকতায় বেঁচে আছেন, তাদের আত্মহত্যার জন্য কোভিড-১৯ উপস্থিত হয়েছে একটি চূড়ান্ত সময় হিসেবে। অর্থনৈতিক ঝুঁকি, সংসারে সন্তানদেরকে দেখভাল করতে না পারার যন্ত্রণা, অনিশ্চিত ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করে আত্মহত্যার পথে ধাবিত হচ্ছেন অনেকে।
এর আগে বিশ্বমন্দা, যুদ্ধ বা অন্য যেকোনো প্রাকৃতিক দুর্যোগের সময়গুলোতে চরম হতাশায় মানুষের মাঝে আত্মহত্যার প্রবণতা কাজ করলেও পারস্পারিক এবং সামাজিক সম্পর্কজনিত কারণে তার অনেকখানি নিয়ন্ত্রণে রাখা সম্ভব হয়েছে। কারণ যুদ্ধ বা অন্য কোনো প্রাকৃতিক দুর্যোগের সময়ে মানুষ সাধারণত একসাথে মিলিত হয়, সুখ-দুঃখ ভাগাভাগি করে নেয়। কিন্তু করোনাভাইরাসের ক্ষেত্রে বিষয়টি সম্পূর্ণ উল্টো। সামাজিক বিচ্ছিন্নতা নিজেকে শেষ করে দেয়ার জন্য একটি বড় অস্ত্র বলে মনে করেন মনোবিজ্ঞানীরা।
ইউনিভার্সিটি অব রচেস্টার মেডিক্যাল সেন্টারের সেন্টার ফর দ্য স্ট্যাডি অব প্রিভেনশন অব সুইসাইড-এর সমন্বয়ক এরিক কেইনের বক্তব্য মতে,
স্পষ্টত চোখের সামনে করোনাভাইরাসের মতো এমন কিছুতে আক্রান্ত হওয়ার ভয় কিংবা মৃত্যু ঝুঁকি আত্মহত্যার মতো প্রবণতার ডালপালা সম্প্রসারিত করছে। সামাজিক দূরত্বের মধ্যে খুব সহজেই চোখে পড়ে এমন ভয়ানক পরিস্থিতির।
ন্যাশনাল অ্যালায়েন্স অন মেন্টাল হেলথের পরিচালক জেফ ফ্লাডেন বলেছেন,
যারা কখনও আত্মহত্যার কথা কল্পনাই করেননি, এমন জনগোষ্ঠীর অসংখ্য মানুষের ফোনও আমাদের কাছে আসছে আত্মহত্যার প্রবণতা থেকে মুক্তির সাহায্যে। করোনাভাইরাসের অভিঘাতে তারা প্রত্যেকেই কোনো না কোনোভাবে ক্ষতিগ্রস্ত।
এ অবস্থায় আত্মহত্যার প্রবণতা থেকে যে কাউকে বাঁচাতে প্রয়োজন আইসোলেশনে শারীরিকভাবে দূরে থাকলেও মানসিকভাবে পরিবারের সদস্যদের একে অপরের খুব কাছে থাকা। প্রয়োজন নিয়মিত সবার খোঁজ খবর নেয়া, ফেসবুকের মতো সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে এসে অনেকর সাথে সব কিছু শেয়ার করা, তথ্য বিনিময় করা, বাড়িতেই শিশুদের স্কুলের কার্যক্রমগুলো চালিয়ে নেওয়া, বয়স্ক মানুষদের সাথে যোগাযোগটা আরও বাড়ানো। বয়স্কদের নানা ধরনের প্রয়োজন মেটাতে এগিয়ে আসা উচিত সামাজিক সংগঠনগুলোকেও।