১৯ বছর বয়স মুনিরের। ঢাকার স্থানীয় বাসিন্দা সে। পরিবারের সাথেই থাকে। পড়ে একটা বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে, প্রথম বর্ষে। তার বয়সী আর পাঁচটা সাধারণ তরুণের মতো তার জীবনাচরণও বড্ড ছন্নছাড়া। রাত আড়াইটা-তিনটার আগে ঘুমায় না সে।
কী করে সে ওই সময়? ওই তো, নেটফ্লিক্সে কোনো টিভি সিরিজ বিঞ্জ ওয়াচিং, মেসেঞ্জারে কারো সাথে সুখ-দুঃখের আলাপ, কিংবা নিছকই উদ্দেশ্যহীনভাবে ফেসবুকের নিউজফিড স্ক্রলিং। আর এসবের পর রাতের শেষ ভাগে ঘুমাতে গিয়ে, স্বাভাবিকভাবেই সকাল সাড়ে দশটা-এগারোটার আগে ঘুম দিয়ে উঠতে পারে না সে।
এই নিয়ে পরিবারে তুমুল অশান্তি। এই মায়ের ধমকানি তো খানিক বাদে বড় ভাইয়ের বক্রোক্তি। ভয়ে তো বাবার সামনে যাওয়াই যায় না। গেলেই যদি জিজ্ঞেস করে বসেন, “কী অবস্থা তোমার? আর কতদিন গায়ে হাওয়া লাগিয়ে ঘুরে বেড়াবে? জানো, তোমার বয়সে আমি…”
সব মিলিয়ে নিজের জীবন নিয়ে খুবই অসন্তুষ্ট মুনির। বলতে গেলে প্রায় নিজের ইচ্ছামতো জীবনই কাটাচ্ছে সে। তবু তার মনে হয়, কোথাও একটা যেন কিছু ঠিক নেই। পরম আকাঙ্ক্ষিত ‘ব্যক্তি-স্বাধীনতা’ নেই তার জীবনে। মাঝেমধ্যেই তার মনে এক অদ্ভূত খেয়াল খেলা করে যায়: কী মজাই না হতো, যদি পরিবারের বাইরে গিয়ে একদম একা একা, নিজের মতো একটা জীবন যাপন করা যেত!
কিন্তু শেষ পর্যন্ত এমনটা করতে পারে না মুনির। এর পেছনে বেশ কিছু কারণ আছে। প্রথমত, বাংলাদেশী পরিবারগুলোর পারিবারিক বন্ধনের শেকড় এতটা গভীরে যে, চাইলেই তা ছিন্ন করে একা হয়ে যাওয়া যায় না। দ্বিতীয়ত, দেশের সামাজিক অবস্থাও এই বিষয়টিকে সমর্থন করে না। ঢাকা শহরে নিজের পৈতৃক বাসা থাকতেও একটা ছেলে বা মেয়ে আলাদা থাকবে, তা কখনো হয় বুঝি! সন্দেহের বশে বাড়িওয়ালারাও তো এমন ছেলে বা মেয়েকে বাসা ভাড়া দিতে চাইবেন না। আর তৃতীয়ত, পারিবারিক বন্ধন এবং সামাজিক রীতিনীতিকে যদি বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখানো যায়ও, এই দেশে একটা বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া তরুণ বা তরুণীর কী এমন উপার্জন যে সে একাই একটা ফ্ল্যাট নিয়ে থাকতে পারবে? বড়জোর কোনো হোস্টেল বা মেসে নিজের একটা রুম বা সিট পেতে পারে সে, যেমনটি করে থাকে ঢাকার বাইরে থেকে আসা তরুণ-তরুণীরা। কিন্তু সম্পূর্ণ একটা ফ্ল্যাট নিজের করে পাওয়ার মতো আর্থিক সামর্থ তার না থাকার সম্ভাবনাই বেশি।
মুনির কিন্তু একা নয়। এমন ছেলে-মেয়ে আমাদের চারপাশে অসংখ্য রয়েছে। ব্যক্তি-স্বাধীনতার লোভে তারা পরিবারের থেকে আলাদা হয়ে থাকার স্বপ্ন দেখে বটে, কিন্তু সে স্বপ্ন অধরাই রয়ে যায়। আলাদা একটা বাসা বা ফ্ল্যাটে থাকার সুযোগ অধিকাংশ ক্ষেত্রেই হয় বিয়ের পর, তার আগে কখনোই নয়। এর মানে হলো, সত্যিকারের একা থাকা, যাকে বলে এক সদস্যের পরিবারে থাকা, এমন প্রচলন আমাদের দেশে নেই বললেই চলে।
এবং কেউ যেন ভাববেন না, এক সদস্যের পরিবার শুধু আমাদের দেশেই বিরল। পৃথিবীর বেশিরভাগ দেশেই এখনো এই প্রথাটি জাঁকিয়ে বসতে পারেনি। বরং যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্যের মতো দেশেও তরুণ-তরুণীদের সপরিবারে থাকার প্রবণতা দিন দিন বাড়ছে।
আমরা ভাবি, আধুনিক যুগে পশ্চিম বিশ্বে হয়তো বাবা-মায়ের সাথে সন্তানদের দূরত্ব ক্রমশ বেড়ে চলেছে। অথচ পরিসংখ্যান বলছে একেবারেই ভিন্ন কথা। সম্প্রতি পিউ রিসার্চ সেন্টার কর্তৃক আদমশুমারি বিশ্লেষণ করে দেখানো হয়েছে, যুক্তরাষ্ট্রে ১৯৪০ সালের পর থেকে তরুণ-তরুণীদের বাবা-মায়ের সাথে থাকার প্রবণতা উর্ধ্বমুখী। এদিকে ব্রিটিশ থিংক ট্যাংক সিভিটাস ২০১৯ সালে প্রকাশিত তাদের এক গবেষণা প্রবন্ধে জানিয়েছে, ১৯৯৮ সালে যেখানে যুক্তরাজ্যের মাত্র ৩৭ শতাংশ ২৩ বছর বয়সী তরুণ-তরুণীরা বাবা-মায়ের সাথে থাকত, এক দশকের মাথায় তা বেড়ে দাঁড়িয়েছিল ৪৯ শতাংশে।
ইউরোস্ট্যাট হতে প্রাপ্ত উপাত্ত অনুযায়ী, সামগ্রিকভাবে ইউরোপিয়ান ইউনিয়নভুক্ত দেশগুলোতেও তরুণ প্রজন্মের পরিবার তথা বাবা-মায়ের সঙ্গ ছেড়ে বেরিয়ে আসার গড় বয়স ২৬। এমনকি ইটালি ও ক্রোয়েশিয়ার মতো দেশগুলোতে তো মানুষ গড়ে ৩০ বছরেরও বেশি বয়স পর্যন্ত বাবা-মায়ের সাথে এক পরিবারে থাকে।
ব্যতিক্রম শুধু একটি দেশ, সুইডেন। বয়স গড়ে ১৮ পেরোতে না পেরোতেই তারা পরিবার ছেড়ে একা বাস করতে শুরু করে দেয়। পুরুষদের বেলায় পরিবার ত্যাগের গড় বয়স ১৮.৪, এবং নারীদের বেলায় ১৮.৫। ইউরোপিয়ান ইউনিয়ানের আর কোনো দেশের তরুণ-তরুণীরাই গড়ে ২০ বছর বয়সের আগে নিজ পরিবার ত্যাগ করে না।
২০১৮ সালের মে মাসে প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে জানা যায়, সুইডেনের ৪৭ শতাংশ পরিবারেই মাত্র একজন সদস্য বাস করে, এমনকি কোনো শিশুও থাকে না সেখানে। বলাই বাহুল্য, একা থাকা এমন মানুষদের অধিকাংশই তরুণ প্রজন্মের, যাদের বয়স ৩০-এর কম। এছাড়া ২০১৬ সালে ইউরোস্ট্যাটে প্রকাশিত তালিকা ছিল আরো বেশি চমকপ্রদ। সেই তালিকা অনুযায়ী, দেশটির অর্ধেকের বেশি পরিবারই ছিল এক সদস্য বিশিষ্ট। দ্বিতীয় ও তৃতীয় সর্বোচ্চ, লিথুনিয়া ও ডেনমার্কের চেয়ে সুইডেনের এক সদস্য বিশিষ্ট পরিবার ছিল প্রায় ১০ শতাংশ বেশি।
অতি অল্প বয়সে সুইডিশদের নিজ পরিবার ত্যাগ করে একা, আলাদা বাসায় থাকতে চাওয়ার প্রবণতার কারণে সেখানে আবাসন ব্যবস্থার তীব্র সংকট দেখা দিচ্ছে। চাহিদার তুলনায় একা মানুষের উপযোগী ছোট ফ্ল্যাটের সংখ্যা পরিমিত নয়। তাই যেসব ফ্ল্যাট পাওয়া যায়, সেগুলো অধিগ্রহণের জন্য প্রতিযোগীর সংখ্যা থাকে অনেক বেশি, এবং বাকি প্রতিদ্বন্দ্বীদের টপকে ফ্ল্যাটটি নিজের করে নিতে পকেট থেকে বিপুল অংকের অর্থই খসাতে হয়। শুধু এখানেই শেষ নয়। বাড়িওয়ালা কিংবা হাউজিং কোম্পানিদের সাথে দীর্ঘমেয়াদী চুক্তিও করে নিতে হয়, যেন তারা হুট করে কোনো একদিন সিদ্ধান্ত নিতে না পারে যে আর একা থাকবে না, ফিরে যাবে নিজ পরিবারের কাছে।
স্বভাবতই মনে প্রশ্ন জাগে, কেন সুইডিশদের মাঝে এমন ভীষণ তাড়াহুড়া? কেন প্রাপ্তবয়স্ক হওয়ামাত্রই তাদেরকে পরিবার ত্যাগ করে একা থাকতে হবে? এর নেপথ্যের কারণ ব্যাখ্যা করেছেন গানার অ্যান্ডারসন। তিনি স্টকহোম ইউনিভার্সিটির ডেমোগ্রাফির অধ্যাপক। তার ভাষ্যমতে, সুইডিশ ও অন্যান্য নর্ডিকদের মাঝে ‘আত্মনির্ভরশীল’ হতে চাওয়ার প্রবণতা সবচেয়ে বেশি।
সুইডিশ, এবং অন্যান্য নর্ডিকদের জন্য পরিবার ত্যাগের বিষয়টি একটু বেশিই স্পেশাল। ইউরোপের অন্যান্য দেশে পরিবারের উপর নির্ভরশীল হওয়াকে কখনোই সমস্যা বলে গণ্য করা হয় না। দক্ষিণ ইউরোপের অনেক দেশে তো পরিবারের সাথে থাকাকেই প্রধান লক্ষ্য হিসেবে বিবেচনা করা হয়। সেখানে বিষয়টি এমন যে, আপনি যদি পরিবারের সাথে বাস না করেন বা তাদের উপর নির্ভরশীল না হন, তার মানে আপনি নিজের পরিবারকে উপেক্ষা করছেন। কিন্তু সুইডেনে প্রতিটি মানুষের লক্ষ্য থাকে ব্যক্তি-স্বাধীনতা সৃষ্টি করা। কোনো সন্তান যদি (প্রাপ্তবয়স্ক হয়ে যাওয়ার পরও) পরিবারের সাথে থাকে, তাহলে মানুষ মনে করে তার বুঝি কোনো সমস্যা রয়েছে।
সুতরাং অধ্যাপক অ্যান্ডারসনের কথা থেকে যা বোঝা যাচ্ছে, আমাদের দেশের তরুণদের যে সমস্যা, সুইডিশ তরুণদের সমস্যা তার একদম ১৮০ ডিগ্রি উল্টো। আমাদের দেশে, কিংবা পৃথিবীর অন্য অনেক দেশেই, পরিবার ছেড়ে একা থাকাকে যেখানে সমাজ কর্তৃক অনুৎসাহিত করা হয়, সুইডেনে সেখানে পরিবার ত্যাগ করাটাই সামাজিক নিয়ম।
এ কথাও অনস্বীকার্য যে, সুইডিশ তরুণ-তরুণীরা এত তাড়াতাড়ি পরিবার ত্যাগ করে বলে, তাদের মধ্যে ব্যক্তি-স্বাধীনতা সত্যিই অনেক বেশি। তারা এমন একটি জীবনের স্বাদ আস্বাদন করে, আমাদের দেশের তরুণ-তরুণীরা যে জীবনের স্বপ্নই শুধু দেখতে পারে। তারা যেকোনো ক্ষেত্রে নিজে সিদ্ধান্ত নিতে পারে, নিজের যা মন চায় তা-ই করতে পারে। কেউ তাদের কাজকে প্রশ্নবিদ্ধ করে না, অহেতুক হস্তক্ষেপও করে না। অর্থাৎ নিজেদের জীবনের প্রকৃত চালক হয় তারা নিজেরাই, এবং নিজেদের ইচ্ছামাফিক তারা সেই জীবনকে ঢেলে সাজাতে পারে।
সুইডিশ তরুণ-তরুণীরা যে কেবল নিজ পরিবারই ত্যাগ করে, তা কিন্তু নয়। পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, পরিবার ছেড়ে আসা তরুণ-তরুণীদের মাঝে খুব কম সংখ্যকই পরবর্তী সময়ে তাদের অন্যান্য আত্মীয়-স্বজনের সাথে যোগাযোগ বহাল রেখেছে। অর্থাৎ পরিবার ত্যাগের সাথে সাথে তারা সামাজিকতাকেও বিদায় জানাচ্ছে। পাশাপাশি নিজেদের কাজের জায়গার বাইরে বন্ধু-বান্ধবের সাথেও তাদের সশরীরে সাক্ষাৎ ইদানিং খুব কমই হয়, যেহেতু অনলাইনে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের প্ল্যাটফর্মগুলোই সুযোগ করে দিচ্ছে সবার সাথে ভার্চুয়ালি সংযুক্ত থাকার।
কিন্তু এখন প্রশ্ন হলো, একা একা থাকতে গিয়ে সুইডেনের তরুণ প্রজন্ম কি একাকিত্বে ভোগে না? একা থাকা ও একাকী বোধ করা সম্পূর্ণ ভিন্ন দুটি ধারণা হলেও, কখনো কি এই দুই ধারণা এসে এক স্রোতে মিশে যায় না? নিশ্চয়ই যায়, এবং তার জ্বলজ্বলে দৃষ্টান্ত সুইডিশ তরুণ-তরুণীরাই।
এখানে আমরা উদাহরণ টানতে পারি জনৈক সুইডিশ তরুণীর। মাত্র ২৫ বছরের জীবনেই তিনি সম্পূর্ণ বিপরীতধর্মী দুটি আবেগের সম্মুখীন হয়েছেন। টিনেজ বয়সের শেষ ভাগে, এবং বয়স ২০ স্পর্শের পর পর তার মনে তীব্র আকাঙ্ক্ষা জাগত একা থাকতে চাওয়ার। কারণ তখনো তিনি পরিবারের সাথেই বাস করতেন। এবং একা থাকতে চাওয়ার সেই তীব্র আকাঙ্ক্ষা নিয়েই তিনি একপর্যায়ে একা থাকা শুরু করেছিলেন। প্রথম কিছুদিন বেশ ভালোই ছিলেন তিনি। কিন্তু তারপরই শুরু হলো সমস্যা। একা থাকার ‘হানিমুন পিরিয়ড’ শেষ হতেই তিনি ভুগতে শুরু করলেন একাকিত্বে। এখন আর তার কাছে একা থাকার ধারণাটিকে অত বেশি আকর্ষণীয় বলে মনে হয় না। বরং পরিবারের সাথে কাটানো সময়গুলোকেই তার কাছে অনেক বেশি বর্ণিল লাগে।
এই তরুণীর উদাহরণ থেকে নিশ্চয়ই অনেকের মনের কোণেই উঁকি দিয়ে যাচ্ছে রবি ঠাকুরের সেই অমর পঙক্তিগুলো:
নদীর এপার কহে ছাড়িয়া নিশ্বাস,
ওপারেতে সর্বসুখ আমার বিশ্বাস।
নদীর ওপার বসি দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে;
কহে, যাহা কিছু সুখ সকলি ওপারে।
একা থাকার সমস্যা কেবল আবেগিক ক্ষেত্রেই সীমাবদ্ধ নেই। এর রয়েছে বিভিন্ন ব্যবহারিক দিকও। যেমন ধরা যাক, ২৩ বছর বয়সী এক সুইডিশ তরুণের কথা। পরিবারের সাথে যখন তিনি থাকতেন, সাংসারিক খুব কম বিষয় নিয়েই তাকে মাথা ঘামাতে হতো। কারণ তার হয়ে মাথা ঘামানোর জন্য ছিলেন তার বাবা-মা। কিন্তু এখন গোটা সংসারের দায়িত্ব তার একার কাঁধে। প্রতিদিন ফ্ল্যাট ঝাড়পোঁছ করা তো রয়েছেই, সেই সাথে রান্নার কোন জিনিস কতটুকু আছে আর কোন জিনিস কতটুকু বাজার করে আনতে হবে, সব চিন্তাই এখন তার একার মাথায়। বিদ্যুৎ বিল, গ্যাস বিল, ইন্টারনেট বিল পরিশোধের দায়িত্বও কেবল তারই। কেউ নেই যে তাকে এসব বিষয়ে সাহায্য করবে। তাই আজকাল প্রায়ই তার মনে হয়, ব্যক্তিস্বাধীনতা কি সত্যিই সুখের? পুরোপুরি নিজের উপর নির্ভরশীল হতে গিয়ে তিনি জীবনের প্রকৃত সুখকে বিসর্জন দিয়ে দিচ্ছেন না তো?
তবে ওই যে কথায় আছে না, সমস্যা যেখানে আছে, সেখানে উপায়ও আছে। তাই একা থাকার এই সমস্যারও আপাত সমাধান বের করে ফেলেছে সুইডিশরা। তারা উদ্ভাবন করেছে কো-লিভিং নামক একটি নতুন ধারণার। এই ধারণার মূল বিষয়বস্তু হলো: তরুণরা পরিবারের সাথে থাকবে না বটে, কিন্তু তাই বলে তারা পুরোপুরি একাও থাকবে না। তারা তাদের ফ্ল্যাট শেয়ার করে নেবে অন্য কোনো সঙ্গীর সাথে।
এই ধারণাকে উপজীব্য করে চালু হয়েছে কোলিভ নামক একটি কোম্পানিও। তাদের রয়েছে নিজস্ব একটি অ্যাপ। সেই অ্যাপ ব্যবহার করে স্টকহোমের ১৮ থেকে ৩৫ বছর বয়সীরা চাইলে তাদের সঙ্গী বেছে নিতে পারবে, যেই সঙ্গীর সাথে তারা এক ছাদের নিচে বসবাস করবে। অনেকটা ম্যাট্রিমোনিয়াল সাইটগুলোর মতো মনে হতে পারে এই অ্যাপের কার্যক্রমকে। আর সঙ্গী বেছে নেয়ার ব্যবস্থাটিকেও অনেকে তুলনা করতে পারেন কারো সাথে বৈবাহিক সম্পর্কে আবদ্ধ হওয়ার সাথে। অর্থাৎ ঘুরেফিরে সেই পরিবারের বাইরে এসে আলাদা একটি পরিবার গঠনের রাস্তাই দেখাচ্ছে কোলিভ। ফলে অনেকেই বিদ্রুপ করে বলছেন, এমনই যদি করবে, তবে নিজ পরিবারের সাথে থাকলেই বা ক্ষতি কী ছিল! এ কারণেই কো-লিভিংয়ের ধারণাটি কতটুকু মূলধারায় আসতে পারবে, সে ব্যাপারে সন্দেহের অবকাশ রয়েই যায়।
বিয়ের কথা যেহেতু চলেই এলো, এই ফাঁকে তবে আরেকটি তথ্যও জানিয়ে রাখা যাক। ব্যক্তি-স্বাধীনতা ও আত্মনির্ভরশীলতায় বিশ্বাসী সুইডিশরা কিন্তু বিয়ে নামক প্রতিষ্ঠানটিকেও খুব একটা গুরুত্ব দেয় না। এ কারণেই বিবাহ বিচ্ছেদের হারের (২.৫) বৈশ্বিক তালিকায় উপরের দিকেই রয়েছে সুইডেনের অবস্থান (৫ম)। তাছাড়া বিয়ের প্রতি তাদের অনাগ্রহও প্রকাশ পায় অনেক দেরিতে প্রথম বিয়ের চিত্র দেখে। সুইডেনের নারীরা গড়ে ৩৩ বছর, এবং পুরুষরা গড়ে ৩৫.৭ বছর বয়সে প্রথম বিয়ে করে (যুক্তরাষ্ট্রে নারী ও পুরুষরা গড়ে যথাক্রমে ২৭ ও ২৯ বছর বয়সে বিয়ে করে)।
তাহলে দেখতেই পাচ্ছেন, পরিবার, বিয়ে এবং সামাজিকতা রক্ষার মতো বিষয়গুলোতে কতটা উদাসীন সুইডিশরা। তাই সে দেশের তরুণ প্রজন্ম যে প্রাপ্তবয়স্ক হওয়ার পরই একা থাকতে চাইবে, তাতে আর আশ্চর্য হওয়ার কী আছে!
একা হোক বা দোকা, সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো সুখী থাকা। এবং সুইডিশরা সব মিলিয়ে সুখীই আছে। তাই তো ওয়ার্ল্ড হ্যাপিনেস ইনডেক্স ২০১৯ অনুযায়ী তাদের অবস্থান ৭ম। এরপরও কি তাদের একা থাকতে, কিংবা পরিবার, বিয়ে, সামাজিকতাকে উপেক্ষা করে ব্যক্তিস্বাধীনতা ও আত্মনির্ভরশীলতার পেছনে ছুটতে দেখে নাক সিঁটকাবেন?
বিশ্বের চমৎকার সব বিষয়ে রোর বাংলায় লিখতে আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন এই লিঙ্কেঃ roar.media/contribute/