আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে আগ্রহ আছে এমন সবার মনেই কখনও না কখনও খুব সাধারণ একটি প্রশ্ন উঁকি দিয়ে গেছে, আর তা হলো: তাইওয়ান কি স্বাধীন কোনো দেশ, নাকি চীনেরই একটি অংশ? সম্প্রতি (২ জানুয়ারি, ২০১৯) চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং পরিষ্কারভাবে জানিয়ে দিয়েছেন, তাইওয়ান খুব শীঘ্রই চীনের সাথে পুনরায় একীভূত হয়ে যাবে। মূলত তাইওয়ান চীনেরই একটি অংশ এবং এ সত্য কেউ পরিবর্তন করতে পারবে না।
আসলেই কি তাই? মূল সত্যটি কি এতটাই সহজ-সরল? মোটেই না। চীন তাইওয়ানকে নিজেদের অংশ মনে করলেও তাইওয়ান কিন্তু নিজেদেরকে একটি স্বাধীন দেশ হিসেবেই বিবেচনা করে। সেই ১৯৫০ সাল থেকেই তাইওয়ান একটি স্বাধীন দেশের ন্যায় ব্যবহার করে আসছে, এবং নতুন বছরের শুরুর দিনই দেশটির প্রেসিডেন্ট সাই ইং-ওয়েন সাফ জানিয়ে দিয়েছেন, বেইজিংকে অবশ্যই তাইওয়ানের অস্তিত্ব মেনে নিয়ে, সকল বিবাদ মিটিয়ে একটি শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান সৃষ্টি করতে হবে।
এই লেখায় আমরা আলোচনা করবো চীন ও তাইওয়ানের অতীত ইতিহাস, বর্তমানে বিদ্যমান সম্পর্ক ও বিরোধ, এবং দুই দেশের ভবিষ্যৎ প্রসঙ্গে। তবে তার আগে আপনাদের সামনে হাজির করবো চমকপ্রদ একটি তথ্য। এই মুহূর্তে চীনকে প্রতিনিধিত্ব করছে আলাদা দুটি প্রশাসন। একটির নাম রিপাবলিক অব চায়না, যা দ্বারা তাইওয়ানকে বোঝানো হয়। আর অপরটির নাম পিপলস রিপাবলিক অব চায়না, যা দ্বারা চীনের মূলভূমিকে বোঝানো হয়, অর্থাৎ আমরা স্বাভাবিক অর্থে চীন বলতে যে দেশটিকে বুঝে থাকি। বিশ্বাস না হলে গুগল করেই নিশ্চিত হয়ে নিতে পারেন!
ইতিহাস
প্রথমেই একটি বিষয় খোলাসা করা দরকার। তাইওয়ান কিন্তু ভৌগোলিকভাবেই চীনের মূল ভূখন্ড থেকে বিচ্ছিন্ন একটি দ্বীপ, যার অবস্থান দক্ষিণ চীন সমুদ্রে। এই দ্বীপের আদি নাম ছিল ফরমোসা। সপ্তদশ শতকের আগপর্যন্ত এখানে কেবল আদিবাসীদের বাস ছিল। এরপর এখানে ওলন্দাজ ও স্প্যানিশরা উপনিবেশ গড়ে তোলে। তবে ১৬৮৩ সালে দ্বীপটি চীনের সর্বশেষ সাম্রাজ্য অর্থাৎ কিং সাম্রাজ্যের দখলে চলে যায়। কিন্তু প্রথম সাইনো-জাপানী যুদ্ধে হেরে যাওয়ার পর কিংরা জাপানের কাছে ছেড়ে দেয় দ্বীপটি। এরপর তাইওয়ান জাপানের অধীনে থাকাকালীন সময়েই ১৯১২ সালে কিং সাম্রাজ্যের পতনের পর চীনের মূলভূমিতে গড়ে ওঠে রিপাবলিক অব চায়না।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষে ১৯৪৫ সালে জাপান মিত্রশক্তির কাছে আত্মসমর্পণ করলে রিপাবলিক অব চায়না তাইওয়ান দখল করে। কিন্তু এরপরই চীনে শুরু হয় গৃহযুদ্ধ, যেখানে রিপাবলিক অব চায়নার মুখোমুখি হয় মাও সে তুংয়ের নেতৃত্বাধীন কমিউনিস্টরা। ১৯৪৯ সাল নাগাদ চীনের সমগ্র মূলভূমিই চলে যায় কমিউনিস্টদের দখলে, যারা গড়ে তোলে পিপলস রিপাবলিক অব চায়না। ১৯৫০ সালে হাইনান দ্বীপের দখলদারিত্বও তারা নিয়ে নেয়। অন্যদিকে রিপাবলিক অব চায়নার নিয়ন্ত্রণে অবশিষ্ট থাকে কেবল তাইওয়ান।
১৯৫০ সাল থেকেই রিপাবলিক অব চায়না তাইওয়ানকে স্বাধীন ঘোষণা দিয়ে আসছে, পাশাপাশি নিজেদেরকে সমগ্র চীনের বৈধ অধিকারী হিসেবেও দাবি করে আসছে। রাজনৈতিক ও প্রশাসনিকভাবে তা সম্ভব না হলেও, প্রতিষ্ঠাতা সদস্য হিসেবে ১৯৭১ সাল পর্যন্ত জাতিসংঘে সমগ্র চীনের প্রতিনিধিত্ব করে এসেছে এই রিপাবলিক অব চায়নাই। কিন্তু ১৯৭১ সালে জাতিসংঘ পিপলস রিপাবলিক অব চায়নাকে স্বীকৃতি দেয়, এবং রিপাবলিক অব চায়নার সদস্যপদ কেড়ে নেয়। সেই থেকে তাইওয়ান জাতিসংঘের বাইরে আছে। তাইওয়ানই এই মুহূর্তে জাতিসংঘের বাইরে থাকা বিশ্বের সবচেয়ে জনবহুল ও বৃহত্তম অর্থনীতির দেশ।
কেমন আছে তাইওয়ান?
জাতিসংঘের অন্তর্ভুক্ত না হলেও দেশ হিসেবে তাইওয়ান কিন্তু মোটেই পিছিয়ে নেই। ১৯৬০ এর দশকের শুরু থেকেই তাইওয়ানে ব্যাপক অর্থনৈতিক অগ্রগতি ও শিল্পায়নের সূচনা ঘটে, যার ফলে দেশটিতে একটি স্থিতিশীল শিল্প-অর্থনীতি ব্যবস্থা গড়ে ওঠে। ১৯৯০ এর দশকের গোড়ার দিকে দেশটি একদলীয় সেনাশাসন থেকে বেরিয়ে এসে সেমি-প্রেসিডেন্সিয়াল ব্যবস্থার বহুদলীয় গণতন্ত্রের পথে পা বাড়ায়।
আয়তন মাত্র ৩৫,৮৮৭ বর্গ কিলোমিটার হলেও, এই মুহূর্তে তাইওয়ান বিশ্বের ২২ তম বৃহত্তম অর্থনীতির দেশ। দেশটির উন্নত প্রযুক্তি শিল্প বিশ্ব অর্থনীতিতে বড় ভূমিকা রাখছে। গণমাধ্যমের স্বাধীনতা, স্বাস্থ্যসেবা, শিক্ষা, অর্থনৈতিক স্বাধীনতা, মানব উন্নয়নসহ সম্ভাব্য সকল সূচকেই দেশটি অনেক এগিয়ে আছে। দেশটির উন্নয়নের পেছনে প্রধান ভূমিকা রেখেছে দক্ষ জনশক্তি। পাশাপাশি বিশ্বের সবচেয়ে শিক্ষিত দেশগুলোর একটিও এখন তাইওয়ান।
তাহলে তাইওয়ান কি আসলেই স্বাধীন?
এই প্রশ্নের উত্তর হ্যাঁ-ও হতে পারে, আবার না-ও হতে পারে, এবং সেটি নির্ভর করছে আপনার দৃষ্টিভঙ্গির উপর। তাইওয়ানের বর্তমান সরকারব্যবস্থা সম্পূর্ণ স্বাধীন ও সক্রিয়। বেইজিংয়ের থেকে এই দেশের অর্থনীতি ও মুদ্রাব্যবস্থাও একেবারেই ভিন্ন। তাছাড়া সকল সূচকে তাইওয়ান কতটা এগিয়ে আছে, তা-ও তো খানিক আগেই জেনেছেন। কিন্তু তারপরও ‘স্বাধীনতা’ শব্দটি ভীষণ ভারি, তাই এত সহজেই এক্ষেত্রে কোনো সিদ্ধান্তে আসা সম্ভব না।
২ কোটি ৩০ লক্ষ জনসংখ্যার দেশ তাইওয়ানের সবচেয়ে বড় দুর্বলতা এর পররাষ্ট্রনীতি। ১৯৯২ সাল থেকেই চীনের মূলভূমির সকল সরকারই ‘এক চীন’ নীতিতে বিশ্বাসী, অর্থাৎ তারা তাইওয়ানকে স্বাধীন দেশ হিসেবে স্বীকৃতি দিচ্ছে না, নিজেদের অংশ বলেই মনে করছে। বহির্বিশ্বের অন্য কোনো দেশের সাথে তাইওয়ানের কূটনৈতিক সম্পর্ক বজায় থাকুক, এটাও চায় না তারা। তাই এই মুহূর্তে মাত্র ১৭টি দেশের সাথে তাইওয়ানের কূটনৈতিক সম্পর্ক রয়েছে। কোনো এশীয় দেশের সাথেই তাদের কূটনৈতিক সম্পর্ক নেই। তবে কূটনৈতিক সম্পর্ক না থাকলেও বাংলাদেশের সাথে বাণিজ্যিক সম্পর্ক রয়েছে দেশটির। দক্ষিণ এশিয়ায় বাংলাদেশ তাদের দ্বিতীয় ঘনিষ্ঠ বাণিজ্যিক অংশীদার।
তাইওয়ানের সাথে কূটনৈতিক সম্পর্ক গড়লে মূল চীনের সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করতে হবে, এমন আশঙ্কায় বেশিরভাগ দেশই তাইওয়ানের সাথে আনুষ্ঠানিকভাবে সম্পর্কে জড়াতে চায় না। ফলে অধিকাংশ দেশই তাইওয়ানের সাথে অনানুষ্ঠানিক সম্পর্ক বজায় রেখেছে। এখানে বেশিরভাগ দেশেরই দূতাবাস নেই। তার পরিবর্তে রয়েছে বিভিন্ন অনানুষ্ঠানিক দূতাবাস। কেবল তাইওয়ানের সাথে কূটনৈতিক সম্পর্ক রয়েছে এমন দেশগুলোর পাসপোর্টধারীদের পক্ষেই এ দেশে প্রবেশ সম্ভব। জাতিসংঘসহ বড় কোনো আন্তর্জাতিক সংস্থাও চীনের উপস্থিতিতে তাইওয়ানকে সদস্যপদ দিতে নারাজ। এমনকি চীনের চাপে পড়ে গত বছর বিশ্বের শীর্ষস্থানীয় এয়ারলাইন্স ও হোটেলগুলো তাদের ওয়েবসাইটে তাইওয়ানকে আলাদা একটি দেশের পরিবর্তে চীনের একটি প্রদেশ হিসেবে দেখাতে বাধ্য হয়েছে।
অর্থাৎ একটি স্বাধীন দেশ হওয়ার সকল উপাদান তাইওয়ানের মধ্যে বিদ্যমান থাকা সত্ত্বেও আন্তর্জাতিক মহলের পরিপূর্ণ স্বীকৃতি দেশটি এখনও পায়নি। রিপাবলিক অব চায়না নিজেরাই নিজেদেরকে স্বাধীন দেশ হিসেবে ঘোষণা দিয়ে আসলেও বিশ্ববাসীর কাছ থেকে তারা সর্বসম্মতিক্রমে সমর্থন কখনোই পায়নি, এবং অদূর ভবিষ্যতেও পাওয়ার সম্ভাবনা ক্ষীণ।
চীন-তাইওয়ান সম্পর্কের ভবিষ্যৎ কী?
২০১৬ সালে ক্ষমতায় আসেন তাইওয়ানের বর্তমান প্রেসিডেন্ট সাই। এরপর থেকেই চীনা সরকার তার উপর প্রচন্ড চাপ প্রয়োগ করে আসছে। তারা তাইওয়ানের সাথে সংলাপ বন্ধ করে দিয়েছে, যে কয়টি দেশের সাথে তাইওয়ানের কূটনৈতিক সম্পর্ক রয়েছে তাদেরকেও ক্রমাগত হুমকি-ধামকি দিয়ে আসছে।
যদিও সাই জানিয়েছেন, তিনি তাইওয়ানের বর্তমান অবস্থা নিয়েই সন্তুষ্ট, কিন্তু চীনা সরকার ভয় পাচ্ছে, তিনি হয়তো যেকোনো মুহূর্তে তাইওয়ানের আনুষ্ঠানিক স্বাধীনতা ঘোষণা করে দেবেন। তা যাতে না হয়, এজন্য বেইজিং থেকে সবসময় তাইওয়ানের আকাশসীমার আশেপাশে মিলিটারি এয়ারক্র্যাফট ও জলসীমার চারদিকে জাহাজ পাঠানো হচ্ছে। ফলে সাইয়ের দাবি, দ্বীপরাষ্ট্রটির আভ্যন্তরীণ রাজনীতি ও সামাজিক উন্নয়নে চীনের হস্তক্ষেপই তাইওয়ানের জন্য এই মুহূর্তে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ। তবে চীন তা স্বীকার করতে নারাজ। তাদের মতে, তাইওয়ান তাদের নিজেদেরই আওতাধীন একটি প্রদেশমাত্র, তাই প্রয়োজনে সর্বশক্তি প্রয়োগ করে তারা তাইওয়ানের দখল নিয়ে নিতে প্রস্তুত।
বোঝাই যাচ্ছে, গণতান্ত্রিক তাইওয়ানের কোনো ইচ্ছাই নেই চীনের অধীনে যাওয়ার। কিন্তু তাইওয়ানের সাধারণ মানুষ স্বাধীনতার প্রশ্নে অনেকটাই উদাসীন। তারা এখন যেমন আছে তাতে খুবই সন্তুষ্ট, কিন্তু যদি চীনের অধীনে চলে যেতে হয়, তাহলেও তাদের খুব একটা আপত্তি নেই। অন্যদিকে সাংস্কৃতিক, সামাজিক ও অর্থনৈতিকভাবে তাইওয়ান ও চীনের সাধারণ মানুষের যোগাযোগ এতটাই দৃঢ় যে, তাইওয়ানের একাংশ এখন মনে করছে তাদের দেশ চীনের অধীনে চলে গেলে নেহাত মন্দ হয় না, বরং সেটিই বাস্তবসম্মত সম্ভাবনা!
দ্বিমুখী অবস্থানে তাইওয়ানের প্রধান দুটি রাজনৈতিক দলও। ‘ডেমোক্রেটিক প্রোগ্রেসিভ পার্টি’র অবস্থান স্বাধীনতার পক্ষে হলেও, ‘কুওমিনটাং পার্টি’ মনে করে চীনের সঙ্গে একত্রীকরণই শ্রেয়।
ফলে একটি ব্যাপার দিনের আলোর মতো পরিষ্কার যে, চীন যদি হঠাৎ একদিন তাইওয়ানের দখল নিয়ে নিতে চায়, সেক্ষেত্রে তারা যেমন আন্তর্জাতিক মহল থেকে তেমন বিরোধিতার সম্মুখীন হবে না, তেমনই তাইওয়ানের সাধারণ জনগণ ও রাজনৈতিক একাংশও তাদেরকে সমর্থন দেবে। সুতরাং বিগত ৬৮ বছর ধরে তাইওয়ান তথাকথিত স্বাধীনতার বড়াই করে আসলেও, ভবিষ্যতে যেকোনো সময়েই হয়তো তারা সেই স্বাধীনতা হারিয়ে বসবে।
চমৎকার সব বিষয়ে রোর বাংলায় লিখতে আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন এই লিঙ্কে: roar.media/contribute/