“A mari usque ad mare”- ল্যাটিন এই কথাটির অর্থ করলে দাঁড়ায় “Sea to sea” বা “সমুদ্র থেকে সমুদ্র”। কানাডার এই নীতিবাক্যটি দেখলেই আন্দাজ করে নেওয়া যায়, এই দেশটির সাথে সমুদ্র ওতপ্রোতভাবে জড়িত। আসলেই তা-ই! পৃথিবীর মানচিত্রে দেশটির দিকে তাকালে দেখা যাবে, একে ঘিরে আছে নীল জলরাশির সাগর। দেশটির পূর্বে রয়েছে আটলান্টিক সাগর, পশ্চিমে প্যাসিফিক সাগর এবং উত্তরে আর্কটিক সাগর। পৃথিবীর দ্বিতীয় বৃহত্তম এই দেশটিতে বছরের প্রায় আট মাস শীতকাল থাকে এবং এই সময়টাতে এখানে প্রচুর বরফ পড়ে। কানাডার শিক্ষার হার শুনলে অনেকের মাথা ঘুরে যাবার উপক্রম হয়। প্রতি ১০০ জনে ৯৯ জন মানুষ এখানে শিক্ষিত! কল্পনা করা যায়? শিক্ষার হারের দিক থেকে বিশ্বে প্রথম অবস্থানে থাকা এই দেশটির মানুষের থেকে আমাদের শেখার এবং জানার আছে অনেক কিছুই। চলুন, দেখে নেওয়া যাক এমনই কিছু বিষয়!
১.
ল্যাব রিপোর্ট সাবমিট করার শেষ দিন আজ। অনেক ভয়ে ভয়ে গেলাম ল্যাব করার জন্য। কারণটা নিশ্চয় বুঝতেই পারছেন? সারারাত ধরে লেখার পরেও সবগুলো রিপোর্ট তৈরি করা হয়নি। কীভাবে কী করা যায় ভেবে ভেবে যখন আমি অস্থির, ঠিক তখনই স্যার এসে জিজ্ঞাসা করলেন, “আজকে কি তুমি ল্যাব রিপোর্ট সাবমিট করতে চাও?” আমি তো খুশিতে আত্মহারা! স্যার কী বলছেন এসব? নিজের কানকেই যেন বিশ্বাস করতে কষ্ট হচ্ছে। আমার উত্তর যে ‘না’ হবে তা বোধহয় আর বলার অপেক্ষা রাখে না।
উপরের পুরো ঘটনা কাল্পনিক। আমাদের দেশে এমন অবস্থা কখনো কল্পনা করা যায় না। কিন্তু কানাডায় এ ধরনের ব্যাপার একেবারে স্বাভাবিক। সেখানে শিক্ষক এসে আপনাকে জিজ্ঞাসা করতে পারেন, তুমি দাঁড়াতে চাও কি না। কিন্তু তার মানে এই নয় যে আপনি এই প্রশ্নের উত্তরে ‘না’ কিংবা ‘হ্যাঁ’ বলবেন। এই কথার মানে হলো আপনাকে দাঁড়াতে বলা হচ্ছে। কিংবা কেউ একজন আপনাকে বলছে, আপনি কি তাকে তার বইটি ফেরত দিতে চান কি না। এই কথার অর্থ আপনি তাকে তার বইটি ফেরত দিন! কানাডিয়ানদের ভদ্রতা প্রকাশের ছোট্ট একটি উদাহরণ এটি।
২.
কানাডিয়ানদের ব্যক্তিত্বের অনন্য একটি দিক হলো স্যরি বলা বা দুঃখ প্রকাশ করা। এ বিষয়ে একটি কৌতুক প্রচলিত আছে। কানাডিয়ানরা নাকি সবকিছুর জন্যই স্যরি বলতে পছন্দ করে। কথাটা পুরোপুরি মিথ্যে নয় কিন্তু। রাস্তাঘাটে চলাফেরা করার সময় লক্ষ্য করবেন, কানাডিয়ানরা যেকোনো ছোটখাট ব্যাপারেও স্যরি বলছে। ক্লাসে দেরি করে যাওয়া থেকে শুরু করে কারো বাসায় বেড়াতে গেলে দরজা খুলতে দেরি হওয়া পর্যন্ত তাদের এই রীতির দেখা পাওয়া যায়। কারো সাথে ধাক্কা লাগলে তো অবশ্যই, বরং কারো সাথে যদি ধাক্কা লাগার উপক্রমও হয়, তখনও দেখা যায় কানাডিয়ানরা স্যরি বলে দুঃখ প্রকাশ করে ফেলছে। বিনয় প্রকাশের এমন রীতি বিশ্বের অন্য যেকোনো প্রান্তে পাওয়া অনেকটাই দুষ্কর।
স্যরি বলা বা দুঃখ প্রকাশ করার পাশাপাশি কানাডিয়ান মানুষের চরিত্রের অন্য একটি দিক হলো ধন্যবাদ দেওয়া। এই ব্যাপারটিও তারা প্রতিনিয়তই করে থাকেন। খুব ছোট কোনো ঘটনা থেকে শুরু করে বিশাল কোনো কাজ, তাদের ধন্যবাদ জানানো থেকে বাদ পড়ে না কোনো কিছুই! বাস কিংবা গাড়ি থেকে নামার সময় ড্রাইভারকে ধন্যবাদ জানাতেও কানাডিয়ানরা কখনো ভোলে না। রাস্তা দিয়ে হেঁটে আপনার পাশ কেটে যাওয়ার সময়ও হয়তো কেউ আপনাকে ধন্যবাদ জানাতে পারে কেবল আপনি তার জন্য জায়গা রেখে তার পাশ দিয়ে হেঁটে গিয়েছেন এই কারণে!
৩.
আমরা যখন কোনো দুশ্চিন্তা কিংবা চাপের মধ্যে থাকি, তখন আমরা নিজেদের জন্য একটুখানি সময় খুঁজি, নিজের পরিবারের সদস্যদের সাথে কিছুক্ষণ সময় কাটাতে চাই কিংবা তাদের সাথে কোথাও ঘুরতে যেতে চাই। এবং ঘুরে আসার পর দেখা যায়, ম্যাজিক ঘটে গেছে! দুশ্চিন্তা, ঝামেলা কিংব চাপ সব কর্পূরের মতো উবে গিয়েছে।
কানাডিয়ান মানুষেরা এ ব্যাপারগুলো নিয়ে অনেক বেশি সচেতন। “Family comes first“- এই নীতিতে তারা বিশ্বাসী। উন্নত বিশ্বের অনেক দেশে যেখানে পারিবারিক বিচ্ছেদের ঘটনা বেশ স্বাভাবিক ব্যাপার, সেখানে কানাডায় এই হার অনেকাংশে কম। কানাডিয়ান পরিবারগুলো প্রতি বছর ছুটি কাটাতে পরিজনদের সাথে বিভিন্ন জায়গায় যায়। এমনকি কানাডার অনেক অঞ্চলে বিনামূল্যেই পরিবারের সাথে ছুটি কাটানোর ব্যবস্থা রয়েছে।
৪.
কানাডার রাস্তায় চলাফেরা করার সময় লক্ষ্য করা যায় বিচিত্র ধরনের সব মানুষ। একজনের সাথে অন্য জনের দৈহিক গঠনের যেমন মিল নেই, তেমনি মিল নেই ভাষার ক্ষেত্রে। কানাডার বেশিরভাগ মানুষ ইংরেজি এবং ফ্রেঞ্চ দুটি ভাষাতে কথা বলেন। কানাডার মোট জনসংখ্যার বড় একটি অংশ অভিবাসী জনগোষ্ঠী। এদের মধ্যে আমেরিকান কিংবা অস্ট্রেলিয়ান যেমন রয়েছে, তেমনি রয়েছে এশিয়ান এবং আফ্রিকানও। ফলে কানাডাকে বিশ্ব সংস্কৃতির এক মিলনমেলা বলা চলে। এ কারণে তাদের মধ্যে বিশেষ একটি গুণ গড়ে উঠেছে। সেটি হলো ভ্রমণবিলাসীতা। কানাডিয়ানরা প্রতিবছর পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে ছুটি কাটাতে যায়। বিশেষ এ গুণটি তাদেরকে পৃথিবীর অন্য জাতিগুলোর তুলনায় অনন্য করে তুলেছে।
৫.
ঢাকার রাস্তায় হেঁটে যাওয়ার সময় খেয়াল করলাম একজন মানুষ আমার দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসছে। আরে! কী ব্যাপার? এই মানুষকে কি কোথাও দেখেছি? নাহ! মনে পড়ছে না। এ কী! এখনও আমার দিকে তাকিয়ে হাসছে। কী ব্যাপার? পাগল নাকি? – উপরের ঘটনার ফলাফল “পাগল নাকি“-তে গিয়ে শেষ হওয়া আমাদের দেশে অস্বাভাবিক নয়। কেবল আমাদের দেশ নয়, বিশ্বের অন্যান্য দেশেও এই ঘটনার ফলাফলের পুনরাবৃত্তি ঘটতে পারে। এমনকি ফলাফল এর চেয়ে খারাপও হতে পারে।
কিন্তু কানাডার অবস্থা একটু ভিন্ন। দেশটিতে রাস্তাঘাটে চলাফেরা করার সময় একে অপরের মধ্যে এ ধরনের মুচকি হাসির বিনিময় প্রায়শ হয়ে থাকে। কানাডায় এ ব্যাপারটি ভদ্রতার অংশ হিসেবে দেখা হয়। রাস্তাঘাটে যার সাথে দেখা হোক, সে পরিচিত হোক কিংবা অপরিচিত, আফ্রিকান হোক কিংবা এশিয়ান, কানাডিয়ানরা তার দিকে তাকিয়ে একটা মুচকি হাসি দিবেই। এর ফলে অপর পাশের মানুষটির মধ্যে একধরনের পজিটিভ ভাইব (Positive Vive) তৈরি হয়। হয়তো দুজনের মধ্যে পরিচয়ের সূত্রপাতও এই মুচকি হাসিকে কেন্দ্র করে হয়ে যায়!
ভেবে দেখুন একবার? একদিন সকালে ঘুম থেকে উঠে আপনার খুব মন খারাপ। কিচ্ছু ভাল লাগছে না। ফোন হাতে নিয়ে দেখলেন এক দাগ চার্জও নেই। বিরক্তি নিয়ে উঠে আপনি এক কাপ কফি গলাধঃকরণ করলেন। কিন্তু এ কী! তাতেও চিনি হয়েছে কম। একটা দিনের বাজে শুরু হওয়ার জন্য আর কী লাগে? চরম বিরক্তি নিয়ে আপনি বাসা থেকে বের হলেন। ফুটপাত দিয়ে হাঁটার সময় হঠাৎ লক্ষ্য করলেন আপনার পাশ দিয়ে যাওয়া মানুষটা আপনার দিকে তাকিয়ে মুচকি একটা হাসি দিল। আপনিও তার দিকে তাকিয়ে মুচকি আরেকটা হাসি দিলেন।
এভাবে বেশ কয়েকজনের সাথেই আপনার হাসির বিনিময় হয়ে গেল। বাহ! বেশ মজার ব্যাপার তো। আপনার একটু একটু ভাল লাগতে শুরু করল। হঠাৎ একজন মানুষ আপনাকে ধন্যবাদ দিয়ে বসল। আপনি তো অবাক! কৌতূহল দমাতে না পেরে জিজ্ঞাসা করে বসলেন তার ধন্যবাদ দেওয়ার কারণটা। লোকটি বলল, এই যে রাস্তা দিয়ে হাঁটার সময় আপনি তাকে জায়গা করে দিলেন, এটার জন্য একটা ধন্যবাদ আপনি অবশ্যই পান। নাহ! দিনটা যতটা ভেবেছিলেনন ততটা খারাপ যাচ্ছে না।
কানাডায় ঠিক এই ব্যাপারগুলোই হয়। এবং সম্ভবত এ কারণেই বিশ্বের অন্যতম বিনয়ী এবং সুখী জাতি তারাই।