“রাজকুমারী মার্থা-লুইস সম্পর্কে আপনি কী ভাবেন?”
লেক জেনেভার তীরে বসে বিশ্বখ্যাত সাহিত্যিক পাউলো কোয়েলহোকে এমন প্রশ্নই ছুঁড়ে দিয়েছিলেন জনৈক নরওয়েজিয়ান সাংবাদিক। সাধারণত কোয়েলহো নিজের কাজের সাথে প্রাসঙ্গিক না এমন বিষয়ে কথা বলতে অস্বীকৃতি জানান। কিন্তু সেদিন এই প্রশ্নটি শুনে তার কাছে পুরোপুরি অপ্রাসঙ্গিক লাগেনি। কারণ প্রশ্নটি যাকে কেন্দ্র করে, তিনি হলেন সেই রাজকুমারী, যিনি তার ৩০তম জন্মদিনে এমন একটি পোশাক পরেছিলেন, যেখানে উল্লেখ করা হয়েছিল তার জীবনে মূল্যবান সকল মানুষের নাম। এবং সেই তালিকায় স্থান পেয়েছিল পাউলো কোয়েলহো নামটিও।
এ ঘটনা কোয়েলহোর স্ত্রীকে এতটাই নাড়া দিয়েছিল যে, তিনি নিজেও তার ৫০তম জন্মদিনে একই কাজ করেছিলেন। আর পোশাকের এক কোনায় লিখেছিলেন, “নরওয়ের রাজকুমারীর থেকে অনুপ্রাণিত”।
“আমার মনে হয় তিনি খুবই সংবেদনশীল, কমনীয় এবং বুদ্ধিমান একজন মানুষ,” সাংবাদিকের প্রশ্নের জবাবে বলেছিলেন কোয়েলহো। তিনি এগুলো জানতেন, কারণ তার একবার সুযোগ হয়েছিল অসলোতে রাজকুমারীর সাথে সামনাসামনি সাক্ষাতের। তখন রাজকুমারী কোয়েলহোকে তার প্রাক্তন লেখক স্বামীর সাথেও পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলেন।
তবে এটুকু বলার পর কিছুক্ষণ বিরতি নিয়ে আরেকটি কথা কোয়েলহো না বলে পারেননি, “একটি জিনিস আমি সত্যিই বুঝতে পারিনি: কেন নরয়েজীয় সংবাদমাধ্যম বিয়ের পরই রাজকুমারীর স্বামীর সকল সাহিত্যকর্ম নিয়ে সমালোচনা শুরু করে দিয়েছিল? এর আগে তো সবখানে তার সাহিত্যকর্মের ব্যাপারে ইতিবাচক প্রতিক্রিয়াই দেখা যেত।”
একে সরাসরি একটি প্রশ্ন বলা যাবে না। কোয়েলহোর কাছে এটি ছিল একটি প্ররোচনা মাত্র। কারণ তার মনে হয়েছিল, তিনি নিজেই বুঝতে পেরেছেন ঘটনাটির কারণ। সাধারণ মানুষ ও সংবাদমাধ্যমের প্রতিক্রিয়া যে নেতিবাচক হয়ে গেছে, এর প্রধান কারণ ঈর্ষা। মানবমনের সবচেয়ে তিক্ত অনুভূতিটির কারণেই হঠাৎ করে রাজকুমারীর স্বামীর ব্যাপারে সবাই বিদ্বেষ ছড়াতে শুরু করেছে।
তবে ওই সাংবাদিকের মুখে কোয়েলহো যে কারণটি শুনতে পেয়েছিলেন, সেটি ছিল তার কাছে একেবারেই অজ্ঞাতপূর্ব একটি বিষয়। সাংবাদিকের সোজাসাপটা উত্তর ছিল, “কারণ তিনি জান্টে আইন ভেঙেছেন।”
হ্যাঁ, আমাদের আজকের আলোচনার বিষয়বস্তু এই জান্টে আইন। এটি এমনই একটি আইন, যার ফলে ইতিপূর্বে ইতিবাচক ধারণা থাকা একজন ব্যক্তির প্রতি মানসিকতাও আকস্মিকভাবে পরিবর্তন হয়ে যেতে পারে। এটি এমনই একটি আইন, যেটি আদালত কর্তৃক স্বীকৃত না হলেও, স্ক্যান্ডিনেভিয়ান দেশগুলোর প্রায় সব মানুষই এর ব্যাপারে অবগত। এটি এমনই একটি আইন, যেটির অস্তিত্ব সেই সভ্যতার সূচনালগ্ন হতেই বিদ্যমান।
তবে প্রথম আনুষ্ঠানিকভাবে এই আইনটির প্রচলন শুরু হয় ১৯৩৩ সালে, আকসেল সান্দেমোসা রচিত ব্যাঙ্গধর্মী উপন্যাস En flyktning krysser sitt spor এর মাধ্যমে। উপন্যাসটির আক্ষরিক বাংলা হতে পারে, “যে শরণার্থী তার সীমা পার করেছে”। উপন্যাসটির প্রেক্ষাপট ছিল ডেনমার্কের একটি কাল্পনিক ছোট শহর জান্টে। এই শহরের নিয়ম ছিল এমন যে, সেখানের সকল অধিবাসীই হবে সমান। কেউ নিজেকে অন্যদের চেয়ে বিশেষ, ভিন্ন বা অধিক মূল্যবান বলে মনে করতে পারবে না। যদি কেউ তা করে, তাহলে বাকি সবাই মিলে তার বিরুদ্ধে অবস্থান নেবে।
জান্টে শহরে প্রচলিত সেই আইনের দশটি প্রধান বিধি ছিল। সেগুলো হলো:
১. তোমার এটি ভাবা যাবে না যে তুমি বিশেষ কেউ।
২. তোমার এটি ভাবা যাবে না যে তুমি আমাদের সকলের সমান।
৩. তোমার এটি ভাবা যাবে না যে তুমি আমাদের থেকে বুদ্ধিমান।
৪. তোমার এটি ভাবা যাবে না যে তুমি আমাদের চেয়ে ভালো।
৫. তোমার এটি ভাবা যাবে না যে তুমি আমাদের চেয়ে বেশি জানো।
৬. তোমার এটি ভাবা যাবে না যে তুমি আমাদের চেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ।
৭. তোমার এটি ভাবা যাবে না যে তুমি কোনো বিষয়ে ভালো।
৮. তোমার এটি ভাবা যাবে না যে তুমি আমাদের দেখে হাসতে পারো।
৯. তোমার এটি ভাবা যাবে না যে তোমাকে কেউ পাত্তা দেয়।
১০. তোমার এটি ভাবা যাবে না যে তুমি আমাদের কিছু শিখাতে পারো।
এছাড়া ১১ নম্বরে আরেকটি বিধি ছিল, যেটি বিবেচিত হতো জান্টের পেনাল কোড হিসেবে,
“সম্ভবত তুমি মনে করো না আমরা তোমার ব্যাপারে কিছু জিনিস জানি?”
কোনো জান্টেবাসী যদি এই অলিখিত বিধিগুলোকে অস্বীকার করত, বাকিরা সবাই মিলে তাকে সন্দেহের দৃষ্টিতে দেখত, এবং সকলে একাট্টা হয়ে তার বিপক্ষে অবস্থান নিত। কারণ তারা মনে করত, কোনো ব্যক্তিবিশেষ যদি এই বিধিগুলো অমান্য করে নিজেকে ব্যতিক্রম কেউ বলে মনে করে, তবে তাতে শহরের মানুষের আকাঙ্ক্ষিত ঐকতান, সামাজিক স্থিতিশীলতা ও অভিন্নতা ব্যাহত হয়।
এখানে একটি বিষয় পরিষ্কারভাবে জানিয়ে রাখা প্রয়োজন, সান্দেমোসা রচিত উপন্যাসটি ছিল পুরোদস্তুর একটি স্যাটায়ার। জর্জ অরওয়েল যেমন তাঁর অ্যানিমেল ফার্ম (১৯৪৫) উপন্যাসে ব্যাঙ্গাত্মকভাবে সমাজের প্রচলিত কিছু নিয়মকে তুলে ধরেছিলেন, তারও এক যুগ আগে সান্দেমোসাও ঠিক একই কাজই করেছিলেন।
সান্দেমোসা তাঁর উপন্যাসটিতে জান্টে শহরের কর্মজীবী শ্রেণীর রূপ তুলে ধরতে চেয়েছিলেন, সামাজিক দৃষ্টিকোণ থেকে যাদের সকলের অবস্থান সমান। তাছাড়া জান্টে শহরের মাধ্যমেও তিনি কেবল একটি শহর বা দেশকেই বোঝাতে চাননি, প্রতীকীভাবে তিনি গোটা বিশ্বের চালচিত্রই তুলে ধরতে চেয়েছিলেন। তিনি নিজে কোনো বিধিও তৈরি করতে চাননি। শতকের পর শতক ধরে ড্যানিশ ও নরওয়েজিয়ানদের মননে যে ধারণাগুলো ছিল, সেগুলোকেই ব্যাঙ্গাত্মকভাবে উপস্থাপনের মাধ্যমে সমালোচনায় বিদ্ধ করতে চেয়েছিলেন তিনি।
কিন্তু সান্দেমোসা যা চেয়েছিলেন, তা হয়নি। তিনি পাঠকদের সামনে তথাকথিত সাম্যবাদী দৃষ্টিভঙ্গির দুর্বলতাগুলোকে তুলে ধরতে চেয়েছিলেন। কিন্তু সাধারণ পাঠক সেগুলোকে সত্যি বলেই ধরে নিয়েছিল। তাই তো স্ক্যান্ডিনেভিয়ান দেশগুলো, অর্থাৎ ডেনমার্ক, নরওয়ে, সুইডেনের মানুষ জান্টে আইনকে অলিখিত সামাজিক প্রথা হিসেবেই মেনে চলতে শুরু করেছে।
সান্দেমোসা প্রণীত বিধিগুলোর দিকে লক্ষ্য করলে একটি তাৎপর্যপূর্ণ জিনিস খুঁজে পাওয়া যাবে। এখানে উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবেই শুরু করা হয়েছে ‘তুমি’ দিয়ে, আর শেষ করা হয়েছে ‘আমরা’ দিয়ে। ‘তুমি’ দ্বারা বোঝানো হয়েছে নিজেকে ভিন্ন বা বিশেষ ভাবা মানুষদেরকে, যারা একবচন তথা সংখ্যায় সীমিত। আর ‘আমরা’ দ্বারা বোঝানো হয়েছে সমাজের সাধারণ মানুষকে, যারা সংখ্যায় বিপুল। এভাবে সংখ্যাগরিষ্ঠ সাধারণ মানুষের সামনে যে সংখ্যালঘু অসাধারণ মানুষেরা মাথা তুলে দাঁড়াতে পারে না, সেই চরম সত্যের দিকেই ইঙ্গিত করা হয়েছে।
এবার আমরা নজর ফেরাতে পারি আমাদের নিজেদের দেশের দিকে। একটি ধারণা প্রচলিত আছে, বাংলাদেশীরা নাকি কারো উন্নতি সহ্য করতে পারে না। একই বৈশিষ্ট্যের দায়ভার আরেকটু সাধারণীকরণের মাধ্যমে গোটা বাঙালি জাতির উপরও চাইলে চাপিয়ে দেয়া যায়, তাতেও বিবৃতিটি তার যোগ্যতা হারাবে না। মোদ্দা কথা হলো, বাংলাদেশী বা বাঙালিরা নাকি নিজ দেশ বা জাতিরই উন্নতি সহ্য করতে পারে না, তাই একজন উপরে উঠতে শুরু করলে বাকি সবাই মিলে তার পা ধরে টেনে তাকে নিচে নামাতে চায়।
মজার ব্যাপার হলো, ফরাসিদের নামেও একই অপবাদ রয়েছে। ব্রাজিলিয়ানদের নামেও রয়েছে। এবং শুধু তারাই কেন, ঈর্ষা একটি বিশ্বজনীন মানবীয় অনুভূতি। তাই প্রায় সকল দেশ, সকল সমাজ, সকল সংস্কৃতিতেই চেতনে বা অবচেতনে জান্টে আইন ঘামটি মেরে আছে। স্ক্যান্ডিনেভিয়ান দেশগুলোর বিশেষত্ব হলো, তারা একদম ঢাকঢোল পিটিয়ে এই আইনটিকে অনুসরণ করে থাকে, এমনকি নিজেদের সুখ-স্বাচ্ছন্দ্য-সমৃদ্ধির পেছনেও এই আইনের অপরিসীম অবদান রয়েছে বলে তারা মনে করে!
জান্টে আইনকে ড্যানিশ ও নরওয়েজিয়ানরা আখ্যায়িত করে থাকে ‘জান্টেলোভেন’ হিসেবে। আর সুইডেনের মানুষের কাছে এটি পরিচিত ‘জান্টেলাগেন’ নামে। জান্টেলোভেন বা জান্টেলাগেন অনুযায়ী এই তিন স্ক্যান্ডিনেভিয়ান দেশের মানুষ সবসময় চেষ্টা করে নিজেকে একই সামাজিক অবস্থান সম্পন্ন সকলের সমান বা সমপর্যায়ের হিসেবে প্রদর্শনের। যাতে নিজেকে অন্যদের চেয়ে বড় বা ভিন্নরূপে জাহির করা না হয়, এজন্য তারা যেকোনো সামাজিক মিলনে একই পোশাক পরে, রাস্তায় একই ধরনের গাড়ি চালিয়ে যাতায়াত করে, এমনকি নিজেদের বাড়িতে ব্যবহারের জন্যও একই ধরনের পণ্য কেনে (যদিও লোকচক্ষুর আড়ালে অনেকেই বিলাসদ্রব্য ক্রয় ও ব্যবহার করে)। অর্থনৈতিকভাবেও কেউ বেশি ধনী, আবার কেউ কম ধনী বা দরিদ্র হলেও, নিজমুখে তারা এ বিষয়গুলো নিয়ে কখনো চর্চা করে না। সম্পদের পরিমাণ বা মাসিক আয় উচ্চারণ করা এসব দেশে যৌনতার চেয়েও বড় ট্যাবু।
সাধারণভাবে ধরা হয়ে থাকে, বিভিন্ন প্রদেশ কিংবা ছোট শহরেই জান্টে আইন বেশি দেখা যায়, কেননা অপেক্ষাকৃত ছোট জায়গার মানুষেরা পরস্পরকে চেনে ও জানে। কিন্তু অনেক সমাজবিজ্ঞানীই মনে করেন যে, জান্টে আইনের প্রভাব থেকে রক্ষা পায় না স্ক্যান্ডিনেভিয়ান দেশের মেট্রোপলিটন শহরগুলোও। এবং জান্টে আইনের বিধিগুলো এমনভাবে সাধারণ মানুষের মনে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে গেছে যে, বাইরের দেশ থেকে আসা মানুষরাও এখন স্ক্যান্ডিনেভিয়ান দেশে গিয়ে সবার সাথে তাল মিলিয়ে চলতে নিজেকে আলাদা বা ব্যতিক্রম ভাবা থেকে বিরত থাকে।
নরওয়ের রাজনীতিবিদ ও শিক্ষা উপদেষ্টা অরলিন কান্তারজিফ জানান, সে দেশের স্কুলগুলোতেও নাকি গুরুত্বপূর্ণ সামাজিক প্রথা হিসেবে বাচ্চাদের জান্টে আইন শেখানো হয় এবং গোষ্ঠী আচরণে উৎসাহ দেয়া হয়। পাশাপাশি নর্ডিক দেশগুলোতে সুখের পরিমাণ বেশি হওয়ার পেছনেও অন্যতম প্রধান কারণ হিসেবে তিনি উল্লেখ করেন জান্টে আইনকেই।
এ কথা সত্য যে সাম্যবাদ অতি আকাঙ্ক্ষিত একটি ধারণা, এবং সকলেরই তা কাম্য। কিন্তু জান্টে আইনের মাধ্যমে যে সাম্যবাদের আদর্শ প্রচারিত হয়, সেই সাম্যবাদ কি যুক্তিসঙ্গত? স্ক্যান্ডিনেভিয়ান দেশগুলোর জনপ্রিয় অভিমত এর পক্ষে হলেও, এর বিপক্ষেও কিন্তু অবস্থান রয়েছে অনেকের। বিশেষত জান্টে আইনের কারণে অন্যদের চেয়ে বেশি মেধাবী ও যোগ্যতাসম্পন্ন হওয়া সত্ত্বেও যারা নিজেদেরকে প্রকাশ করতে পারে না, একটি দলের অন্যতম সদস্য হিসেবেই যাদেরকে সন্তুষ্ট থাকতে বাধ্য হয়, তারা কখনোই ভালো চোখে দেখে না জান্টে আইনকে। তাদের মতে, এই ধরনের সাম্যবাদ আদতে ব্যক্তিস্বাধীনতার উপর নগ্ন হস্তক্ষেপ। যদি নিজের মতো করে কিছু করার, নিজেকে মেলে ধরার সুযোগই না থাকে, তাহলে শুধু সাম্যবাদ দিয়ে কী লাভ!
তাছাড়া নিজ যোগ্যতাবলে কেউ বড় কিছু করতে চাইলেও তাকে সামাজিক প্রথার অজুহাত দেখিয়ে আটকে রাখা কতটা মানবিক, সেই প্রশ্নও থেকেই যায়। একজন জনপ্রিয় লেখকের লেখা যদি ইতিপূর্বে সাধারণ মানুষের কাছে প্রশংসার যোগ্য হয়, তাহলে সেই লেখকই রাজপরিবারের কাউকে বিয়ে করে নিজের সামাজিক অবস্থানের পরিবর্তন ঘটালে তার লেখা ‘আবর্জনা’ হয়ে যায় কীভাবে? যদি এমন দ্বিমুখিতাই হয়ে থাকে কোনো সামাজিক প্রথার সারকথা, তাহলে অবশ্যই ধরে নিতে হবে যে সেটির মাঝে কোনো গলদ রয়েছে।
ড. স্টিফেন ট্রটার একজন স্কটিশ-নরওয়েজিয়ান শিক্ষাবিদ, যিনি স্কটল্যান্ডের ইউনিভার্সিটি অভ গ্লাসগোতে জান্টে আইন নিয়ে গবেষণা করেছেন। তার মতে, এটি এমন এক ধরনের মানসিকতা, যা নর্ডিক দেশগুলোতে, বিশেষত সেখানকার প্রত্যন্ত অঞ্চলে, শত শত বছর ধরে বিদ্যমান ছিল। এই মানসিকতার পেছনে তিনি দায়ী করেন সামাজিক নিয়ন্ত্রণবাদকে।
“জান্টে আইন হলো সামাজিক নিয়ন্ত্রণ অর্জনের লক্ষ্যে একটি হাতিয়ার। এটি শুধু অর্থ সংক্রান্তই নয়, এর মানে হলো নিজেকে অন্যদের চেয়ে বেশি জ্ঞানী মনে না করা, কিংবা নিজের সীমারেখা টপকে কোনো কাজ না করা।”
এদিকে সুইডিশদের সুখী জীবন নিয়ে রচিত বই, Lagom: The Swedish Secret of Living Well এর রচয়িতা আকিনমাদে আকারস্ট্রম মনে করেন, জান্টেলাগেন (জান্টে আইনের সুইডিশ রূপ) আসলেই দেশটির সুখের অন্যতম কারণ।
“জান্টেলাগেন একটি অকথিত সামাজিক নিয়ম যার অস্তিত্ব সুইডেনসহ আরো কিছু নর্ডিক দেশে রয়েছে। এর মূল কথা হলো খুব বেশি চটকদার না হওয়া, অপ্রয়োজনে নিজেকে নিয়ে বাগাড়ম্বর না করা। এটি মূলত একধরনের উপায় সমাজের সবাইকে সমান রাখা, কোনো গোষ্ঠী পর্যায় থেকে উদ্বেগের বিষয়গুলোকে ঝেড়ে ফেলার মাধ্যমে।”
কিন্তু যেমনটি আগেই বলেছি, জান্টে আইনের মাধ্যমে গোষ্ঠী বা সামাজিক পর্যায়ে অস্থিরতা দূর হলেও, ব্যক্তিপর্যায়ে অস্থিরতা রয়েই যায়। সমাজের অধিকাংশ মানুষ হয়তো জান্টে আইনের মাধ্যমে ভালো থাকে, কিন্তু সংখ্যালঘু সেই মানুষগুলো, যারা প্রচলিত নিয়মের বাইরে গিয়ে নতুন কিছু করতে চায়, ভিন্ন কিছু হতে চায়, জান্টে আইনের কারণে তাদেরকে পিছিয়ে যেতে হয়, অদৃশ্য শেকলে বন্দি থাকতে হয়। অবদমিত বাসনা তাদেরকে মানসিক পীড়া দেয়, ক্রমশ মানসিকভাবে দুর্বল করে দিতে থাকে। ফলে স্ক্যান্ডিনেভিয়ান দেশগুলোর অধিক আত্মহত্যা প্রবণতার পেছনেও অনেকে জান্টে আইনকেই দায়ী করে থাকে।
২০১৭ সালে গার্ডিয়ানে প্রকাশিত একটি প্রবন্ধে ড্যানিয়েল সিমনসেন দাবি করেন, নরওয়েকে বিশ্বের সবচেয়ে সুখী দেশ মানতে তিনি নারাজ। তিনি বলেন, গ্রিক, আমেরিকান এবং লাতিনোদের তার কাছে বেশি সুখী বলে মনে হয়, কেননা ওসব দেশের মানুষেরা আরো বেশি স্বাধীন, আরো প্রাণোচ্ছ্বল, চাইলেই যেকোনো কিছু হতে বা করতে সক্ষম।
নরওয়ে বা অন্যান্য স্ক্যান্ডিনেভিয়ান দেশকে অপেক্ষাকৃত কম সুখী মনে করার পেছনে তিনি দায়ী করেন জান্টে আইনকে,
“অন্যদের তুলনায় আমরা অনেক বেশি অবদমিত, আর এই অবদমনের কারণ জান্টে আইন নামক সামাজিক প্রথাটি। এর অর্থ হলো আপনি বিশ্বাস করতে পারবেন না আপনি বিশেষ কেউ, কিংবা আপনি নিজের ব্যক্তিসত্তা নিয়েও খুব বেশি খুশি পারবেন না। এটি খুবই অপ্রয়োজনীয় একটি আইন, এবং শুনতেও অনেকাংশে নিজের নামের মতোই হাস্যকর। তবে এই আইনেরও একটি ব্যতিক্রমের সুযোগ আছে, যখন আপনি মাতাল থাকবেন। মাতাল অবস্থায় আপনি নিজেকে আরো বেশি প্রকাশের সুযোগ পাবেন, যে কারণে আমাদের দেশের সাধারণ মানুষ তাদের ছুটির দিনগুলোর পুরোপুরিটাই মদ্যপ হয়ে নষ্ট করে।”
ব্যক্তিস্বাধীনতার সুযোগ না থাকায় জান্টে আইন নিয়ে স্ক্যান্ডিনেভিয়ান দেশগুলোর অনেক মানুষের মধ্যেই রয়েছে তীব্র ক্ষোভ। ২০০৫ সালে একবার সেই ক্ষোভের উদ্গীরণ ঘটেছিল, যখন নরওয়েতে কেউ একজন জান্টে আইনের জন্য কবর খুঁড়ে ঘোষণা দিয়েছিল যে আইনটি মারা গেছে। কিন্তু সত্য কথা হলো, ১৪ বছর পর এই ২০১৯ সালে এসেও আইনটি বহাল তবিয়তেই রয়েছে। কারণ এটি তো তথাকথিত একটি আইনই শুধু নয়, এটি একটি মূল্যবোধ যা স্ক্যান্ডিনেভিয়ান সমাজের গভীরে ঢুকে পড়েছে। চাইলেই কি আর সেই মূল্যবোধকে সমূলে উপড়ে ফেলা যায়!
বিশ্বের চমৎকার সব বিষয়ে রোর বাংলায় লিখতে আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন এই লিঙ্কেঃ roar.media/contribute/