পশ্চিমা বিশ্ব ও রাশিয়া উভয়ের জন্যই তুরস্কের সঙ্গে তাদের নিজ নিজ দ্বন্দ্বের তুলনায় রুশ–পশ্চিমা দ্বন্দ্বের গুরুত্বের মাত্রা অনেক বেশি। পশ্চিমা রাষ্ট্রগুলো বিশ্বে তাদের একাধিপত্য বজায় রাখার জন্য রাশিয়াকে যতদূর সম্ভব দুর্বল রাখতে আগ্রহী এবং রাশিয়া যাতে বহির্বিশ্বের ঘটনাবলিতে তাদের হস্তক্ষেপ সীমিত রাখতে বাধ্য হয়, সেজন্য রাশিয়ার সীমান্তে তাদের মনোযোগ নিবদ্ধ রাখতে ইচ্ছুক। এক্ষেত্রে কৃষ্ণসাগরে রাশিয়ার ওপর চাপ বৃদ্ধি তাদের জন্য একটি আদর্শ কৌশল।
উল্লেখ্য, ১৮৫৩–৫৬ সালের পূর্বাঞ্চলীয়/ক্রিমিয়ান যুদ্ধে কৃষ্ণসাগরেই ব্রিটেন, ফ্রান্স, ওসমানীয় রাষ্ট্র ও সার্দিনিয়ার সমন্বয়ে গঠিত একটি জোট রাশিয়াকে পরাজিত করে এবং এর ঐতিহাসিক স্মৃতি রুশ জনমানসে এখনও আছে। তদুপরি, সোভিয়েত আমলে কৃষ্ণসাগরে মস্কোর যেরকম একাধিপত্য ছিল, সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর সেই একাধিপত্য আর নেই, কারণ কৃষ্ণসাগরে নতুন রাশিয়ার জলসীমা বহুলাংশে হ্রাস পেয়েছে এবং রুশ নৌবাহিনীও আগের চেয়ে অনেকাংশে দুর্বল হয়ে পড়েছে।
এই পরিস্থিতিতে কৃষ্ণসাগরীয় অঞ্চলে রাশিয়ার নিরাপত্তা নিশ্চিত করার অন্যতম মাধ্যম মনথ্রো কনভেনশন, যার কারণে কৃষ্ণসাগরে পশ্চিমা সামরিক নৌযানের প্রবেশের ওপর নানা বিধিনিষেধ বিদ্যমান। ইস্তাম্বুল খাল নির্মিত হলে এবং এটি উক্ত কনভেনশনের আওতায় না পড়লে এক্ষেত্রে কৃষ্ণসাগরে রাশিয়ার নিরাপত্তাহীনতা বৃদ্ধি পাবে। এই অঞ্চলে নিজেদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা ও পশ্চিমা সামরিক নৌযানের প্রবেশাধিকার সীমিত রাখার উদ্দেশ্যে রাশিয়াকে তখন তুরস্কের সঙ্গে সমঝোতায় পৌঁছাতে হবে এবং তুরস্ক বিনিময়ে অন্যান্য অঞ্চলে রাশিয়ার কাছ থেকে ছাড় চাইবে– অন্তত তুর্কি বিশ্লেষকদের একাংশ এরকমই ধারণা করছেন।
অবশ্য তুরস্ক ও তুরস্কের বর্তমান সরকার সম্পর্কে রুশদের বিস্তৃত ধারণা রয়েছে এবং এর ভিত্তিতে তারা ইস্তাম্বুল খাল প্রকল্পকে এরদোয়ানের একটি ‘অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক চাল’ হিসেবে বিবেচনা করে এসেছে। রুশ বিশ্লেষকদের অনেকেরই ধারণা ছিল, ইস্তাম্বুল খাল প্রকল্প অর্থনৈতিকভাবে টেকসই নয় এবং তুরস্কের পক্ষে এই প্রকল্প বাস্তবায়িত করা সম্ভব নয়। এজন্য তারা এতদিন পর্যন্ত এই প্রকল্প নিয়ে বিশেষ উচ্চবাচ্য করেনি। কিন্তু তুরস্ক যদি এই খাল খনন করেই ফেলে এবং মনথ্রো কনভেনশনে কোনো পরিবর্তন আনার প্রচেষ্টা চালায়, সেক্ষেত্রে রুশদের প্রতিক্রিয়া ভিন্ন রূপ নিতে পারে। ইতোমধ্যে রুশ পররাষ্ট্রমন্ত্রী সের্গেই লাভরভ এবং তুরস্কে নিযুক্ত রুশ রাষ্ট্রদূত আলেক্সেই ইয়েরখভ জানিয়েছেন যে, রাশিয়া মনথ্রো কনভেনশন নিয়ে নতুন করে কোনো আলোচনায় আগ্রহী নয়। তাদের এই বক্তব্যের পর তুর্কি সরকার ইস্তাম্বুল খাল প্রকল্পের পরিবেশগত প্রভাব সংক্রান্ত প্রতিবেদন সংশোধন করে সেখানে সংযোজন করেছে যে, ইস্তাম্বুল খালের ক্ষেত্রে মনথ্রো কনভেনশনের সকল শর্ত প্রযোজ্য হবে এবং বসফরাস প্রণালী নৌ চলাচলের জন্য উন্মুক্ত থাকবে।
এই ব্যাপারে কোনো সন্দেহ নেই যে, কেবল রুশদের সন্তুষ্ট করার জন্যই তুর্কি সরকার তাদের প্রতিবেদনে এই বক্তব্য সংযোজন করেছে এবং এর কার্যত কোনো মূল্য নেই। ইস্তাম্বুল খাল নির্মিত হওয়ার পর তুর্কি সরকার যে তাদের এই প্রতিশ্রুতি পালন করবে, সেটির কোনো নিশ্চয়তা নেই। কিন্তু তুর্কি সরকার যে রাশিয়াকে এটুকু ছাড় দিতে রাজি হয়েছে, এর থেকে প্রতীয়মান হয় যে, তুর্কি সরকার ইস্তাম্বুল খালকে ঘিরে বৃহৎ শক্তিগুলোর সঙ্গে তাদের সম্পর্কে নতুন দ্বন্দ্ব সৃষ্টিতে বিশেষ আগ্রহী নয়।
অন্যদিকে, পশ্চিমা বিশ্বও কৃষ্ণসাগরে রাশিয়ার ওপর সামরিক চাপ বৃদ্ধি এবং ভূমধ্যসাগরে রুশদের উপস্থিতি সীমিত রাখার জন্য তুরস্কের সঙ্গে সমঝোতায় পৌঁছাতে চাইবে এবং সেক্ষেত্রে তুরস্ক অন্যান্য বিষয়ে পশ্চিমা বিশ্বের কাছ থেকে ছাড় দাবি করবে– এরকমটা তুর্কি বিশ্লেষকদের একাংশের ধারণা। কিন্তু পশ্চিমা বিশ্ব কৃষ্ণসাগরে নিজেদের প্রভাব বৃদ্ধি ও রুশ প্রভাব হ্রাস করার জন্য তুরস্ককে কতটুকু ছাড় দিতে আগ্রহী, সেটি একটি প্রশ্নসাপেক্ষ বিষয়।
প্রথমত, কৃষ্ণসাগরকে রাশিয়া ঐতিহাসিকভাবে নিজস্ব প্রভাব বলয়ের অংশ হিসেবে বিবেচনা করে এসেছে এবং প্রাক্তন সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর এতদঞ্চলে রুশ প্রভাব হ্রাস পেলেও এখন পর্যন্ত এই অঞ্চলের ক্ষমতার ভারসাম্য রুশদের অনুকূলে রয়েছে। পশ্চিমারা যদি এই ভারসাম্যে গুরুতর পরিবর্তন আনার প্রচেষ্টা চালায়, সেক্ষেত্রে রাশিয়ার সঙ্গে তাদের বড় ধরনের দ্বন্দ্ব দেখা দিতে পারে। সম্প্রতি একটি ব্রিটিশ যুদ্ধজাহাজ রুশ জলসীমায় প্রবেশ করার পর রুশ কোস্টগার্ড উক্ত যুদ্ধজাহাজের গমনপথে বোমাবর্ষণ করে সেটিকে পশ্চাৎপসরণে বাধ্য করেছে। কৃষ্ণসাগর রুশদের জন্য কতটা স্পর্শকাতর অঞ্চল, সেটি এই ঘটনা থেকে অনুধাবন করা যায়। পশ্চিমা বিশ্ব বিশ্বব্যাপী রুশ প্রভাব হ্রাস করতে আগ্রহী বটে, কিন্তু সেজন্য এই ধরনের ঝুঁকি নিতে ইচ্ছুক নয়।
দ্বিতীয়ত, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র যদি ইস্তাম্বুল খালকে রুশদের বিরুদ্ধে পূর্ণরূপে ব্যবহার করতে চায়, সেক্ষেত্রে তুরস্ক যে এস–৪০০ ইস্যু, সিরীয় কুর্দিদের প্রতি মার্কিন সমর্থন ও গুলেনকে আশ্রয় প্রদানসহ বিভিন্ন বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্রের কাছ থেকে ছাড় চাইবে, সেটি বলাই বাহুল্য। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্র যে এসব ক্ষেত্রে ছাড় দিতে আগ্রহী হবে, সেটির কোনো নিশ্চয়তা নেই। এজন্য ইস্তাম্বুল খাল এতদঞ্চলে মার্কিন ভূরাজনৈতিক স্বার্থের জন্য অনুকূল হবে, এরকম প্রচারণা সত্ত্বেও এখন পর্যন্ত মার্কিনিরা এই প্রকল্প নিয়ে বিশেষ আগ্রহ দেখায় নি। এজন্য এই খাল খননের ফলে যে পশ্চিমা বিশ্বের সঙ্গে তুরস্কের দর কষাকষির ক্ষমতা স্বয়ংক্রিয়ভাবে বেড়ে যাবে, এমনটি ভাবার কোনো কারণ নেই।
সামগ্রিকভাবে, ইস্তাম্বুল খালের মূল ভূরাজনৈতিক তাৎপর্য হচ্ছে, এটি পশ্চিমা বিশ্ব ও রাশিয়া উভয়ের সঙ্গেই তুরস্কের দর কষাকষির সুযোগ বহুলাংশে বৃদ্ধি করবে। এভাবে তুরস্ক ইস্তাম্বুল খাল খননের মাধ্যমে তাদের ভূকৌশলগত অবস্থানকে কাজে লাগিয়ে একটি বৃহৎ শক্তি হিসেবে নিজেদেরকে প্রতিষ্ঠা করতে আগ্রহী। অবশ্য কেবল এই খাল খনন করলেই যে তুরস্ক একটি বৃহৎ শক্তিতে পরিণত হবে, বিষয়টা এত সরল নয়। বৃহৎ শক্তি হওয়ার জন্য যে বিপুল রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক সামর্থ্যের দরকার, সেটি অর্জন করার আগ পর্যন্ত তুরস্কের এই মহাপরিকল্পনা সফল হবে না। কিন্তু ইস্তাম্বুল খাল খনন তুরস্কের বৃহৎ শক্তিতে পরিণত হওয়ার এই পরিকল্পনা বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে সহায়ক ভূমিকা পালন করতে পারে।
এছাড়া, তুর্কি জাতীয়তাবাদীদের জন্য ইস্তাম্বুল খাল প্রকল্পের বাস্তবায়ন একটি মনস্তাত্ত্বিক বিজয় হিসেবে বিবেচিত হবে। তুর্কি উগ্র জাতীয়তাবাদীদের একাংশ ১৯২৩ সালে প্রথম বিশ্বযুদ্ধের মিত্রশক্তি ও তুরস্কের মধ্যে সম্পাদিত লুজান চুক্তিকে ‘দ্বিতীয় সেভ্রে চুক্তি’ হিসেবে বিবেচনা করে। উল্লেখ্য, সেভ্রে চুক্তিকে ‘সাইকস–পিকো চুক্তি’র তুর্কি সংস্করণ হিসেবে আখ্যায়িত করা যায়, কারণ সাইকস–পিকো চুক্তির মধ্য দিয়ে যেভাবে ব্রিটেন ও ফ্রান্স মধ্যপ্রাচ্যকে নিজেদের মধ্যে ভাগাভাগি করে নিয়েছিল, তেমনিভাবে সেভ্রে চুক্তির মধ্য দিয়ে মিত্রশক্তি তুরস্ককে নিজেদের মধ্যে ভাগাভাগি করে নিতে চেয়েছিল।
অবশ্য লুজান চুক্তি (এবং পরবর্তীতে সম্পাদিত মনথ্রো কনভেনশন) তুরস্কের জন্য তুলনামূলকভাবে অনেক বেশি সুবিধাজনক ছিল। কিন্তু তা সত্ত্বেও বর্তমানে তুর্কি উগ্র জাতীয়তাবাদীরা লুজান চুক্তি ও মনথ্রো কনভেনশনকে তুরস্কের ওপর ‘চাপিয়ে দেয়া চুক্তি’ হিসেবে বিবেচনা করে এবং এগুলো বাতিল করতে ইচ্ছুক। ইস্তাম্বুল খাল খননের পর এর ক্ষেত্রে মনথ্রো কনভেনশন প্রযোজ্য হবে না, তুর্কি সরকার তুর্কি জনসাধারণকে এরকম একটি ধারণা প্রদান করেছে। এজন্য ইস্তাম্বুল খাল খননকে তুর্কি উগ্র জাতীয়তাবাদীদের একাংশ নিজেদের একটি বিজয় হিসেবে বিবেচনা করছে। উল্লেখ্য, তুর্কি উগ্র জাতীয়তাবাদী দল ‘এমএইচপি’ বর্তমানে একেপি–নিয়ন্ত্রিত তুর্কি সরকারের অংশীদার এবং ক্ষমতায় টিকে থাকার জন্য তাদের সমর্থন বর্তমানে এরদোয়ানের জন্য বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
অবশ্য এক্ষেত্রে আরেকটি বিষয় বিবেচনায় রাখা জরুরি। সেটি হচ্ছে, কৃষ্ণসাগরে পশ্চিমা বিশ্ব ও রাশিয়ার মধ্যে যুদ্ধ বেঁধে যাওয়া কিংবা এই অঞ্চলে পশ্চিমা ও রুশদের ব্যাপক সামরিকায়ন– কোনোটিই তুরস্কের স্বার্থের অনুকূলে নয়। কারণ এই অঞ্চলে উক্ত দুই পক্ষের মধ্যে যুদ্ধ শুরু হয়ে গেলে সেই যুদ্ধ কেবল এই অঞ্চলে সীমাবদ্ধ থাকবে না, বরং সমগ্র বিশ্বে ছড়িয়ে পড়বে। এক্ষেত্রে তুরস্ক নিজেও এই যুদ্ধে জড়িয়ে পড়তে পারে। অনুরূপভাবে, এই অঞ্চলে পশ্চিমা রাষ্ট্রগুলো ও রাশিয়ার সামরিক শক্তি বৃদ্ধিও তুরস্কের স্বার্থের জন্য অনুকূল নয়। এজন্য তুর্কি জাতীয়তাবাদীদের একাংশ এই প্রকল্পের ঘোর বিরোধী।
উল্লেখ্য, কিছুদিন আগেই তুর্কি নৌবাহিনীর ১০৪ জন অবসরপ্রাপ্ত অ্যাডমিরাল একটি খোলা চিঠিতে তুরস্কের সার্বভৌমত্ব রক্ষার ক্ষেত্রে মনথ্রো কনভেনশনের গুরুত্বের কথা উল্লেখ করেছেন এবং এই কনভেনশনের শর্তের যাতে খেলাপ না করা হয় সেটির আহ্বান জানিয়েছেন। তাদের ভাষ্যমতে, মনথ্রো কনভেনশন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে তুরস্কের নিরপেক্ষতা বজায় রাখার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছিল। কিন্তু তুর্কি সরকার এর বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছে এবং উক্ত চিঠিতে স্বাক্ষর প্রদানকারী ১০ জন অবসরপ্রাপ্ত নৌ কর্মকর্তাকে গ্রেপ্তার করেছে। তুর্কি সরকারপন্থী প্রচারমাধ্যমে দাবি করা হয়েছে, উক্ত নৌ কর্মকর্তা যুক্তরাষ্ট্র বা রাশিয়ার নির্দেশে এই খোলা চিঠি লিখেছেন, যদিও তুর্কি নৌ কর্মকর্তারা রুশদের নির্দেশনা অনুযায়ী চলবেন, এই সম্ভাবনা খুবই কম। বস্তুত উক্ত নৌ কর্মকর্তাদের গ্রেপ্তার ইস্তাম্বুল খাল ও মনথ্রো কনভেনশন নিয়ে তুর্কি সমাজে যে বিভাজনের সৃষ্টি হয়েছে, সেটিরই প্রতিফলন।
কিন্তু ইস্তাম্বুল খাল প্রকল্প বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে তুরস্ক নানাবিধ সমস্যার মুখোমুখি হচ্ছে এবং ভবিষ্যতেও হবে। ইস্তাম্বুল খাল নির্মাণে সম্ভাব্য নেতিবাচক পরিবেশগত প্রভাব এবং এটির অর্থনৈতিক কার্যকারিতা সম্পর্কে বিদ্যমান সংশয় নিয়ে ইতিপূর্বেই আলোচনা করা হয়েছে। এছাড়া এই খালটি নির্মাণ করা আদৌ তুরস্কের পক্ষে সম্ভব হবে কিনা, সেটি নিয়েও এখনো অনেকের মনে সংশয় রয়েছে। তুর্কি রাষ্ট্রপতি এরদোয়ান ইতিপূর্বে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন যে, ২০২৩ সালে তুর্কি প্রজাতন্ত্রের শতবর্ষ পূর্তির সময় ইস্তাম্বুল খালের নির্মাণকাজ সমাপ্ত হবে। কিন্তু কার্যত এখনো খালটির নির্মাণকাজ আরম্ভই হয়নি এবং ২০২৩ সাল নাগাদ এর নির্মাণকাজ সমাপ্ত হওয়ার কোনো সম্ভাবনা নেই। এরদোয়ানের নিজের ভাষ্যমতেই, ২০২৬ সালের আগে এই খালের নির্মাণকাজ সমাপ্ত হবে না। এমতাবস্থায় তুরস্কের বিরোধী দলগুলোর ধারণা, ইস্তাম্বুল খাল প্রকল্প অভ্যন্তরীণ জনপ্রিয়তা ধরে রাখার জন্য একেপির ব্যবহৃত একটি কৌশল মাত্র এবং এই খাল বাস্তবে নির্মিত হওয়ারই কোনো সম্ভাবনা নেই। অবশ্য তাদের এই ধারণা কতটুকু সঠিক, সেটি প্রশ্নসাপেক্ষ।
কিন্তু এটি সত্যি যে, তুর্কি সরকারের জন্য ইস্তাম্বুল খাল খননের জন্য প্রয়োজনীয় অর্থ সংগ্রহ করা ক্রমশ কঠিন হয়ে উঠেছে। তুর্কি সরকার তুরস্কের শীর্ষ ব্যাঙ্কগুলোকে এই প্রকল্পের অর্থায়নের জন্য রাজনৈতিকভাবে চাপ দিতে পারে, এই আশঙ্কায় তুরস্কের ৬টি শীর্ষ ব্যাঙ্ক আগেই জানিয়ে রেখেছে যে, তারা ইতিপূর্বে ‘বৈশ্বিক স্থায়িত্ব চুক্তি’তে (global sustainability pact) স্বাক্ষর করেছে এবং ইস্তাম্বুল খাল প্রকল্পকে যেহেতু একটি ‘টেকসই প্রকল্প’ হিসেবে বিবেচনা করা হয় না, সেহেতু এই প্রকল্পের অর্থায়ন করতে তারা আইনত অপারগ। তদুপরি, তুর্কি সরকার ইস্তাম্বুল খাল প্রকল্পের অর্থায়নের জন্য যে ‘সরকারি–বেসরকারি অংশীদারিত্ব’ মডেল অনুসরণ করার আগ্রহ ব্যক্ত করেছে, অতীতে সেটি অর্থনৈতিকভাবে অলাভজনক হিসেবে প্রমাণিত হয়েছে (এক্ষেত্রে ইতিপূর্বে প্রদত্ত ওসমান গাজী সেতুর উদাহরণ দ্রষ্টব্য)। এই পরিস্থিতিতে তুর্কি সরকার উক্ত প্রকল্পের অর্থায়নের জন্য বিদেশি বিনিয়োগকারীদের প্রতি ঝুঁকে পড়তে পারে।
কিন্তু এক্ষেত্রে তুরস্কের জন্য সমস্যা হচ্ছে– পশ্চিমা বিশ্ব বা রাশিয়া এই প্রকল্পের অর্থায়নের জন্য রাজি হবে না। এক্ষেত্রে তুরস্ক এই প্রকল্পের বিনিয়োগের জন্য চীনের প্রতি ঝুঁকে পড়তে পারে বলে অনেক বিশ্লেষক ধারণা করছেন। কিন্তু এক্ষেত্রে মনে রাখা প্রয়োজন যে, এই ধরনের প্রশ্নবিদ্ধ প্রকল্পের অর্থায়নের মাধ্যমে সংশ্লিষ্ট রাষ্ট্রকে ‘ঋণের ফাঁদে’ (debt trap) আটকে ফেলা চীনা সরকারের একটি ভূরাজনৈতিক কৌশল, বহু পশ্চিমা বিশ্লেষকই এমনটা বিবেচনা করে থাকেন। এক্ষেত্রে তারা শ্রীলঙ্কার হাম্বানটোটা সমুদ্রবন্দর প্রকল্পের উদাহরণ প্রদান করে থাকেন। শ্রীলঙ্কান সরকার অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক স্বার্থে চীনা অর্থায়নে উক্ত সমুদ্রবন্দরটি নির্মাণ করেছিল এবং সেটি অর্থনৈতিকভাবে লাভজনক না হওয়ায় পরবর্তীতে চীনের কাছে ৯৯ বছরের জন্য হস্তান্তর করতে বাধ্য হয়েছে। অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের টিউটর স্যামুয়েল রামানির ভাষ্যমতে, ইস্তাম্বুল খাল যদি অর্থনৈতিকভাবে অলাভজনক হয় এবং তুর্কি অর্থনীতির বর্তমান দূরবস্থার প্রেক্ষাপটে তুরস্ক যদি চীনের কাছ থেকে গৃহীত ঋণ পরিশোধে অপারগ হয়, সেক্ষেত্রে উক্ত খালের ওপর তুরস্কের সার্বভৌমত্ব নিয়ে শঙ্কা দেখা দিতে পারে। স্বভাবতই পশ্চিমা বিশ্ব কৃষ্ণসাগরকে চীনা প্রভাব বলয়ের অংশ হিসেবে বিবেচনা করে না এবং এতদঞ্চলে চীনা প্রভাব বৃদ্ধিকে তারা ইতিবাচক দৃষ্টিতে দেখবে না।
তদুপরি, ইস্তাম্বুল খাল প্রকল্পকে তুর্কি সরকার যেভাবে তুর্কি রাষ্ট্রের স্বার্থের জন্য গৃহীত মহাপ্রকল্প হিসেবে উপস্থাপন করছে, সেই উপস্থাপনা কতটুকু সত্যি, সেটি নিয়েও তুর্কি বিশ্লেষকদের মধ্যে সংশয় রয়েছে। এরদোয়ানের ভাষ্যমতে, প্রকল্পটির পেছনে মোট খরচ হবে ১,৫০০ কোটি (বা ১৫ বিলিয়ন) মার্কিন ডলার। কিন্তু তুর্কি অর্থনীতিবিদদের ধারণা, এর নির্মাণব্যয় ২,০০০ কোটি (বা ২০ বিলিয়ন) মার্কিন ডলার ছাড়িয়ে যাবে। তদুপরি, এই খাল নির্মাণ করতে গেলে ইস্তাম্বুলের সবগুলো রাজপথ, সড়ক, পানির পাইপ, বিদ্যুতের লাইন, গ্যাসের লাইন ও কিছু কিছু মহল্লার সম্পূর্ণ অংশ নির্মূল করে ফেলতে হবে এবং আবার নতুন করে গড়ে তুলতে হবে। এসব অবকাঠামোগত সংস্কারের জন্য অন্তত ২৫,০০০ কোটি (বা ২৫০ বিলিয়ন) মার্কিন ডলার ব্যয় হবে বলে ধারণা করা হয়।
ইতিহাসকে যদি অভিজ্ঞতার মাপকাঠি হিসেবে বিবেচনা করা হয়, সেক্ষেত্রে বলা যায়, উন্নয়নশীল রাষ্ট্রগুলোতে বড় ধরনের অবকাঠামোগত প্রকল্প গ্রহণ স্বাভাবিকভাবেই ক্ষমতাসীন দলের নেতা ও সরকারি কর্মকর্তাদের ব্যাপক দুর্নীতি করার সুযোগ করে দেয়। তুর্কি বিশ্লেষক ইয়োরুক ইশিকের মতে, ইস্তাম্বুল খাল প্রকল্পের ক্ষেত্রে তুরস্কেও একই ঘটনা ঘটছে। উক্ত প্রকল্পে সর্বপ্রথম যারা বিনিয়োগ করেছেন, তাদের মধ্যে রয়েছেন তুর্কি সরকারের কিছু মন্ত্রী এবং তুরস্কের ঘনিষ্ঠ উপসাগরীয় আরব মিত্র রাষ্ট্র কাতারের বর্তমান আমিরের মা মোজা বিনতে নাসের। ইতোমধ্যেই তারা ইস্তাম্বুল খালের সম্ভাব্য গতিপথ নিয়ে যে ভূমি বাণিজ্য চলছে, সেই প্রক্রিয়া থেকে বিপুল মুনাফা অর্জন করেছেন।
সুতরাং ইস্তাম্বুল খাল প্রকল্প একদিকে যেমন বহির্বিশ্বে তুরস্কের ভূরাজনৈতিক গুরুত্ব বৃদ্ধির জন্য গুরুত্বপূর্ণ, তেমনিভাবে তুর্কি সরকারি কর্মকর্তাদের ব্যক্তিগত লাভেরও একটি গুরুত্বপূর্ণ মাধ্যম হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে। বস্তুত কিছু কিছু তুর্কি বিশ্লেষকের ধারণা, ইস্তাম্বুল খাল প্রকল্পের মূল উদ্দেশ্য অর্থনৈতিক তো নয়ই, এমনকি ভূরাজনীতিও এটির মূল উদ্দেশ্য নয়। তাদের মতে, এটি কার্যত একটি রিয়েল এস্টেট প্রকল্প,যার মূল উদ্দেশ্য সরকারের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ ব্যক্তিবর্গ ও কোম্পানিগুলোকে ব্যাপক হারে মুনাফা অর্জনের সুযোগ করে দেয়া।
সামগ্রিকভাবে, ইস্তাম্বুল খাল প্রকল্প তুরস্কের অভ্যন্তরে ও বাইরে ব্যাপক আলোচনা–সমালোচনার জন্ম দিয়েছে। এগুলোর মধ্যে কতটুকু সত্যি আর কতটুকু বাড়াবাড়ি, সেটি সঠিকভাবে নির্ধারণ করা কঠিন হয়ে দাঁড়িয়েছে। অবশ্য বাস্তবতা হচ্ছে, এখন পর্যন্ত খালের নির্মাণকাজ আরম্ভই হয়নি। এজন্য ইস্তাম্বুল খাল তুরস্কের জন্য একটি ‘গেইম–চেঞ্জার’ ভূরাজনৈতিক প্রকল্প হবে, নাকি তুর্কি সরকারের অন্য বেশ কিছু মেগাপ্রকল্পের মতো অর্থনৈতিকভাবে অলাভজনক একটি ‘শ্বেত হস্তী’ (White Elephant) হয়ে দাঁড়াবে, সেটি কেবল খালটির নির্মাণকাজ সমাপ্ত হওয়ার পরেই নিশ্চিতভাবে বোঝা যাবে।