২০১৮ সালের নভেম্বরে জন অ্যালেন চাও নামের ২৬ বছর বয়সী এক আমেরিকান খ্রিস্টান মিশনারি পর্যটক রহস্যময় নর্থ সেন্টিনেল দ্বীপে পা রাখেন। তিনি এখানে আসেন আন্দামান দ্বীপপুঞ্জ অঞ্চলের সাতজন জেলেকে মোটা অঙ্কের ঘুষ দিয়ে। কারণ এ দ্বীপে বিদেশি পর্যটকদের প্রবেশের ব্যাপারে নিষেধাজ্ঞা আছে ভারত সরকারের। কিন্তু সেই ব্যক্তির অভিজ্ঞতা সুখকর হয়নি। তাকে মৃত্যুবরণ করতে হয় সেই দ্বীপবাসীদের হাতে, যাদের ‘সেন্টিনেলিজ’ বলা হয়। তারা অ্যালেনের লাশটাও দ্বীপেই সমাহিত করে। ভারতীয় পুলিশও তার মৃতদেহ উদ্ধার করতে পারেনি। বরং বলা যায়, তারা সেটা করতে চায়নি।
ভারত সরকার এই দ্বীপবাসীদের বিরক্ত করতে চায় না। রহস্যময় এই দ্বীপবাসীরা সভ্যতার আলো থেকে বিচ্ছিন্ন। তাদের সাথে বহির্বিশ্বের মানুষদের কোনো যোগাযোগ নেই। তাদের ভাষাও আলাদা। তারা কী ভাষায় কথা বলে, কেউ জানে না। এমনকি তারা নিজেদের কী জাতি মনে করে বা দ্বীপটিকে কী নামে ডাকে, সেটাও কেউ জানে না। একবিংশ শতাব্দীর অত্যাধুনিক প্রযুক্তি কম্পিউটার, ইন্টারনেট, ফেসবুক, ইউটিউব সম্পর্কে তাদের কোনো পরিচিতিই নেই। এমনকি কৃষিকাজও করে না তারা। শিকারের মাধ্যমেই খাদ্য সংগ্রহ করে থাকে তারা।
তাদের দ্বীপে বহিরাগত কেউ এলে খুবই আক্রমণাত্মক হয়ে ওঠে তারা। দ্বীপের কাছাকাছি কোনো নৌকা বা জাহাজ যেতে দেখলেই তীর, বর্শা, পাথর উড়িয়ে মারতে থাকে। এমনকি খুন করতেও দ্বিধা করে না। যেহেতু তারা দ্বীপে কাউকে প্রবেশ করতে দেয় না, তাই দ্বীপ সম্পর্কেও খুব বেশি তথ্য জানা যায় না। তাদের সম্পর্কে এখন পর্যন্ত যতটুকু তথ্য জানা গেছে, সবই দূর থেকে নৌকা বা জাহাজ থেকে পর্যবেক্ষণের মাধ্যমে এবং সেন্টিনেলিজরা যতটুকু কাছে যেতে দিয়েছে, ততটুকু দূরত্ব থেকে।
তারা দ্বীপের জঙ্গল থেকে বন্য প্রাণী শিকার করে আর উপকূলের কাছে মাছ শিকার করে। অন্য আদিবাসীদের মতো তারা বড় নৌকা তৈরি করে না, খুবই সরু ও ছোট ক্যানু তৈরি করে। দুই ধরনের ঘর আছে তাদের। দ্বীপের ভেতরের দিকে বড় কুঁড়েঘর, যাতে একসাথে অনেক জন থাকতে পারে। আবার কিছু ঘর আছে, যেগুলোর শুধু ছাদ থাকে, দেয়াল বা বেড়া থাকে না। এগুলো মাঝে মাঝে সমুদ্রসৈকতের কাছেও দেখা যায়। ছোট ঘরগুলোতে সাধারণত ছোট এক পরিবার থাকে।
রহস্যময় এই দ্বীপটি আনুষ্ঠানিকভাবে ভারতের অধীনস্থ। এটি আন্দামান দ্বীপপুঞ্জের একটি অংশ। এই দ্বীপগুলো ভারতের মূল ভূখণ্ড থেকে অনেকটা দূরে ভারত মহাসাগরের মাঝখানে ভারত ও মালয় উপদ্বীপের মধ্যবর্তী অঞ্চলে অবস্থিত। এসব দ্বীপে ভারতীয়দের পাশাপাশি অল্প সংখ্যক স্থানীয় আদিবাসীরা বসবাস করে। এই আদিবাসীদের মধ্যে সেন্টিনেলিজরাও আছে। এই আদিবাসীরা ঐতিহাসিকভাবেই শিকারনির্ভর। অন্য আদিবাসীদের সাথে বহির্বিশ্বের সম্পর্ক স্থাপন সম্ভব হলেও সেন্টিনেলিজদের সাথে এখনো সম্ভব হয়নি। এমনকি তাদের সাথে অন্যান্য দ্বীপের আদিবাসীদের মধ্যেও কোনো যোগাযোগ নেই। সেন্টিনেল দ্বীপটি আয়তনে প্রায় ম্যানহাটনের সমান। সে দ্বীপে তাদের জনসংখ্যা কত, সে সম্পর্কে সঠিক তথ্য নেই। আনুমানিক ১৫ থেকে ৫০০ জন সেন্টিনেলিজ থাকে দ্বীপে। ১৯৯১ সালে প্রথমবারের মতো আদমশুমারিতে তাদের সংখ্যা অন্তর্ভুক্ত করে ভারত সরকার। সেবার আনুমানিক ১১৭ জন হিসাব করা হয়েছিল। ২০১১ সালে মাত্র ১৫ জন যোগ করা হয়। ধারণা করা হয়, অন্তত ৩০ হাজার বছর ধরে তাদের বসবাস এখানে। তবে সভ্যতা থেকে বিচ্ছিন্ন থাকলেও গত ২০০ বছরে একেবারেই যে তাদের সাথে বহির্বিশ্বের মানুষের যোগাযোগ হয়নি তা নয়।
১৭৭১ সালের এক রাতে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির একটি জাহাজ সেন্টিনেল দ্বীপের সামনে দিয়ে যাচ্ছিল। জাহাজ থেকে দ্বীপের কূলের দিকে আলো জ্বলতে দেখা যায়। জাহাজটি সমুদ্র নিয়ে জরিপের কাজে থাকায় সেখানে আর থামেনি। সেন্টিনেলিজরাও তাই আর কোনো প্রতিক্রিয়া দেখায়নি। এরপর প্রায় একশো বছর তাদের সাথে বহির্বিশ্বের যোগাযোগের কথা শোনা যায়নি।
১৮৬৭ সালের গ্রীষ্মের এক দিনে ‘নিনেভাহ’ নামের এক ভারতীয় বাণিজ্য জাহাজ ঝড়ের কবলে পড়ে। জাহাজের ৮৬ জন যাত্রী ও ২০ জন ক্রু সদস্য তখন সাঁতার দিয়ে দ্বীপে গিয়ে আশ্রয় নেয়। তারা সেখানে তিন দিন অবস্থান করে। শুরুতে সেন্টিনেলিজ আদিবাসীরা তাদের সামনে না এলেও তৃতীয় দিনের দিন এসে তীর-ধনুক নিয়ে আক্রমণ করা শুরু করে। প্রত্যক্ষদর্শীদের ভাষ্যে, তারা ছিল সম্পূর্ণ নগ্ন, নাকে ছিল লাল রঙ মাখানো, তীরের মাথা ছিল লোহার। জাহাজবাসীরাও ছেড়ে কথা বলেনি। তারাও লাঠি আর পাথর দিয়ে আদিবাসীদের আঘাত করতে থাকে। শেষপর্যন্ত ব্রিটিশ রয়েল নেভির একটি জাহাজ এসে নিনেভাহ জাহাজের যাত্রী ও ক্রুদের রক্ষা করে।
এগুলো অবশ্য শুধুমাত্র নিনেভাহ জাহাজের বেঁচে ফেরাদের পক্ষের কথা। তারা যখন দ্বীপে প্রবেশ করে, তখন সেন্টিনেলিজরা কী ভাবছিল, তা কৌতূহলের বিষয়। জাহাজবাসীরা যে তিন দিন সেখানে ছিল, সেন্টিনেলিজরা তাদের গ্রামে নতুন আগন্তুকদের নিয়ে কী আলোচনা করছিল, জাহাজবাসীরাও কোনো সীমা লঙ্ঘনের মতো কাজ করেছিল কি না, সেগুলো কখনো জানা যাবে না। ব্রিটিশরা তখন সেন্টিনেল দ্বীপকে তাদের কলোনির অংশই বিবেচনা করা শুরু করে।
১৮৮০ সালে ব্রিটিশ রয়েল নেভির তরুণ অফিসার মরিস ভিদাল পোর্টম্যান আন্দামান ও নিকোবর কলোনির দায়িত্ব নেন। তিনি নিজেকে একজন নৃবিজ্ঞানীও মনে করতেন। ১৮৮০ সালে তিনি নর্থ সেন্টিনেল দ্বীপে প্রবেশ করেন। তার সাথে ছিল ব্রিটিশ নৌবাহিনীর অফিসারদের বিশাল বহর, বৃহত্তর আন্দামান দ্বীপের বন্দিশিবিরের বিভিন্ন আসামী আর স্থানীয় আন্দামানীয় কিছু লোক। তারা গিয়ে দেখেন, সেখানে জনমানবশূন্য এক গ্রাম। বহিরাগতদের দেখে তারা হয়তো দ্বীপের আরো ভেতরে গিয়ে লুকিয়ে ছিল। সম্ভবত এক দম্পতি আর চার শিশু গ্রামবাসীদের থেকে পেছনে পড়ে গিয়েছিল। পোর্টম্যানের অভিযাত্রী দল তাদেরকে আটকে ফেলে এবং দক্ষিণ আন্দামান দ্বীপের উপনিবেশীয় রাজধানী পোর্ট ব্লেয়ারে নিয়ে যায়।
কিন্তু সভ্য সমাজ থেকে বিচ্ছিন্ন থাকায় তাদের শরীরে সাধারণ ফ্লু কিংবা হামের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা থাকার কথা নয়। সেই ছয়জন খুব দ্রুতই অসুস্থ হয়ে পড়ে। দম্পতি মারা যাওয়ায় পোর্টম্যান বাকি চার শিশুকে সামান্য কিছু উপহার দিয়ে দ্বীপে রেখে চলে আসেন। চার শিশুর কী হয়েছিল, তা জানা যায়নি। তারা গ্রামে গিয়ে রোগ ছড়িয়ে দিয়েছিল কি না, তা-ও জানা যায়নি। তবে তা হওয়ার সম্ভাবনা ছিল ভালোই। আর যদি তা হয়েই থাকে, তাহলে সেন্টিনেলিজরা কেন এখনও তাদের দ্বীপে বহিরাগতদের ঢুকতে দেয় না, সেটা অনুমান করা কঠিন কিছু নয়।
১৮৯৬ সালে আন্দামান দ্বীপের জেল থেকে এক আসামী পালিয়ে সেখানে যায়। কিন্তু সে তো আর জানত না, জ্বলন্ত আগুন থেকে ফুটন্ত তেলের মাঝে গিয়ে পড়েছে! উপনিবেশীয় এক সার্চ পার্টি কিছুদিন পর তীরে বিদ্ধ গলাকাটা সেই আসামীর লাশ খুঁজে পায় সমুদ্রে। ব্রিটিশরা তখন সিদ্ধান্ত নেয়, সেন্টিনেলিজদের আর বিরক্ত না করার।
ভারত স্বাধীন হওয়ার পর ১৯৬৭ সালে সরকারের পক্ষ থেকে নৃবিজ্ঞানী ত্রিনক নাথ পণ্ডিত তার একটি দল নিয়ে সেই দ্বীপে যান। তারাও সেখানে গিয়ে পোর্টম্যানের মতো খালি গ্রাম দেখতে পান। তারা এত দ্রুত পালিয়ে গিয়েছিল যে, তাদের বাড়ির সামনে তখনো আগুন জ্বলছিল। পণ্ডিত আর দল তখন সেন্টিনেলিজদের জন্য কিছু উপহার রেখে যান। এগুলোর মধ্যে ছিল কাপড়, চকলেট, প্লাস্টিকের বালতি ইত্যাদি। অন্যদিকে পণ্ডিতের দলের সাথে থাকা ভারতীয় নৌবাহিনীর অফিসার আর পুলিশ সদস্যরা সেন্টিনেলিজদের তীর-ধনুক আর কিছু ব্যবহার্য জিনিস চুরি করে নিয়ে এসেছিল। নৃবিজ্ঞানীদের প্রতিবাদ সত্ত্বেও তারা এগুলো নিয়ে আসে। সেন্টিনেলিজরা হয়তো সেটাও পছন্দ করেনি।
পণ্ডিত তার সহকর্মীদের সাথে তারপরও বিভিন্ন সময়ে সেন্টিনেলিজদের সাথে যোগাযোগের চেষ্টা অব্যাহত রাখেন। তারা ডিঙ্গি নৌকা নিয়ে দ্বীপের কাছাকাছি স্থানে গিয়ে বিভিন্ন সময়ে উপহার দিয়ে আসতেন। দ্বীপের নিকটবর্তী পানিতে নারিকেল ও অন্যান্য খাবার ভাসিয়ে দিতেন। কিন্তু তাদের পক্ষ থেকে কোনো ইতিবাচক প্রতিক্রিয়া পাওয়া যায়নি। একবার তাদের একটি শূকর আর পুতুল উপহার দেওয়া হয়েছিল। তারা শূকরটিকে তীরবিদ্ধ করে মেরে মাটিতে পুঁতে ফেলে। পুতুলটিও একইসাথে পুঁতে ফেলে। তবে তাদের ধাতব পাত্রের প্রতি আগ্রহ দেখা যায়। এছাড়াও ধীরে ধীরে তারা নারিকেলের প্রতি আগ্রহী হয়, যা তাদের দ্বীপে জন্মায় না। এভাবে ২৫ বছর চলে যায়, সেন্টিনেলিজদের সাথে কোনো সরাসরি যোগাযোগ হয় না। কিন্তু পণ্ডিত মনে করছিলেন, তারা সেন্টিনেলিজদের আস্থা অর্জন করছিলেন।
পণ্ডিতের অভিযানগুলোর মাঝেই বিভিন্ন সময়ে সেন্টিনেলিজদের আক্রমণের ঘটনা ঘটে। ১৯৭৪ সালে ন্যাশনাল জিওগ্রাফিকের একটি ডকুমেন্টারির ভিডিও ধারণের সময় সেন্টিনেলিজদের আক্রমণের শিকার হন। ১৯৭৫ সালে নির্বাসনে থাকা বেলজিয়ামের রাজা তৃতীয় লিওপোল্ড সেন্টিনেল দ্বীপের কাছে ভ্রমণ করতে এলে তিনিও আক্রমণের শিকার হন। ১৯৮১ সালে ‘প্রিমরোজ’ নামের পানামার এক কার্গো জাহাজ সেন্টিনেল দ্বীপের কাছে প্রবালে আটকে যায়। জাহাজের ২৮ জন ক্রু তখন সেন্টিনেলিজদের আক্রমণের শিকার হয়। তারা জাহাজ ভাঙা শুরু করে এবং ধাতব অংশগুলো নিয়ে যায়, সম্ভবত অস্ত্র বানানোর জন্য। জাহাজের ক্রুদের বিপদ থেকে রক্ষা করার জন্য দ্রুত হেলিকপ্টার চলে আসে। এসবের মাঝেও পণ্ডিত দুয়েকমাস পর পর তার অভিযান অব্যাহত রাখেন।
অবশেষে ১৯৯১ সালের এক দিন সেন্টিনেলিজরা প্রথমবারের মতো অস্ত্র ছাড়া পণ্ডিতের দলের সামনে আসে। তারা এসে নৌকার কাছ থেকে নারিকেল নিয়ে যায়। এতটা কাছে এর আগে কখনো তারা আসেনি। তবে এর মানে এই নয় যে, তারা বহিরাগতদের সাথে বন্ধুত্ব করতে চেয়েছিল। এর কয়েক সপ্তাহ পর পণ্ডিত তার দল নিয়ে আবার গেলে সেন্টিনেলিজ এক লোক তাদের দিকে অস্ত্র তাক করে বুঝিয়ে দেয়, এটা শুধুই তাদের এলাকা। ১৯৯৬ সালে ভারত সরকার এখানে অভিযান বন্ধ করে দেয়।
২০০৪ সালে সুনামির সময় ভারতীয় কোস্টগার্ড হেলিকপ্টার দিয়ে টহল দিতে যায়, সেখানে তারা ঠিক আছে কি না, দেখতে। আশ্চর্যজনকভাবে তারা সুনামি থেকে রক্ষা পায় বলেই মনে হয়। হেলিকপ্টার দেখে তারা তীর ছুঁড়ে মারার জন্য চলে আসে।
সেন্টিনেলিজদের সাথে কি বাইরের দুনিয়ার বন্ধুত্ব সম্ভব? সমস্যা হচ্ছে বন্ধুত্ব একদিক থেকে হয় না। অ্যালেন চাওয়ের ঘটনার আগে ২০০৬ সালেও অবৈধভাবে মাছ ধরতে যাওয়া জেলেদের প্রাণ দিতে হয়েছিল সেন্টিনেলিজদের হাতে। এটা স্পষ্ট যে, তারা তাদের মতো থাকতে চায়, কারো সাথে বন্ধুত্ব করার ইচ্ছা নেই তাদের। তাদের বিরক্ত না করলে তারাও অন্যদের নিয়ে মাথা ঘামায় না। তাই বিশেষজ্ঞরা মতামত দিয়েছেন, তাদেরকে তাদের মতোই থাকতে দেওয়া হোক।
তাছাড়া তাদের পাশের দ্বীপগুলোতে ব্রিটিশরা কলোনি স্থাপন করার পর সেখানকার আদিবাসীরা বিলুপ্ত হয়ে গেছে। তারা এখনো টিকে আছে হয়তো বিচ্ছিন্ন থাকার কারণেই। এ দ্বীপে জোর খাটিয়ে প্রবেশ করতে হলে সেন্টিনেলিজদের ওপর আক্রমণ করেই ঢুকতে হবে। আর তা হবে খুবই অমানবিক। তবে এ দ্বীপ নিয়ে বহির্বিশ্বে কৌতূহলের শেষ নেই, হয়তো এখানেই লুকিয়ে আছে সেন্টিনেলিজদের আড়ালে কোনো এক গোপন সভ্যতা!