নানা ঘটনা-দুর্ঘটনার অবলোকনের মধ্য দিয়ে শেষ হলো ২০২২ সাল। ২০২২ সালে যেমন পৃথিবী করোনা মহামারী থেকে পরিত্রাণ পায়, তেমনি প্রত্যক্ষ করে ভয়াবহ যুদ্ধ, মানবিক সংকট ও জলবায়ু পরিবর্তনের। চলুন, একনজরে দেখে নেয়া যাক ২০২২ সালে পৃথিবীতে ঘটে যাওয়া উল্লেখযোগ্য ১০টি রাজনৈতিক ঘটনা।
১) ইউক্রেনে রাশিয়ার আগ্রাসন
২০২২ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে বছরের সবচেয়ে দুর্যোগপূর্ণ রাজনৈতিক সংঘাত বা যুদ্ধের সূচনা পর্যবেক্ষণ করে বিশ্ববাসী। প্রাক্তন সোভিয়েতভুক্ত ও রাশিয়ার প্রতিবেশী দেশ ইউক্রেনের রাষ্ট্রপতি জেলেনেস্কি মার্কিন নিরাপত্তাবলয় সংগঠন ন্যাটোতে যোগদানে আগ্রহ প্রকাশ করেন। বাড়ির পাশে ন্যাটো বাহিনীর অবস্থান যেমন মেনে নিতে পারবে না রাশিয়া, তেমনই ভৌগলিক ও নিরাপত্তার জন্য ইউক্রেন রাশিয়ার নিকট অতি গুরুত্বপূর্ণ দেশ। ফেব্রুয়ারির ২৪ তারিখ থেকে শুরু হওয়া এই যুদ্ধ চলছে ২০২২ সালের পুরোটা জুড়েই। রাশিয়ার ইউক্রেন অভিযানের পর বিশ্বজুড়ে দেখা যায় খাদ্য সংকট, শক্তি সংকট। আন্তর্জাতিক শক্তির অন্যতম প্রদর্শনক্ষেত্র হয়ে উঠেছে ইউক্রেন।
২) শ্রীলঙ্কার রাজনৈতিক অস্থিরতা
শ্রীলঙ্কায় গৃহযুদ্ধের অবসানের পর রাষ্ট্রপতি রাজাপক্ষে যুদ্ধের ব্যয়, ট্যুরিজম সেক্টরে উন্নতির জন্য বৃহৎ অবকাঠামো নির্মাণ, মিত্রদের পুরস্কৃত করার জন্য প্রচুর বৈদেশিক ঋণ নেন। তখন শ্রীলংকার বৈদেশিক রিজার্ভ ছিল কম। রাজাপক্ষে রাজনৈতিক সমর্থন আদায় ও অস্থিরতা দূর করার জন্য কর কমিয়ে দেন। কিন্তু ২০১৯ সালে বিশ্বব্যাপী করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাব শ্রীলংকার ট্যুরিজম সেক্টরে ধস নামায়। এই ট্যুরিজম সেক্টর হচ্ছে শ্রীলংকার বৈদেশিক আয়ের সবচেয়ে বড় উৎস। ২০২১ সালে আবার গোতাবায়া সিদ্ধান্ত নেন কৃষিকাজে কেমিক্যাল ফার্টিলাইজার ব্যবহার করা যাবে না, যা শ্রীলংকার চা উৎপাদনশিল্পে ধস নামায়।
চা শ্রীলঙ্কার সবচেয়ে বড় রপ্তানি পণ্য। এর সাথে নতুন মাত্রা যোগ করে ২০২২ সালে শুরু হওয়া রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ। যুদ্ধের ফলে বিশ্বব্যাপী খাদ্য সংকটের ধাক্কা লাগে শ্রীলঙ্কায়, যা দেশটিতে রাজনৈতিক অস্থিরতা তৈরি করে। শ্রীলঙ্কার সর্বস্তরের জনগণের আন্দোলনের মুখে রাজাপক্ষে সরকারের পতন ঘটে, এবং তিনি পালিয়ে যান।
৩) শিনজো আবে হত্যাকান্ড
এশিয়ান টাইগার্সের দেশ জাপানের সাবেক প্রধানমন্ত্রী শিনজো আবে ২০২২ সালের ৮ জুলাই হত্যাকাণ্ডের শিকার হন। আবে জাপানের নারা শহরের পশ্চিমে একটি ক্যাম্পেইনে বক্তৃতা দিচ্ছিলেন। তখন বাসায় বানানো একটি বন্দুক দিয়ে তাকে মাত্র ১০ ফুট দূর থেকে গুলি করা হয়।
হত্যাকারী ৪১ বছর তেতসুয়া ইয়ামাগামি জাপানের নৌবাহিনীর সাবেক কর্মকতা। ইয়ামাগামির মতে, শিনজো আবে একটি ধর্মীয় গোষ্ঠীকে সমর্থন করেছেন যা ঐ গোষ্ঠীর পক্ষে প্রচারণা করা হয়। ধর্মীয় দলটিতে ইয়ামাগামির মা অর্থ দিয়ে নিজে দেউলিয়া হয়ে যান, এমন বক্তব্য তার। জাপানের প্রধানমন্ত্রী থাকাকালে আবে ঐ গোষ্ঠীকে সমর্থন দিতেন, কারণ তারা জাপানের শিশুদের এমন শিক্ষা দিত যাতে কমিউনিজমকে তারা ঘৃণা করতে শেখে।
৪) রানী ২য় এলিজাবেথের মৃত্যু
ব্রিটেনের সবচেয়ে দীর্ঘস্থায়ী শাসক রানী ২য় এলিজাবেথ, যিনি ২০২২ সালের ৮ সেপ্টেম্বর ৯৬ বছর বয়সে মৃত্যুবরণ করেন। তিনি মোট ৭০ বছর ব্রিটিশ রাজতন্ত্রের প্রধান হিসেবে ছিলেন। ব্রিটেনের রানী পৃথিবীর মোট ১৪টি দেশের নিয়মতান্ত্রিক রাষ্ট্রপ্রধান ও কমনওয়েলথের প্রধান। এলিজাবেথের মৃত্যুর পর রাজা হন তার ছেলে তৃতীয় চার্লস। রানীর মৃত্যুর পর ব্রিটেনে ১০ দিনের শোক ঘোষণা করা হয়, যা অর্থনীতিতেও প্রভাব ফেলে।
৫) ইরানের বিদ্রোহ
২০২২ সালের অন্যতম একটি ঘটনা হচ্ছে ইরানের হিজাববিরোধী বিদ্রোহ। ১৯৭৯ সালের পর ইরানের সরকার ২০২২ সালে একটি বড়সড় বিদ্রোহের সম্মুখীন হয়। ইরানে পুলিশের হেফাজতে মাশা আমিনি নামে এক তরুণীর মৃত্যুর পর হিজাব এবং নৈতিকতা-পুলিশের বিরুদ্ধে বিক্ষোভে নামে ইরানের হাজার হাজার তরুণী। তারা প্রকাশ্যে পুড়িয়ে দেয় নিজেদের হিজাব। মাশা আমিনি তেহরানে তার ভাইয়ের সাথে থাকা অবস্থায় তার বিরুদ্ধে হিজাব দিয়ে চুল ঢেকে রাখা এবং ঢিলেঢালা পোশাক পরার আইন ভঙ্গ করার অভিযোগ ওঠে। তারপর তিনি ইরানের পুলিশের হেফাজতে থাকাবস্থায় কোমায় চলে যান। পুলিশের বিরুদ্ধে অভিযোগ ওঠে তাকে নির্যাতনের। তার মৃত্যুর পর ইরানসহ পুরো পৃথিবী প্রত্যক্ষ করে এক বড়সড় বিদ্রোহ।
৬) চীনে শি জিনপিংয়ের তৃতীয় মেয়াদে জয়
পৃথিবীর অন্যতম বড় জনসংখ্যার দেশ চীন বর্তমান বিশ্বের অর্থনৈতিক ক্ষমতাবান দেশ। চীনের সর্বোচ্চ ক্ষমতাবান ব্যক্তি হচ্ছেন চীনের রাষ্ট্রপতি। কমিউনিস্ট পার্টি শাসিত চীনের রাষ্ট্রপতি হন পার্টির সাধারণ সম্পাদক। সুতরাং যিনি কমিউনিস্ট পার্টি অব চায়না বা সিপিসির সাধারণ সম্পাদক হবেন, তিনিই হবেন চীনের রাষ্ট্রপতি। ২০২২ সালের নভেম্বরে চীনের গ্রেট হলে অনুষ্ঠিত হলো সিপিসির ২০ তম কংগ্রেস। উক্ত কংগ্রেসে সিপিসির সাধারণ সম্পাদক হিসেবে পুনর্নির্বাচিত হন শি জিনপিং। সুতরাং শি জিনপিং চীনের রাষ্ট্রপতি হিসেবে বহাল থাকছেন। বলা যায়, শি হচ্ছেন বর্তমান পৃথিবীর অন্যতম এক শক্তিশালী রাষ্ট্রপতি। তার পুনরায় রাষ্ট্রপতি থাকা একটি বড় রাজনৈতিক ঘটনা গত বছরের।
৭) বিশ্বজুড়ে বামদের ক্ষমতায়ন বৃদ্ধি
২০২২ সালে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে বাম রাজনৈতিক দলগুলো ক্ষমতাসীন হয়েছে। লাতিন আমেরিকায় যার সবচেয়ে বেশি প্রভাব লক্ষ্যণীয়। গত চার বছরে বামপন্থী প্রার্থীরা একের পর এক লাতিন আমেরিকার দেশে রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে জয়ী হয়েছেন। যেমন- মেক্সিকো, আর্জেন্টিনা, বলিভিয়া, পেরু, চিলি এবং কলম্বিয়া। সবশেষ এই তালিকায় যুক্ত হলো পৃথিবীর সপ্তম বৃহত্তম অর্থনীতির দেশ ব্রাজিল।
ব্রাজিলের ২ অক্টোবরের নির্বাচনে রাষ্ট্রপতি হিসেবে নির্বাচিত হয়েছেন শ্রমিক দলের লুইজ ইনাসিও লুলা দা সিলভা। ২০২২ সালে গণতান্ত্রিক সমাজতান্ত্রিক জিওমারা কাস্ত্রো হন্ডুরাসের রাষ্ট্রপতি হিসেবে শপথ গ্রহণ করেন, প্রাক্তন বিদ্রোহী গুস্তাভো পেট্রো কলম্বিয়ার প্রথম বামপন্থী রাষ্ট্রপতি হয়েছেন। ইউরোপীয় দেশ জার্মানির বর্তমান নেতা একজন বামপন্থী। ফ্রান্সে বামপন্থী দল হয়েছে আরো শক্তিশালী। আয়রল্যান্ড, হাঙ্গেরিতেও বাম দলগুলোর প্রভাব-প্রতিপত্তি বৃদ্ধি পাচ্ছে। সর্বশেষ নেপালের নির্বাচনে জয় পেয়েছেন একজন বামপন্থী নেতা। ২০২২ সালে বামপন্থী দলগুলো অনেক দেশে এসেছে ক্ষমতায়, হয়েছে আরো শক্তিশালী।
৮) ইংল্যান্ডে এক বছরে তিন প্রধানমন্ত্রী
২০২২ সালে যুক্তরাজ্যে ২ মাসে তিনজন প্রধানমন্ত্রী উত্থান-পতন ঘটেছে। প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসনের পদত্যাগের পর সেই পদে আসীন হন লিজ ট্রাস। পরে তিনিই হয়ে যান ব্রিটেনের ইতিহাসের সবচেয়ে কম সময়ের প্রধানমন্ত্রী। তিনি পদত্যাগ করলে তার পদাসীন হন রিশি সুনাক। তাছাড়া, একই বছরে ব্রিটেন হারায় সবচেয়ে বেশি সময় শাসন করা রাজতান্ত্রিক প্রধানকে। ২০২২ যুক্তরাজ্যের রাজনীতিতে বড়সড় নাড়া দেয় বলাই যায়।
৯) আরবে প্রথম বিশ্বকাপ
আরব দেশ তথা মেনাভুক্ত (MENA – Middle East and North Africa) প্রথম কোনো দেশ হিসেবে ফিফা বিশ্বকাপ আয়োজন করলো কাতার। আয়োজক হিসেবে কাতার খরচ করেছে স্মরণকালের সবচেয়ে বেশি অর্থ। কাতারের উপর অভিযোগ এসেছে নানা বিষয়ে, যার দরুন ইউরোপের বিভিন্ন দেশে গণমাধ্যমে খেলার সম্প্রচার বন্ধ থাকে। আরবের এই রাষ্ট্রের বিশ্বকাপ আয়োজন আলোড়ন ফেলেছে মুসলিমবিশ্বেও। এই বিশ্বকাপ আরববিশ্বের গতানুগতিক চিত্রের বাইরে নতুন চিত্র তৈরি করেছে।
১০) জলবায়ু পরিবর্তন ও COP27
২০২২ সালে পৃথিবীকে দেখতে হয়েছে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবজনিত নানা দুর্যোগ। বিজ্ঞানীরা সতর্ক করে আসছিলেন জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাব নিয়ে। ২০২২-এ এসে তার নানাবিধ প্রভাব দেখা যায়। পাকিস্তানে ভয়াবহ বন্যায় দেশের এক-তৃতীয়াংশ এলাকা পানির নিচে তলিয়ে যায়। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ফ্লোরিডায় আঘাত আনে ভয়াবহ ঘুর্ণিঝড়। অন্যদিকে, আমেরিকার দক্ষিণে ভয়াবহ খরা দেখা দেয় যা পূর্বের তুলনায় প্রথমবার ঘটে, যার দরুন ফসল উৎপাদন ব্যহত হয়, এমনকি লেক পর্যন্ত শুকিয়ে যায়। জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবেলায় ২০২২ সালে মিশরের শার্ম আল শেখে COP27 সভা অনুষ্ঠিত হয়। সভায় জলবায়ু পরিবর্তনে সম্ভাব্য ক্ষতিগ্রস্ত ও দরিদ্র দেশগুলোর কঠোর দাবি অনুযায়ী একটি ফান্ড গঠন করা হয়, যে ফান্ডের অর্থ পৃথিবীর দরিদ্র ও জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে ক্ষতিগ্রস্ত রাষ্ট্রগুলোর মাঝে বণ্টন করা হবে। বণ্টনের জন্য একটি অস্থায়ী কমিটিও গঠন করা হয় সম্মেলনে। চুক্তি অনুযায়ী ধনী দেশগুলো জলবায়ু পরিবর্তনে ক্ষতিগ্রস্ত দরিদ্র দেশগুলোকে ক্ষতিপূরণ দিতে নেতৃত্ব দেবে।