২০২০ সালের ২ জানুয়ারি তুর্কি আইনসভা ‘তুর্কি বৃহৎ জাতীয় সভা’ (Türkiye Büyük Millet Meslici, ‘তুর্কিয়ে বুয়ুক মিল্লেত মেসলিসি’) ৩২৫–১৮৪ ভোটে লিবিয়ায় তুর্কি সৈন্য মোতায়েনের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। ৫ জানুয়ারি থেকে তুরস্ক লিবিয়ায় তুর্কি সৈন্য এবং তুর্কি–সমর্থিত সিরীয় মার্সেনারিদের মোতায়েন করতে আরম্ভ করে।
আনুষ্ঠানিকভাবে, লিবিয়ার জাতিসংঘ–সমর্থিত ত্রিপোলি–ভিত্তিক সরকারের অনুরোধে তুরস্ক লিবিয়ায় সামরিক হস্তক্ষেপ করেছে। ২০১৪ সালের মে থেকে লিবিয়ার ত্রিপোলি–ভিত্তিক ‘জাতীয় ঐক্য সরকার’ (Government of National Accord) এবং তবরুক–ভিত্তিক ‘প্রতিনিধি পরিষদ’-এর (House of Representatives) মধ্যে গৃহযুদ্ধ চলছে। ত্রিপোলি–ভিত্তিক সরকারের নেতা রাষ্ট্রপতি পরিষদের সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী ফায়েজ আল–সাররাজ, এবং তবরুক–ভিত্তিক সরকারের নেতা ‘লিবীয় জাতীয় সেনাবাহিনী’র (Libyan National Army) সুপ্রিম কমান্ডার ফিল্ড মার্শাল খলিফা হাফতার।
ত্রিপোলি–ভিত্তিক সরকার লিবিয়ার রাজধানী ত্রিপোলিসহ উপকূলীয় ত্রিপোলিতানিয়া অঞ্চলটি নিয়ন্ত্রণ করছে, অন্যদিকে, তবরুক–ভিত্তিক সরকার ত্রিপোলিতানিয়ার পূর্বাঞ্চল এবং সাইরেনাইকা ও ফেজ্জান অঞ্চলের অধিকাংশ নিয়ন্ত্রণ করছে। লিবিয়ায় অধিকাংশ ভূমি তবরুক–ভিত্তিক সরকারের নিয়ন্ত্রণাধীন, কিন্তু জনসংখ্যার অধিকাংশই ত্রিপোলি–ভিত্তিক সরকারের নিয়ন্ত্রণাধীন। জাতিসংঘ ও আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় ত্রিপোলি–ভিত্তিক সরকারকে লিবিয়ার বৈধ সরকার হিসেবে স্বীকার করে।
লিবিয়ায় চলমান গৃহযুদ্ধে ত্রিপোলি–ভিত্তিক সরকারের বিদেশি সমর্থক মূলত তুরস্ক, কাতার ও ইতালি। অন্যদিকে, ইমারাত (সংযুক্ত আরব আমিরাত), মিসর, জর্দান, সৌদি আরব, রাশিয়া এবং ফ্রান্স সমর্থন দিচ্ছে তবরুক–ভিত্তিক সরকারকে। কার্যত লিবিয়া বিভক্ত হয়ে পড়েছে তুর্কি–নিয়ন্ত্রিত লিবিয়া এবং রুশ–ইমারাতি যৌথ নিয়ন্ত্রণাধীন লিবিয়ায়। কিন্তু এখন পর্যন্ত তুরস্ক ছাড়া অন্য কোনো রাষ্ট্র আনুষ্ঠানিকভাবে লিবিয়ায় সৈন্য মোতায়েন করেনি। তুর্কি হস্তক্ষেপের কারণে প্রায় কোণঠাসা হয়ে পড়া ত্রিপোলি–ভিত্তিক সরকারের অবস্থান শক্তিশালী হয়েছে এবং তবরুক–ভিত্তিক সরকারের সৈন্যরা প্রচুর ক্ষয়ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছে, কিন্তু তুর্কি–ত্রিপোলি জোটের জয়লাভের সম্ভাবনা এখনও অনিশ্চিত।
২০১১ সালে সিরিয়ার গৃহযুদ্ধ শুরু হলে তুরস্ক সিরীয় সরকারের বিরুদ্ধে অবস্থান নেয় এবং সিরীয় মিলিট্যান্ট গ্রুপগুলোকে সক্রিয়ভাবে সমর্থন দিতে শুরু করে। প্রায় ৯ বছর পর ২০২০ সালে সিরীয় অভিযানে তুরস্কের অর্জন কী? বর্তমানে সিরিয়ার তুর্কি–সমর্থিত মিলিট্যান্ট গ্রুপগুলো সিরিয়ার সমস্ত অঞ্চল থেকে বিতাড়িত হয়ে ইদলিব প্রদেশে কোনোক্রমে টিকে আছে; তুরস্কে অবস্থান করছে প্রায় ৩৮ লক্ষ সিরীয় শরণার্থী, যারা তুরস্কের ওপর বিরাট রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিক বোঝা হয়ে দাঁড়িয়েছে; শরণার্থী ব্যবস্থাপনা, সিরীয় মিলিট্যান্টদের সহায়তা প্রদান ও সিরিয়ায় সামরিক অভিযান পরিচালনা বাবদ আঙ্কারার ব্যয় হয়েছে ৫,০০০ কোটিরও (বা ৫০ বিলিয়ন) বেশি মার্কিন ডলার; এবং তুর্কি–সিরীয় সীমান্ত থেকে সিরীয় কুর্দি মিলিট্যান্টরা তুর্কি আক্রমণে পশ্চাৎপসরণে বাধ্য হলেও সিরিয়ার অভ্যন্তরে ২০ মাইল গভীর ‘নিরাপদ অঞ্চল’ সৃষ্টির তুর্কি প্রচেষ্টা রুশ ও সিরীয় বিরোধিতার কারণে ব্যর্থ হয়েছে। অর্থাৎ, সিরীয় গৃহযুদ্ধে হস্তক্ষেপ তুরস্কের জন্য একটি বড় ব্যর্থতা হয়ে দাঁড়ানোর সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে।
সিরিয়া তুরস্কের দক্ষিণ–পূর্বাঞ্চলীয় প্রতিবেশী রাষ্ট্র। সেখানে হস্তক্ষেপ করেই তুরস্ক সুবিধা করতে পারেনি, তাহলে আঙ্কারা কেন লিবিয়ায় হস্তক্ষেপ করছে, যেটি তুর্কি সীমান্ত থেকে ১,০০০ কিলোমিটারেরও বেশি দূরে অবস্থিত?
প্রথমত, তুরস্কের বর্তমান রাষ্ট্রপতি রিসেপ তাইয়্যেপ এরদোয়ান ও তাঁর রাজনৈতিক দল ‘একেপি’ (Adalet ve Kalkinma Partisi, ‘AKP’) ইসলামপন্থী ও জাতীয়তাবাদী চেতনায় বিশ্বাসী, এবং ওসমানীয় সাম্রাজ্যের ঐতিহ্য ও গৌরব ফিরিয়ে আনতে আগ্রহী। ষোড়শ শতাব্দীর মাঝামাঝি সময় থেকে ১৯১২ সাল পর্যন্ত লিবিয়া আনুষ্ঠানিকভাবে ওসমানীয় সাম্রাজ্যের অংশ ছিল, এজন্য একেপি লিবিয়াকে তুরস্কের প্রভাব অঞ্চল (sphere of influence) হিসেবে বিবেচনা করে। এই উদ্দেশ্যে ২০১১ সালের লিবীয় গৃহযুদ্ধে তুরস্ক সক্রিয়ভাবে লিবীয় বিদ্রোহীদেরকে সহযোগিতা করেছে এবং পরবর্তীতেও বিভিন্ন লিবীয় মিলিট্যান্ট গ্রুপকে সহায়তা করেছে। বর্তমানে ত্রিপোলি–ভিত্তিক সরকারকে সমর্থন প্রদান তুরস্কের নব্য–ওসমানীয় জাতীয়তাবাদী প্রকল্পেরই একটি অংশ।
দ্বিতীয়ত, খনিজ তেল ও প্রাকৃতিক গ্যাসে লিবিয়া সমৃদ্ধ। লিবিয়ায় রয়েছে বিশ্বের ৯ম বৃহত্তম খনিজ তেলের মজুদ। তুর্কি অর্থনীতিতে জ্বালানির প্রচুর চাহিদা রয়েছে এবং তুরস্ক তার প্রয়োজনীয় জ্বালানির প্রায় তিন–চতুর্থাংশ বাইরে থেকে আমদানি করে। ২০১৮ সালেই তুরস্ক ৪,২৯৯ কোটি (বা ৪২.৯৯ বিলিয়ন) মার্কিন ডলার সমমূল্যের জ্বালানি আমদানি করেছে। এজন্য তুর্কিরা জ্বালানি সরবরাহের একটি নির্ভরযোগ্য উৎস পেতে আগ্রহী। তুর্কি–প্রভাবাধীন লিবিয়া তুরস্কের জন্য একটি নির্ভরযোগ্য ও নিয়মিত জ্বালানি সরবরাহকারী রাষ্ট্র হতে পারে।
তৃতীয়ত, লিবিয়ায় বহুসংখ্যক তুর্কি কোম্পানি কর্মরত এবং তারা গৃহযুদ্ধে আগেই লিবিয়ায় কয়েক হাজার কোটি মার্কিন ডলার বিনিয়োগ করেছে। ইমারাতি–সমর্থিত ও রুশ–সমর্থিত তবরুক–ভিত্তিক সরকার লিবিয়ার পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নিলে তুরস্ক এই বিপুল পরিমাণ বিনিয়োগকৃত অর্থ হারাতে পারে– এই আশঙ্কাও আঙ্কারা কর্তৃক ত্রিপোলি–ভিত্তিক সরকারকে সমর্থনের অন্যতম একটি কারণ। এছাড়া, লিবিয়ায় তুর্কি–নিয়ন্ত্রণাধীন একটি সরকার স্থায়ীভাবে প্রতিষ্ঠিত হলে লিবিয়ায় তুর্কি বাণিজ্য ও বিনিয়োগের সুযোগ আরো বিস্তৃত হবে এবং যুদ্ধবিধ্বস্ত লিবিয়াকে পুনর্গঠনের অত্যন্ত লাভজনক কাজগুলো তুর্কি কোম্পানিগুলোকে দেয়া হবে– এই সম্ভাবনাও রয়েছে, যদিও যতদিন লিবিয়ার গৃহযুদ্ধের সমাপ্তি না ঘটছে, ততদিন পর্যন্ত লিবিয়ায় ব্যবসা-বাণিজ্যের স্বাভাবিক পরিস্থিতি ফিরে আসবে না বা পুনর্গঠনের কাজও আরম্ভ হবে না।
চতুর্থত, তুরস্ক আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে নিজেকে একটি স্বতন্ত্র শক্তি হিসেবে প্রতিষ্ঠা করতে আগ্রহী। আঞ্চলিক পর্যায়ে মধ্যপ্রাচ্যে ইমারাত, সৌদি আরব, মিসর ও ইরান তুরস্কের প্রতিদ্বন্দ্বী। আন্তর্জাতিক পর্যায়ে রাশিয়া, ইউরোপীয় ইউনিয়ন ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে তুরস্ক একইসঙ্গে সহযোগিতা ও প্রতিদ্বন্দ্বিতায় লিপ্ত। কার্যত এখন পশ্চিম এশিয়া ও উত্তর আফ্রিকায় কাতার ছাড়া অন্য কোনো রাষ্ট্র আঙ্কারার মিত্ররাষ্ট্র নয়, এবং কাতারও সম্প্রতি সৌদি–ইমারাতি জোটের সঙ্গে সম্পর্ক স্বাভাবিকীকরণের প্রচেষ্টা চালাচ্ছে। এমতাবস্থায় আঞ্চলিক ভারসাম্য যাতে পুরোপুরি তুরস্কের বিরুদ্ধে চলে না যায় সেজন্য তুরস্ক লিবিয়ায় একটি তুর্কিপন্থী সরকার সুপ্রতিষ্ঠিত করতে আগ্রহী।
পঞ্চমত, ত্রিপোলি–ভিত্তিক সরকার ইসলামপন্থী মিলিশিয়াদের ওপর বহুলাংশে নির্ভরশীল এবং এজন্য আদর্শিক দৃষ্টিভঙ্গি থেকে তুর্কি সরকারের সঙ্গে সাদৃশ্যপূর্ণ। তুরস্ক ও কাতার মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন রাষ্ট্রে ‘ইখওয়ান আল–মুসলিমিন’সহ বিভিন্ন ইসলামপন্থী দলকে সমর্থন করে এবং লিবিয়ার ক্ষেত্রেও একই ঘটনা ঘটছে। কিন্তু শুধুমাত্র আদর্শগত সামঞ্জস্য থাকার কারণে কখনো কোনো রাষ্ট্র অন্য কোনো রাষ্ট্রের পক্ষে যুদ্ধে অবতীর্ণ হয় না। এজন্য বিশ্লেষকদের ধারণা, ত্রিপোলি–ভিত্তিক সরকারকে তুরস্কের সমর্থন করার পেছনে আদর্শগত বিবেচনা তেমন কোনো প্রভাব রাখেনি।
সর্বোপরি, পূর্ব ভূমধ্যসাগরীয় অঞ্চলে তুরস্কের ভূরাজনৈতিক স্বার্থ লিবীয় গৃহযুদ্ধে তুর্কি হস্তক্ষেপের মূল কারণ বলে বিশ্লেষকরা ধারণা করছেন। তুরস্ক একটি ভূমধ্যসাগরীয় রাষ্ট্র এবং তুরস্কের দিকে পূর্ব ভূমধ্যসাগর অবস্থিত। সাম্প্রতিক সময়ে পূর্ব ভূমধ্যসাগরে বিপুল পরিমাণ প্রাকৃতিক গ্যাসের মজুদ আবিষ্কৃত হয়েছে। এখন পর্যন্ত পূর্ব ভূমধ্যসাগরে আবিষ্কৃত প্রাকৃতিক গ্যাসের মজুদের পরিমাণ ১২২ ট্রিলিয়ন ঘন মিটার (১ ট্রিলিয়ন = ১,০০০ বিলিয়ন)। ভূমধ্যসাগরীয় রাষ্ট্র হিসেবে স্বাভাবিকভাবেই তুরস্ক এই খনিজ সম্পদ নিজের নিয়ন্ত্রণে আনতে আগ্রহী।
কিন্তু তুরস্ক একমাত্র পূর্ব ভূমধ্যসাগরীয় রাষ্ট্র নয়। আরো বেশ কয়েকটি রাষ্ট্র, বিশেষত গ্রিস, ইসরায়েল, মিসর ও সাইপ্রাসের সঙ্গেও পূর্ব ভূমধ্যসাগরের সীমান্ত রয়েছে। এই রাষ্ট্রগুলো পূর্ব ভূমধ্যসাগরে গ্যাস উত্তোলনের ক্ষেত্রে একে অপরকে সহযোগিতা করছে এবং তুরস্ককে এই প্রক্রিয়ার বাইরে রাখা হয়েছে। তুরস্কের তীব্র বিরোধিতা সত্ত্বেও মিসর, লেবানন ও ইসরায়েল যথাক্রমে ২০০৩, ২০০৭ ও ২০১০ সালে পূর্ব ভূমধ্যসাগরে তাদের সামুদ্রিক সীমান্ত নির্ধারণ সম্পর্কিত চুক্তি স্বাক্ষর করেছে।
তুরস্কের দাবি, এর ফলে পূর্ব ভূমধ্যসাগরে তুরস্ক এবং তুর্কি–নিয়ন্ত্রিত ‘উত্তর সাইপ্রাস তুর্কি প্রজাতন্ত্রে’র ন্যায্য অধিকার ক্ষুণ্ন হয়েছে। উল্লেখ্য, উত্তর সাইপ্রাস তুর্কি প্রজাতন্ত্র (Kuzey Kıbrıs Türk Cumhuriyeti) বা সংক্ষেপে ‘উত্তর সাইপ্রাস’ সাইপ্রাস দ্বীপের উত্তর–পূর্বাংশে অবস্থিত তুর্কি সাইপ্রিয়ট–অধ্যুষিত একটি রাষ্ট্র। ১৯৭৪ সালে তুরস্ক সাইপ্রাস আক্রমণ করে এই অঞ্চলটি দখল করে নিয়ে সেখানে একটি স্বায়ত্তশাসিত প্রশাসন প্রতিষ্ঠা করে, যেটি ১৯৮৩ সালের ১৫ নভেম্বর সাইপ্রাস থেকে স্বাধীনতা ঘোষণা করে। তুরস্ক ছাড়া বিশ্বের অন্য কোনো রাষ্ট্র উত্তর সাইপ্রাসকে স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি প্রদান করেনি।
২০০৯ ও ২০১০ সালে পূর্ব ভূমধ্যসাগরে ইসরায়েলি সমুদ্রসীমায় ২টি, ২০১১ সালে সাইপ্রিয়ট সমুদ্রসীমায় ১টি এবং ২০১৩–১৪ সালে মিসরীয় সমুদ্রসীমায় ১টি বৃহৎ গ্যাসক্ষেত্র আবিষ্কৃত হয়। সে তুলনায় পূর্ব ভূমধ্যসাগরে তুর্কি সমুদ্রসীমায় উল্লেখযোগ্য কোনো গ্যাসক্ষেত্র আবিষ্কৃত হয়নি। ২০১৯ সালের জানুয়ারিতে পূর্ব ভূমধ্যসাগরের উপকূলে অবস্থিত রাষ্ট্রগুলো (ইতালি, গ্রিস, সাইপ্রাস, ইসরায়েল, ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষ, জর্দান ও মিসর) পূর্ব ভূমধ্যসাগরে গ্যাস উত্তোলন–সংক্রান্ত কার্যক্রম সমন্বয় করতে গঠন করেছে পূর্ব ভূমধ্যসাগরীয় গ্যাস ফোরাম (Eastern Mediterranean Gas Forum, ‘EMGF’)। তুরস্ক ও উত্তর সাইপ্রাসকে ইচ্ছে করেই এই সংগঠনের বাইরে রাখা হয়েছে। উল্লেখ্য, লেবানন ও সিরিয়া কর্তৃক ইসরায়েলকে স্বীকৃতি না দেয়ার কারণে পূর্ব ভূমধ্যসাগরের উপকূলে অবস্থিত হওয়া সত্ত্বেও এই রাষ্ট্র দুটিকেও এই ফোরামের বাইরে রাখা হয়েছে।
তদুপরি, ইসরায়েল ভূমধ্যসাগরীয় গ্যাস ইউরোপীয় রাষ্ট্রগুলোর কাছে রপ্তানি করতে ইচ্ছুক এবং এজন্য তেল আভিভ তুরস্কের পাইপলাইন ব্যবহার না করে গ্রিসের অন্তর্গত ক্রিট দ্বীপ ও সাইপ্রাস হয়ে গ্রিস পর্যন্ত একটি নতুন পাইপলাইন নির্মাণের সিদ্ধান্ত নিয়েছে। যেদিন তুর্কি আইনসভা লিবিয়ায় সৈন্য প্রেরণের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে, ঠিক সেদিনই অর্থাৎ ২০২০ সালের ২ জানুয়ারি গ্রিস, সাইপ্রাস ও ইসরায়েলের নেতারা ‘পূর্ব ভূমধ্যসাগরীয় পাইপলাইন’ (Eastern Mediterranean Pipeline, ‘EastMed’) নির্মাণের জন্য চুক্তিবদ্ধ হন।
২০১৯ সাল পর্যন্ত তুরস্ক আলোচনা ও ভয়ভীতি প্রদর্শনের মাধ্যমে এগুলোকে ঠেকানোর প্রচেষ্টা চালিয়েছে, কিন্তু তাতে কোনো কাজ হয়নি। গ্রিস ও সাইপ্রাসের দাবি, আন্তর্জাতিক আইন অনুযায়ী কোনো রাষ্ট্রের মূল ভূখণ্ড থেকে ২০০ কি.মি. পর্যন্ত যেমন ঐ রাষ্ট্রের একচ্ছত্র অর্থনৈতিক সমুদ্রসীমা (exclusive economic zone) থাকে, তেমনি সেই রাষ্ট্রের দ্বীপগুলোরও চারপাশে ২০০ কি.মি. পর্যন্ত অর্থনৈতিক সমুদ্রসীমা থাকে এবং উভয় সমুদ্রসীমার ওপরই ঐ রাষ্ট্রের একচ্ছত্র সার্বভৌমত্ব থাকা উচিত। এই যুক্তি অনুযায়ী ভূমধ্যসাগরে অবস্থিত গ্রিসের ক্রিট দ্বীপটির নিজস্ব অর্থনৈতিক সমুদ্রসীমা রয়েছে এবং সেটি গ্রিসের কর্তৃত্বাধীনে আসা উচিত।
কিন্তু তুরস্কের দাবি, রাষ্ট্রের মূল ভূখণ্ডের ক্ষেত্রে অর্থনৈতিক সমুদ্রসীমা যতটুকু প্রযোজ্য, দ্বীপের ক্ষেত্রে ততটুকু প্রযোজ্য নয়। তাই গ্রিস পূর্ব ভূমধ্যসাগরে যে সমুদ্রসীমা দাবি করে, সেটি অযৌক্তিক। তুরস্কের মতে, দ্বীপের অবস্থানের পরিবর্তে রাষ্ট্রগুলোর মহীসোপান (continental shelf) অনুযায়ী পূর্ব ভূমধ্যসাগরে অর্থনৈতিক সমুদ্রসীমা নির্ধারণ করা উচিত। তদুপরি, উত্তর সাইপ্রাস একটি দ্বীপে অবস্থিত হওয়া সত্ত্বেও রাষ্ট্রটিকে তার সমুদ্রসীমা থেকে বঞ্চিত করা হচ্ছে বলে তুরস্ক অভিযোগ করে। কিন্তু তুরস্কের দাবি অন্য রাষ্ট্রগুলো মেনে নেয়নি।
এমতাবস্থায় ২০১৯ সালের ২৭ নভেম্বর তুরস্ক ও লিবিয়ার ত্রিপোলি–ভিত্তিক সরকার ভূমধ্যসাগরে সমুদ্রসীমা নির্ধারণ সংক্রান্ত একটি চুক্তি স্বাক্ষর করে। এই চুক্তির ফলে তুরস্ক ও লিবিয়ার মধ্যে যে অর্থনৈতিক সমুদ্রসীমা নির্ধারিত হয়েছে, তার ফলে এখন, তুর্কি সংবাদ সংস্থা টিআরটি ওয়ার্ল্ডের ভাষ্যমতে, তুরস্ক ও লিবিয়ার মধ্যে একটি সীমান্ত প্রতিষ্ঠিত হয়েছে।
এই চুক্তি অনুযায়ী তুরস্ক ও লিবিয়ার যে সমুদ্রসীমা নির্ধারিত হয়েছে, সেটি গ্রিসের ক্রিট দ্বীপের অর্থনৈতিক সমুদ্রসীমাকে উপেক্ষা করেছে। ফলে স্বাভাবিকভাবেই গ্রিস ক্ষুব্ধ হয়েছে। গ্রিস থেকে লিবিয়ার ত্রিপোলি–ভিত্তিক সরকারের রাষ্ট্রদূতকে বহিষ্কার করা হয়েছে এবং গ্রিক পররাষ্ট্রমন্ত্রী নিকোস ডেন্ডিয়াস তবরুক–ভিত্তিক সরকারের নেতা খলিফা হাফতারের সঙ্গে দেখা করে সহযোগিতা সম্পর্কিত আলোচনা করেছেন। সাইপ্রাস, মিসর ও ইসরায়েলও এই চুক্তির নিন্দা জানিয়েছে।
লিবিয়ার ত্রিপোলি–ভিত্তিক সরকার তুরস্ককে এই ছাড় দিয়েছে নিজস্ব স্বার্থে। সেসময় তবরুক–ভিত্তিক সরকারের সৈন্যরা ত্রিপোলি আক্রমণ করেছিল এবং ত্রিপোলি–ভিত্তিক সরকারের সামরিক সহায়তা প্রয়োজন ছিল। তুরস্ক সামরিক সরঞ্জাম সরবরাহের মাধ্যমে এবং পরবর্তীতে সরাসরি সৈন্য মোতায়েন করে এই সহায়তা প্রদান করেছে।
বর্তমানে তুরস্কের অর্থনৈতিক অবস্থা তেমন ভালো নয়। মার্কিন ডলারের বিপরীতে তুর্কি লিরার মান ক্রম-হ্রাসমান। তুরস্কের বিরোধী দলগুলো এবং তুর্কি জনসাধারণের বড় একটি অংশ এ ধরনের বৈদেশিক ‘অ্যাডভেঞ্চারে’র বিরোধী। এছাড়াও সাম্প্রতিক বৈশ্বিক করোনাভাইরাস প্রাদুর্ভাব অন্যান্য বহু রাষ্ট্রের মতো তুরস্ককেও যথেষ্ট কঠিন পরিস্থিতিতে ফেলেছে।
তদুপরি, লিবিয়ার তবরুক–ভিত্তিক সরকারের বিদেশি সমর্থকরা এত সহজেই হাল ছেড়ে দেবে না। সম্প্রতি তুর্কি সহযোগিতায় ত্রিপোলি–ভিত্তিক সরকার বেশ কিছু সাফল্য অর্জন করেছে, কিন্তু এই সাফল্যের ধারা অব্যাহত থাকবে কি না কিংবা এই সাফল্য ব্যর্থতায় পর্যবসিত হবে কি না— সেটির কোনো নিশ্চয়তা নেই। লিবিয়ার গৃহযুদ্ধ দ্রুত শেষ হবে এমন কোনো সম্ভাবনা এখনও নেই, বরং লিবিয়ার স্থায়ীভাবে তুর্কি–নিয়ন্ত্রিত এবং রুশ–ইমারাতি নিয়ন্ত্রণাধীন দুটি খণ্ডে বিভক্ত হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। তুরস্কের সঙ্গে তবরুক–ভিত্তিক সরকারের বিদেশি সমর্থক ইমারাত, মিসর, এমনকি রাশিয়ারও সরাসরি সশস্ত্র সংঘর্ষ হওয়ার আশঙ্কা একেবারে উড়িয়ে দেয়া যায় না।
এই ঝুঁকিগুলোর সম্পর্কে আঙ্কারা পুরোপুরি সচেতন, কিন্তু তুর্কি জাতীয় স্বার্থ রক্ষার উদ্দেশ্যে তুর্কি সরকার ঝুঁকি নিয়েছে এবং লিবিয়ায় সামরিক হস্তক্ষেপ করেছে। শেষ পর্যন্ত তুরস্কের স্বার্থ রক্ষা হবে কি না এবং বড় ধরনের কোনো সঙ্কটে তুরস্ক জড়িয়ে পড়বে কি না– এটাই প্রশ্ন।