এই মুহূর্তে প্রযুক্তি দুনিয়ার সবচেয়ে বড় সংবাদ হলো টুইটার কর্তৃক সব ধরনের রাজনৈতিক বিজ্ঞাপন প্রচারণাকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করা। ২০২০ সালের ৩ নভেম্বর অনুষ্ঠিতব্য যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেনশিয়াল নির্বাচনের মাত্র এক বছর আগে এমন একটি সিদ্ধান্ত নিঃসন্দেহে অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ।
২০১৬ সালের সর্বশেষ নির্বাচনের আগে করা সব জরিপে পিছিয়ে থাকলেও, সেগুলোকে মিথ্যা প্রমাণ করে দিয়ে শেষ হাসি হেসেছিলেন ডোনাল্ড ট্রাম্প। তার এই বিস্ময়কর বিজয়ে অন্যতম তুরুপের তাস হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছিল সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম। তার নির্বাচনী প্রচারণাকে কেন্দ্র করে ফেসবুক-ক্যামব্রিজ অ্যানালিটিকা কেলেঙ্কারির কথা তো দীর্ঘদিন ধরেই ঘুরবে মানুষের মুখে মুখে।
আরো একটি নির্বাচনের আগে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের অনুরূপ ভূমিকা থাকবে বলেই আশঙ্কা করছিলেন বিশ্বব্যাপী বিশেষজ্ঞরা। ঠিক এমন সময়ই টুইটারের পক্ষ থেকে এলো রাজনৈতিক বিজ্ঞাপন নিষিদ্ধের ঘোষণা। অথচ মাত্র কিছুদিন আগেই টুইটারের সবচেয়ে বড় প্রতিদ্বন্দ্বী ফেসবুক উড়িয়ে দিয়েছিল রাজনৈতিক বিজ্ঞাপন নিষিদ্ধের সম্ভাবনাকে।
কেন এ সিদ্ধান্ত?
টুইটারের সিইও জ্যাক ডরসি টুইট করে তার কোম্পানির এ সিদ্ধান্তের কথাটি জানিয়েছেন। তিনি বলেছেন, বিজ্ঞাপনী বার্তা কত মানুষের কাছে পৌঁছাবে, সে সংখ্যাটি উচিৎ “অর্জন করে নেয়া, অর্থ দিয়ে কেনা নয়।”
“এ ব্যাপারে কোনো সন্দেহ নেই যে ইন্টারনেটে বিজ্ঞাপন প্রচার অত্যন্ত শক্তিশালী একটি মাধ্যম এবং বাণিজ্যিকভাবেও খুবই প্রভাবসম্পন্ন। কিন্তু এই ক্ষমতা রাজনীতিতেও প্রচণ্ড ঝুঁকি বয়ে আনে।”
কেন তার কোম্পানি এ সিদ্ধান্ত নিয়েছে, সেটিও ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করেছেন ডরসি।
“আমার মনে হয় না আমাদের জন্য এটি বলা বিশ্বাসযোগ্য হবে যে আমরা সর্বাত্মক চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি যেন আমাদের সিস্টেম ব্যবহার করে কেউ মিথ্যা বা বিভ্রান্তিকর তথ্য ছড়াতে পারে, অথচ আমাদেরকে অর্থ প্রদান করলেই যে কেউ রাজনৈতিক বিজ্ঞাপন প্রচার করতে পারবে, এবং সেখানে তারা যা খুশি তা বলতে পারবে!”
কিছুদিন আগে ফেসবুকের সিইও মার্ক জাকারবার্গ দাবি করেছিলেন যে তারা ফেসবুকে রাজনৈতিক বিজ্ঞাপন প্রচার নিষিদ্ধ করবেন না, কেননা এতে করে ইতিমধ্যেই গণমাধ্যমে পরিচিত কিংবা ক্ষমতাসীন ব্যক্তিরাই বেশি সুবিধা লাভ করবেন। জাকারবার্গ বলেছিলেন,
“আমি মনে করি না কোনো গণতন্ত্রে একটি ব্যক্তি মালিকানাধীন কোম্পানির উচিৎ কোনো রাজনীতিবিদ কিংবা সংবাদকে সেন্সর করা। আমরা মূল্যায়ন অব্যহত রাখব যে ফেসবুকে রাজনৈতিক বিজ্ঞাপন রাখা সুবিধাজনক হবে কি না, তবে এখন পর্যন্ত আমাদের অবস্থান এই যে রাজনৈতিক বিজ্ঞাপন প্রচারণাই অপেক্ষাকৃত শ্রেয় সিদ্ধান্ত।”
কিন্তু ডরসি জাকারবার্গের এই যুক্তিও খণ্ডনের চেষ্টা করেছেন।
“অনেক সামাজিক আন্দোলনই ব্যাপক আকার ধারণা করে কোনো ধরনের রাজনৈতিক বিজ্ঞাপন প্রচারণা ছাড়াই।”
নিষেধাজ্ঞাটি শুরু হবে আগামী ২২ নভেম্বর থেকে, এবং এ ব্যাপারে বিস্তারিত তথ্য প্রকাশ করা হবে ১৫ নভেম্বর।
সিদ্ধান্তটি অর্থনৈতিক নয়, মতাদর্শিক
রাজনৈতিক বিজ্ঞাপন কখনোই টুইটারের জন্য খুব লাভজনক একটি খাত ছিল না। টুইটারের প্রধান অর্থনৈতিক কর্মকর্তা নেড সেগাল জানিয়েছেন, গত অর্থবছরে কোম্পানিটি রাজনৈতিক বিজ্ঞাপন থেকে লাভ করেছে ৩ মিলিয়ন ডলারেরও কম।
একই কথা প্রযোজ্য ফেসবুকের ক্ষেত্রেও। কিছুদিন আগেই জাকারবার্গ জানিয়েছিলেন, ফেসবুক আগামী বছর যে পরিমাণ লাভ আশা করছে, তার মাত্র ০.৫ শতাংশেরও কম আসতে পারে রাজনৈতিক বিজ্ঞাপন থেকে।
সুতরাং একটি বিষয় মোটামুটি পরিষ্কার যে ফেসবুক, টুইটারের মতো কোম্পানিগুলো তাদের প্ল্যাটফর্মে রাজনৈতিক বিজ্ঞাপন প্রচার করতে দেবে কি না, সেটি সম্পূর্ণই নির্ভর করছে তাদের নিজস্ব মতাদর্শের উপর। এক্ষেত্রে অর্থনীতির ভূমিকা নেই বললেই চলে।
প্রতিক্রিয়া
অনুমিতভাবেই, টুইটারের এ সিদ্ধান্তের পক্ষে-বিপক্ষে দুটি দল গড়ে উঠেছে। বিপক্ষ শিবিরের হয়ে মুখ খুলেছেন ট্রাম্পের পুনঃনির্বাচন প্রচারণার ব্যবস্থাপক ব্র্যাড পারস্কেল। তার মতে, এই নিষিদ্ধের সিদ্ধান্ত “বামদের পক্ষ থেকে আরো একটি প্রচেষ্টা ট্রাম্প ও কনজারভেটিভদের মুখ বন্ধ করে দেয়ার।”
অবশ্য ডেমোক্রেটিক ফ্রন্ট-রানার জো বিডেনের নির্বাচনী প্রচারণার মুখপাত্র বিল রুসো স্বাগত জানিয়েছেন টুইটারের সিদ্ধান্তকে। তিনি বলেন,
“টুইটারের জন্য বেছে নেয়ার মতো দুটি জিনিস ছিল: বিজ্ঞাপনী ডলার কিংবা আমাদের গণতান্ত্রিক অখণ্ডতা। এবং বিষয়টি অত্যন্ত উৎসাহব্যঞ্জক যে অন্তত একবারের জন্য হলেও আর্থিক লাভের বিষয়টি এখানে জয়ী হয়নি।”
এদিকে সাবেক ডেমোক্রেটিক প্রার্থী হিলারি ক্লিনটন, যিনি ২০১৬ সালের নির্বাচনে হেরে গিয়েছিলেন ট্রাম্পের কাছে, প্রশংসা করেছেন টুইটারের সিদ্ধান্তের, এবং ফেসবুককেও আহবান জানিয়েছেন তাদের অবস্থান পরিবর্তনের। তার মতে,
“এটিই আমেরিকা ও গোটা বিশ্বের গণতন্ত্রের জন্য সঠিক সিদ্ধান্ত।”
আসন্ন মার্কিন প্রেসিডেনশিয়াল নির্বাচনে প্রভাব
সত্যি কথা বলতে, টুইটারের এ সিদ্ধান্ত প্রত্যক্ষভাবে আসন্ন নির্বাচনে খুব বড় কোনো প্রভাব ফেলতে পারবে না। কেননা একটু আগেই জেনেছেন, রাজনৈতিক বিজ্ঞাপন থেকে গত বছর টুইটারের আয় ছিল ৩ মিলিয়ন ডলারের কম। প্রেসিডেনশিয়াল নির্বাচনী মৌসুমী তা হয়তো বেড়ে দাঁড়াত বড়জোর ১০ মিলিয়ন ডলারে। কিন্তু আসন্ন নির্বাচনে প্রার্থীরা তাদের প্রচারণায় সাকুল্যে ব্যয় করতে চলেছেন প্রায় ৬ বিলিয়ন ডলার। তাহলে বুঝতেই পারছেন, মোট ৬ বিলিয়ন ডলারের কাছে ১০ মিলিয়নও খুবই ছোট একটি সংখ্যা।
নির্বাচনী বিজ্ঞাপন প্রচারের সবচেয়ে বড় মাধ্যম অবশ্যই টেলিভিশন। প্রার্থীরা মূলত টেলিভিশনে বিজ্ঞাপন প্রচারের জন্যই তাদের বাজেটের সিংহভাগ ব্যয় করবেন। মাত্র ২০ শতাংশ অর্থ ব্যয় হতে পারে ডিজিটাল বিজ্ঞাপনে।
সেই ২০ শতাংশ ডিজিটাল বিজ্ঞাপনেরও বেশিরভাগই যাবে ফেসবুকে। কারণ ফেসবুকের তুলনায় টুইটার খুবই ছোট। সেপ্টেম্বরে টুইটারের গড়ে দৈনিক ব্যবহারকারী ছিল যেখানে ১২৬ মিলিয়ন, সেখানে ফেসবুকের দৈনিক ব্যবহারকারী ছিল ১.৬৩ বিলিয়ন। সুতরাং ফেসবুক যদি রাজনৈতিক বিজ্ঞাপন প্রচার বন্ধ না করে, শুধু টুইটারের নিষেধাজ্ঞা খুব বড় কোনো পার্থক্য গড়ে দিতে পারবে না।
তবে হ্যাঁ, টুইটারের এ সিদ্ধান্তের পরোক্ষ প্রভাব অবশ্যই থাকতে পারে। কীভাবে? যদি তাদের এ সিদ্ধান্ত চাপ প্রয়োগ করে ফেসবুকের উপর, এবং ফেসবুকও বাধ্য হয় টুইটারের পথ অনুসরণে।
টুইটারে সবচেয়ে বেশি ব্যয় করেন কারা?
ব্যক্তিগতভাবে নিজেদের রাজনৈতিক বিজ্ঞাপন প্রচারে সবচেয়ে বেশি ব্যয় করে থাকেন ডেমোক্রেটিক সিনেটর এলিজাবেথ ওয়ারেন এবং কামালা হ্যারিস, এমনটিই জানিয়েছে টুইটারের অ্যাড ট্রান্সপারেন্সি টুল। টুইটারের নিষেধাজ্ঞায় তারাই হতে চলেছেন সবচেয়ে বড় ভুক্তভোগী।
চলুন দেখা যাক টুইটারে রাজনৈতিক বিজ্ঞাপন প্রচারণায় কে কী পরিমাণ অর্থ ব্যয় করেন
- কামালা হ্যারিস: ১.১ মিলিয়ন ডলার
- এলিজাবেথ ওয়ারেন: ৯,০২,২০০ ডলার
- জো বিডেন: ৬১৭,১০০ ডলার
- পিট বুটিজেজ: ৩,৮১,৯০০ ডলার
- বার্নি স্যান্ডার্স: ৩,১৭,৪০০ ডলার
- টুলসি গ্যাবার্ড: ১,৭৭,৫০০ ডলার
- অ্যামি ক্লোবুচার: ৮৭,১০০ ডলার
- কোরি বুকার: ৫১,২০০ ডলার
- আন্ড্রু ইয়াং: ১৯,৪০০ ডলার
- ডোনাল্ড ট্রাম্প: ৬,৫৬৬ ডলার
* ২০১৮ সালের জুন মাসের পর থেকে ট্রাম্প তার নিজের টুইটার অ্যাকাউন্ট থেকে কোনো টুইট প্রচার করেননি। এখানে যে সংখ্যা দেখানো হয়েছে, তা ব্যয় করা হয়েছে তার আনুষ্ঠানিক প্রচারণা অ্যাকাউন্টের পক্ষ থেকে।
বিজ্ঞাপনের সবচেয়ে বড় মাধ্যম ফেসবুকই
ট্রাম্প টুইটারে যে পরিমাণ অর্থ ব্যয় করেছেন প্রচারণায়, তা দেখে অনেকেই বিস্মিত হতে পারেন। তবে বিষয়টিকে একটু অন্যভাবেও দেখতে পারেন। তিনি আসলে বিজ্ঞাপন প্রচারণাকে মোটেই অবহেলা করছেন না। স্রেফ টুইটারকে তিনি খুব একটা গুরুত্ব দিচ্ছেন না। ফেসবুকে ঠিকই তিনি বিপুল পরিমাণ অর্থ ব্যয় করে যাচ্ছেন। ফেসবুক ডাটা অনুযায়ী, ট্রাম্পের প্রচারণা শিবির ২০১৮ সালের মে মাসের পর থেকে এখন পর্যন্ত ফেসবুক বিজ্ঞাপনের পেছনে ২১.২৫ মিলিয়ন ডলার ব্যয় করেছে। এদিকে ওয়ারেন, স্যান্ডার্স, বুটিজেজের প্রত্যেকেও ৪ মিলিয়ন ডলারের বেশি খরচ করেছেন। বিডেন খরচ করেছেন ২.৮ মিলিয়ন ডলার, আর হ্যারিস ৩.৫ মিলিয়ন ডলার।
শেষ কথা
টুইটারের এ সিদ্ধান্ত একদিক থেকে সত্যিই অনেক প্রশংসনীয়। কারণ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে আজকাল বিজ্ঞাপন প্রচারে বিভিন্ন অনৈতিক কৌশল অবলম্বন করা যায়। সে কারণে রাজনীতিবিদরা একেক ভৌগোলিক অবস্থানের মানুষকে লক্ষ্য করে একেক ধরনের রাজনৈতিক বক্তব্য প্রচার করেন, যেগুলো হয়তো পারস্পরিক সাংঘর্ষিক। এভাবে তারা নিজেদের প্রচারণায় বাড়তি সুযোগ করে নিতে গিয়ে সাধারণ ভোটারদের সাথে প্রতারণা বা জোচ্চুরিও করেন অনেক সময়। তাই স্বাভাবিকভাবেই সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে নির্বাচনী বিজ্ঞাপন প্রচার গণতন্ত্রের কোনো সুষ্ঠু চর্চার মধ্যে পড়ে না। টুইটার যে অর্থের (তা যত কমই হোক) চিন্তা না করে মতাদর্শিক কারণে এমন একটি সিদ্ধান্ত নিল, তাতে সমমনা ব্যক্তিদের কাছে নিঃসন্দেহে কোম্পানিটির ভাবমূর্তি অনেক উজ্জ্বল হলো।
কিন্তু হ্যাঁ, দিনশেষে ভাবমূর্তির চেয়েও অনেক বড় বিষয় হলো সিদ্ধান্তটি কোনো বড় ব্যবধান গড়ে দিতে পারল কি না। সেক্ষেত্রে টুইটারের ব্যর্থ হওয়ার সম্ভাবনাই বেশি। আজকের দিনে টুইটার ব্যবহার করে কিন্তু ফেসবুক ব্যবহার করে না এমন মানুষ খুঁজে পাওয়া অসম্ভব। তাই রাজনীতিবিদরা ফেসবুকের মাধ্যমেই তাদের টার্গেট অডিয়েন্সের কাছে পৌঁছাতে পারবেন। টুইটারে যে অর্থ তারা ব্যয় করতেন, সেটিও এখন তারা ফেসবুকেই ব্যয় করতে পারবেন। ফলে ফেসবুকে তাদের প্রচারণা আরো জোরদার হবে।
এখন দেখার বিষয় শুধু এটিই যে, টুইটারের সিদ্ধান্ত তারা প্রভাবিত হয়ে ফেসবুকও এমন কোনো সিদ্ধান্ত গ্রহণে বাধ্য হয় কি না। যদি তারা হয়, কেবল তাহলেই সত্যিকার অর্থে টুইটারের সিদ্ধান্তটির একটি ব্যাপক প্রভাব সৃষ্টি হবে।
বিশ্বের চমৎকার সব বিষয়ে রোর বাংলায় লিখতে আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন এই লিঙ্কেঃ roar.media/contribute/