৭০ লাখ মানুষ নিয়ে গড়ে ওঠা শহর হংকং একসময় ব্রিটিশ উপনিবেশের অন্তর্ভুক্ত ছিল। ১৯৯৭ সালে হংকংকে ‘এক রাষ্ট্র, দুই নীতি’ কাঠামোর প্রেক্ষিতে চীনের নিকট হস্তান্তর করা হয়। এর মানে হলো যদিও হংকং চীন দেশেরই অংশ, তবুও শহরটির নিজস্ব কিছু স্বাধীনতা ও স্বাতন্ত্র্য থাকবে। চীনের রাজধানী বেইজিং শহরটির প্রতিরক্ষা এবং বহির্বিশ্বের সাথে সম্পর্ক বজায় রাখতে সহায়তা করবে। তবে অভ্যন্তরীণ সব ব্যাপারে চাইলেই চীন নাক গলাতে পারবে না। হংকংয়ের নিজস্ব কিন্তু সীমিত অধিকারসম্পন্ন সরকার ব্যবস্থা, নাগরিকদের স্বাধীনতা, স্বাধীন বিচার ব্যবস্থা এবং গণযোগাযোগ মাধ্যমের উপর কোনো প্রকার সীমাবদ্ধতা আরোপ করার অধিকার চীনের থাকবে না।
প্রথম কয়েক বছর বেশ ভালোমতোই এই নীতিতে সবকিছু চললেও সমস্যা বাঁধে যখন চীন হংকংকে পুরোপুরি নিজেদের আয়ত্ত্বে আনার চেষ্টা শুরু করে। ২০০৩ থেকে আজ অবধি নিরাপত্তা, শিক্ষা, ব্যক্তিগত স্বাধীনতা এবং এরকম নানা বিষয়ে চীন নিজেদের মতো করে শহরটিকে গড়ে তুলতে চায়। তবে হংকংবাসী বারবারই এসব কিছুর বিরুদ্ধে আন্দোলন করে প্রতিরোধ গড়ে তোলে। ২০১৪ সালের আন্দোলনের পরই মূলত হংকংয়ের এসব আন্দোলন ‘ছাতা বিপ্লব’ বা ‘ছাতা আন্দোলন’ হিসেবে পরিচিতি লাভ করে বিধায় প্রায়ই ২০০৩ সাল থেকে বর্তমানের সব আন্দোলনকে একত্রে এই নাম দুটি দিয়েই প্রকাশ করা হয়।
জাতীয় নিরাপত্তা আইন
২০০৩ সাল হংকংয়ের ইতিহাসে গুরুত্বপূর্ণ একটি বছর। বছরের শুরুতেই হংকংয়ে সিভিয়ার অ্যাকিউট রেসপিরেটরি সিনড্রোম (সার্স) ছড়িয়ে পড়ে। ফলে অনেক মানুষ মারা যায়। বিশ্বের বিভিন্ন দেশ এ সময় হংকংয়ের সাথে যোগাযোগ ব্যবস্থা বন্ধ রাখে, যাতে করে এই রোগের ভাইরাস অন্যান্য দেশে ছড়াতে না পারে। হংকং এই সময়ে আর্থিকভাবে বেশ ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এক সমস্যা যেতে না যেতেই আরেক সমস্যার শুরু হয় যখন সরকার এমন একটি বিল পাস করতে চায় যা হংকংবাসীর অধিকার ক্ষুণ্ণ করবে।
অর্ধ-স্বাতন্ত্র্য হংকংয়ের উপর চীন আর্টিকেল ২৩ পাস করানোর জন্য চাপ দিতে থাকে যা অনুসারে হংকংকে অবশ্যই চীনের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা, অপসারণ, রাষ্ট্রদ্রোহ, পরাভব এবং প্রতারণা যেন না করা হয় সেজন্য চীনের প্রস্তাবিত জাতীয় নিরাপত্তা আইন পাস করতেই হবে। হংকংয়ের নিজস্ব রাজনৈতিক ব্যাপারেও চীনের হস্তক্ষেপ থাকবে বলে এই আইনে উল্লেখ করা হয়। শহরটিকে বারবার নিজের ‘সাংবিধানিক দায়িত্ব’র কথা মনে করিয়ে দিয়ে আইনটি পাস করার জন্য চাপ দেওয়া হয়। কিন্তু সেই সময়ে হংকংয়ের সংবিধানে এটি অন্তর্ভুক্ত করা সম্ভব হয়নি। সাধারণ জনগণ আশঙ্কা করে যে এর ফলে তাদের যে স্বাতন্ত্র্য বা স্বাধীনতা রয়েছে তা হুমকির মুখে পড়ে যাবে। প্রায় পাঁচ লাখ লোকের সমাগম ঘটে শহরটির রাস্তায়। অবরুদ্ধ হয়ে যায় গোটা শহর। ফলে সেই সময়ে জনগণের তোপের মুখে পড়ে সরকারকে এই সিদ্ধান্ত বাতিল করতে হয়।
শিক্ষার জন্য আন্দোলন
২০০৩ সালে জাতীয় নিরাপত্তা আইনে পরিবর্তন আনতে ব্যর্থ হওয়ার নয় বছরের মাথায় শিক্ষা ব্যবস্থায় পরিবর্তন আনার কাজে উঠে পড়ে লাগে চীনের কেন্দ্রীয় সরকার। কোনো শহর বা দেশকে আয়ত্ত্বে আনতে চাইলে তার শিক্ষা ব্যবস্থাকে পুঁজি করে কাজ করার ব্যাপারটি নিতান্তই মন্দ নয়। আর এই কৌশলই অবলম্বন করতে চেয়েছিল চীন। হংকংয়ের শিক্ষা ব্যবস্থায় এমন কিছু সংযুক্তির বিষয় বলা হয় যার ফলে শিক্ষার্থীরা নিজেদের গণতান্ত্রিক মনোভাব বদলে চীনের কমিউনিজম এবং কমিউনিস্ট নেতাদের সমর্থন করা শুরু করবে।
সোজা কথায়, মগজধোলাই করে চীনের প্রতি আনুগত্য জাতি গড়ে তোলাই ছিল এর প্রকৃত লক্ষ্য। যদিও সরকারের মতে জাতীয় গর্ব এবং পরিচয় রক্ষার জন্যই এই কর্মসূচি। ২০১২ সালে এই কর্মসূচি চালু এবং ২০১৬ সালের মধ্যে এটি বাধ্যতামূলক করারও চিন্তা করা হয়। বিষয়টির গভীরতা হংকংবাসী প্রথমে বুঝতে না পারলেও কিছু অ্যাক্টিভিস্ট বা সক্রিয় কর্মী অনশন ধর্মঘটে বসলে তা সকলের দৃষ্টিগোচর হয়। ধর্মঘটে যোগদান করেন শিক্ষক, শিক্ষার্থী এবং তাদের অভিভাবকেরা। প্রায় এক লাখ মানুষের সহায়তায় আন্দোলন আরো জোরদার হয়ে ওঠে। জাতীয় নিরাপত্তা আইনের মতো এই আইন বা পদক্ষেপ নেওয়ার পরিকল্পনাও বাতিল করতে হয় সরকারকে।
ছাতা আন্দোলন
হংকংয়ের সাধারণ শিক্ষার্থীরা নিজেদের রাজনৈতিক স্বাধীনতা রক্ষার্থে এবং একটি সুষ্ঠু ও প্রকৃত গণতান্ত্রিক নির্বাচনের উদ্দেশ্য আদায়ে যখন রাস্তায় নামে তখন তাদের থামানোর উদ্দেশ্যে সরকার অনেক চেষ্টাই করে।
২০১৪ সালের ২৮ সেপ্টেম্বর হংকংয়ে সরকারের প্রধান কার্যালয়ের সামনে অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করতে আসা শিক্ষার্থীদের উপর পুলিশ মরিচের গুঁড়ো, কাঁদানে গ্যাস এবং জলকামান দিয়ে আক্রমণ করে। এই আক্রমণের উদ্দেশ্য ছিল ছাত্রছাত্রীদের দাবিগুলো অগ্রাহ্য করে তাদের আন্দোলন বন্ধ করে দেওয়া। তবে ফলাফল হলো ঠিক এর বিপরীত। সাধারণ জনগণেরাও দলে দলে এই আন্দোলনে যোগদান করা শুরু করল। নিরস্ত্র আন্দোলনকারীদের কাছে এই জ্বালাময় হামলা থেকে বাঁচার হাতিয়ার হিসেবে ছিল ছাতা এবং ভেজা তোয়ালে। পুলিশের আক্রমণের সময় পুরো জনসমুদ্র হাজার হাজার ছাতার রঙে রঙিন হয়ে উঠে। সাধারণ ছাতাই যেন আন্দোলনটির মূল প্রতীক হয়ে দাঁড়ায়। আর এজন্যই সংবাদমাধ্যমে এটি ‘ছাতা বিপ্লব’ নামে পরিচিতি লাভ করে। অবশ্য আন্দোলনের নেতাদের মতে এটা কোনো বিপ্লব নয়, বরং নিজেদের অধিকার রক্ষা এবং ন্যায্য দাবি আদায়ের আন্দোলন। চীনের কেন্দ্রীয় সরকার যেভাবে তাদের রাজনৈতিক অধিকার ক্ষুণ্ণ করছে তা পুনরায় আদায় করার উদ্দেশ্যেই শুরু করা হয় এই আন্দোলন।
বিদেশি গণযোগাযোগ মাধ্যমগুলোতে বারবার ‘ছাতা বিপ্লব’ বলতে শুরু করলে ‘হংকং ডেমোক্রসি নাউ’ ফেসবুক পেজ এই অভিধার সংশোধনী আনে। পেজটি মূলত আন্দোলনের মূল নেতৃত্বদানকারীদের উদ্যোগে খোলা হয়। সেখানে তারা ‘বিপ্লব’ এর পরিবর্তে ‘আন্দোলন’ শব্দটি ব্যবহার করার অনুরোধ জানান। তাদের বক্তব্যের সারসংক্ষেপ হলো, একে আন্দোলন বললেই তাদের কর্মসূচির সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ হবে। কারণ তাদের একমাত্র হাতিয়ার হলো ছাতা। ঝড়, বৃষ্টি থেকে বাঁচার জন্য যেমন ছাতা দরকার তেমনি এই বিপদের সময়ও ছাতা তাদেরকে সকল অরাজকতা থেকে রক্ষা করবে। এই আন্দোলনের স্বার্থে অনেকে ছবি এবং লোগোও ডিজাইন করেন। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো সানি ইয়েন, ক্যারোল চ্যান, অ্যান্ড্রিয়ু ওং, লিলি চিয়ুং, চুন মান এবং অ্যাঙ্গ্যালো কস্টাডিমাসের লোগো বা ছবি।
আন্দোলন আরো জোরদার হয় যখন সাধারণ জনগণের পাশে দূরদর্শী নেতারা এসে দাঁড়ায়। বেসামরিক জনতা হংকংয়ের মূল বাণিজ্যিক অঞ্চলগুলোর রাস্তাঘাট ৭৯ দিনের জন্য বন্ধ করে দেয়। খুব শান্তভাবেই তারা তাদের কর্মসূচি পালন করছিল। তবে এর ফলে হংকংয়ের অর্থনৈতিক ব্যবস্থা অচল হয়ে পড়ে। এমতাবস্থায় পুলিশ আন্দোলনকারীদের জলকামান নিয়ে আক্রমণ করে বসলে ছাতা হয়ে যায় আমজনতার মূল হাতিয়ার। অবশ্য এসব কিছুর পেছনে জনগণের স্বার্থ লুকিয়ে থাকা সত্ত্বেও শহরের কিছু বাসিন্দা এবং ব্যবসায়ী তাদের সাময়িক সমস্যার কারণে এই আন্দোলনের প্রতি অসন্তোষ প্রকাশ করেন।
বহিঃসমর্পণ আইন
হংকংয়ে ২০১৯ সালে বহিঃসমর্পণ আইন পাস করারও চেষ্টা করা হয়, যা অনুসারে যেকোনো দোষীকে সর্বোচ্চ শাস্তি দেওয়ার অধিকার থাকবে চীনের। শহরটির অভ্যন্তরীণ কোনো বিষয়ে সাব্যস্ত হলে শহরের পুলিশ বাহিনীর কাছে আত্মসমর্পণ করাই গ্রহণযোগ্য নিয়ম। নিজস্ব বিচার ব্যবস্থা থাকা সত্ত্বেও চীনের কাছেই যদি বিচারের জন্য শরণাপন্ন হতে হয় তাহলে বিচারকার্যে ব্যাঘাত ঘটাই স্বাভাবিক। তবে এই আইন পাসের পক্ষে যারা রয়েছে তাদের মতে হংকং যেন অপরাধীদের জন্য শরণার্থী শিবিরে পরিণত না হয় সেজন্যই আইনের এই সংশোধন প্রয়োজন। এই আইন পাস হলে ম্যাকাও এবং তাইওয়ানকেও এই বহিঃসমর্পণ আইন মানতে হবে।
এর সূত্রপাত ঘটে ২০১৮ সালের শেষের দিকে। হংকংয়ের এক নারী তাইওয়ানে গেলে সেখানে খুন হন। তাইওয়ানের পুলিশ সেই সময়ে ঐ মহিলার বন্ধুকে এই খুনের পেছনে দায়ী বলে মনে করেন। কিন্তু ঐ ব্যক্তি হংকংয়ে অবস্থান করার কারণে তাইওয়ানের পুলিশ বিচারকার্য সম্পাদন করতে পারেনি। আর এ থেকেই চীনের কেন্দ্রীয় সরকার এরকম অবস্থায় বহিঃসমর্পণ আইনের প্রয়োজনীয়তা অনুভব করে। দাবী করা এই আইনে দোষীরা বহিঃসমর্পণ করলে সরকার তাদের সাত বছর কিংবা এর অধিক সময় শাস্তি দেওয়ার অধিকার পেয়ে যাবে। হংকংয়ের নেতা তথা মুখ্য কার্যনির্বাহী কোনো দোষীর বহিঃসমর্পণের সকল দলিল ঠিকমতো দেখে তাকে হস্তান্তর করতে পারবে। এই আইন পাস হলে আসলে ‘এক রাষ্ট্র, দুই নীতি’র কাঠামো আর থাকে না। কারণ সেক্ষেত্রে অভ্যন্তরীণ সব ব্যাপারেই চীনের আদেশ মানতে হবে। তাহলে দুই নীতি তো আর থাকছে না।
সর্বশেষ পরিস্থিতি
জুনের ৯ তারিখ ১০ লাখের চেয়েও বেশি আমজনতা চীন সরকারের বিরুদ্ধে একত্রিত হয়ে রাস্তায় নামে। ছাতা আন্দোলনের পর এটাই ছিল হংকংয়ের সবচেয়ে বড় আন্দোলন। তবে পুলিশের কারণে এই কর্মসূচি বিপাকে পড়ে যায়। কাঁদানে গ্যাস ও জলকামান দিয়ে আক্রমণ করার পাশাপাশি ১৯ জন আন্দোলনকারীকে গ্রেফতারও করে পুলিশ। ১৯৯৭ সালের এই প্রথম ২০১৯ সালে পুলিশ বাহিনী সাধারণ জনগণের উপর এভাবে আক্রমণ করে। এই হামলায় ৮০ জন আহত হয়। ফলশ্রুতিতে আন্দোলনের বিস্তৃতি আরো বেড়ে যায়। ১২ জুন বিল পাসের জন্য আরেকটি বৈঠক হওয়ার কথা থাকলেও আন্দোলনের দরুণ তা বাতিল হয়ে যায়। আন্দোলনকে সমর্থন দিয়ে ১০০টির বেশি ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান এবং দোকানপাট বন্ধ করে দেয় সাধারণ জনগণ। এমনকি বেইজিং এই ঝামেলায় জড়াতে চায় না বলে সরে দাঁড়ায়। অবশেষে ১৫ জুন হংকংয়ের মুখ্য কার্যনির্বাহী ক্যারি লাম বিলটি স্থগিত করে। তারপরও ১৬ জুন রাস্তা অবরোধ করা হয়।
আমজনতার উপর হামলা এবং আন্দোলনের নেতাদের গ্রেফতার করার প্রতিবাদে এই অবরোধ করা হয়। ১৭ জুন ‘ছাতা আন্দোলন’-এর নেতৃত্বদানকারী অ্যাক্টিভিস্ট জোশুয়া ওংকে জেল থেকে মুক্ত করা হয়। মুক্তির পরপরই তিনি লামের পদত্যাগের দাবি করেন।