
পৃথিবীতে সবচেয়ে বড় প্রবীণ জনগোষ্ঠীর বাস জাপানে। দেশটির মোট জনসংখ্যার এক চতুর্থাংশের বয়স ৬৫’র বেশি। জাপানের জাতীয় অর্থনীতিতে এমনিতেই রয়েছে এর বড় প্রভাব। কিন্তু সম্প্রতি প্রবীণ জনগোষ্ঠী নিয়ে আরো একটি অপ্রত্যাশিত সমস্যায় পড়েছে জাপান। পৃথিবীর সর্বোচ্চ সংখ্যক প্রবীণ কারাগারবাসীও এখন জাপানেই! কারাগারে বয়স্ক আসামীদের জায়গা করে দিতে হিমশিম খেতে হচ্ছে জাপানের কারা কর্তৃপক্ষের। আর এই তথ্যের সবচেয়ে অস্বাভাবিক এবং অস্বস্তিকর দিকটি হলো, এই আসামিদের একটা বড় অংশই দণ্ডিত হচ্ছে ইচ্ছাকৃত। অর্থাৎ, তারা জেনেবুঝে, একরকম পরিকল্পিতভাবেই ছোটখাটো অপরাধ করছেন, বিশেষ করে দোকান থেকে চুরি করছেন জেলে যাবার জন্য!

জাপানের কারাগারগুলোতে এখন প্রতি ৫ জনে ১ জন হলেন প্রবীণ বন্দী। কিছু বড় কারাগারে তো দেখা গেছে, প্রতি ১০ জনে ৯ জনই ‘সিনিয়র সিটিজেন’ তথা জ্যেষ্ঠ নাগরিক। এমনিতেই জাপান বয়স্ক নাগরিকদের পরিচর্যায় নানারকম সমস্যার সম্মুখীন হচ্ছিল। এই সমস্যায় নতুন মাত্রা যোগ করেছে বয়স্কদের একাকিত্বের হার। ১৯৮৫-২০১৫ সাল পর্যন্ত জাপানে একা বসবাস করা প্রবীণ মানুষের সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়েছে ৬০০ শতাংশ! আর এই একা মানুষগুলোই যে চুরির মতো অপরাধে লিপ্ত হচ্ছেন, তার পরিসংখ্যানগত প্রমাণও প্রকাশ করেছে জাপানের পুলিশ। কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, প্রবীণ বন্দীদের অর্ধেকের বেশিই একাকী বসবাসকারী। তাদের মাঝে আবার ৪০ শতাংশের পরিবার আছে, কিন্তু তারা বিচ্ছিন্নভাবে বসবাস করেন কিংবা করতে বাধ্য হন।
“তাদের একটি বাড়ি আছে, একটি পরিবারও হয়তো আছে, কিন্তু সুখ নেই!”- প্রবীণ বন্দীদের সম্পর্কে জাপানের এক কারাগারের ওয়ার্ডেন ইয়ুমি মুরানাকা
এদিকে জাপানের কারাগার কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, তাদের কর্মীদের কারাগারে অন্যান্য কাজের চেয়ে নার্সের কাজই বেশি করতে হচ্ছে! কেননা, বয়স্কদের একটু বেশিই পরিচর্যা প্রয়োজন হয়। তাছাড়া, জাপানে কারাবন্দী প্রতিটি মানুষের পেছনে বছরে ২০ হাজার ডলার ব্যয় হয়। প্রবীণদের বিশেষ যত্ন এবং চিকিৎসাসেবার জন্য সে খরচ আরো বৃদ্ধি পায়। ফলে কারাগারের জন্য বাৎসরিক খরচ মেটাতে বিপাকে পড়তে হচ্ছে জাপান সরকারকে।
কারাগার এমন একটি জায়গা, যেখানে বিনা খরচে মাথা গোঁজার ঠাঁই আর আহার পাওয়া যায়। কিন্তু তারপরও দরিদ্র কিংবা অতি দরিদ্র মানুষজনও কারাগারের বন্দিত্ব নিতে চাইবেন না। অথচ জাপানের বৃদ্ধ মানুষজন প্রতিনিয়ত কারাগার জীবনের প্রতি আকৃষ্ট হয়েই চলেছেন, যাদের বড় অংশেরই অর্থ সমস্যা নেই। তারা কারাগারের যে বিষয়টির প্রতি আকৃষ্ট হন, তা হলো সঙ্গী লাভের উপায়।
উপরে ছবিটিতে লক্ষ করুন। ২০১৪ সালে জাপানে চুরির দায়ে গ্রেফতারকৃত মানুষের ৩৫ ভাগই প্রবীণ। অবশ্য কিছু মানুষ অর্থাভাবেও এমনটি করছেন বলে প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে ফরচুন। জাপানে অবসরপ্রাপ্তদের সর্বনিম্ন পেনসনের স্কেল বাৎসরিক ৬,৮০০ ডলারের কিছু বেশি। কিন্তু একজন মানুষের জীবনধারণের গড়পড়তা খরচ সাড়ে আট হাজার ডলারেরও বেশি। তাই বাধ্য হয়েও কিছু মানুষ জেলে যেতে চান।
মানুষগুলো যে ইচ্ছাকৃতই জেলে যাচ্ছেন, তার আরো স্পষ্ট প্রমাণ দিয়েছে সিএনবিসির প্রতিবেদন। উপরে চুরির দায়ে ধরা পড়া যে ৩৫ ভাগ প্রবীণ ব্যক্তির কথা বলা হয়েছে, তাদের মাঝে আবার ৪০ ভাগই বারংবার একই অপরাধে ধরা পড়েছেন, জেল খেটেছেন, ছাড়া পেয়ে আবার অপরাধ করে ধরা পড়েছেন। এই পুনরাবৃত্তির সংখ্যাও চোখ কপালে তোলার মতো। যে ৪০ ভাগের কথা বলা হচ্ছে, তারা অন্তত ৬ বার একই অপরাধে গ্রেফতার হয়েছেন!
এদিকে পরিসংখ্যান বলছে, ২০৬০ সালের মধ্যে জাপানের মোট জনসংখ্যার ৪০ ভাগই হতে চলেছে ষাটোর্ধ্ব। ফলে, বর্তমানকালে প্রবীণদের মাঝে যে হারে অপরাধপ্রবণতা দেখা যাচ্ছে এবং কারাগারে বসবাস করার আকর্ষণ যেভাবে বৃদ্ধি পাচ্ছে, তাতে ভবিষ্যতে কারাগারে বন্দীদের স্থান সংকুলানই হবে বড় চ্যালেঞ্জ। কিন্তু এ সমস্যার জন্য প্রবীণদের কিছুতেই দায়ী করতে পারছেন না জাপানের সমাজবিদরা। তাদের মতে, এই অপ্রত্যাশিত সমস্যাই চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিচ্ছে জাপানের সামাজিক সমস্যাগুলোকে, যা তাদের জেলে যেতে বাধ্য করছে। তাছাড়া, তাদের অপরাধপ্রবণতাও এখন চক্রাকার হয়ে গেছে। জেল থেকে বেরিয়ে তারা দেখছেন যে তাদের কোনো পরিবার নেই, সঙ্গ দেবার লোক, জীবনধারণের পর্যাপ্ত টাকা নেই, অনেক ক্ষেত্রে মাথার উপর ছাদটাও নেই। ফলে, তারা পুনরায় অপরাধ করতে বাধ্য হন। কেননা, অপরাধ করলে তার দু’দিকে লাভ। ধরা না পড়লে তিনি প্রয়োজনীয় কিছু দ্রব্যাদি পাচ্ছেন বিনামূল্যে। ধরা পড়লেও জেলে যেতে পারছেন, যেখানে থাকা-খাওয়া দুটোই মিলবে বিনা মূল্যে। উপরন্তু, সাথে পাওয়া যাবে সমবয়সী অনেকগুলো মানুষের সঙ্গ।
এদিকে, এ সমস্যা নিরসনে জাপান সরকার জ্যেষ্ঠ নাগরিকদের জন্য বিভিন্ন কল্যাণমুখী পরিকল্পনা হাতে নিতে চায়। বয়স্ক জনসংখ্যার জন্য বাৎসরিক বাজেটও উল্লেখযোগ্য পরিমাণ বৃদ্ধির পরিকল্পনা রয়েছে সরকারের। কিন্তু সমস্যা হলো, সে প্রক্রিয়া শুরু করার সুযোগ মিলছে না। প্রবীণদের একটা বড় অংশই যখন কারাগারে, তখন তাদের পরিচর্যার জন্য বরাদ্দ বাজেটের বড় অংশও যাচ্ছে কারাগারেই। আর কল্যাণমুখী বাজেট বাধ্য হয়ে কারাগারে খরচ করাটা কোনো দেশের সরকারের জন্যই সুখকর নয়। আবার ছোটখাটো চুরির দায়ে ধরা পড়া প্রবীণ আসামীদের দ্রুত সাজা মওকুফ করে ছেড়ে দেয়ার একটি পরিকল্পনাও করেছিল জাপান সরকার। কিন্তু তাতে বরং অপরাধ আরো বেড়েছেই, সাথে যোগ হয়েছে আইনি জটিলতাও।
২০১৬ সালের একটি তথ্যই উল্লেখ করা যাক। কেবল সে বছরই চুরির দায়ে গ্রেফতার হওয়া ষাটোর্ধ্ব মানুষের সংখ্যা ২৫০০! এই ২৫০০ জনের মাঝে আবার ১ হাজারের বেশি সংখ্যকই ২০১৬’র পূর্বে অন্তত পাঁচবার গ্রেফতার হয়েছেন একই অপরাধে! এদের অর্ধেক নারী আসামী। গ্রেফতারকৃতদের মূল অপরাধই ছিল খাবার চুরি, যার গড় মূল্য ২৫ ডলারেরও কম।
প্রবীণ জাপানিদের মাঝে এরূপ অপরাধপ্রবণতা বৃদ্ধির কারণ নির্ণয় করবার পূর্বে চলুন জেনে নিই কারাগারে বন্দী কয়েকজন প্রবীণ ব্যক্তির অপরাধ ও ধরা পড়ার গল্প। আমেরিকা ভিত্তিক মিডিয়া কোম্পানি ব্লুমবার্গ জাপানের বেশ কয়েকজন প্রবীণের জেলে যাবার কারণ প্রকাশ করে ২০১৮ সালে। মানবিক কারণে প্রকাশিত প্রতিবেদনটিতে কারো প্রকৃত নাম দেয়া হয়নি।
ঘটনা-১
জনাব ক ৬২ বছর বয়সে প্রথম চুরি করেন। সে চুরিতে অবশ্য তিনি ধরা পড়েননি, স্বেচ্ছায় ধরা দিয়েছিলেন। অবসরের পর পেনসনের টাকায় যখন আর কুলাচ্ছে না, তখন দোকান থেকে নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্যসামগ্রী চুরি করার সিদ্ধান্ত নেন। প্রথম চুরিই সফল হলেও মনের ভেতর অপরাধবোধ থেকেই যায়। আর অপরাধবোধ থেকে তিনি আরো ভালো উপায় উদ্ভাবন করেন। জাপানে যেহেতু ছিঁচকে চুরি বেশ গুরুতর অপরাধ মনে করা হয়, তাই তিনি তার চুরি করা সামগ্রী নিয়ে সোজা চলে গেলেন থানায়, দিলেন স্বীকারোক্তি! ব্যস, ১ বছরের কারাদণ্ড তথা থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থা হয়ে গেলে। এভাবে পরপর দু বছর করার পর পন্থা বদলালেন তিনি। তৃতীয় বছর ছাড়া পাবার একটি বড়সড় ছুরি নিয়ে চলে গেলেন পার্কে এবং সাধারণ মানুষের দিকে ভয়ানক ভঙ্গিতে তেড়ে গেলেন। এরপর কী হয়েছে, তা নিশ্চয়ই বলে দিতে হবে না? কেউ একজন পুলিশে ফোন দিলেন এবং জনাব ক এবার বেশ কয়েক বছরের জন্য জেলখানায় স্থায়ী হলেন।

ঘটনা-২
মিসেস খ’র স্বামী মারা গেছেন। তার ৩ বিবাহিত ছেলেই আলাদা বসবাস করে। অবশ্য ছেলেরা প্রতি মাসে তার জন্য যথেষ্ট পরিমাণ টাকা পাঠিয়ে দেয়। কিন্তু একা বসবাস করা মিসেস খ’র অর্থের চেয়ে একজন কথা বলার সঙ্গীর চাহিদাই ছিল বেশি। এরই মাঝে তিনি জানতে পারলেন, জেলে তার মতো অনেক বয়স্ক নারীরাই স্বাচ্ছন্দে বসবাস করেন অনেকটা পরিবারের মতো! তিনিও তখন তাদের পথ ধরলেন। এক ইলেকট্রনিকসের দোকান থেকে ইলেকট্রনিক সামগ্রী চুরি করতে গিয়ে ধরা পড়ে চলে গেলেন জেলে।
ঘটনা-৩
মিসেস গ ২০১৮ সালে চতুর্থবারের মতো চুরি করে ধরা পড়েছেন। এখন তিনি ৩ বছরের কারাদণ্ড ভোগ করছেন। ৮১ বছর বয়সী এ মহিলা প্রথম কারাভোগ করেছিলেন ৭০ বছর বয়সে। তার ছেলেরা তার দেখাশোনা করে না বিধায় তাকে থাকতে হতো তার বিবাহিত মেয়ের সাথে। কিন্তু, জামাতা তাকে কোনোদিন সুনজরে দেখেনি। উপরন্তু, তার দুজন নাতি থাকা সত্ত্বেও সারাদিনে তাকে সময় দেন না কেউই। খাবার সময়গুলো ব্যতীত নিজের ঘর থেকেই বের হন না কিংবা হতে পারেন না। এই বন্দীদশা থেকে মুক্তি পেতে কারাগার বেছে নিয়েছেন তিনি! ব্যাপারটা কতটা হৃদয়বিদারক হলে কারাগারের বন্দীদশাকেই তার মুক্তি ভাবতে হচ্ছে?

ঘটনা-৪
জনাব ঘ কোকাকোলার কিছু বোতল চুরির দায়ে এখন তৃতীয়বারের মতো জেল খাটছেন। জেলখানার বন্দীদশা তারও ভালো লাগে না। তার ভাষায়, “জেলখানায় আমার কোনো স্বাধীনতা নেই, আমি চাইলেই কিছু করতে পারি না। তথাপি এখানে আমার থাকা-খাওয়ার সমস্যা নেই। খাবার দেয়ার জন্য কেউ আমাকে অবজ্ঞা করে না। এখানে আমার সাথে কথা বলার অনেক মানুষ আছে, আমরা সবাই পরিবারের মতো বাস করি।” পরিবার কতটা অসহযোগিতামূলক হলে কেউ জেলখানায় পারিবারিক সম্প্রীতি খুঁজে পায়, তা অনুধাবন করা কষ্টকর নয়।

উপরের চারটি ঘটনা এরকম আরো হাজারো প্রবীণ নারী-পুরুষের বঞ্চনার গল্প। অর্থই যে সব নয়, এটা তার বড় প্রমাণ। পুঁজিবাদী বিশ্বের ফসল হলো আজকের এই একাকিত্ব, বিষণ্ণতা। যৌথ পরিবার না থাকায় মানুষ বয়সকালে চরম নিঃসঙ্গতায় ভোগেন। ফলে নানাবিধ অপরাধকর্মে লিপ্ত হন। কেউ আবার অর্থাভাবের কারণেও অপরাধে লিপ্ত হয়েছেন। ৪র্থ ঘটনা থেকে জানা যায় যে জেলখানার বন্দীদশা আসলে এই মানুষগুলোরও ভালো লাগে না। কিন্তু নিঃসঙ্গতা তাদের কাছে একাকিত্বের চেয়েও ভয়ানক অসুখ। সে অসুখ থেকে বাঁচতে জীবনের শেষ অধ্যায়ে এসে জেলখানাতেই আশ্রয় নিচ্ছেন তারা।
এ সমস্যার প্রকৃত সমাধান যা হতে পারতো, তা হলো পারিবারিক বন্ধন দৃঢ় করা, সম্ভব হলে যৌথ পরিবারে ফিরে যাওয়া। কিন্তু তিক্ত সত্য হলো, পুঁজিবাদ যতদিন থাকছে, পারিবারিকভাবে নিঃসঙ্গতার সমস্যা দূর করা অনেকটাই অসম্ভব। এক্ষেত্রে জাপানের জন্য আপাতকালীন সমাধান হলো প্রবীণ জনগোষ্ঠীর দেখাশোনার জন্য প্রচুর পরিমাণে বৃদ্ধাশ্রম নির্মাণ, যেখানে তারা মিলেমিশে থাকবেন এবং পরস্পরের একাকিত্ব ঘোচাবেন। বয়স্ক জনগোষ্ঠীর জন্য পৃথক বিনোদনের ব্যবস্থা, পার্ক, সমিতি ও অনুরূপ বিভিন্ন গোষ্ঠী ও সংগঠন তৈরি করা, যেখানে তারা তাদের অবসর সময়টা পার করতে পারবেন অনায়াসে। সর্বোপরি, প্রবীণদের প্রতি জাপান সরকারের বিশেষ নজর দেয়াটা এখন সময়ের দাবিও।