১৯৩৮ সালের নভেম্বরে সৌদি আরবে তেল আবিষ্কৃত হওয়ার পর আয়তনে পশ্চিম এশিয়ার বৃহত্তম রাষ্ট্রটি দ্রুত একটি অত্যন্ত সম্পদশালী রাষ্ট্রে পরিণত হয়। কিন্তু রাষ্ট্রটির আয়তনের অনুপাতে জনসংখ্যার পরিমাণ অত্যন্ত কম এবং রাষ্ট্রটির ৯৫% ভূমিই মরুভূমি। এজন্য সৌদি সরকার সবসময়ই তাদের তুলনামূলকভাবে জনবহুল কিন্তু দরিদ্রতর প্রতিবেশী রাষ্ট্রগুলোর দ্বারা আক্রান্ত হওয়ার ভয়ে ছিল।
১৯৬৯ সালে সৌদি আরবের ইতিহাসে প্রথম আদমশুমারি অনুষ্ঠিত হয়। আদমশুমারিতে সৌদি আরবের জনসংখ্যার পরিমাণ দেখে তৎকালীন বাদশাহ ফয়সাল বিন আব্দুল আজিজ শঙ্কিত হন এবং সংখ্যাটি দ্বিগুণ করে প্রকাশ করেন, যাতে সৌদি আরবের জনতাত্ত্বিক দুর্বলতা বহির্বিশ্বের কাছে প্রকাশ না পায়। এর ফলে সৌদি আরবে পরবর্তীতে অনুষ্ঠিত প্রতিটি আদমশুমারির ফলাফলই ছিল মিথ্যা। সৌদি সরকারের তথ্যমতে, ১৯৯০ সালে সৌদি আরবের জনসংখ্যা ছিল ১ কোটি ৬০ লক্ষের বেশি, যা ছিল সৌদি আরবের উত্তরাঞ্চলীয় প্রতিবেশী রাষ্ট্র ইরাকের জনসংখ্যার প্রায় সমান (এসময় ইরাকের জনসংখ্যা ছিল ১ কোটি ৭০ লক্ষের কিছু বেশি)।
কিন্তু সেসময়কার সৌদি গোয়েন্দা সংস্থা ‘জেনারেল ইন্টেলিজেন্স প্রেসিডেন্সি’র (رئاسة الاستخبارات العامة, ‘রিয়াসাত আল–ইসতিখবারাত আল–আমাহ) পরিচালক তুর্কি বিন ফয়সালের মতে, এসময় সৌদি আরবের মোট জনসংখ্যা ছিল মাত্র ৫০ লক্ষের কিছু বেশি! স্বাভাবিকভাবেই, জনসংখ্যা কমপক্ষে হওয়ায় সশস্ত্রবাহিনীতে যোগদানের উপযুক্ত লোকের সংখ্যাও ছিল কম, ফলে সৌদি সশস্ত্রবাহিনী সংখ্যাগত দিক থেকে ছিল বেশ দুর্বল।
এই সংখ্যাগত দুর্বলতা কাটিয়ে ওঠার জন্য সৌদি আরব বিপুল পরিমাণ অর্থ ব্যয় করে এবং সর্বাধুনিক অস্ত্রশস্ত্র ক্রয় করে। সৌদি আরবের অস্ত্রশস্ত্রের প্রধান উৎস ছিল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, ফ্রান্স এবং চীন। সৌদি আরব এই রাষ্ট্রগুলো থেকে বিলিয়ন বিলিয়ন মার্কিন ডলার সমমূল্যের অস্ত্রশস্ত্র ক্রয় করে। প্রায় প্রতিটি রাষ্ট্রেই প্রতিরক্ষা খাতে দুর্নীতির সুযোগ থাকে, এবং সৌদি আরবেও এর ব্যতিক্রম হয়নি। অস্ত্র ব্যবসায় জড়িত হয়ে সৌদি রাজপরিবারের সদস্যদের অনেকে আরো বিত্তশালী হয়ে ওঠে।
১৯৮০–এর দশকে সৌদি আরব ৫,০০০ কোটি (বা ৫০ বিলিয়ন) মার্কিন ডলার ব্যয়ে একটি এয়ার ডিফেন্স সিস্টেম গড়ে তোলে। মার্কিন সেনাবাহিনীর ইঞ্জিনিয়ার কোর তাদের বৈদেশিক সদর দপ্তর তদানীন্তন পশ্চিম জার্মানি থেকে সৌদি আরবে স্থানান্তরিত করে। তারা সৌদি সশস্ত্রবাহিনী এবং জাতীয় রক্ষীবাহিনীর (National Guard) জন্য ঘাঁটি, প্রশিক্ষণকেন্দ্র এবং সদর দপ্তর নির্মাণ করে।
১৯৮৫ সালের ২৬ সেপ্টেম্বর সৌদি আরব যুক্তরাজ্যের সঙ্গে একটি বৃহৎ অস্ত্রচুক্তিতে স্বাক্ষর করে, যেটি ‘আল–ইয়ামামাহ অস্ত্র চুক্তি’ নামে পরিচিত। এই চুক্তি অনুযায়ী যুক্তরাজ্য সৌদি আরবকে ৯৬টি ‘টর্নেডো ইন্টারডিক্টর/স্ট্রাইকার’, ২৪টি ‘টর্নেডো এয়ার ডিফেন্স ভ্যারিয়ান্ট’, ৫০টি ‘বিএই হক’ এবং ৫০টি ‘পিলেটাস পিসি–৯’ যুদ্ধবিমান সরবরাহ করে। তদুপরি, যুক্তরাজ্য সৌদি আরবকে বিভিন্ন ধরনের ক্ষেপনাস্ত্র ও বিশেষায়িত নৌযান সরবরাহ করে এবং সৌদি আরবে বিভিন্ন সামরিক অবকাঠামো নির্মাণ করে দেয়। এটি ছিল যুক্তরাজ্যের ইতিহাসে সর্ববৃহৎ অস্ত্র চুক্তি!
বস্তুত, ১৯৮০–এর দশকের শেষদিকে সৌদি সশস্ত্রবাহিনী প্রচুর পরিমাণ সর্বাধুনিক অস্ত্রশস্ত্রে সুসজ্জিত ছিল। সেই অনুযায়ী রাষ্ট্রটির সেসময় প্রতিবেশী রাষ্ট্রগুলোর যেকোনো আক্রমণ প্রতিহত করার সামর্থ্য থাকার কথা ছিল। কিন্তু সৌদি সশস্ত্রবাহিনীতে দুটি জিনিসের ঘাটতি ছিল– প্রশিক্ষণ এবং সৈন্যসংখ্যা। জনসংখ্যা কম হওয়ায় কারণে সৌদি সশস্ত্রবাহিনীর আকৃতি যথেষ্ট বড় ছিল না এবং সৈন্যদের প্রশিক্ষণের মান ছিল নিম্ন।
অবশ্য সৌদি আরবের প্রতিবেশী রাষ্ট্রগুলোর সম্পর্কে আতঙ্কিত হওয়ার মতো কোনো পরিস্থিতি তখনো সৃষ্টি হয়নি। সৌদি আরবের উত্তরে জর্দান ও ইরাক, উত্তর–পূর্বে কুয়েত, পূর্বে কাতার, বাহরাইন ও সংযুক্ত আরব আমিরাত, দক্ষিণ–পূর্বে ওমান এবং দক্ষিণে জনগণতান্ত্রিক ইয়েমেন প্রজাতন্ত্র (দক্ষিণ ইয়েমেন) এবং ইয়েমেন প্রজাতন্ত্র (উত্তর ইয়েমেন) অবস্থিত ছিল। এই রাষ্ট্রগুলোর মধ্যে একমাত্র সমাজতান্ত্রিক দক্ষিণ ইয়েমেন ছাড়া অন্য রাষ্ট্রগুলোর সঙ্গে সৌদি আরবের সুসম্পর্ক বজায় ছিল। দক্ষিণ ইয়েমেনের সঙ্গে সৌদি আরবের সম্পর্ক ভালো ছিল না, কিন্তু এই দরিদ্র রাষ্ট্রটির জনসংখ্যা ছিল সৌদি আরবের প্রকৃত জনসংখ্যার প্রায় অর্ধেক (২৫ লক্ষের কিছু বেশি) এবং রাষ্ট্রটির সৌদি আরবকে আক্রমণ করার কোনো বাস্তব সম্ভাবনা ছিল না। ১৯৯০ সালে উত্তর ও দক্ষিণ ইয়েমেন একত্রিত হয় এবং সৌদি রাষ্ট্রের প্রতি দক্ষিণ ইয়েমেনি হুমকির আপাতত অবসান ঘটে।
একমাত্র সৌদি আরবের উত্তরাঞ্চলীয় প্রতিবেশী রাষ্ট্র ইরাকের সৌদি আরবকে আক্রমণ করার সামর্থ্য ছিল। সেসময় ইরাকের ছিল বিশ্বের চতুর্থ বৃহত্তম সশস্ত্রবাহিনী, যারা ইরানের বিরুদ্ধে আট বছরব্যাপী যুদ্ধে (১৯৮০–১৯৮৮) অভিজ্ঞ হয়ে উঠেছিল। ইরাকি সেনাবাহিনীতে ৫৩টি ডিভিশন এবং ২০টি স্পেশাল ফোর্স ব্রিগেড ছিল, এবং ইরাকি সেনাবাহিনীর মোট সদস্যসংখ্যা ছিল ৯,৫৫,০০০। এছাড়া ইরাকের ‘ইরাকি পপুলার আর্মি’, ‘রিপাবলিকান গার্ড’ ও ‘স্পেশাল রিপাবলিকান গার্ড’ আধা–সামরিক বাহিনী এবং আঞ্চলিক মিলিশিয়া বাহিনীগুলোতে ছিল আরো প্রায় সাড়ে ৬ লক্ষ সৈন্য। তদুপরি, ইরাকের ছিল ৫,৭০০টি ট্যাঙ্ক, ৩,০০০টি কামান, ৭০০টি যুদ্ধবিমান ও হেলিকপ্টার এবং একটি শক্তিশালী এয়ার ডিফেন্স বাহিনী। বিশেষত ইরাকের রিপাবলিকান গার্ড বাহিনীতে ছিল মধ্যপ্রাচ্যের সবচেয়ে দক্ষ এবং অভিজ্ঞ কয়েকটি ডিভিশন।
সৌদি সরকার ইরাকি সামরিক সক্ষমতা সম্পর্কে সম্পূর্ণ সচেতন ছিল এবং এজন্য ইরাকের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক বজায় রেখে চলছিল। এসময় সৌদি আরব ইরাককে নয়, ইসলামি বিপ্লবের আদর্শে উদ্বুদ্ধ ইরানকে নিজেদের জন্য বড় হুমকি হিসেবে বিবেচনা করত। ইরাক–ইরান যুদ্ধ চলাকালে ইরাকের মূল অর্থনৈতিক মিত্র ছিল সৌদি আরব। এসময় রিয়াদ বাগদাদকে প্রায় ৩,০৯০ কোটি (বা ৩০.৯ বিলিয়ন) মার্কিন ডলার আর্থিক সহায়তা প্রদান করেছিল। ১৯৮৯ সালে সৌদি আরব ও ইরাক একটি পারস্পরিক অনাক্রমণ চুক্তিতে স্বাক্ষর করে। অর্থাৎ, বাহ্যিকভাবে ইরাকের দিক থেকেও সৌদি আরবের প্রতি কোনো হুমকি ছিল না।
তদুপরি, ইরাকি রাষ্ট্রপতি সাদ্দাম হুসেইন সৌদি জনসাধারণের মধ্যে বিশেষ জনপ্রিয় ছিলেন। সাদ্দাম ইসরায়েলের অর্ধেক রাসায়নিক অস্ত্র দিয়ে পুড়িয়ে দেয়ার হুমকি দিয়েছিলেন। তার তীব্র ইসরায়েলবিরোধী মনোভাব এবং পশ্চিমাবিদ্বেষী বক্তব্যগুলো আরব বিশ্বের বহু মানুষ বিশেষভাবে পছন্দ করত। এর ফলে সাদ্দাম কখনো সৌদি আরব আক্রমণ করতে পারেন, এই আশঙ্কা অল্প কিছু সৌদি নিরাপত্তা কর্মকর্তা ছাড়া আর কারো মনে ছিল না।
১৯৯০ সালে ইরাক ও কুয়েতের মধ্যে বেশ কিছু বিষয় নিয়ে দ্বন্দ্বের সৃষ্টি হয়। ইরাক–ইরান যুদ্ধের সময় ইরাক কুয়েতের কাছ থেকে ১,৪০০ কোটি (বা ১৪ বিলিয়ন) মার্কিন ডলার ঋণ নেয় এবং যুদ্ধপরবর্তী ইরাকের অর্থনৈতিক দুরবস্থার কারণে এই ঋণ মওকুফ করার জন্য ইরাক কুয়েতকে চাপ দিচ্ছিল। কিন্তু কুয়েত তাতে রাজি ছিল না; ইরাকি–কুয়েতি সীমান্তবর্তী তেলক্ষেত্রগুলোর মালিকানা নিয়ে রাষ্ট্র দুটির মধ্যে বিরোধ দেখা দেয়। ইরাক তার অর্থনৈতিক দুরবস্থা কাটিয়ে উঠতে তেলের মূল্য বৃদ্ধির জন্য তেল উৎপাদনকারী রাষ্ট্রগুলোকে অনুরোধ জানালেও কুয়েত তাতে সম্মত হচ্ছিল না; এবং ইরাক কুয়েতকে ঐতিহাসিকভাবে ইরাকি ভূমি হিসেবে বিবেচনা করত।
সৌদি আরব ইরাক ও কুয়েতের মধ্যে মধ্যস্থতার চেষ্টা করে, এবং সৌদি বাদশাহ ফাহাদ বিন আব্দুল আজিজ ১৯৯০ সালের ৩১ জুলাই স্বয়ং ইরাকি ও কুয়েতি প্রতিনিধিদের সঙ্গে বৈঠকে তাদের মধ্যে একটি সমঝোতা স্থাপনের চেষ্টা করেন, কিন্তু তার প্রচেষ্টা ব্যর্থ হয়। এসময় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সাদ্দামের সঙ্গে আলোচনায় এবং তাদের বিবৃতিতে ইঙ্গিত প্রদান করে যে, ইরাক ও কুয়েতের মধ্যে দ্বন্দ্বে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র নিরপেক্ষতা অবলম্বন করবে।
১৯৯০ সালের ২ আগস্ট ইরাক কুয়েত আক্রমণ করে এবং দুই দিনের মধ্যে ক্ষুদ্র রাষ্ট্রটি দখল করে নেয়। ইরাক কর্তৃক কুয়েত দখল সৌদি সরকারকে হতচকিত এবং আতঙ্কিত করে তোলে। বস্তুত সৌদি সরকার এতটাই হতবাক হয়ে পড়ে যে, সৌদি আরবের সরকার–নিয়ন্ত্রিত প্রচারমাধ্যমকে এই খবর প্রকাশ করতে নিষেধ করা হয়। ইরাকের কুয়েত আক্রমণের এক সপ্তাহ পর সৌদি গণমাধ্যম এই খবরটি সম্প্রচার করে।
ইরাকের কুয়েত আক্রমণের ফলে সৌদি আরব আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে কতটা একাকী সেটা সুস্পষ্ট হয়ে ওঠে। কয়েক দশক ধরে তারা আরব রাষ্ট্রগুলোকে হাজার হাজার কোটি মার্কিন ডলার সমমূল্যের সহায়তা প্রদান করেছিল তাদের সঙ্গে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক বজায় রাখার জন্য। কিন্তু ইরাকের কুয়েত দখলের পর দেখা গেল যে, ইয়েমেন, লিবিয়া, তিউনিসিয়া, আলজেরিয়া, সুদান, জর্দান এবং ফিলিস্তিন মুক্তি সংস্থা (Palestine Liberation Organization, PLO)– এদের সকলেই ইরাককে সমর্থন করছে।
ইরাকের কুয়েত দখলের ফলে সৌদি আরবের দীর্ঘদিনের দুঃস্বপ্ন বাস্তবে রূপ নেয়। কুয়েতে মোতায়েনকৃত ইরাকি বাহিনী এবং সৌদি আরবের পূর্বাঞ্চলীয় প্রদেশে অবস্থিত তেলক্ষেত্রগুলোর মধ্যে কয়েক মাইল বালি ছাড়া আর কোনো বাধা ছিল না। সৌদি ন্যাশনাল গার্ডের একটি ব্যাটালিয়ন, এক হাজারেরও কম সংখ্যক সৈন্য, তেলক্ষেত্রগুলো পাহারা দিচ্ছিল। এমতাবস্থায় ইরাকি ট্যাঙ্কবহর যদি সৌদি সীমান্ত অতিক্রম করে সৌদি তেলক্ষেত্রগুলোর দিকে ধাবিত হতো, সৌদি আরবের পক্ষে কিছুই করা সম্ভব হতো না।
সৌদি সশস্ত্রবাহিনী প্রচুর অস্ত্রশস্ত্রে সুসজ্জিত ছিল, কিন্তু সেসময় তাদের সৈন্যসংখ্যা ছিল মাত্র ৫৮,০০০ এবং তারা ইরাকি সৈন্যদের মতো সুপ্রশিক্ষিত ও অভিজ্ঞ ছিল না। এই শক্তি দিয়ে বিশ্বের চতুর্থ বৃহত্তম সশস্ত্রবাহিনীকে মোকাবেলা করা ছিল এক অসম্ভব ব্যাপার। সৌদি আরবের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য তাদের কাছে একটি পথই খোলা ছিল – সৌদি আরবের মাটিতে মার্কিন সৈন্য মোতায়েন করা।
ইরাকি–কুয়েতি দ্বন্দ্বে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ভূমিকা বিতর্কিত। ইরাক কুয়েত দখল করে নেয়ার আগে মার্কিনীরা এই দ্বন্দ্বে নিরপেক্ষ থাকবে বলে ইঙ্গিত দিয়েছিল এবং তাদের এই অবস্থান ইরাককে কুয়েত আক্রমণ করতে উৎসাহিত করেছিল বলে অনেক বিশ্লেষক মনে করেন। কিন্তু মার্কিনীরা এই অভিযোগ অস্বীকার করে। ইরাক কর্তৃক কুয়েত দখলের পর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র কুয়েতি তেলভাণ্ডারের ওপর ইরাকের নিয়ন্ত্রণকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয় নিরাপত্তার জন্য হুমকি হিসেবে আখ্যায়িত করে এবং কুয়েত থেকে ইরাককে বিতাড়িত করার সিদ্ধান্ত নেয়।
কূটনৈতিক চাপ ও অর্থনৈতিক অবরোধের মাধ্যমে ইরাককে কুয়েত থেকে সৈন্য প্রত্যাহারে বাধ্য করতে ব্যর্থ হয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সরাসরি সামরিক হস্তক্ষেপের সিদ্ধান্ত নেয় এবং এজন্য সৌদি আরবে সৈন্য মোতায়েন করতে সৌদি সরকারের সঙ্গে আলোচনা শুরু করে।
সৌদি রাজপরিবার সৌদি আরবে মার্কিন সৈন্য মোতায়েনের বিষয়টি নিয়ে দ্বিধাবিভক্ত ছিল। যুবরাজ ও ন্যাশনাল গার্ডের প্রধান প্রিন্স আব্দুল্লাহ সৌদি আরবের মাটিতে মার্কিন সৈন্য মোতায়েনের ঘোর বিরোধী ছিলেন, কারণ তার বিশ্বাস ছিল, একবার সেখানে ঘাঁটি স্থাপন করলে মার্কিনীরা আর কখনো সেখান থেকে সরবে না। অন্যদিকে, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী প্রিন্স নাইফের মতে, মার্কিন সহযোগিতা ছাড়া সম্ভাব্য ইরাকি আক্রমণ থেকে সৌদি আরবের রক্ষা পাওয়া অসম্ভব।
ইতোমধ্যে মার্কিন প্রতিরক্ষামন্ত্রী ডিক চেনি এবং মধ্যপ্রাচ্যে নিয়োজিত মার্কিন সেনাবাহিনীর কেন্দ্রীয় কমান্ডের কমান্ডার জেনারেল নর্মান শোয়ার্জকফ একদল উপদেষ্টাসহ জেদ্দায় আসেন এবং সৌদি বাদশাহ ফাহাদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। তাদের উদ্দেশ্য ছিল সৌদি আরবে মার্কিন সৈন্য মোতায়েনের ব্যাপারে বাদশাহকে রাজি করানো। শোয়ার্জকফ সৌদি বাদশাহকে স্যাটেলাইট থেকে প্রাপ্ত কুয়েতে মোতায়েনকৃত ইরাকি বাহিনীর চিত্র দেখান। তার মতে, কুয়েতে ৩টি ইরাকি আর্মার্ড ডিভিশন এবং অতিরিক্ত পদাতিক সৈন্য অবস্থান করছিল। তিনি যুক্তি দেখান যে, কুয়েতের মতো ক্ষুদ্র রাষ্ট্র দখল করে রাখার জন্য এত সৈন্যসামন্তের প্রয়োজন নেই এবং ইরাক কুয়েতে এত সৈন্য মোতায়েন করেছে সৌদি আরবকে আক্রমণ করার উদ্দেশ্যে।
সৌদি গোয়েন্দা সংস্থাও এসময় জানায় যে, ইতোমধ্যে বেশ কয়েকটি ইরাকি গোয়েন্দা দল সৌদি আরবের সীমান্ত অঞ্চলে অনুপ্রবেশ করেছিল। এর ফলে ইরাক সৌদি আরব আক্রমণ করার জন্য তথ্য সংগ্রহ করছে, এই ধারণা সৌদি রাজপরিবারের সদস্যদের মধ্যে দৃঢ় হয়।
মার্কিন সৈন্যরা কখনোই সৌদি আরব ছেড়ে যাবে না, সৌদিদের এরকম আশঙ্কা দূর করার জন্য ডিক চেনি মার্কিন রাষ্ট্রপতির পক্ষ থেকে প্রতিশ্রুতি দেন, ইরাকি হুমকির অবসান ঘটার সঙ্গে সঙ্গে অথবা সৌদি বাদশাহ যখন চাইবেন তখনই মার্কিন সৈন্যদের সৌদি আরব থেকে প্রত্যাহার করে নেয়া হবে। মার্কিনীদের এই প্রতিশ্রুতির পর অবশেষে সৌদি বাদশাহ ফাহাদ সৌদি আরবের মাটিতে মার্কিন সৈন্য মোতায়েনের অনুমতি প্রদান করেন।
এসময় হাজার হাজার কুয়েতি শরণার্থী সৌদি আরবে এসে পৌঁছাচ্ছিল এবং তাদের কাছে থেকে সৌদি জনসাধারণ কুয়েতে ইরাকি সৈন্যদের দ্বারা সংঘটিত খুন, লুণ্ঠন, অপহরণ ও নারী নির্যাতন সম্পর্কে জানতে পারে। তা সত্ত্বেও সৌদি জনসাধারণের একটি অংশ তাদের রাষ্ট্রে মার্কিন সৈন্য মোতায়েনের পক্ষপাতী ছিল না। সৌদি আরবে ইসলাম ধর্মের সবচেয়ে পবিত্র দুটি স্থান– মক্কা ও মদিনা – অবস্থিত, এবং মুসলিমদের এই পবিত্র ভূমির সুরক্ষার জন্য অমুসলিমদের সহায়তা নিতে হবে, এই ধারণাটিই রক্ষণশীল সৌদি জনগণকে আতঙ্কিত করে তোলে।
সৌদি সরকার জনসাধারণের অসন্তোষ প্রশমিত করার জন্য সৌদি ধর্মীয় নেতাদের সৌদি আরবে মার্কিন সৈন্য মোতায়েনের পক্ষে ফতোয়া দেয়ার নির্দেশ দেয়। সেই অনুযায়ী সৌদি ধর্মীয় নেতারা ফতোয়া জারি করেন যে, মার্কিন সৈন্যরা ‘ইসলামকে রক্ষা’ করার জন্য সৌদি আরবে আসছে।
এভাবে শুরু হয় ‘অপারেশন ডেজার্ট শিল্ড’। ১৯৯০ সালের সেপ্টেম্বরে মার্কিন সৈন্যরা সৌদি আরবে আসতে শুরু করে এবং পাঁচ লক্ষাধিক মার্কিন সৈন্য সৌদি আরবে এসে পৌঁছে। প্রাথমিকভাবে সৌদি আরবকে রক্ষা করার জন্য নিয়োজিত হলেও ১৯৯১ সালে তাদেরকে কুয়েতকে ইরাকি দখলদারিত্ব থেকে মুক্ত করার দায়িত্ব প্রদান করা হয়। ‘অপারেশন ডেজার্ট শিল্ড’ পরিণত হয় ‘অপারেশন ডেজার্ট স্টর্ম’–এ।
১৯৯১ সালের উপসাগরীয় যুদ্ধে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বাধীন জোট ইরাকি সামরিক বাহিনীকে বিধ্বস্ত করে দেয় এবং কুয়েত থেকে ইরাকি সৈন্যদেরকে বিতাড়িত করে। কিন্তু সৌদি আরব থেকে মার্কিন সৈন্য আর কখনোই পুরোপুরিভাবে প্রত্যাহার করা হয়নি। প্রথমে ইরাকে ‘নো–ফ্লাই জোন’ কার্যকরী করার জন্য, পরবর্তীতে বিশ্বব্যাপী ‘সন্ত্রাসবিরোধী যুদ্ধে’র অংশ হিসেবে এবং বর্তমানে ইরানের সঙ্গে উপসাগরীয় আরব রাষ্ট্রগুলোর দ্বন্দ্বের প্রেক্ষাপটে সৌদি আরবে মার্কিন সৈন্যদের উপস্থিতি বজায় রাখা হয়েছে।
বর্তমানে সৌদি আরবে কমপক্ষে ৫টি মার্কিন সামরিক ঘাঁটি রয়েছে। উপসাগরীয় যুদ্ধের প্রাক্কালে যে বিপুল সংখ্যক মার্কিন সৈন্য সৌদি আরবে মোতায়েন করা হয়েছিল, ২০০৩ সালের মধ্যে তাদের সিংহভাগকেই প্রত্যাহার করে নেয়া হয়। বর্তমানে অল্প কিছু মার্কিন সৈন্য সৌদি আরবে মোতায়েন রয়েছে। ২০১৯ সালে সৌদি তেলক্ষেত্রের ওপর আক্রমণের পর প্রায় ৩,০০০ মার্কিন সৈন্য সেখানে প্রেরণ করা হয়েছিল, কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ে তেলের মূল্য নিয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও সৌদি আরবের মধ্যে বিরোধ দেখা দেয়ায় এদের অধিকাংশকে প্রত্যাহার করে নেয়া হয়েছে।
উল্লেখ্য, সৌদি বিন–লাদিন গ্রুপের একজন প্রাক্তন অংশীদার এবং ১৯৮০–এর দশকে আফগান যুদ্ধে অংশগ্রহণকারী ওসামা বিন লাদেন সৌদি আরবে মার্কিন সৈন্য মোতায়েনের ঘোর বিরোধী ছিলেন এবং সৌদি সরকার যাতে দেশটিতে মার্কিন সৈন্য মোতায়েনের অনুমতি না দেয়ায় সেজন্য অনেক চেষ্টা করেন। পরবর্তীতে আল–কায়েদা যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে লক্ষ্যবস্তু হিসেবে বেছে নিয়েছিল, তার নানাবিধ কারণের মধ্যে একটি কারণ ছিল সৌদি আরবের মাটিতে মার্কিন সৈন্যদের উপস্থিতি।