জীবনে দ্বিতীয় সুযোগ অনেকেই পান, কিন্তু মালভিকা আইয়ারের মতো সুযোগটা দুমড়ে-মুচড়ে জীবনটা আস্বাদন করেন কয়জন! খুব অল্প বয়সে এক গ্রেনেড বিস্ফোরণে হাত হারান এই নারী। এরপর আঠারো মাস হাসপাতালে কাটাতে হয় তাকে। নানারকম অপারেশন ও ট্রমার মধ্যে দিয়ে গেছে সে এই দেড়টা বছর। অনেক মানুষ তাকে দেখতে এসেছে হাসপাতালে। কেউ কেউ কষ্ট পেয়েছেন তার এমন করুণ অবস্থা দেখে, কেউ বা মুখের উপরেই বলে গেছেন, দুই হাত হারানো মেয়েটাকে কে বিয়ে করবে! এখানেই শেষ নয়। সবচেয়ে বড় কথা ডাক্তার বলেছেন, মালভিকার বেঁচে থাকার আশা নেই। কিন্তু জীবনযোদ্ধা মালভিকা সকল আশঙ্কাকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে দিব্যি মানসিক প্রশান্তি ও সম্মানের সাথে পার করে দিচ্ছেন জীবন।
ফ্যাশন ডিজাইনার হওয়ার স্বপ্ন ও নৃত্যের প্রতি ভালোবাসা নিয়ে বেড়ে ওঠা মালভিকা আইয়ার জন্ম তামিল নাড়ুর কুম্বাকোনাম শহরে। বি. ক্রিশনান ও হেমা ক্রিশনান দম্পতির ঘরে। ক্রিশনান দম্পতির দুই সন্তান, আরেক সন্তান কদম্বরি। মালভিকার জীবনে আকস্মিক ঘটনাটা ঘটার সময় বি. ক্রিশনান চাকরি সূত্রে পরিবারকে নিয়ে থাকতেন রাজস্থানের বিকানেন শহরে। দুই মেয়েকে নিয়ে সুখেই দিন কাটছিল প্রকৌশলী বি. ক্রিশনান ও তার স্ত্রীর। কিন্তু সুখ সকলের কপালে সয় না।
২০০২ সালের ২৬ মে, মালভিকার বয়স তখন ১৩ বছর। মালভিকার স্বপ্ন ছিল ফ্যাশন ডিজাইনার হওয়া। সেই স্বপ্নের লক্ষ্যেই সে টুকটুক করে এগিয়ে চলছিল। দর্জি বাড়ি থেকে টুকরা কাপড় নিয়ে এসে নিজেই জামায় কারুকাজ করতেন তিনি। সেদিনও তিনি জামা ডিজাইন করতে গিয়েছিলেন, কিন্তু ঘটে গেল এক বিপত্তি।
বোমা বিস্ফোরণে মালভিকার জীবনের উত্থান-পতন
জিন্সের প্যান্টটা ছিঁড়ে গিয়েছিল মালভিকার। ছেঁড়া প্যান্টে আঠা লাগাতে বসে তার মনে হলো, আঠা বসানোর জন্য অনেকক্ষণ প্যান্টটা চেপে রাখতে হবে। কোনোকিছু দিয়ে চেপে রাখলে সময়টা বাঁচবে, এই ভেবে তিনি গ্যারেজে যায় প্যান্ট চাপা দিয়ে রাখার জন্য কিছু আনতে। মালভিকার বাসার পাশে ছিল সামরিক বাহিনীর একটি ক্যাম্প। সেখানকার পরীক্ষামূলক একটি গ্রেনেড তার বাসার গ্যারাজে পড়ে ছিল। মালভিকা আইয়ার না বুঝে সেটি নিয়ে যান প্যান্ট চাপা দিয়ে রাখার জন্য। গ্রেনেডটা প্যান্টের উপর চেপে ধরতেই বিকট শব্দে বিস্ফোরিত হয়।
মালভিকা হারান তার দুই হাত, পা দুটোও হয় ক্ষত বিক্ষত হয়ে যায়। এছাড়াও অভ্যন্তরীণ ক্ষত হয় অনেক, নার্ভগুলো প্যারালাইজড হয়ে যায় তার। অনুভূতি শক্তিও হারিয়ে ফেলেন তিনি। ডাক্তাররা মালভিকার বাঁচার আশা রাখেননি কিন্তু তিনি বেঁচে ওঠেন। হাতহীন মালভিকার জীবন হয় আগের চেয়ে একটু ব্যতিক্রম। ফ্যাশন ডিজাইনার হওয়ার স্বপ্ন ক্রমেই ঘুচে যায়। শখের নাচটাও আর চালিয়ে যাওয়া সম্ভব হয় না তার পক্ষে।
হাসপাতালে তার দিন কাটতে থাকে চোখে জলে গাল ভিজিয়ে ও মানুষের করুণা দৃষ্টি নিয়ে। মালভিকা এমন জীবন মোটেও চাইতেন না। তিনি সব সময়ই একজন আশাবাদী মানুষ। ভেঙ্গে পড়তে শেখেননি কখনও। এখনও ভেঙ্গে পড়তে চান না। যেখানে তার ঘুরে দাঁড়ানোর অবলম্বন স্বয়ং মা, তখন ভেঙ্গে পড়ার প্রশ্নই উঠে না। হেমা ক্রিশনান ছোট মেয়েকে সবসময় বলতেন, “তোমার কোনো না কোনো গুণ আছে অবশ্যই। যেটা তুমি এখন খুঁজে পাচ্ছো না কিন্তু সঠিক সময় আসলে তুমি সেটা খুঁজে নিতে পারবে।”
বিকানেনের কলোনির বাচ্চাদের সাথে ফুটবল খেলা, ঘুড়ি উড়ানো, মায়ের শাড়ি জড়িয়ে শিক্ষক হওয়ার খেলা খেলে বেড়ানো মালভিকার হাস্যোজ্জ্বল জীবনটা এভাবে এলোমেলো হয়ে যাওয়ায় হাসপাতালে বসে মা-মেয়ে একসাথে শুধু কাঁদতেনই না, ইন্টারনেটে কৃত্রিম হাতের সন্ধানও করতেন। অবশেষে সন্ধান মেলে জার্মানিতে প্রস্তুতকৃত কৃত্রিম হাতের। লাগানো হয় কৃত্রিম হাত। অত্যন্ত আনন্দ আর স্বাভাবিক জীবনযাপন করার স্বপ্ন নিয়ে বাসায় ফিরে আসেন মালভিকা। কিন্তু নকল হাত কি কখনও আসল হাতের জায়গা নিতে পারে? তাই একটু অসুবিধার শিকার হতে হতো তাকে কিন্তু ধৈর্য ধরে তিনি এসব সমস্যা মোকাবেলা করে গেছেন।
বোমা বিস্ফোরণের শিকার হয়ে মালভিকাকে এক বছর স্কুল ড্রপ দিতে হয়। সেই সময় ছিল তার এস.এস.এল.সি পরীক্ষা (Secondary School Leaving Certificate examination in Chennai)। সুস্থ হয়ে উঠার পর তিনি সহযোগী লেখক নিয়ে পরীক্ষার্থী হিসেবে এস.এস.এল.সি পরীক্ষা দেন। প্রাইভেট ক্যান্ডিডেটদের এস.এস.এল.সি পরীক্ষার ফলাফল প্রকাশ হয়। হাজার হাজার প্রাইভেট ক্যান্ডিডেটের মধ্যে মালভিকা ৪৮৩/৫০০ পেয়ে তার রাজ্যে প্রথম স্থান অধিকার করেন। এরপর তাকে আর ফিরে তাকাতে হয়নি। ভারতের তৎকালীন রাষ্ট্রপতি ড. এ পি জে আবদুল কালামের সাথে সাক্ষাতের জন্য তাকে রাষ্ট্রপতি ভবনে আমন্ত্রণ জানানো হয়। সেই মুহূর্তে তিনি অনুধাবন করে, “আমার ভেঙ্গে পড়া উচিত না। আমি আর পেছনে ঘুরে তাকাবো না।”
মালভিকা এগিয়ে যেতে থাকেন জীবন যুদ্ধে। দিল্লীর সেইন্ট স্টিভেনস কলেজ থেকে অর্থনীতিতে স্নাতক সম্পন্ন করেন। এরপর সমাজকর্মে স্নাতকোত্তর ডিগ্রির নেওয়ার জন্য ভর্তি হয় দিল্লি স্কুল অব সোশ্যাল ওয়ার্কে (Delhi School of Social Work, Delhi) ভর্তি হন। এখানেই থেমে থাকেননি মালভিকা। ২০১২ সালে মাদ্রাজ স্কুল অব সোশ্যাল ওয়ার্কে (Madras School of Social Work, Chennai) থেকে এম.ফিল ও ডক্টরেট ডিগ্রি অর্জন করেন তিনি; সাথে চালিয়ে যান তার সামাজিক কাজগুলো।
মালভিকা এখন বেশ আলোচিত। ২০১৩ সালে TEDxYouth@Chennai থেকে ডাক পান একটি বক্তৃতা দেওয়ার জন্য। এরপর থেকে তিনি হয়ে উঠেন মোটিভেশনাল স্পিকার।
দ্য বেটার ইন্ডিয়ার একটি সাক্ষাৎকারে মালভিকা আইয়ার বলেন,
আমার আশেপাশের মানুষগুলো যখন দৌড়ে প্রথম হওয়ার প্রতিযোগীতায় মত্ত। আমি তখন স্বপ্ন দেখি নিজের পায়ের হাঁটার। নিজের পায়ের হাঁটতে শেখার পর স্বপ্ন দেখতে লাগলাম এক পা, এক পা করে সিঁড়ি বেয়ে উঠার। এরপর লক্ষ্য ছিল কনুই দিয়ে রিমোট চালাতে পারা। এভাবে আমি একটু একটু করে এগিয়েছি। আমার পক্ষে দৌড়ানো সম্ভব ছিল না।
দ্য নিউ ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেসের আরেকটি সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন,
কখনোই নিজের অক্ষমতাকে নিজের উপর জেঁকে বসতে দেবেন না। আপনি যেমন সেভাবেই নিজেকে গ্রহণ করতে শিখুন। আমি যখন কলেজে পড়তাম তখন নিজের কাজগুলো একা করতে আমার বেশ কষ্ট হতো। তবুও আমি ধীরে ধীরে চেষ্টা করতাম। ক্যান্টিনে গিয়ে নিজে নিজে খাওয়ার চেষ্টা করতাম, ক্লাস নোটগুলোও নিজে নিজে করার চেষ্টা করতাম। এখন আমার সব কাজ আমি একাই করতে পারি; এমন কি চুলের বেনিও নিজে করি। আমি কখনই নকল হাতগুলো পরে আয়নার সামনের দাঁড়াই না। আমি যেমন, তেমনভাবেই আয়নার সামনে দাঁড়াই। আমার নিজস্বতাকে আমি ভালোবাসি বলেই এটা সম্ভব হয়। আমাদের সকলেরই নিজস্বতাকে ভালোবাসা উচিত, সেটা যেমনই হোক। তবে কষ্ট হয় যখন রাস্তা দিয়ে হেঁটে যাওয়ার সময় কেউ করুণার দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকায় কারণ আমি দুই হাতহীন একটি মেয়ে। প্রতিটি শিশুকে শেখানো উচিত – শারীরিকভাবে অক্ষম ব্যক্তি স্বাভাবিক মানুষের চেয়ে আলাদা নয়। আমি এই বিষয়ের উপরেই ডক্টরেট ডিগ্রি নিয়েছি যেন সমাজে পরিবর্তন আনতে পারি।
মালভিকা আইয়ার বর্তমানে আন্তর্জাতিক মোটিভেশনাল স্পিকার। ইতোমধ্যে তিনি আমেরিকা, ইন্দোনেশিয়া, নরওয়ে ও সাউথ আফ্রিকায় বক্তৃতা দিয়েছেন। এছাড়াও তিনি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের সাথে যুক্ত থেকে শারীরিকভাবে অক্ষম ব্যক্তিদের কল্যাণের লক্ষ্যে কাজ করে যাচ্ছেন।
চাইলে দেখে নিতে পারেন TEDxYouth@Chennai এ মালভিকার বক্তৃতা। শারীরিক অক্ষমতাকে জয় করে জীবনে এগিয়ে যাওয়া যায় তা মালভিকা আইয়ারকে দেখলে বোঝা যায়।