Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website.
The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

শহুরে-শিক্ষিত-নীতিবাগীশ দর্শককে ক্রমাগত সুড়সুড়ি দিয়ে যাওয়া মানেই তার নাড়ি বুঝে ফেলা?

গত বছর বেঙ্গালুরুতে একদিন টিকিট কেটে হলে গিয়ে একটি বাংলা ছবি দেখেছিলাম। নাম ‘পোস্ত’। খারাপ লাগেনি। আজকালকার জেট যুগে ক্যারিয়ার নিয়ে লড়তে থাকা বাবা-মায়ের সন্তানেরা তাদের ঠাকুর্দা-ঠাকুমার কাছে বড় হয়ে ওঠা এবং সেই সূত্রে নানারকম সমস্যার সূত্রপাতে শেষ পর্যন্ত পরিবারটির আদালতের দ্বারস্থ হওয়া- মোটামুটি এই ছিল ছবিটির সারমর্ম।

এই ছবিটির পরিচালকদ্বয় নন্দিতা রায় এবং শিবপ্রসাদ মুখোপাধ্যায় গত কয়েক বছর যাবৎ বেশ কিছু সফল ছবি বানিয়ে দর্শক মহলে বেশ নাম করেছেন। ২০১১ সালে ‘ইচ্ছে’ ছবি দিয়ে তাদের যাত্রা শুরু। তারপর ‘মুক্তধারা’, ‘এক্সিডেন্ট’, ‘অলীক সুখ’, ‘রামধনু’, ‘বেলা শেষে’, ‘প্রাক্তন’, ‘পোস্ত’ হয়ে সাম্প্রতিকতম ছবি ‘হামি’ এই কয়েকদিন আগেই মুক্তি পেল। নন্দিতা-শিবপ্রসাদ জুটির এই ছবিগুলোর দাক্ষিণ্যে যে এখন বাঙালি দর্শকের ঘরে ঘরে তাদের নাম হয়ে গিয়েছে, তা সত্যি। আর হবেই বা কেন? তারা যখন রীতিমতো খেটেখুটে ছবি বানাচ্ছেন, সেই পরিশ্রমের তো একটা ইতিবাচক মূল্যায়ন হওয়াই বাঞ্চনীয়।

শিবপ্রসাদ মুখোপাধ্যায় এবং নন্দিতা রায় পরিচালিত সদ্য মুক্তিপ্রাপ্ত ছবি ‘হামি’-র পোস্টার; Source: Twitter handle of Shiboprosad Mukherjee @shibumukherjee

অনেকে আবার বলছেন, শিবপ্রসাদ অনেক নামকরা লেখকের লেখা বেমালুম টুকে ছবি করেন, প্রাপ্ত কৃতিত্বটুকুও দেন না। এব্যাপারে কোনো প্রত্যক্ষ প্রমাণ আমাদের কাছে নেই, তাই এই নিয়ে বাক্যব্যয় করাও অর্থহীন এখানে।

জ্বলন্ত সমস্যা নিয়ে কাজ করা আর গড়পড়তাকে ভাঙাগড়া এক ব্যাপার নয়

কিন্তু নন্দিতা-শিবপ্রসাদ জুটির চলচ্চিত্রের একটি অন্য দিক নিয়ে কিছু কথা না বলে পারা যায় না। শিবপ্রসাদবাবুকে ক’দিন আগে পশ্চিমবঙ্গের একটি বহুল প্রচারিত দৈনিক যখন একটি সাক্ষাৎকারে জিজ্ঞেস করা হয় যে, তিনি সামাজিক বিষয়ের বাইরে গিয়ে অন্য কিছু নিয়ে ছবি করবেন কিনা, নিজেদের ভাঙবেন কিনা, তখন পরিচালক বলেন যে, তারা তারকাখচিত ইন্ডাস্ট্রিতে কোনো স্টারকে না নিয়েও একটি জ্বলন্ত সমস্যার উপর কাজ করে দেখিয়েছেন ‘হামি’তে। আর তার মতে, এর চেয়ে বড় ‘ভাঙা’ আর কিছু হতে পারে না।

পরিচালক এও বোঝান কথায় কথায় যে, প্রথমদিকে তার কয়েকটি ছবি সেভাবে সাড়া না পেলেও তিনি সরে আসেননি তার লক্ষ্য থেকে; সোজাসাপ্টা দক্ষিণ ভারতীয় ছবি রিমেক করে ব্যবসায়িক সাফল্যকেই মূলমন্ত্র করার কথা ভাবেননি। শিবপ্রসাদবাবুর কথায় যেন পশ্চিমবাংলার সমসাময়িক চলচ্চিত্র ইন্ডাস্ট্রির প্রতি একটি হালকা তাচ্ছিল্যও ছিল।

শিবপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়-নন্দিতা রায় জুটির পরিচালিত তিনটি সফল ছবি ‘বেলাশেষে’, ‘প্রাক্তন’ এবং ‘পোস্ত’-র পোস্টার; source: Twitter; @ErosNow

শিবপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়ের এই কথাগুলোর মধ্যে সার যে নেই, তা কেউ বলবে না। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, এই যে তাদের ‘দর্শকের নাড়ি বুঝতে পারেন’ বলে বিশেষ সমাদর করা হয়, তা কতটা যুক্তিযুক্ত?

কোন বাঙালির সমস্যা নিয়ে ছবি করেন নন্দিতা-শিবপ্রসাদ জুটি?

যদি কেউ বলে থাকেন যে, শিবপ্রসাদ-নন্দিতা জুটি বাঙালির সমস্যা-সুখ-দুঃখ-জয়-পরাজয়ের দিকগুলি খুব ভালো করে বুঝে গেছেন বলে সাফল্য তাদের পিছু পিছু হাঁটে, তাহলে প্রশ্ন: বাঙালির সুখ-দুঃখ কি শুধুমাত্র শহুরে-শিক্ষিত-রবীন্দ্রসংগীত শোনা-শান্তিনিকেতন ঘোরা মানুষের মধ্যেই সীমিত? শহুরে নামি স্কুলে পড়ানোর ঝামেলা, সেখানে ছেলেমেয়েদের নিরাপত্তার ঝামেলা, বার্ধক্যের ঝামেলা, সন্তানের অভিভাবকত্বের ঝামেলা, ধন্বন্তরি ডাক্তারের মুহূর্তে দায়িত্বজ্ঞানহীন হয়ে পড়ার ঝামেলা, প্রাক্তন স্ত্রীর সামনে পড়ে বর্তমান স্ত্রীর সামনে সহজ হয়ে থাকার ঝামেলা, মায়ের চাপিয়ে দেওয়ার স্বপ্ন পূরণ করার ঝামেলা- এগুলোই কি বাঙালির জীবনের তামাম সংকটের পরিচয়? এই যে প্রত্যেকটি সমস্যার মধ্যে একটি নৈতিকতার সংকট আর যা সবচেয়ে বেশি প্রকট শিক্ষিত-মধ্যবিত্তের মধ্যেই, তাই নিয়ে চর্চাই কি তবে আজকালকার পপুলার মিডিয়া বা চলচ্চিত্রে সাফল্য পাওয়ার সবচেয়ে বিশ্বস্ত ফর্মুলা?

যদি ব্যবসায়িক মুনাফাই চলচ্চিত্রের বা যেকোনো দায়বদ্ধতাপূর্ণ মাধ্যমের একমাত্র পরিচয় হয়ে থাকে, তবে এই তর্ক এখানেই বন্ধ করে দেওয়া ভালো। কিন্তু যদি এই মাধ্যমকে আরও বৃহত্তর কার্যসাধনের অস্ত্র হিসেবে দেখা হয়, তবে এই তর্ক চলতেই থাকবে।

প্রকৃত নাড়ি ধরতে গেলে স্বস্তি-সুবিধার ঘেরাটোপ থেকে বেরোতে হয়

সত্যজিৎ দর্শকের নাড়ি ধরতে পারতেন গোছের মন্তব্য যদি কেউ করে থাকেন (যদিও তাকে নাড়ি ধরতে হতো না, নাড়ি নিজেই এসে তার কাছে ধরা দিত), তাও নাহয় বোঝা যায়, কারণ, তার কাজের কোনো শ্রেণীগত, ভৌগোলিক বা মানসিক সীমারেখা ছিল না। তিনি শহর-গ্রাম-শিক্ষিত-অশিক্ষিত-পুরোনো-নতুন-এলিট-সাবঅল্টার্ন সব বিষয়ের উপরেই সমান পারদর্শী ছিলেন। একজন শিল্পী হিসেবে তার সামগ্রিক পূর্ণতা ছিল। এবং তার সময়কার মেরুকরণের কথা মাথায় রেখে বলা চলে, তিনি পক্ষপাতদুষ্ট ছিলেন না; তা তার নিজস্ব বিশ্বাস যা-ই হোক না কেন।

আজকের অনেক সফল ছবি নির্মাতাই শহুরে মধ্যবিত্তের নানা নৈতিক-সামাজিক সমস্যা নিয়ে ছবি করেন; বলা হয় তারা দর্শকের নাড়ি ধরতে পারেন; কিন্তু, দর্শকের ধারণাটা কি শুধুমাত্রই একটি ভৌগোলিক এবং আর্থ-সামাজিক বৃত্ত দ্বারা সীমিত? বর্তমান ভারতে কৃষকের সঙ্কট একটি জ্বলন্ত সমস্যা। তাকে নিয়ে ছবি করেন না কেন এই সফল ছবি নির্মাতারা? অনাগ্রহ না ব্যর্থতার ভয়?

পশ্চিমবঙ্গের বহরমপুরের এক চাষী কৃষিকাজে ব্যস্ত; Source: Author: ILRI; flickr.com

কিন্তু আজকের চূড়ান্ত সফল ‘দর্শকের নাড়ি বুঝতে পারা’ পরিচালকদের চারপাশে এত সীমারেখা টানা কেন? কলকাতা শহর থেকে ২০০ কিলোমিটার গাড়ি চালিয়ে গেলে যে সাঁওতাল গ্রাম পড়ে, সেখানে তার দামি স্কুলে ছেলেপুলেকে ভর্তি না করতে পারা অভিভাবকের দুঃখ কে বুঝবে? আর যদি তাদের লক্ষ্য শুধুমাত্র শহুরে উচ্চ-মধ্যবিত্তরাই হয়; কলকাতা বা বেঙ্গালুরু বা বিদেশের শহরে থাকা প্রবাসী বাঙালিরাই হয়, তবে তাদের ‘দর্শকের নাড়ি বুঝতে পারার’ কৃতিত্বটি ফাঁপা বলেই পরিগণিত হবে। দর্শকের শ্রেণীবিভাজন করে প্রশংসিত হওয়া অনেকটা ওই রাজ্যভাগ করে নিজেদের অনুগতদের ভোট পেয়ে ক্ষমতায় আসা রাজনীতিবিদদের মতো। ওতে ঠিক ভক্তি আসে না।

শহুরে দর্শকের আবেগে সুড়সুড়ি দিয়ে ছবি চালানো অনেক দিক থেকেই সুবিধার, কারণ দিনের শেষে এরাই দেখবেন ছবি

শিবপ্রসাদবাবু-নন্দিতাদেবীরা তো প্রান্তিক বাঙালিদের নিয়েও কিছু ভাবতে পারেন। তারা কি আজ একটা ‘অশনি সংকেত’ আমাদের উপহার দিতে পারেন না? গ্রামাঞ্চলে আজ খরা না হলেও চাষীদের অবস্থা যথেষ্ঠ করুণ; তাদের সাথে শহুরে শিক্ষিত মানুষ যারা নিজেদেরকে চিন্তাবিদ, সংবেদনশীল বলে দাবি করে, তাদের দূরত্ব কমানোর প্রয়াস কি নিতে পারেন না এই ক্ষুরধার পরিচালকরা? নাকি চেনা গণ্ডির মধ্যে থেকে বেরোতে চান না গড় রান কমে যেতে পারে, সেই ভয়ে?

প্রবাদপ্রতিম চিত্র পরিচালক সত্যজিৎ রায়; তিনিও মধ্যবিত্তের সমস্যা নিয়ে ছবি বানিয়েছেন কিন্তু নিজের পরিধি শুধু সেই শ্রেণীর মধ্যেই আবদ্ধ রাখেননি; নানাবিধ বিষয় নিয়ে তার সৃষ্টি আমরা প্রত্যক্ষ করেছি; Source: Twitter

আসলে একবারে ছকবন্দি হয়ে পড়লে তা থেকে বেরোতে অনেক প্রতিষ্ঠিত ব্যক্তিত্বই ভয় পান; কারণ তখন হারানোর অনেক কিছু থাকে। কিন্তু চলচ্চিত্রের মতো একটি অতীব শক্তিশালী মাধ্যমও যদি এই পিঠ বাঁচানোর চিন্তাতেই বিভোর হয়ে পড়ে, তাহলে সমাজের বার্তা কে বহন করবে?

অবশ্য নিজের প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা থেকে দেখেছি, গণমাধ্যমের অনেক হোতাই আজকাল সমাজের নাম শুনলেই তিতকুটে হয়ে যান; বলেন আমরা ব্যবসা করছি, সমাজ সংস্কার নয়।

শিবপ্রসাদবাবু বলেছেন, বর্ষীয়ান চিত্র পরিচালক মৃণাল সেন নাকি তাকে একবার বলেন: “আপনি কোথায় ছিলেন এতদিন?” নিঃসন্দেহে বড় প্রশংসা, বড় পাওয়া। কিন্তু এই পাওনাকে আরও বড় পাথেয় করা যাবে তখনই, যখন এই পরিচালকরা নিজেদেরকে পরের স্তরে নিয়ে যাওয়ার কথা ভাববেন বা করে দেখবেন- এই স্তরের উন্নয়ন একটি বড় ব্যাপার যেকোনো সৃষ্টিশীল মানুষের কাছেই, নতুবা তা স্থবিরতা নিয়ে আসে। মৃণাল সেনরা এই কাজটাই করে যেতেন অক্লান্তভাবে; তাদের ভাঙাগড়ার ধারণাটাও ভিন্নপ্রকৃতির ছিল।

ভৌগোলিক এবং মানসিক শ্রেণীবিভাগকে ভাঙা হবে কবে?

শিবপ্রসাদবাবুরা যে শহুরে-ব্যক্তিকেন্দ্রিক-পরিবারকেন্দ্রিক বা সামাজিক সমস্যা নিয়ে কাজ করছেন, তা অবশ্যই করুন, সময়ের ও তার সমস্যার জ্বলন্ত দলিল অবশ্যই চলচ্চিত্র। কিন্তু তার পাশাপাশি যে শ্রেণীর দর্শকরা আলোর বৃত্তের বাইরে পড়ে আছেন বা থাকেন সবসময়, তাদের জীবনের জ্বলন্ত সমস্যা নিয়েও ভাবুন দয়া করে। শহরে তাও পুলিশ-ডাক্তার-উকিল রয়েছে; খুব খারাপ অবস্থাতেও পরিষেবার অভাব ঘটবে না, কিন্তু এখনও ভারতে অনেক বাঙালি আছেন, যারা রবীন্দ্রজয়ন্তী পালনের সময় পান না; নিশ্চিন্ত নিরাপত্তায় কন্যাকে ঘরের চৌকাঠ থেকে বেরোতে দিতে পারেন না; নিজেদের গণতান্ত্রিক অধিকার যে ভোট দেওয়া তা দিতেও পারেন না; রক্ত জল করে ফসল ফলিয়েও তার যোগ্য দাম পান না। অথচ তারাও বাঙালি; আমার আপনার মতো বাংলা ভাষাতেই কথা বলেন, হয়তো বা অঞ্চলবিশেষে ভাষার টানে সামান্য তারতম্য থাকে।

ম্মৃণাল সেন; Source: Flickr

এখন প্রশ্ন হচ্ছে, সেই কন্টেন্টের দাম বোঝার মতো আজ যথেষ্ঠ দর্শক আছেন কি? আর যদি থেকেও থাকে, সেই চেনা গণ্ডির বাইরে গিয়ে ছবি বানাতে গেলে যে সমস্ত চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি পরিচালককে হতে হবে, তা ক্রমাগত সহ্য করে একটি নতুন বিষয়ের উপর পরিবেশনা করার ঝক্কি তিনি নেবেন কি?

Featured Image © Atanu Roy Chowdhury, Windows Production House

Related Articles