পশ্চিমবঙ্গের প্রখ্যাত অভিনেত্রী সুপ্রিয়া দেবী গত ২৬শে জানুয়ারি প্রয়াত হওয়ার পর সেখানকার বাংলা চলচ্চিত্র জগতের বেশ কিছু কুশীলব সংবাদমাধ্যমের সামনে তাদের বক্তব্য রাখছিলেন বিষাদময় কণ্ঠে। “মেঘে ঢাকা তারাতে তার অনবদ্য অভিনয় ভোলার নয়”, “উত্তমকুমারের সঙ্গে অভিনয়ের আঙিনায় উনি যেভাবে প্রফেশনাল থাকতেন, তা শিক্ষণীয়”, ইত্যাদি বিভিন্ন কথা প্রয়াত শিল্পীর সম্পর্কে বলেন পশ্চিমবঙ্গে আজকের প্রথম সারির বাঙালি অভিনেতা-অভিনেত্রীরা।
ব্যাপার হচ্ছে, বিগত যুগের স্বনামধন্য ভারতীয় বাঙালি অভিনেতা-পরিচালকরা পৃথিবীর বুক থেকে চিরবিদায় নিলে মোটামুটি এই একই বক্তব্য আমরা শুনে থাকি বর্তমান শিল্পী-পরিচালকদের মুখ থেকে। তারা এই বিষয়ে মোটামুটি একমত যে, অতীতের সেই উচ্চমানের কাজ আজকের প্রজন্মের কাছে এক বিরাট বড় চ্যালেঞ্জ। তা টপকানো তো দূরের কথা, সেই কাজের ধারেকাছে পৌঁছানোটাই বেশ বেশ কঠিন।
এটি যদি এক ধরনের পরোক্ষ স্বীকারোক্তি হয় যে, উত্তম-সুচিত্রা-সুপ্রিয়া-ভানু-উৎপল-রবি-তুলসী-সৌমিত্র-ঋত্বিক-সত্যজিৎ, তাদের সেই যুগের সঙ্গে পাল্লা দেওয়া আজ আর সম্ভব নয়, তবে তার সততা অনস্বীকার্য। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে, আজকের ভারতীয় বাংলা ছবি সেই যুগের সঙ্গে যেমন পাল্লা দেওয়ার দুঃসাহস দেখাচ্ছে না, তেমনি তার থেকে শিখছেও না কিছু। ছবির চাকচিক্য বেড়েছে, পয়সা-ব্যবসা আগের তুলনায় বেড়েছে, গল্পের জোগান কমেনি, কিন্তু কোথায় যেন প্রাণের সুর ও তাল কেটে গিয়েছে। এক কথায়, বাংলা ছবির ‘হরাইজন্টাল ডাইভার্সিটি’ বাড়লেও ‘ভার্টিকাল ডেপথ’-এর বড় খামতি রয়ে গিয়েছে।
টলিউডের এক নম্বর অভিনেতা প্রসেনজিৎ চট্টোপাধ্যায়কে প্রায়শই এই ব্যাপারে গর্ববোধ প্রকাশ করতে দেখা যায় যে, বাংলা ছবির ভৌগোলিক প্রসার বেড়েছে, ইন্ডাস্ট্রির পরিধি আগের চেয়ে অনেক বড় এবং একসময়ে এই ইন্ডাস্ট্রিরই দুঃস্থ অবস্থা প্রত্যক্ষ করার পর আজকের এই সফলতাতে তিনি অভিভূত। তার কথা নিঃসন্দেহে ঠিক। বাংলা ছবির বাহ্যিক রূপটি আজকে অনেক ছিমছাম। বিশ্বায়িত বাঙালির সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে আজ পশ্চিমবঙ্গের বাংলা ছবি বৈশ্বিক পটভূমিতে পা রেখেছে। ইউরোপ, আমেরিকা থেকে শুরু করে এখন আফ্রিকা বা দক্ষিণ আমেরিকাতেও বাংলা ছবির শ্যুটিং হচ্ছে। ঝকঝকে নাচ-গান, দুর্দান্ত সিনেম্যাটোগ্রাফি ইত্যাদি দেখে সাধারণ বাঙালি দর্শক এখন অভিভূত বোধ করেন।
করবার কথাও। ১৯৮০ সালে উত্তম কুমার এবং ১৯৯২ সালে সত্যজিৎ রায় মারা যাওয়ার পর ভারতীয় বাংলা ছবিতে এক ছন্নছাড়া যুগের আগমন ঘটেছিল। একঘেয়ে এবং নিম্নমানের ছবি, যা দেখতে মস্তিষ্কের কোনো প্রয়োজন নেই, তাতেই বাজার সরগরম থাকত সেই সময়গুলোতে। উত্তমকুমার নামক মহিরূহটির পতন হওয়ার পরে ‘হিরো’র তখন রীতিমতো আকাল। প্রসেনজিৎ- তাপস পাল-চিরঞ্জিত-অভিষেক-রঞ্জিত মল্লিকরা যথাসাধ্য চেষ্টা করছিলেন ঠিকই, কিন্তু মন ভরছিল না।
সত্যজিতের দেহাবসানের পরে বাঙালি দর্শকের বুদ্ধিক্ষয় করার মতো পরিচালকেরও অভাব ঘটেছিল। সোজা কোথায়, সিনেমাকে যে মানুষের মননকে নাড়িয়ে দেওয়ার এক মোক্ষম মাধ্যম হিসেবে ব্যবহার করা যেতে পারে, সেই ধারণাটাই যেন উবে গিয়েছিল। ছবি তখন স্রেফ সহজলভ্য এন্টারটেনমেন্ট, তার ইন্টেলিজেন্স কোশেন্ট যেন শূন্য। এর ফলে শিক্ষিত শহুরে দর্শকের কাছে ক্রমেই ফেলনা হয়ে উঠছিল বাংলা ছবি। প্রসেনজিৎ হয়ে উঠছিলেন গ্রামবাংলার ‘পোসেনজিৎ’ এবং বাংলা ছবির এই ভৌগোলিক গণতন্ত্রীকরণ অনেকেই ভালো চোখে নেননি। হিন্দি এবং ইংরেজি ছবি সেই জায়গাটা ক্রমেই নিয়ে নেয়। বাংলা ছবির পক্ষে এ ছিল এক আত্মঘাতী বিজ্ঞাপন।
ঋতুপর্ণ ঘোষ একসময় হাল ফেরান বাংলা ছবির
এই অবস্থায় এক তরুণ পরিচালক হাল ধরেন। তার নাম ঋতুপর্ণ ঘোষ। সত্যজিৎ পরবর্তী সময়ে ঋতুপর্ণই শহুরে মধ্যবিত্ত দর্শককে বাংলা ছবির জন্যে হলমুখো করেন আর এখানেই তার সবচেয়ে বড় কৃতিত্ব। বাঙালি মধ্যবিত্তের নানাবিধ সমস্যা, যা সাধারণত লোকচক্ষুর আড়ালে থেকে এসেছে এত দিন, তা তিনি নিয়ে আসেন আলোচনা-চর্চার কেন্দ্রবিন্দুতে। সম্পর্কের টানাপোড়েন, বৈবাহিক ধর্ষণ, সমকামিতা, নৈতিক অবক্ষয় এবং দ্বিচারিতা ইত্যাদি নানা বিষয় নিয়ে ঋতুপর্ণ ফের বাঙালির ছবি দেখার সংস্কৃতি-সম্পন্ন মননকে জাগিয়ে তোলেন ঋতুপর্ণ। তার আগে স্বনামধন্য অভিনেত্রী-পরিচালক অপর্ণা সেনও এই কাজটি মন দিয়ে করেছেন কিন্তু ঋতুপর্ণ যেন একটি সম্পূর্ণ নতুন সূচনা করেন এই মর্মে। ভারতীয় বাংলা ছবি ফের চাঙ্গা হয়।
এখন পশ্চিমবঙ্গের বাংলা ছবিতে বেশ কয়েকজন ভালো পরিচালক এসেছেন। ঋতুপর্ণর আকস্মিক মৃত্যু অবশ্যই বাংলা চলচ্চিত্র জগতের এক অপূরণীয় ক্ষতি করে দিয়েছে, কিন্তু পরিচালকের সংখ্যায় ভাটা পড়েনি। নতুন নতুন বিষয় নিয়ে ছবি হচ্ছে, পোসেনজিৎ আর প্রসেনজিৎ- এর মধ্যকার বেড়াজাল ভেঙে গিয়েছে অনেকটাই এবং তার কৃতিত্ব এই নতুন প্রজন্মের পরিচালকদের। শহুরে-গ্রাম্য, কমার্শিয়াল-আর্ট ফিল্ম- এর তারতম্যগুলো ঘুচে যাচ্ছে নানাভাবে। নানা স্বাদের বাংলা ছবি তৈরি হচ্ছে এবং সন্তুষ্টি প্রকাশ করছেন এক শ্রেণীর দর্শক।
কিন্তু এতকিছু সত্ত্বেও অপূর্ণতা অনুভূত হচ্ছে
কিন্তু এসব সত্ত্বেও মনে হচ্ছে, কোথাও একটা অপূর্ণতা রয়ে গিয়েছে এবং যা পূরণ করতে পারেন ঋতুপর্ণর মতো কোনো চিন্তাশীল পরিচালকই। নানাবিধ ছবির রমরমাতেও দেখা যাচ্ছে বাঙালি ক্রমেই ঝুঁকছে গোয়েন্দা গল্পের দিকে। পর্দায় ফেলুদা-ব্যোমকেশ-কিরীটি-শবর প্রমুখদের ভিড় ক্রমাগত বেড়েই চলেছে। বাংলা ছবির বাজার বড় নয় আর এই গোয়েন্দাদের উপর ক্রমাগত ভর করে থাকার একটি অর্থ হচ্ছে, পরিচালকদের অনেকেই চান কম ঝুঁকি নিতে। অর্থনৈতিক অর্থে এই প্রবণতার মধ্যে হয়তো ভুল কিছু নেই, কিন্তু চলচ্চিত্র নামক সৃষ্টিশীল বিষয়ে এই সীমাবদ্ধতা আশার কথা নয়।
কেন এত রিমেক?
একই কথা ক্রমাগত রিমেকের প্রবণতা ঘিরেও ওঠে। একসময়ে বাংলা ছবির রিমেক বানানো হতো বলিউড অর্থাৎ পৃথিবীর সবচেয়ে বড় চলচ্চিত্র ইন্ডাস্ট্রিতে। অনেক বড় বাঙালি পরিচালক বলিউডে গিয়ে নজরও কেড়েছেন। প্রতিভার কমতি আজও হয়তো নেই কিন্তু শর্টকাটে মুনাফা লোটার প্রচেষ্টায় যেভাবে দক্ষিণী ছবির রিমেক বানানোর হিড়িক পড়েছে, বাংলার নিজস্ব চলচ্চিত্রের ভবিষ্যৎ সম্পর্কে তা ভাবতে বাধ্য করে। বাঙালির মননের সঙ্গে এই ধুমধাড়াক্কা ছবিগুলোর সঙ্গে দীর্ঘমেয়াদি সংযোগ স্থাপন করা সহজ, এমনকি সম্ভবও নয়।
বাংলার সংস্কৃতি-বুদ্ধি এবং মেধা চর্চার যে চল রয়েছে, তাতে এই রিমেক করা অনেক ক্ষেত্রেই অর্থহীন। কিন্তু ঋতুপর্ণ বা অপর্ণার মতো করে ভাববার কেউ নেই আজ। সমাজের গভীরতা মাপার যন্ত্র হিসেবে সিনেমার উপকারিতাটাই যেন লোপ পেয়েছে। অনেক অভিনেতাকেই এই রিমেক সংস্কৃতির বিরুদ্ধে বিরক্তি প্রকাশ করতে দেখা যায় নানা সময়ে, কিন্তু তাতে থামেনি এই প্রবণতা।
ভাষার উপর দুর্বল কর্তৃত্ব
আরও একটি ব্যাপার বাংলা ছবির ভবিষ্যৎ নিয়ে ভাবায়। তা হচ্ছে ভাষার ব্যবহার। যে ভাষায় এককালে ছবির গান শুনে কানে মধুর লেপন পড়ত, এখন তা শুনলে মাঝে মাঝে মনে বিরক্তি এবং বিভীষিকা দুইই জাগে। বাংলা ছবির গান ঝকঝকে এবং তার শ্যুটিং হচ্ছে সুইৎজারল্যান্ডে, এ দারুণ কথা। কিন্তু সেই বাংলা গানের মধ্যে যদি বাংলা কথাই বিরল হয়ে পড়ে, তবে তা অসহনীয় যন্ত্রণার সৃষ্টি করে।
দুঃসহ বিষয় ঘটছে ডায়লগ ডেলিভারি নিয়েও। উত্তমকুমার, সুচিত্রা সেন, সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়, উৎপল দত্ত, শর্মিলা ঠাকুর সহ দিকপাল অভিনেতাদের অন্যতম বড় গুণ হচ্ছে তাদের বাংলা উচ্চারণ। যদি ভাষাটাই ঠিক করে উচ্চারিত না হয়, তবে মাধ্যমের গুরুত্ব মাঠেই মারা যায়। এখনকার দিক্পালদের এটি এক বড় সমস্যা। তারা প্রধান চরিত্রে অভিনয় করেন ঠিকই, কিন্তু তাদের ভাষার উপর নিয়ন্ত্রণ দুর্বল। ভারতের দক্ষিণী রাজ্যগুলির ছবি-সংস্কৃতিতে এমন জিনিস ভাবাই যায় না। বাঙালিকে নিজের ভাষার শুদ্ধতা বাড়াতেই হবে যদি সে নিজের মাধ্যমকে দূর ভবিষ্যতে মিউজিয়ামে দেখতে না চায়। এটি একটি বড় চ্যালেঞ্জ। কিন্তু আমরা কতটা ভাবছি এর মোকাবেলার কথা?
বাংলা ছবিকে তার ব্যবসায়িক এবং বুদ্ধিবৃত্তিক আকর্ষণ বাড়াতে গেলে নিজের বাজার বাড়াতেই হবে। এবং তার জন্যে চাই উন্নত এবং গভীর ভাবনাকে উস্কে দেওয়ার মতো বিষয় এবং নির্মাণ। এখনকার পরিচালকরা নিঃসন্দেহে প্রতিভাবান এবং ভালো ছবি বানাতে জানেন, কিন্তু মস্তিষ্ক-মননকে চাগিয়ে তোলার মতো প্রোডাক্ট তারা ক’টা পেশ করছেন দর্শকদের কাছে? যাদের ছবি খুব ভালো চলছে বাজারে, তাদের ছবির বিষয়বস্তু কি আমাদের বুদ্ধিবৃত্তিকভাবে উৎকৃষ্ট করছে নাকি মধ্যবিত্তের আবেগকে সুড়সুড়ি দিয়ে বাড়ছে তাদের জনপ্রিয়তা? যদি দ্বিতীয়টি হয়, তবে বলতে হবে এই সাফল্য চিরস্থায়ী নাও হতে পারে। একটা সময়ের পরে দর্শকের মনে এই ধরনের ছবি সম্পর্কে এক ধরনের একঘেয়েমি চলে আসতে পারে, দেরিতে হলেও।
বাংলা ছবির জগৎকে ঠিক আঞ্চলিক বলা চলে না, কারণ, বাংলাদেশ আর ভারতের পশ্চিমবঙ্গ বিপুলসংখ্যক মানুষ এই ভাষায় কথা বলে এবং সারা পৃথিবীতেও এই ভাষায় কথা বলে এমন অসংখ্য মানুষ থাকেন। কিন্তু তবুও বাংলার ছবি যেন আঞ্চলিকতার তকমা হঠিয়ে বিশ্বপ্রান্তরে নিজেকে ঠিক মেলে ধরতে পারছে না। কারণ কি তবে ধারাবাহিকভাবে ভালো কনটেন্টের অভাব? যার জন্য ভৌগোলিক সীমানা পেরুলেও মনের কোনে দাগ কাটার মতো একটা ‘মেঘে ঢাকা তারা’ আজ আর তৈরি হচ্ছে না? এই সময়ের প্রাজ্ঞ অভিনেতা-পরিচালক এবং অন্যান্য বিশেষজ্ঞরা কি এ ব্যাপারে বসছেন একত্রে, নাকি ছোটখাটো ব্যবসায়িক স্বার্থকেই বড় বলে মনে করছেন সিনেমা ব্যবসায়ীরা?
প্রয়াত সুপ্রিয়া দেবীর সম্পর্কে বলা হয়, তিনি তার সময়ে উত্তম কুমারের কাছাকাছি এসে যে বুকের পাটা দেখিয়ে ছিলেন, তা করতে অনেকেরই কাঁপুনি ধরে যাবে। তবে কি আজকের কাণ্ডারীদের সেই ধরনের সাহসের অভাব রয়েছে? নিরাপত্তার বাইরে যাওয়ার মতো ভাবনাচিন্তা করতে কি তারা অপারগ? উত্তরটা আমাদেরই খুঁজতে হবে, এবং তা যত তাড়াতাড়ি সম্ভব।
ফিচার ইমেজ: Cine Kolkata