গত মার্চ মাসে ভারতীয় জনতা পার্টি (বিজেপি) যখন উত্তর-পূর্ব ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যে ২৫ বছরের বাম শাসনকে উৎখাত করে সেখানে প্রথম সরকার গড়ল, তখন তা নিয়ে কম আলোড়ন ওঠেনি ভারতীয় রাজনীতিতে। একে তো শূন্য থেকে গেরুয়া বাহিনীর একেবারে ক্ষমতা দখল, তার উপরে জয়ের পরে রাজ্যজুড়ে বাম কর্মীদের উপর আক্রমণ এবং তাদের দৈবপুরুষ ভ্লাদিমির লেনিনের মূর্তি উপড়ে দেওয়ার ঘটনা- সব মিলিয়ে ত্রিপুরা দৈনিক খবরের শিরোনামে জায়গা করে নেয়।
তবে এর মধ্যে একটি সুরুচির পরিচয় দেন রাজ্যের নতুন মুখ্যমন্ত্রী বিপ্লব কুমার দেব। আটচল্লিশ বছর বয়সী এই বিজেপি নেতা শপথগ্রহণ অনুষ্ঠানে দলের শীর্ষ নেতৃত্বের সামনেই প্রণাম করেন তার পূর্বসূরি মানিক সরকারকে, যাকে তার দল নির্বাচনের আগে রীতিমতো উঠেপড়ে নেমেছিল পরাজিত করতে। কিন্তু বিপ্লব একটি সৌজন্যের দৃষ্টান্ত রাখেন বর্ষীয়ান প্ৰাক্তন মুখ্যমন্ত্রীকে প্রকাশ্যে সম্মান জানিয়ে।
ত্রিপুরাতে বিজেপির উত্থানের পিছনে যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছেন বিপ্লব এবং বিজেপি নেতৃত্ব মনে করেছিল যে, মধ্যবিত্ত পরিবার থেকে উঠে আসা এই রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘের মন্ত্রে দীক্ষিত নেতা দলকে উচ্চে উঠতে সাহায্য করবেন তার শাসনকালে।
বিপ্লব দেবের ‘বৈপ্লবিক‘ কথাবার্তা বিজেপির অন্দরেই অস্বস্তি বাড়িয়েছে
কিন্তু বিধি বাম! ক্ষমতায় আসার এক মাসের মধ্যে বিপ্লব দেবের খোলস খসে পড়তে থাকে। প্রায় রোজই এমন অপ্রাসঙ্গিক এবং অযৌক্তিক উক্তি করতে থাকেন যে প্রচণ্ড বিড়ম্বনার মধ্যে পড়তে হয় বিজেপির শীর্ষ নেতৃত্বকেই। ২রা মে রাজধানী নয়াদিল্লিতে বিপ্লব দেবকে ডেকে পাঠান খোদ প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী, যেখানে দলের শীর্ষ সভাপতি অমিত শাহ-এরও থাকার কথা। বিপ্লবের মুখ থেকে “মহাভারতের যুগেও ইন্টারনেট ছিল” বা “সিভিল সার্ভিসে শুধুমাত্র সিভিল ইঞ্জিনিয়ারদেরই বসা উচিত” বা “ডায়না হেডেনকে বিশ্বসুন্দরী খেতাব দেওয়া ঠিক হয়নি” বা “সরকারি চাকরির পিছনে না দৌড়ে পানের দোকান দেওয়া বা গরুর দুধ বিক্রি করুন” ইত্যাদি কথার ফুলঝুড়িতে ব্যতিব্যস্ত আগরতলা থেকে নয়াদিল্লি- বিজেপির অনেকেই। ঘটনা এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে যে সুনীল দেওধর, যিনি এবছর ত্রিপুরায় বিজেপির জয়ের পিছনে এক অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছেন এবং বিপ্লবের ঘনিষ্ঠ বলে পরিচিত, তিনিও নাকি তার দায়িত্ব থেকে অব্যহতি চাইছেন।
সংশ্লিষ্ট মহলের ধারণা, বিপ্লবকে এখনই ত্রিপুরার মুখ্যমন্ত্রীর পদ থেকে সরানো হবে না যদিও তার বাক্যবাণে দলের ভাবমূর্তি যথেষ্ঠ ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। এক তো এখুনি মুখ্যমন্ত্রী বদল করা হলে তা নেতিবাচক বার্তাই পাঠাবে; আর দ্বিতীয়ত, বিজেপির শীর্ষ নেতৃত্ব আপাতত ব্যস্ত অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ কর্ণাটক নির্বাচন নিয়ে। এখনই বিপ্লবের বিষয়ে তারা বড় কোনো সিদ্ধান্ত নিতে চাইছেন না। তাকে আপাতত সতর্ক করেই হয়তো দায় সারবে দল।
বাচালতার সমস্যা নতুন কিছু নয়
কিন্তু বিজেপির এই সমস্যা নতুন কিছু নয়। গত সোমবার, ৩০ এপ্রিল, দায়িত্বভার নিয়েই “কাঠুয়ার ঘটনা সামান্য ব্যাপার” বলে বিতর্ক তৈরি করেন জম্মু-কাশ্মীরের উপ-মুখ্যমন্ত্রী কবীন্দ্র গুপ্ত- বিজেপিরই আরেক নেতা। প্রশাসনিক নেতৃত্ব ছাড়াও নানা সময়ে দলের চুনোপুঁটিরাও নানা বেলাগাম মন্তব্য করে লোক হাসান, লোককে রাগান, অস্বস্তি বাড়ান দলের। অবস্থা সামাল দিতে সম্প্রতি স্বয়ং প্রধানমন্ত্রীকে তাদের মুখ বন্ধ রাখার নিদান পর্যন্ত দিতে হয়। অযথা মন্তব্য করে সংবাদমাধ্যমকে সুযোগ না করে দিয়ে মুখ বন্ধ রাখা অভ্যাস করতে নির্দেশ দেন তিনি।
বেফাঁস, অর্থহীন মন্তব্য করা ভারতীয় রাজনীতিবিদদের পুরোনো রোগ। দলমত নির্বিশেষে এই বাচালতা দেখা যায় নানা সময়েই। আর এখন ভারতীয় রাজনীতিতে যেহেতু বিজেপির একচ্ছত্র কর্তৃত্ব, তাই পাপের বোঝা তাদেরকে একটু বেশিই বইতে হচ্ছে।
এই বেশি কথা বলার রোগ প্রকট করে বিজেপির আরেকটি সমস্যাও
তবে বিজেপির এই সমস্যা একটি অন্য দিক নিয়েও ভাবায়। আর তা হলো তাদের দলের নিদারুন নেতৃত্বের সংকট। অতীতে অটলবিহারী বাজপেয়ী এবং লালকৃষ্ণ আদভানির জমানাতেও বিজেপির ভবিষ্যৎ নিয়ে সন্দিহান ছিলেন অনেক বিশেষজ্ঞই। ওই দুই ব্যক্তিত্বের পর বিজেপিকে কে সামলাবে- এই প্রশ্নের উত্তরে তখন দেখানো হতো দলের তরুণ তুর্কিদের। একদিকে যেমন সুষমা স্বরাজ, অরুণ জেটলি, প্রমোদ মহাজন যারা প্রধানত কেন্দ্রীয় স্তরে কাজ করতেন অন্যদিকে তেমন মোদী, শিবরাজ সিংহ চৌহান, রমন সিংহ, মনোহর পর্রীকর যারা ছিলেন দলের খ্যাতিমান মুখ্যমন্ত্রীবৃন্দ।
বাজপেয়ী সক্রিয় রাজনীতি থেকে বিদায় নেন ২০০৫ সালে, লোকসভা নির্বাচন হারার এক বছর পরেই, আর আদভানির জমানার পতন শুরু হয়ে যায় ২০০৯ সালের লোকসভা নির্বাচনে পরাজয়ের পরেই। সংগঠক বলে পরিচিত মহাজনের মৃত্যু হয় ২০০৬ সালে, যা ছিল বিজেপির কাছে এক বড় ধাক্কা।
এরপর ২০১২ সাল নাগাদ শুরু হয় মোদীর উত্থান এবং টানা তৃতীয়বার গুজরাটের মুখমন্ত্রীত্ব জিতে তিনি পা ফেলতে শুরু করেন দিল্লির তখতের পানে। মোদীর এই উত্থান নিয়ে কম জলঘোলা হয়নি বিজেপির অন্দরে- নানা শিবির থেকেই তার পথে বাধা সৃষ্টি করা হয়, পিছিয়ে ছিলেন না একসময়ের লৌহপুরুষ আদভানিও। কিন্তু, বাজপেয়ী-আদভানির আমলের অবসানের পর বোধহয় এভাবেই বিজেপির উত্তরাধিকারের ফয়সালা হওয়ার ছিল।
২০১৪ সালের নির্বাচনে মোদী ম্যাজিক দারুণভাবে কাজ করে যাওয়ায় এই উত্তরাধিকারের প্রশ্ন চাপা পড়ে যায়; মোদী এমন বিশাল প্রত্যাশার ফানুস তৈরি করেন যে, তার জমানায় পুরোনো বিজেপিকে যে আস্তে আস্তে সমাহিত করা হয়, সে ব্যাপারটা প্রায় অলক্ষিতই থেকে যায়। ক্রমে বাজপেয়ী-আদভানি থেকে বিজেপি হয়ে ওঠে মোদী-শাহের দল।
এপর্যন্ত ঠিকই আছে। দলের প্রধান কাণ্ডারি হিসেবে যে মোদী তার পছন্দের সেনাপতিকেই কাছে রাখবেন, তা স্বাভাবিক। কিন্তু সমস্যা দাঁড়ায় বিজেপির উত্তরাধিকারের প্রশ্নে। বাজপেয়ী-আদভানির সময়ে তো না হয় মোদী-সুষমারা ছিলেন পরবর্তী প্রজন্ম হিসেবে, মোদীর সময়ে সেই পরবর্তী প্রজন্ম করা? মোদী-পরবর্তী যুগে কে দলের দায়িত্ব নেবে? সেইরকম যোগ্য নেতৃত্ব কি আদৌ রয়েছে?
বিজেপির সাম্রাজ্য বিস্তার হচ্ছে কিন্তু তাকে নেতৃত্ব দেওয়ার মতো লোকের অভাব
আর এখানেই প্রাসঙ্গিক বিপ্লব দেবের মতো নেতারা। বিজেপির দশাশ্বমেধের ঘোড়া ইদানিং কালে একের পর এক রাজ্য জয় করছে। তাতে দলের নেতা-কর্মী-সমর্থকরা যারপরনাই আহ্লাদিত হচ্ছেন ঠিকই, কিন্তু পাশাপাশি এও ঠিক যে, এই নতুন তৈরি জমিতে বিজেপিকে নেতৃত্ব দেওয়ার মতো লোক বলতে গেলে প্রায় নেইই। অনেক রাজ্যেই বিজেপি ক্ষমতায় এসেছে অন্যান্য দল থেকে বেরিয়ে এসে তাদের শিবিরে যোগ দেওয়া সংগঠক বা স্থানীয় রাজনৈতিক কর্মীবৃন্দের সহায়তায়। কিন্তু প্রকৃত নেতা বলতে যা বোঝায়, তা বিজেপির নেই আর এখানেই তাদের সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ। যেকোনো প্রাদেশিক নির্বাচনে আজ বিজেপির চাই সেই মোদীর আবেদন, তার প্রভাব। যুক্তরাষ্ট্রীয় ব্যবস্থায় অতিরিক্ত ব্যক্তিনির্ভরতা মোটেই সুস্বাস্থ্যের লক্ষণ নয়।
পুরোনো কংগ্রেস সর্বভারতীয় দল শুধু ভৌগোলিক নিরিখে ছিল না, ছিল রাজনৈতিকভাবেও
বিজেপির নেতা কর্মীরা প্রায়ই দাবি করে থাকেন যে, তাদের দলই এখন নতুন কংগ্রেস। প্রাচীন এই দল যত দুর্বল হয়েছে, ততই তারা অতীতের সেই শক্তিশালী কংগ্রেসের মতো দেশজুড়ে নিজেদের ভিত্তি বিস্তার করেছে। ভৌগোলিক অর্থে একথা ভুল কিছু নয়, কিন্তু রাজনৈতিকভাবে সম্পূর্ণ বেঠিক।
কংগ্রেস এককালে যে কেন্দ্রে এবং একই সঙ্গে সারা ভারতের রাজনীতি শাসন করত, তার কারণ ছিল তৃণমূলস্তরে তার মজবুত সংগঠন এবং নেতৃত্ব। বিধান রায়, কামরাজ, শ্রীকৃষ্ণ সিংহ- রাজ্যস্তরে যোগ্য নেতৃত্বের অভাব ছিল না। আর তাই কেন্দ্র থেকে জওহরলাল নেহরুকে ছুটে ছুটে আসতে হতো না রাজ্যে রাজ্যে ভোট চাইতে। কেন্দ্র এবং রাজ্যের শীর্ষ নেতৃত্বের মধ্যে চিঠি লেখালেখির রেওয়াজও ছিল সেই যুগে। আর এখন? মোদীকে রাজ্যের শীর্ষ নেতৃত্বকে ডেকে পাঠাতে হচ্ছে কম কথা বলার সতর্কবাণী শোনানোর জন্যে।
বিপ্লব দেবকে নিয়ে এই মুহূর্তে বিরোধী দল, সংবাদমাধ্যম এমনকি সাধারণ মানুষ সোচ্চার হলেও এর আগে আরও নানা বিজেপি মুখ্যমন্ত্রীকে নিয়ে কম হাঙ্গামা পোহাতে হয়নি দলীয় নেতৃত্বকে। উত্তরপ্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী যোগী আদিত্যনাথ বা হরিয়ানার মুখ্যমন্ত্রী মনোহর লাল খাট্টার বা অদূর অতীতে কর্ণাটকের বি এস ইয়েদুরাপ্পাকে নিয়ে যথেষ্ঠ জলঘোলা হয়েছে। কখনো এই নতুন সারির নেতাদের মন্তব্য জনমানসে ক্ষোভের উদ্রেক করেছে, কখনোবা হাসির।
একদিকে যেমন বিজেপির ভোটবাক্সে সমর্থন বেড়েছে, অন্যদিকে তাকে নেতৃত্বের যোগান দিতে হিমশিম খেতে হয়েছে। বেড়ে চলা সমর্থনের সঙ্গে তাল মিলিয়ে যে মোদী নেতৃত্ব রাজ্যস্তরে যোগ্য নেতাদের তুলে আনতে পেরেছেন, সে কথা তার অতি বড় সমর্থকও স্বীকার করবে না।
অতএব, বিপ্লব দেবদের হাত থেকে অচিরেই মুক্তির সম্ভাবনা কম। হয় বিজেপিকে দলের অভ্যন্তরে প্রকাশ্য বচনশিল্প নিয়ে নতুন নেতাদের তালিম দিতে হবে, আর নয়তো বকুনি দিয়ে দিয়ে পাখি পড়িয়ে যেতে হবে বেলাগাম ‘কথাশিল্পী’দের। বাজপেয়ী-আদভানিদের থেকে মোদীরা শিখেছেন অনেক কিছু। এবার তাদের ফিরিয়ে দেওয়ার পালা। নচেৎ বিজেপির পরবর্তী প্রজন্মের ভবিষ্যৎ কিন্তু বেশ উদ্বেগের।
Featured Image Source: Zee News