আজকাল পশ্চিমবঙ্গে একটি বিশেষ ধরনের খবর প্রায়ই চোখে পড়ে। কোনো দুর্ঘটনায় কেউ মারা পড়লে তার পরিবার-পরিজন; কোনো এলাকায় স্থানীয় কর্তৃপক্ষ কাজের গাফিলতি করলে সেখানকার মানুষজন; বা কোনো বিখ্যাত খেলোয়াড়ের ঘরোয়া অশান্তির পরে তার স্ত্রী- সকলেই সোজা সেখানকার মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের শরণাপন্ন হন। ‘দেখি মুখ্যমন্ত্রী কিছু সুরাহা করতে পারেন কিনা,’ এমন বলতে শোনা যায় অনেক সাধারণ মানুষকেই।
মুখ্যমন্ত্রীর কাছে সমস্যার সুরাহার আশায় এভাবে দরবার করাকে কীভাবে দেখা উচিত? মানুষ কি মুখ্যমন্ত্রীকে আঁকড়ে ধরতে চান তার মধ্যে এক আন্তরিকতার খোঁজ পেয়ে? নাকি আমাদের গণতান্ত্রিক কাঠামোতে প্রতিষ্ঠানের প্রতিনিয়ত ক্ষয় তাদের উপর থেকে মানুষের বিশ্বাস ক্রমেই দুর্বল করে তুলছে? যার ফলে প্রশাসনের সর্বোচ্চ ব্যক্তিকেই তাদের শেষ আশা বলে মনে হচ্ছে?
এই ব্যক্তিনির্ভরতা বিকেন্দ্রীভূত গণতন্ত্রকে কতটা স্বাবলম্বী করে?
মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে অনেকেই মনে করেন জনসাধারণের কাছের মানুষ, অন্যান্য অনেক প্রশাসকের চেয়েই। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, এই ব্যক্তিনির্ভরতা একটি বিরাট বিকেন্দ্রীভূত গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় কতটা যুক্তিযুক্ত?
প্রশ্নটা ভাবায়। আজকের দুনিয়ায় যেখানে গণতন্ত্রকে বলা হয় মানুষের সমাজ-রাজনীতি-অর্থনীতিতে সবচেয়ে গ্রহণযোগ্য ব্যবস্থা, সেখানে মানুষের রোজকার ভালো মন্দের জন্যে সরাসরি প্রশাসনিক শীর্ষনেতৃত্বকে মাথা ঘামাতে হবে কেন? তাহলে বিকেন্দ্রীভূত গণতন্ত্র, জনপ্রতিনিধিদের ঘটা করে নির্বাচন করে আনা, এসবের প্রয়োজন কী? ভারতে তো আর সামরিক শাসন বা একনায়কতন্ত্র চলছে না; তাহলে কেন এই অতিরিক্ত ব্যক্তিনির্ভরতা?
বিশিষ্ট চিন্তাবিদ অম্লান দত্ত বলেছিলেন, আমাদের সমাজজীবনের এই দৈন্যতা চলতেই থাকবে যদ্দিন না পর্যন্ত আমাদের দেশে আত্মীয় সমাজের বদলে পৌর সমাজের নির্মাণ না হচ্ছে। পর্যবেক্ষণটি একেবারেই যথাযথ। আমরা গণতন্ত্র নিয়ে যতই আড়ম্বর করি না কেন, গণতন্ত্রের কিছু মৌলিক চাহিদা আমরা এখনও মিটিয়ে উঠতে পারিনি- স্বাধীনতার এত দশক পরেও।
শুধু নির্বাচন সংগঠিত করলেই গণতন্ত্র বেগবান হয় না, তার প্রকৃত সাফল্যের জন্যে চাই একটি মজবুত ব্যবস্থাও, যেখানে ব্যক্তি অপ্রাসঙ্গিক। যেখানে তার ব্যক্তিগত মন সংবেদনশীল হোক বা না হোক, তার রাজধর্মের রথ কখনও পাঁকে পড়বে না। কিন্তু আমরা হাঁটছি সেই কাঙ্ক্ষিত পথের সম্পূর্ণ উল্টোমুখে। পৌর সমাজ স্থাপনের কোনো দৃঢ় সংকল্প আমরা এখনও নিইনি; কাজ চালিয়ে নিচ্ছি ‘দাদা’, ‘দিদি’দের হাত-পা ধরে। এর ফলে তৈরি হচ্ছে না কোনো স্বয়ংসম্পূর্ণ ব্যবস্থা; রাজনৈতিক প্রভাবেই সিদ্ধ হচ্ছে কাজ- যেখানে দরকার নেই সেখানেও।
এছাড়াও মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে প্রায়ই দেখা যায় রাজ্যের বিভিন্ন অঞ্চলে বসে সেখানকার স্থানীয়দের থেকে কাজের খতিয়ান নিচ্ছেন। উদ্যোগটি ভালো কিন্তু একজন মুখ্য প্রশাসকের পক্ষে কতদিন এটা করা সম্ভব? ভারতের আরেক পপুলিস্ট নেতা অরবিন্দ কেজরিওয়ালকেও জনসাধারণের দরবার খুলতে দেখা গেছে অতীতে, যদিও তার ইতিবাচক প্রভাব কিছু দেখা যায়নি নেতার নামে সাময়িক জয়ধ্বনি ছাড়া।
পৌর সমাজের কাঠামো তখনই শক্তিশালী হবে যখন আমাদের দেশের গণতন্ত্রের প্রাতিষ্ঠানিক রূপটি আরও জোরালো হবে। প্রতিষ্ঠান পোক্ত হলে মানুষকে একজন ব্যক্তির মুখের দিকে চেয়ে থাকতে হয় না; আবার একই সঙ্গে, ক্ষমতাপ্রিয় প্রশাসকরা প্রতিষ্ঠানের স্বয়ংসম্পূর্ণতা ঠিক হজম করতে পারেন না। কিন্তু দুর্বল প্রতিষ্ঠানের অর্থ হলো, তা আদতে গণতন্ত্রের ভিতকেই দুর্বল করে, তাকে দলীয় রাজনীতির পায়ের নীচে দলিত করে। সাধারণ মানুষের চোখে হিতৈষী ব্যক্তির শাসন যুৎসই মনে হলেও, যদি শেষপর্যন্ত তারা প্রাতিষ্ঠানিক প্রশাসনের উপরে নির্ভর করতে না শেখে, তবে তাদের সামাজিক-রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক অধিকারই ভূলুণ্ঠিত হয়।
সমর্থন যাকে দেওয়া নির্বাচনের সময়ে; পরে তার মুখের দিকে চেয়ে থাকা- এ কেমন ব্যবস্থা?
নাগরিকত্বেরও নিজস্ব শিক্ষা থাকে। কোনও পছন্দের দলকে (বা আসলে ব্যক্তিই) ভোট দিয়ে জিতিয়ে আনা মানে দরকার-অদরকারে সেই দলের নেতৃত্বের কাছে দরবার করার ছাড়পত্র পাওয়া নয়।
হ্যাঁ, একথা ঠিকই যে প্রান্তিক নাগরিকদের কাছে রাজনৈতিক প্রভাবশালী নেতা-নেত্রীদের কাছে সরাসরি দরবার না করলে তাদের জীবন থমকে যায় অনেক ক্ষেত্রেই। শহুরে শিক্ষিত মানুষের পক্ষে সেই বাধ্যবাধ্যকতা বোঝা সম্ভব নয়। কিন্তু এখানেই আমাদের গণতন্ত্রের বড় পরাজয় যে, নির্বাচনের পরে মানুষেরই সমর্থন নিয়ে জিতে আসা জনপ্রতিনিধির কাছে সেই মানুষকেই হাত পাততে হয়। এই ব্যবস্থাকে পাল্টানো প্রয়োজন তাড়াতাড়ি। অন্যথা, গণতন্ত্র রয়ে যায় প্রহসন হয়েই।
উপনিবেশ-পরবর্তী সমাজের চরিত্রই হলো সরকারকে ‘মা-বাপ’ মনে করা। জীবনের সমস্ত সমস্যার সমাধানের চাবিকাঠি সরকারের হাতেই আছে বলে আমাদের মজ্জাগত চিন্তাভাবনা। পাড়ার বেকার যুবককে চাকরির প্রশ্ন করলে সে উত্তর দেয়- “কী করব… সরকার চাকরি দিচ্ছে না।”
আর তার উপর যদি মনে করা হয় যে সরকারের যিনি মুখ্য, তিনি কল্পতরুর মতো আমাদের জীবনে উপস্থিত হবেন আর সব সমস্যা নিমিষে মেটাবেন, তবে তা আরও বড় মূর্খামি। জনগণের সেবার জন্যই তৈরি হয়েছে প্রশাসকের পদ। আর বিস্তৃত প্রশাসনিক কাঠামোর উপরে থেকে সকল মুশকিলের আসান বনে যাওয়াটাও কোনো কাজের কথা নয়।
ভারতের উন্নত রাজ্যগুলোতে এই প্রবণতা কম
দক্ষিণ ভারতের কর্ণাটক, অন্ধ্রপ্রদেশ বা তামিলনাড়ুতে বা পশ্চিম ভারতের মহারাষ্ট্রে যারা সেখানকার বেসরকারি উন্নয়নের প্রসাদ কুড়োচ্ছেন, তারা কেউ সরকারের মুখাপেক্ষী হয়ে বসে নেই। বেঙ্গালুরু, হায়দ্রাবাদ, চেন্নাই বা মুম্বাইয়ের মতো দ্রুত উন্নয়নশীল শহরগুলোতে মেধাভিত্তিক উন্নয়নে সরকারের বিশেষ কোনো ভূমিকা নেই শুধুমাত্র প্রশাসনিক বা ব্যবসায়িক দিকগুলো তত্ত্বাবধান করা ছাড়া।
সেখানে বাজারের নিয়মেই মেধা তার সঠিক পথটি খুঁজে নিচ্ছে- রাজনৈতিক আনুগত্য, ধর্ম, জাতপাতের বেড়াজাল সেখানে অদৃশ্য। উল্টো বিভাজনের রাজনীতির কাণ্ডারি যারা, তাদেরকে খুঁজতে হয় কী উপায়ে স্থানীয় আবেগকে খুঁচিয়ে দিতে হয়। যদিও বেসরকারি বেওসাদার সেসবের ধার ধারে না যদি না সরকার রীতিমতো গা-জোয়ারি নীতির প্রবর্তন করে। তবে সেই নীতি প্রবর্তন করাও সরকারের পক্ষে সহজ কাজ নয়।
প্রকৃত গণতান্ত্রিক উন্নয়ন এটাই যেখানে প্রশাসক বা তার দলের দিকে মুখ চেয়ে কাউকে থাকতে হবে না। কর্মসংস্থা, শিক্ষা, স্বাস্থ্য পরিষেবা সবই চলবে বাজারের চাহিদা-যোগানের নিয়মে। হ্যাঁ, যেখানে শোষণের অভিযোগ আসবে, সেখানেই প্রশাসককে তৎপরতা দেখতে হবে- সে ভূমিকা ভিন্ন এবং যথাযথ।
কিন্তু পশ্চিমবঙ্গে কথায় কথায় মমতাদেবীর মুখাপেক্ষী হওয়ার সমাজনৈতিক অভিরুচিটি হতাশাজনক। প্রত্যেকটি মানুষকে স্বাবলম্বী হতে যে সাহায্যের দরকার তা করে সরে যাক সরকার- কর্মসংস্থানের ঢালাও সুযোগ করে দিক, মানুষ তার নিজের পছন্দের জিনিসটি নিজেই খুঁজে নেবে। কিন্তু রাজনৈতিক নেতৃত্ব এটা করতে ইতস্তত বোধ করেন এই ভেবে যে, এতে তাদের আনুগত্য ক্ষুণ্ণ হবে, দুর্বল হবে ভোটব্যাংক।
এই বিষয়ে কতটা ভাবিত সুশীল সমাজ?
আজকের সুশীল সমাজ এই ব্যাপারটিকে নিয়ে কতটা চিন্তা করছে? নাকি তারা নিজেই রাজনৈতিক নেতৃত্বের আশীর্বাদলাভের জন্য লালায়িত? পশ্চিমবঙ্গে গত এক দশকে রাজনৈতিক-সমাজনৈতিক ঘটনাবলী যে অভিমুখে এগিয়েছে, তাতে এই সন্দেহ তীব্র না হয়ে যায় না। সুশীল সমাজের অন্যতম বড় দায়িত্ব হচ্ছে শাসক আর নাগরিকের মধ্যে দাঁড়িয়ে এক ধরনের ‘Shock Absorber’-এর মতো কাজ করা। পশ্চিমবঙ্গে কি সে কাজ হচ্ছে যথাযথভাবে?
Featured Image Source:Deccan Chronicle