Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website.
The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

ত্রিপুরা নির্বাচন: ভারতে বিজেপির উত্থান এবং বামদের দুরবস্থা

গত বছরের শেষের দিকে গুজরাটে একটি অস্বস্তিকর জয় এলেও নয়া বছরের মার্চ মাসেই ভারতের শাসকদল ভারতীয় জনতা পার্টি বা বিজেপির অনবদ্য জয় এল দক্ষিণ-পূর্বের রাজ্য ত্রিপুরাতে। টানা পঁচিশ বছর রাজত্ব করার পর গেরুয়াবাহিনীর অকস্মাৎ ধাক্কাতে ধরাশায়ী হলো সেখানকার মানিক সরকারের নেতৃত্বাধীন বাম সরকার। পাঞ্জাব ন্যাশনাল ব্যাঙ্ক কেলেঙ্কারির পর যে নরেন্দ্র মোদী সরকারকে নড়বড়ে ঠেকছিল, তাকে ফের চাঙ্গা করল এই জয়।

ত্রিপুরার পাশাপাশি নাগাল্যান্ডেও বিজেপি ভালো ফল করে এবং মেঘালয়তে প্রতিপক্ষ কংগ্রেস বৃহত্তম দল হিসেবে শেষ করলেও জোটের মাধ্যমে সেখানে বিজেপির ক্ষমতারোহণের সম্ভাবনা উড়িয়ে দেওয়া যাচ্ছে না এই মুহূর্তে। কারণ, গত বছর মণিপুর এবং গোয়াতে নির্বাচনে ভালো ফল না করেও কংগ্রেসের মুখের গ্রাস কেড়ে নিয়ে ওই দুটি রাজ্যে শেষপর্যন্ত সরকার গড়ে বিজেপিই।

ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যের রাজ্যপাল তথাগত রায়ের (একেবারে ডানে) সঙ্গে সে রাজ্যের বিদায়ী মুখ্যমন্ত্রী মানিক সরকার; Source: Twitter

ত্রিপুরায় বিজেপির একটি আসনও ছিল না, সেখান থেকে আজ তারা ক্ষমতায়!

তবে বিজেপি যে রাজ্যে সবচেয়ে বেশি অবাক করেছে রাজনৈতিক বিশেষজ্ঞদের, তা হলো ত্রিপুরা। ২০১৩ সালের নির্বাচনেও যে রাজ্যে বিজেপির শতকরা ভোটের হিসাব ছিল দুই শতাংশেরও কম; যে রাজ্যে তারা কোনোদিন কোনো আসন জিতেও দেখাতে পারেনি, তারা যে রাতারাতি সেখানে ক্ষমতা জিতে নিতে পারে, তা খুব বেশি মানুষ ভাবেননি। কিন্তু কথায় বলে, রাজনীতি হচ্ছে অসম্ভবকে সম্ভব করে তোলার কলা এবং সে কাজে মোদী ও তার দলের সর্বভারতীয় সভাপতি অমিত শাহ যারপরনাই সফল।

ভারতীয় জনতা পার্টির সর্বভারতীয় সভাপতি অমিত শাহ; Source: Author: Captgs; Wikimedia Commons

উত্তর-পূর্ব ভারতের সাতটি রাজ্যের পাঁচটিতেই এখন হয় বিজেপি অথবা তার জাতীয় জোট ন্যাশনাল ডেমোক্রেটিক অ্যালায়েন্স বা এনডিএ-র শাসন চলছে। আর মেঘালয়তেও যদি বিজেপিই শেষ হাসি হাসে, তবে কংগ্রেসের ঝুলিতে থাকবে শুধু মিজোরাম।

ভারতজুড়ে বিজেপির দাপট

বিজেপির সাম্প্রতিক জয়ের পর অমিত শাহ বলেছেন, তার দল এবার প্রকৃতই সর্বভারতীয় দল। বক্তব্যটি একেবারেই সঠিক। এককালে পদ্মদলকে শুধুমাত্র হিন্দি বা গো-বলয়ের দল হিসেবে সীমাবদ্ধ করলেও ২০১৪ সালের জাতীয় নির্বাচন জেতার পর থেকে বিজেপির জয়ধ্বজা উড়েছে ভারতের প্রায় সব অঞ্চলেই। জম্মু-কাশ্মীর থেকে শুরু করে আসামেও মোদী-শাহ জুটি অসম্ভবকে সম্ভব করে দেখিয়েছেন। এর মাঝে এসেছে উত্তর প্রদেশের মতো কঠিন রাজ্যেও একক গরিষ্ঠতা। এই মুহূর্তে দক্ষিণাঞ্চলের বড় রাজ্যগুলো এবং পূর্ব ভারতের পশ্চিমবঙ্গ ও ওডিশা ছাড়া বিজেপি প্রভাব বিস্তার করেছে সর্বত্রই। কেরালার মতো রাজ্যে জিততে না পারলেও বছর দুয়েক আগে অন্তত একটি আসন তারা জিতেছে।

ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী; Source: Author: Naveen babu v; Wikimedia Commons

আর বিজেপির এই অভূতপূর্ব উত্থানের পাশাপাশি কংগ্রেস বা কমিউনিস্ট পার্টিগুলির মতো পুরোনো শক্তিগুলোর অবক্ষয় ঘটেছে নিদারুণ রকমের। গত পাঁচ-ছয় বছরে একের পর এক নির্বাচনে হারতে হারতে কংগ্রেসের ঝুলিতে আজ ভারতের মাত্র চারটি রাজ্য রয়েছে- মিজোরাম ছাড়া পাঞ্জাব, কর্ণাটক এবং পন্ডিচেরি। আর কমিউনিস্ট পার্টি সেভাবে সর্বভারতীয় দল না হলেও অতীতে তাদের অধীনে ন্যূনতম তিনটি রাজ্য ছিল- ত্রিপুরার পাশাপাশি কেরালা এবং পশ্চিমবঙ্গ। ত্রিপুরায় হারের পর তাদের অস্তিত্ব বাকি থাকল একমাত্র কেরালাতেই। যদিও সেখানে আছে বামদের জোট সরকার, মার্ক্সবাদী কমিউনিস্ট পার্টির একক গরিষ্ঠতা নয়।

বিজেপির রণনীতির সামনে অসহায় বামেরা

ত্রিপুরায় বামদের পতনের পিছনে কিছু রাজ্যভিত্তিক কারণ রয়েছে, যেমন আদিবাসী এলাকায় বিজেপির কেল্লাফতে করা। স্থানীয় আদিবাসী সংগঠন আইপিএফটির সঙ্গে গাঁঠছড়া বেঁধে বিজেপি যেমন আদিবাসী ভোটের একটি বড় অংশ ছিনিয়ে নিয়েছে, তেমনই সংখ্যাগরিষ্ঠ ধর্মের ভিত্তিতে অনুপ্রবেশকারীদের ভারতীয় নাগরিকত্ব দান করার মোক্ষম চালটিও চেলেছে। আবার আদিবাসীদের নিজস্ব ‘তিপ্রাল্যান্ড’ এর ব্যাপারটি ভেবে দেখার কথা দিলেও বিজেপি এটিও পরিস্কার করে দিয়েছে যে, আলাদা রাজ্যের দাবি মেটানো সম্ভব নয়। আর তাতে খুশি হয়েছে ত্রিপুরার সাধারণ মানুষ। এই নানাবিধ চ্যালেঞ্জের মধ্যে ভারসাম্য রেখে বিজেপি যে রণনীতি সাজিয়েছিল এই নির্বাচনে, শাসক সিপিএম তার কোনো উত্তর খুঁজে পায়নি।

এছাড়াও বিজেপি যে সাংগঠনিক শক্তি দেখিয়েছে এই নির্বাচনে, তা-ও এককথায় ছিল অনবদ্য। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী থেকে শুরু করে অমিত শাহর ঘন ঘন ত্রিপুরা সফর তো বটেই, রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘ বা আরএসএস প্রচারক সুনীল দেওধর থেকে বিজেপির সাধারণ সম্পাদক রাম মাধব এবং উত্তর-পূর্ব অঞ্চলে বিজেপির অন্যতম বড় ট্রাম্প কার্ড হিমন্ত বিশ্ব শর্মার উপস্থিতি গেরুয়াবাহিনীর কাজ অনেকটাই সহজ করে দেয়। প্রাক্তন কংগ্রেস নেতা বিশ্ব শর্মা বছর তিনেক আগে আসামের তদানীন্তন মুখ্যমন্ত্রী তরুণ গগৈর সঙ্গে মন কষাকষির পর দল ছেড়ে বিজেপিতে যোগ দেন। তারপর থেকে তিনি বিজেপির তুরুপের তাস হয়ে উঠেছেন এই অঞ্চলে- আসাম এবং মণিপুরের পর এবার ত্রিপুরাতেও মোদী-শাহকে জিততে সাহায্য করেছেন।

কংগ্রেস এবং কমিউনিস্টদের ছন্নছাড়া অবস্থা

অন্যদিকে, কংগ্রেস বা সিপিএম-এর দিকে যদি তাকানো যায়, এই দলগুলোর কাজকর্ম যেরকম ছন্নছাড়া, তেমনই তাদের নেতৃত্বের অবস্থা। গুজরাট নির্বাচনের ফলাফল দেখে অনেকেই ভেবেছিলেন যে, রাহুল গান্ধীর নেতৃত্বে কংগ্রেসের হয়তোবা এবার পুনরুজ্জীবন দেখা যাবে। কিন্তু, কোথায় কী! ত্রিপুরা দেখালো, তারা যে তিমিরে ছিল, সেই তিমিরেই রয়েছে। কমিউনিস্ট দলগুলোর তো অবস্থা আরও সঙ্গীন। যে দল বছর চৌদ্দ আগেও জাতীয় নির্বাচনে তাক লাগিয়ে দিয়েছিল ৫৯টি আসন জিতে, তারা আজ প্রায় বিলুপ্তির পথে।

কানাডার প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডোর সঙ্গে বাক্যালাপে কংগ্রেস সভাপতি রাহুল গান্ধী, সম্প্রতি নয়াদিল্লিতে; Source: Twitter handle @OfficeOfRG

ভারতের কমিউনিস্টদের সবচেয়ে বড় সমস্যা হচ্ছে তাদের বস্তাপচা চিন্তাভাবনা এবং ক্ষয়িষ্ণু নেতৃত্ব। আজকের ভারতীয় কমিউনিস্টদের কোনো আদর্শগত অবস্থানই নেই। ৩৪ বছর একনাগাড়ে পশ্চিমবঙ্গ শাসন করে সেখানে ভূপাতিত হয়ে কমিউনিস্টরা আজও ঘুরে দাঁড়াবার কোনো ফর্মুলা খুঁজে পেলেন না। শ্রীমতি মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এবং মোদীর সাঁড়াশি আক্রমণে দিশাহীন কমিউনিস্টরা এখন কংগ্রেসের আঁচলের তলায় নিরাপত্তা খুঁজছেন যেখানে কংগ্রেসের নিজের অবস্থাই অত্যন্ত কাহিল।

কংগ্রেসের সঙ্গে জোট বাঁধা সিপিএম এর আত্মহত্যার শামিল

২০১৬ সালে পশ্চিমবঙ্গের নির্বাচনের আগে কংগ্রেসের সঙ্গে জোট বাঁধাকে কেন্দ্র করে দ্বিধাবিভক্ত হয়ে পড়ে সিপিএম। তার ফলে সেই নির্বাচনে তো ভরাডুবি ঘটেই তাদের, সঙ্গে সঙ্গে সাধারণ সমর্থকদের মধ্যেও সিপিএম এর ভাবমূর্তি ধাক্কা খায় তীব্র। যেই কংগ্রেসকে তারা আজীবন শ্রেণীশত্রু বলে জেনে এসেছেন, তাদের সঙ্গেই দলের শীর্ষ নেতৃত্ব কীভাবে রাতারাতি বন্ধু হয়ে যান, তার সদুত্তর পাননি কেউই। কংগ্রেসের সঙ্গে জোট বাঁধাকে কেন্দ্র করে পশ্চিমবঙ্গের কমিউনিস্টদের ঘোর বিরোধিতা করে কেরালার কমিউনিস্টরা। কারণ, তাদের রাজ্যে তাদের এক নম্বর দুশমন কংগ্রেসই। সেখানে কোনো মমতা নেই যে, শত্রুর সঙ্গে জোট বাঁধার প্রয়োজন পড়বে। কিন্তু শেষপর্যন্ত জোট হয় এবং তার মূল্য চুকাতে হচ্ছে সিপিএম এর নেতৃত্বকে। যে মানিক সরকার বছর দুয়েক আগের ওই জোটকে নিয়ে অসন্তোষ প্রকাশ করেছিলেন, তিনিও এবার নিজের বিশ বছরের মুখ্যমন্ত্রীত্বের পদটি হারালেন।

রাজনৈতিক তুলনার কথা উঠলে বলতে হয়, আজকে বিজেপি যে প্রখর মগজ খাটিয়ে তাদের রাজনীতিটি করে, তার এক-তৃতীয়াংশও চোখে পড়ে না কংগ্রেস বা কমিউনিস্টদের কাজেকর্মে।

বামেরা অপ্রাসঙ্গিকই নন শুধু, তারা পরিশ্রমবিমুখীও

ত্রিপুরাতে ভালো করতে বিজেপি যে ‘কর্পোরেট অ্যাপ্রোচ’ নিয়ে ঝাঁপালো, তার মতো উদ্যোগ কমিউনিস্ট বা কংগ্রেসের দেখা গেলো কই? সুনীল দেওধর বাংলা এবং খোকবরক ভাষা শেখেন ত্রিপুরাতে বিজেপির রাজনৈতিক প্রকল্পটি সফল করতে এবং তার এই পরিশ্রম শেষপর্যন্ত কাজেও দেয়। একটি শাসকদল উত্তরপূর্বের একটি ছোট রাজ্যকে জিততে যদি এই পর্যায়ে পরিশ্রম করতে পারে, চিরকালের প্রান্তিক বামেরা কি নিজেদের গণ্ডি পেরিয়ে ভারতের অন্যান্য প্রান্তরে কমিউনিস্ট ভাবধারাকে ছড়িয়ে দিতে সেরকম উদ্যোগ নিতে পারেন না? অবশ্যই পারেন। কিন্তু তারা নিজেদের ‘ইন্টেলেকচুয়ালিজমে’র গজদন্তমিনার থেকে বেরোতে অপারগ।

ত্রিপুরায় এককালে বামদের রাজত্ব আজ ম্রিয়মাণ; Source: cpim.org

আজকের দিনে রাজনীতি আর আদর্শের কচকচিতে সীমাবদ্ধ নেই। মজবুত সংগঠন ছাড়াও বিজেপির গুণ হচ্ছে তারা মাথা খাটিয়ে রাজনীতি করে। ঠিক রিসোর্সকে ঠিক কাজে লাগাতে জানে। হয়তো গুজরাটি ‘ব্যবসায়িক বিচক্ষণতা’ বর্তমান বিজেপি নেতৃত্বকে এ ব্যাপারে আরও ক্ষুরধার করেছে। উচ্চাকাঙ্ক্ষা, চতুর বুদ্ধি এবং অধ্যবসায়- এই তিনের মিশেলে বিজেপি আজ এক অপরাজেয় শক্তি হয়ে উঠেছে।

আর অন্যদিকে, কংগ্রেস বা কমিউনিস্টদের মতো সাবেক চিন্তাভাবনার দলগুলো ভেবেই পাচ্ছে না কীভাবে এরকম রাজনৈতিক ইনোভেশনের মোকাবিলা করা যায়। আজকের নতুন প্রজন্মের ভোটাররাও বিজেপির প্রতি আকৃষ্ট হচ্ছে বেশি তাদের ঝকঝকে রাজনৈতিক অবয়বের জন্য। আর অপরদিকে, পচনশীল চিন্তা আর নেতৃত্বকে আঁকড়ে থেকে খেসারত দিচ্ছে মোদীর বাক্যবাগীশ প্রতিপক্ষরা।

ত্রিপুরার ফলাফল দেখিয়ে দিল যে, খুব শিগগিরই নিজেদের খোলনলচে না বদলালে কংগ্রেস এবং কমিউনিস্ট দু’দলেরই ভবিষ্যৎ অন্ধকারাচ্ছন্ন। কংগ্রেসের রাজ্যসংখ্যা ক্রমশই বামদের সর্বাধিক নম্বর (তিন) এ গিয়ে ঠেকেছে প্রায় আর বামেরা ক্রমশই অদৃশ্য হচ্ছে। এখনও যদি ঘুম না ভাঙে বর্ণময় অতীতের এই দুটি দলের, তবে তা কি আর আদৌ ভাঙবে?

ফিচার ইমেজ:DNA India

Related Articles