Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website.
The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

ভারতে তৃতীয় ফ্রন্ট গড়ার ডাক চন্দ্রশখরের: আবারও কি এক অবান্তর প্রস্তাব?

ভারতের রাজনীতিতে তৃতীয় ফ্রন্টের নাম কিছুদিন আগ পর্যন্তও বেশ ঘন ঘন কানে আসত। তৃতীয় ফ্রন্টের ধারণাটি হলো ভারতের প্রধান দুটি রাজনৈতিক দল বিজেপি এবং কংগ্রেসকে বাদ দিয়ে তৈরি একটি রাজনৈতিক মঞ্চ, যেখানে একজোট হবে অন্যান্য দলগুলো, বিশেষত আঞ্চলিক দলগুলো। কিন্তু বর্তমান পরিস্থিতিতে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর বিজেপি যেভাবে সর্বভারতীয় দল হিসেবে নিজেদের ডালপালা ছড়াচ্ছে, তাতে দ্বিতীয় বা তৃতীয় কোনো রাজনৈতিক বিকল্পের রাস্তাটিই প্রায় হারানোর জোগাড়। ভারতের ২৮টি রাজ্যের মধ্যে ২১টিতেই এখন বিজেপির সরকার- এককভাবে বা জোটের মাধ্যমে। তিনটিতে কংগ্রেস একটিতে বাম এবং বাকি তিনটিতে অন্যান্য আঞ্চলিক দলগুলো ক্ষমতায়। অর্থাৎ, কংগ্রেস বা দ্বিতীয় ফ্রন্টটিও এখন প্রায় বিলুপ্তির পথে। প্রশ্ন হলো, এই মুহূর্তে তৃতীয় ফ্রন্টের প্রাসঙ্গিকতা কতটুকু?

সম্প্রতি ভারতের তেলাঙ্গানা রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী কে চন্দ্রশেখর রাও সেই তৃতীয় ফ্রন্টের পক্ষেই ফের জোরালো আওয়াজ তুলেছেন। তিনি পরপর দুদিন বিজেপি এবং কংগ্রেস দু’পক্ষকেই লক্ষ্য করে বলেছেন, স্বাধীনতার সত্তর বছর অতিক্রান্ত হওয়ার পরেও ভারতের রাজনীতি হয় বিজেপি নয় কংগ্রেস শাসনেই আটকা পড়ে রয়েছে। আর তাই তার মতে, এখন সময় হয়েছে নতুন কোনো রাজনৈতিক সমীকরণ নিয়ে ভাববার। তাই এই আঞ্চলিক দলগুলোকে নিয়ে সম্ভাব্য তৃতীয় ফ্রন্ট নিয়ে ফের শুরু হয়েছে গুঞ্জন।

ভারতের তেলাঙ্গানা রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী কে চন্দ্রশেখর রাও; Source: Twitter handle of Telangana chief minister’s office @ TelanganaCMO

চন্দ্রশেখরের প্রস্তাবে আগ্রহী অনেক কম্পমান দলের নেতৃত্বই

চন্দ্রশেখর রাওয়ের মন্তব্য শুনে নড়েচড়ে বসেছেন দেশের অনেক দলের শীর্ষ নেতৃত্বই। তৃণমূল কংগ্রেস নেত্রী তথা পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় যেমন তেলেঙ্গানার মুখ্যমন্ত্রীকে জানিয়েছেন যে, তিনি তার এই প্রস্তাবের সমর্থন করেন এবং দরকারে তার সঙ্গে আছেন। চন্দ্রশেখর ইতোমধ্যে মমতার সঙ্গে আলোচনাতেও বসেছেন এ নিয়ে। এছাড়াও হায়দারাবাদের এআইএমআইএম সাংসদ আসাদুদ্দিন ওয়াইসি সহ সমাজবাদী পার্টি, ডিএমকে, শিবসেনার মতো দলের সাথেও চন্দ্রশেখরের তেলাঙ্গানা রাষ্ট্র সমিতির কথাবার্তা শুরু হয়েছে বলে জানা গেছে। এমনকি, তেলেঙ্গানার প্রতিবেশী রাজ্য অন্ধ্রপ্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী চন্দ্রবাবু নাইডুও নাকি তেলেঙ্গানার মুখ্যমন্ত্রীর তৃতীয় ফ্রন্টের ধারণার সঙ্গে একমত। নাইডুকে সাধারণত চন্দ্রশেখরের অন্যতম প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে ধরা হয়।

ভারতের উপরাষ্ট্রপতি বেঙ্কাইয়া নাইডুর (ডানে) সঙ্গে অন্ধ্রপ্রদেশ রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী চন্দ্রবাবু নাইডু; Source: Nara Chandrababu Naidu’s Twitter handle @ncbn

উত্তর-পূর্ব ভারতের তিনটি নির্বাচনের ফলাফল বেরোনোর পরেই চন্দ্রশেখর রাওয়ের এই বক্তব্যের মধ্যে যথেষ্ঠ গুরুত্ব লুকিয়ে রয়েছে বলে বিশেষজ্ঞদের অভিমত। তেলাঙ্গানা রাজ্যে আগামী বছরই ভোট আর এই নবনির্মিত রাজ্যের দ্বিতীয় নির্বাচনেই যে শাসকদল হারতে কোনোমোটেই রাজি নয়, তা চন্দ্রশেখর পরিস্কার করে দিয়েছেন তার নানা বক্তব্যের মাধ্যমেই।

নির্বাচনের এক বছর আগে কেন্দ্রে তোপ দাগার সেই চিরাচরিত রাজনীতি

ভারতের রাজ্যস্তরের নির্বাচনে সাধারণত শাসকদল নিশানা করে কেন্দ্রীয় সরকারকে। কারণ, নিজেদের প্রশাসনিক ব্যর্থতা ঢাকতে এর চেয়ে সহজ আর কোনো পন্থা নেই। চন্দ্রশেখরও ব্যতিক্রমী নন। নানা অসুবিধার সম্মুখীন হওয়া সত্ত্বেও প্রধানমন্ত্রী মোদীর নোট বাতিলের সিদ্ধান্তকে স্বাগত জানিয়েছিলেন যে চন্দ্রশেখর, সেই তিনিই সম্প্রতি নিজ রাজ্যের একটি জনসভায় কৃষি সঙ্কটের প্রসঙ্গে কথা বলতে গিয়ে নিদারুণ ভাষায় আক্রমণ করেন স্বয়ং মোদীকেই। এর প্রতিবাদে বিজেপি তেলেঙ্গানার রাজ্যপালের হাতে চন্দ্রশেখরের বিরুদ্ধে অভিযোগপত্রও তুলে দেয়।

পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়; Source: Mamata Banerjee’s Twitter handle @MamataOfficial

ঘটনা হচ্ছে, যে তেলাঙ্গানা স্থাপনের জন্যে চন্দ্রশেখরের তেলাঙ্গানা রাষ্ট্র সমিতি একসময়ে রাজনৈতিক আন্দোলন শুরু করেছিল, সেই নতুন রাজ্য নির্মিত হওয়ার পরে কিন্তু সেখানকার নানা সমস্যার সমাধান এখনও হয়নি। আর এক বছর পর নির্বাচন, আর তাতেই চন্দ্রশেখরের উপর চাপ ক্রমেই বাড়ছে। সে কারণেই তার এই কেন্দ্রকে আক্রমণ আর তৃতীয় ফ্রন্টের প্রস্তাব। এর ফলে একদিকে যেমন চন্দ্রশেখর বন্দুকের নল বিজেপির দিকে ঘুরিয়ে দিতে সক্ষম হবেন, অন্যদিকে জাতীয় রাজনীতিতে নিজের উচ্চাকাঙ্ক্ষা মেটানোর পথেও তিনি যাত্রা শুরু করতে পারবেন।

ধুরন্ধর রাজনীতিবিদ চন্দ্রশেখর জানেন, তৃতীয় ফ্রন্ট আদতে দ্বিতীয় ফ্রন্টেরই নামান্তর, কারণ কংগ্রেসের চূড়ান্ত পতন। এখন যদি তিনি বিজেপির বিরুদ্ধাচারণ করে জাতীয় রাজনীতিতে বিরোধিতার জায়গাটি নিতে পারেন, তাহলে জাতীয় মঞ্চে তার নামডাক হতে বিশেষ সময় লাগবে না। আর চন্দ্রশেখর এই সময়ে ঐক্যেরই ডাক দিয়েছেন কারণ, তিনি জানেন বিজেপির এই অন্তহীন জয়ের সময়ে দেশের অনেক দল এবং তাদের নেতৃত্ব নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছে। অতএব, তিনি যদি এই সময়ে তৃতীয় ফ্রন্টের ডাক দেন, তাহলে শরিকের অভাব হবে না। চন্দ্রশেখরের অবস্থানটি আদতে বিজেপি বিরোধিতার, কারণ কংগ্রেসের বিরোধিতা করা বা না করার মধ্যে বিশেষ ফারাক নেই।

মমতার সঙ্গে দেখা করতে কলকাতায় চন্দ্রশেখর; Source: Firstpost

চন্দ্রশেখর বড় দলগুলোকে আক্রমণ করার আগে নজরে রেখেছেন মহারাষ্ট্র বা অন্ধ্রের মতো রাজ্যগুলোর জোট রাজনীতির ফাঁক-ফোকরগুলোতেও। এই দুই রাজ্যেই বিজেপির জোটসঙ্গী হিসেবে শিবসেনা (মহারাষ্ট্র) এবং তেলুগু দেশম পার্টি (টিডিপি) গেরুয়া শিবিরের উপর খুব যে সন্তুষ্ট তা বলা চলে না। আর চন্দ্রশেখর সেটাকেই নিজের প্রস্তাবিত তৃতীয় ফ্রন্টের পক্ষে অস্ত্র বানিয়েছেন। বড় দলগুলো আঞ্চলিক দলগুলোর সঙ্গে বিমাতাসুলভ আচরণ করে, তাদেরকে গুরুত্ব দিতে চায় না। আর সেজন্যই প্রয়োজন এমন একটি মঞ্চের, যেখানে এই দলগুলো একে অপরকে সমর্থন করতে পারে এবং জাতীয় রাজনীতিতে নিজেদের অবস্থান আরও পরিস্কার করতে পারে।

কিন্তু তৃতীয় ফ্রন্টের পরিকল্পনা আদৌ কতটা কার্যকরী?

কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রীয় গণতান্ত্রিক কাঠামোর পক্ষে এমন ইঙ্গিত শুনতে ভালো লাগলেও, আদতে কতটা সার্থক হবে তেলেঙ্গানার মুখ্যমন্ত্রীর এই প্রস্তাব? ভারতের রাজনীতিতে তৃতীয় ফ্রন্ট গড়ার কথা এই প্রথম শোনা গেল, তা নয়। অতীতে মুলায়ম সিংহ বা নীতিশকুমার বা বামদের হাত ধরেও বহুবার ভেসে উঠেছে এই ফ্রন্টের কথা। কিন্তু শেষপর্যন্ত তা ভুস করে ডুবেও গিয়েছে। রাজনীতির ঘোর বাস্তবতার কাছে এই তৃতীয় ফ্রন্টের ধারণা নিছক রোমান্টিসিজম হয়েই থেকে গিয়েছে। গত লোকসভা নির্বাচনের প্রাক্কালেও এমন ফ্রন্টের কথা শোনা গিয়েছিল, কিন্তু তা নরেন্দ্র মোদীর জয়রথকে থামাতে পারেনি।

ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী এবং শাসকদল ভারতীয় জনতা পার্টির সর্বভারতীয় সভাপতি অমিত শাহ; Source: Amit Shah’s Twitter handle @Amit Shah

এই তৃতীয় ফ্রন্ট তৈরির প্রাথমিক উদ্দেশ্য হচ্ছে ‘সাম্প্রদায়িক’ বিজেপিকে আটকানো এবং তার সফল হওয়ার আশা তখনই থাকে, যখন কংগ্রেস তাকে পিছন থেকে সমর্থন জানায়। এখন কংগ্রেসের এই ভরাডুবির মরশুমে তৃতীয় ফ্রন্টের সেই আশা তো নেই-ই, উপরন্তু তৃতীয় ফ্রন্টের গুরুদায়িত্ব যে সমস্ত পোড়খাওয়া নেতাদের কাঁধে থাকত, সেই মুলায়ম, নীতিশ, লালুপ্রসাদরা আজ বিজেপির দাপটে অনেকটাই ম্রিয়মান।

দলের মধ্যে কোন্দল আর নির্বাচনে প্রবল বিপর্যয়ের পরে মুলায়ম সিংহ যেমন অস্তমিত, তেমন বিজেপির সঙ্গে ফের হাত মিলিয়ে নীতীশকুমারের জৌলুশ আজ অনেকটাই ফিকে। লালুপ্রসাদও আইনি গ্যাঁড়াকলে পড়েছেন মহা ফ্যাসাদে। আর যে কংগ্রেস নেত্রী এই ধরনের জোটের মধ্যমণির ভূমিকা পালন করতেন, সেই সোনিয়া গান্ধী এখন বয়েসের ভরে ন্যুব্জ এবং অবসরপ্রাপ্ত। বামেরাও এখন রীতিমতো পর্যুদস্ত। সব মিলিয়ে, নতুন করে তৃতীয় ফ্রন্টের ধারণাকে জীবিত করে তুলবেন, এমন সর্বস্তরে গ্রহণযোগ্য নেতার এখন বেশ অভাব। তাই চন্দ্রশেখরের পরিকল্পনা বাস্তবায়িত হবে কীভাবে, তা নিয়ে প্রশ্ন থেকেই যায়।

এবার ডাক উঠেছে দক্ষিণ ভারত থেকে

তবে আগেরবারের সঙ্গে এবারের তৃতীয় ফ্রন্টের ধারণার একটি বড় তফাৎ হচ্ছে তার ভৌগোলিক উৎসস্থল। এতদিন তৃতীয় ফ্রন্টের প্রস্তাব উঠে আসত প্রধানত উত্তর ভারত থেকেই। এখন তা আসছে দক্ষিণ থেকে। এর একটি অন্যতম বড় কারণ হচ্ছে উত্তর, পশ্চিম এবং মধ্য ভারতে বিজেপির এখন রমরমা অবস্থা। এই অঞ্চলগুলোতে কংগ্রেস তো বটেই, আঞ্চলিক দলগুলোও এখন ক্ষমতা হারিয়ে ধুয়েমুছে যাওয়ার জোগাড়। সেখানে দক্ষিণ এবং পূর্বের বেশ কিছু রাজ্যে এখনও আঞ্চলিক দলগুলো ক্ষমতায় আছে এবং বিজেপিকে রুখে দেওয়ার খোয়াব দেখছে। কিন্তু আদতে কতটা সফল হবে এই জোট পরিকল্পনা, তা নিয়ে যথেষ্ঠ সন্দেহ রয়েই যায়।

প্রথমত, এই দলগুলোর একটিরও সর্বভারতীয় আবেদন নেই। চন্দ্রশেখর, মমতা, নাইডু, ওয়াইসি প্রমুখ নেতারা তাদের স্ব স্ব ক্ষেত্রে পরিচিত হলেও নিজেদের গণ্ডির বাইরে গিয়ে নরেন্দ্র মোদীর মতো জনপ্রিয় নেতার মোকাবেলা করা তাদের সাধ্যের বাইরে।

ভারতের আসাম রাজ্যে শিশুদের সঙ্গে জাতীয় কংগ্রেস সভাপতি রাহুল গান্ধী; Source: Office of Rahul Gandhi Twitter handle @ Office Of RG

দ্বিতীয়ত, মুখে তৃতীয় ফ্রন্টের কথা বললেও এই দলগুলোর কোনো ন্যূনতম সাধারণ কর্মসূচি নেই, থাকা সম্ভবও নয়। এদের প্রত্যেকের রাজ্যের সমস্যা ভিন্ন, তার সমাধান আলাদা। সুতরাং শুধুমাত্র নরেন্দ্র মোদীকে হারানোর দিবাস্বপ্ন দেখতে গিয়ে গা-জোয়ারি জোট বাঁধার সিদ্ধান্তের মধ্যে বিচক্ষণতা বিশেষ নেই। অতীতে জুলিমিলি সরকারের সময়ের অস্থিরতা প্রত্যক্ষ করেছে ভারতের আমজনতা; তাদের সেই অবস্থায় ফিরে যাওয়ার কোনো অভিপ্রায় থাকার কথা নয়।

আসলে একদিকে বিজেপির অন্তহীন জয় আর কংগ্রেসের ক্ষয় দেখে এই আঞ্চলিক দলগুলোর নেতৃত্ব আশঙ্কিত। যদি বিজেপি তাদের রাজ্যে এসে থাবা বসায়, তবে তারা আত্মরক্ষার্থে কী করবে? এই দুশ্চিন্তা থেকেই চন্দ্রশেখর ডাক দিয়েছেন ফের সেই তৃতীয় ফ্রন্টের। কিন্তু এর মধ্যে দিয়ে বিজেপিকে কতটা আটকানো যাবে? আদৌ কি যাবে?

Featured Image Source: Overseas News

Related Articles