চীনের কমিউনিস্ট পার্টির পক্ষ থেকে সম্প্রতি প্রস্তাব আনা হয়েছে সেদেশের রাষ্ট্রপতির জন্য নির্ধারিত সর্বাধিক দুটি মেয়াদকালের নিয়মে বদল আনার। এর ফলে বর্তমান রাষ্ট্রপতি শি জিনপিংয়ের আজীবন ক্ষমতায় থাকার পথ প্রশস্ত করা হলো বলে মনে করছে বিশেষজ্ঞ মহল। চীনের রাজনীতিতে উত্তরোত্তর শক্তিশালী হয়ে উঠা জিনপিংয়ের অন্যতম প্রধান লক্ষ্য হচ্ছে নিজেকে একবিংশ শতাব্দীর মাও সে তুং হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করা। আর সেজন্যই চীনের ক্ষমতার অলিন্দে তিনি হয়ে উঠেছেন একমেবাদ্বিতীয়ম।
মাও পরবর্তী যুগে যেই চীন একনায়কতন্ত্রের উপর লাগাম পরাতে শীর্ষ নেতৃত্বের কার্যকালের সময়সীমা বেঁধে দিয়েছিল, আজ শি’র ক্ষমতার পাঁচ বছর অতিক্রমের মুখে সেই অবস্থান থেকে সরে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে বিশ্বের সবচেয়ে জনবহুল এবং দ্বিতীয় বৃহত্তম অর্থনীতির দেশটি।
অশনি সংকেত, মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা
চীন বিশেষজ্ঞরা এই প্রবণতার মধ্যে অশনি সংকেত দেখছেন। চীনে ফের ব্যক্তিকেন্দ্রিক শাসন স্থাপনের চেষ্টা হলে তা বিপজ্জনক হয়ে উঠতে পারে চীন এবং বহির্বিশ্ব দু’পক্ষের কাছেই। অভ্যন্তরীন অর্থে জিনপিংয়ের ব্যক্তিকেন্দ্রিক শাসন আপাতত অর্থনীতি, সামরিক, বিদেশনীতি ইত্যাদি নানা ক্ষেত্রে চীনকে দুর্নিবার গতিতে এগিয়ে নিয়ে গেলেও, দীর্ঘমেয়াদে তা অতীতের দুঃসহ স্মৃতিকেই ফের উসকে দিতে পারে বলে আশঙ্কা অনেকের।
চীনের রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে গণতান্ত্রিক রীতিনীতি না থাকার ফলে এমনিই সেখানে অতি-ক্ষমতায়নের সুযোগ বেশি। আর এখন যদি সাংবিধানিক রীতিও বদলে ফেলা হয় ব্যাক্তিশাসনের প্রতিষ্ঠার হেতু, তাহলে তো পরিস্থিতি ঘোরালো হয়ে ওঠার সম্ভাবনা আরও বেশি। জিনপিং চীনের বিদেশনীতিকে আরও প্রভাবশালী করে তুলেছেন, দুর্নীতির বিরুদ্ধে জোরদার অভিযান চালিয়েছেন এবং চীনের সামরিক শক্তির পুনরুজ্জীবনের উপর বিশেষ গুরুত্ব দিয়েছেন। এসবের দরুন তাকে সমসাময়িক এবং আগামী দিনের চীনের রূপকার হিসেবে দেখাচ্ছে বেইজিংয়ের নেতৃত্ব। কিন্তু তাই বলে ব্যক্তিতন্ত্রের পথে পা বাড়ানো?
চীনের রাজনীতিতে দীর্ঘায়িত হয়েছে শি জিনপিংয়ের ছায়া
চীনের রাজনীতিতে শি-এর ছায়া যে দীর্ঘায়িত হয়েছে তার প্রথম মেয়াদকালেই, তা পরিষ্কার হয় ২০১৭ এর শেষের দিকে, চীনা কমিউনিস্ট পার্টির ঊনবিংশতম জাতীয় কংগ্রেসে। সংবিধানে একদিকে যেমন গৃহীত হয় ‘জিনপিং ভাবনা’, তেমনই উন্মোচিত নতুন পলিটব্যুরো স্ট্যান্ডিং কমিটির একজন সদস্যও যে শি-এর উত্তরাধিকার নন অদূর ভবিষ্যতে, তা-ও পরিস্কার হয়ে যায়। নিজের ‘স্বপ্নের চীন’ তৈরি করার পথে শি যে কোনোরকম রাজনৈতিক বিকল্পকে আমল দেবেন না, সে বিষয়ে কোনো দ্বিমত নেই।
জাতীয়তাবাদী জিগির তুলে সমসাময়িক আন্তর্জাতিক দুনিয়ায় অনেক রাষ্ট্রনেতাই নিজেদের দীর্ঘমেয়াদি ক্ষমতায়নকে সুরক্ষিত করার খেলায় মেতেছেন। তুরস্কের এর্দোয়ান, রাশিয়ার পুতিন বা পূর্ব ইউরোপের বেশ কিছু দেশের শীর্ষ নেতৃত্বের মতো এবার শি-ও এবার সেই পথের পথিক হলেন খোলাখুলিভাবে।
কিন্তু চীনের পক্ষে কি আজকের দিনে মাও যুগে ফিরে যাওয়া সম্ভব? বিশেষজ্ঞদের একাংশের মতে, না। মাওয়ের সময়ে চীন যে ভোগান্তির সম্মুখীন হয়েছিল পরীক্ষামূলক পদক্ষেপ নিতে গিয়ে, তা আজকের দিনে ফের করে দেখানো সম্ভব নয়; সে চীন যতই পেশীবলে নিজের রাজত্ব চালাক না কেন। কিন্তু মাও যুগে ফেরত না যেতে পারলেও, শি-এর মাও-করণ অন্যান্য দিক থেকে বড় চ্যালেঞ্জ ডেকে আনতে পারে।
আন্তর্জাতিক পটভূমিকাই শি’র সামনে এনে দিয়েছে সুবর্ণ সুযোগ
একথা ঠিক অস্বীকার করা যায় না যে, চীনের নেতৃত্বের প্রধান হিসেবে শি ঠিক এই সময়েই এমন সাহসী পদক্ষেপ নিচ্ছেন তার অন্যতম বড় কারণ আন্তর্জাতিক রাজনীতির পরিবর্তনশীল প্রেক্ষাপট। ডোনাল্ড ট্রাম্প আমেরিকার রাষ্ট্রপতি হওয়ার পরে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বিদেশনীতি পশ্চাদমুখী আর তাতেই এশিয়ার বিভিন্ন অঞ্চলসহ আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে তৈরি হয়েছে একটি শূন্যতা। আর তাতেই সুবর্ণ সুযোগ দেখেছেন শি-এর মতো ঝানু রাজনীতিবিদ।
‘স্বপ্নের চীন’ গড়ার কাজে এমন অনুকূল পরিস্থিতি পাওয়া যথেষ্ট সৌভাগ্যের ব্যাপার, আর শি এই সুযোগ ছাড়েননি। অর্থনৈতিক, সামরিক এবং সামাজিক ক্ষেত্রে নিজের উচ্চতা অনেকটা বাড়িয়ে নিয়ে শি এখন লম্বা ইনিংস খেলতে উদ্যোগী। চীনের ইতিহাসে নিজেকে অমর প্রতিপন্ন করা তো বটেই, কম করে আরও এক দশক ক্ষমতার শীর্ষে থেকে শি চীনকেও আন্তর্জাতিক মঞ্চে এমন এক জায়গা করে দিয়ে যেতে চান যেন আর কেউ চীনকে স্পর্শ করার কথা কল্পনাতেও না আনতে পারে।
শি-এর সম্ভাব্য চ্যালেঞ্জ
তাত্ত্বিক কল্পনাতে শি-এর স্ক্রিপ্টে কোনো গলদ নেই। একই সঙ্গে ঘরে এবং বাইরে নিজের নেতৃত্বকে প্রতিষ্ঠা দেওয়ার সুযোগ খুব বেশি রাষ্ট্রনেতা পান না। কিন্তু বাস্তব রাজনীতিতে পরিস্থিতি অন্যরকম হতে বেশি সময় না-ও লাগতে পারে।
প্রথমত, রাষ্ট্রপতির দুটি মেয়াদকালের নিয়ম বদলানোর অর্থ চীনের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে তীব্র হবে সেখানকার চাপা অসন্তোষ। গণতান্ত্রিক রীতিনীতি না থাকলে ক্ষমতা কুক্ষিগত করার প্রবণতার বিরুদ্ধে প্রধান অস্ত্র হিসেবে কাজ করে সাংবিধানিক নীতিই। আর এখন সেটাকেই অবান্তর করে দেওয়ার অর্থ রাজনৈতিক ব্যবস্থার অক্সিজেন খুলে ফেলা। শি-এর বিরোধী শিবির এই সিদ্ধান্তে হতাশ তো হবেই, এর ফলে রাজনীতির চোরাস্রোত ভবিষ্যতে চীনের ঘরোয়া রাজনীতিকে বেসামাল করে ফেললেও অবাক হওয়ার কিছু থাকবে না। আর এর বৃহত্তর প্রভাব চীনের সমাজজীবনে পড়লেও তা অস্বাভাবিক কিছু হবে না।
দ্বিতীয়ত, নেতারাও মানুষ এবং তারাও ভুল করেন। চৌষট্টি বছর বয়সী শিকে যদিও গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় রাজনীতিতে লড়তে হয় না, কিন্তু তবুও সাফল্যের মতো ব্যর্থতাও রাজনৈতিক নেতাদের দৈনন্দিন জীবনের অঙ্গ। শি-র সামনে আজ অনেক সম্ভাবনা থাকলেও যদি কাল কোনো কারণে তিনি ব্যর্থ হন বা অসুস্থতা বা মৃত্যুর মত অদেখা কিছু ঘটে, তবে চীনের সামনে বিকল্প কী থাকবে? পরবর্তী নেতৃত্বের উঠে আসার পথটিই তো চীন বন্ধ করে দেওয়ার উদ্যোগ নিয়েছে। তাহলে শি-এর অনুপস্থিতিতে কী হবে? চীনের মতো দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা করে চলা দেশের পক্ষে এমন সিদ্ধান্ত নেওয়াটা বেশ আশ্চর্জনক। কিন্তু রাজনীতিতে সবই সম্ভব।
তৃতীয়ত, চীন যেমন একদিকে অর্থনৈতিক এবং কূটনৈতিক বিশ্বে নিজের গুরুত্ব বাড়িয়েছে, তেমনই তার সঙ্গে তার দায়িত্বও বেড়েছে নিজের তৈরি করা জায়গাটি ধরে রাখার। চীনের অর্থনৈতিক সমস্যা এখনও পুরোপুরি ত্রুটিমুক্ত নয়, দারিদ্র্যের বিরুদ্ধে লড়াই এখনও শেষ হয়নি; সন্ত্রাসবাদের মতো বিষয়ে বা বিভিন্ন প্রতিবেশী দেশের সঙ্গে বেইজিংয়ের রাজনৈতিক বা সীমাগত বিবাদের এখনও সমাধান মেলেনি পুরোপুরি। শি-এর একক নেতৃত্বের উপর তাই এখন প্রবল চাপ থাকবে আর দীর্ঘমেয়াদে তিনি কতটা তা বইতে পারবেন, সেটাই দেখার বিষয়।
একনায়কতন্ত্রের প্রবণতা কোনোকালে, কোনো দেশের পক্ষেই ভালো পরিণাম আনেনি। ভারতেও ইন্দিরা গান্ধী সত্তরের দশকে জরুরি অবস্থা জারি করেন নিজের ক্ষমতাকে কুক্ষিগত করতে; বিরোধীদের জেলে পাঠান। কিন্তু তা-ও পরবর্তী নির্বাচনে নিজের পতন আটকাতে পারেননি; জনপ্রিয় হলেও ভারতের মানুষ তাকে ক্ষমতা থেকে সরিয়ে দেয়।
এই ‘চেক এন্ড ব্যালেন্স’-এর ব্যবস্থাটি অতীব গুরুত্বপূর্ণ। চীনের রাজনীতিতে আজ যে পদক্ষেপটি নেওয়া হলো, তা এই ব্যবস্থার পরিপন্থী। আর তার খেসারত চীনকে চরম মূল্যে দিতে হতে পারে আগামী দিনে।
ফিচার ইমেজ: JOHANNES EISELE/AFP/Getty Images