গুঞ্জন, গুজব ও নাটকীয়তা; ফুটবলে দলবদলের সেরা স্লোগান বলা যায়। ফুটবল ভক্তরা ম্যাচের বাইরে যে ব্যাপারটি প্রবল আগ্রহ ও উৎসাহের সাথে অবলোকন করে, তা হলো ইউরোপের সেরা লিগগুলোর দলবদলের বাজার। ম্যাচের প্রতিটি মিনিটের মতোই উদ্দীপনার সাথে কাটে গোটা দলবদলের মৌসুম, নামীদামী তারকা খেলোয়াড়দের দলবদলের পাশাপাশি মৌসুম জমে ওঠে উঠতি তারকা ফুটবলারদের নতুন ক্লাবে যোগ দেওয়ার মাধ্যমে। সমর্থকরাও তীর্থের কাকের মতো অপেক্ষা করে নিজের পছন্দের ক্লাবে সেরা কিংবা পছন্দের খেলোয়াড়কে দেখার জন্য।
আলোচিত-সমালোচিত, কাঙ্ক্ষিত-অনাকাঙ্ক্ষিত সবরকমের ঘটনায় দলবদলের মৌসুম চাঙ্গা থাকে প্রতি বছর। এই বছরও নিয়মের ব্যত্যয় অবশ্যই ঘটেনি। ইউরোপের শীর্ষ পাঁচ লিগে এই বছর প্রায় ৪.০৩ বিলিয়ন পাউন্ড সমমূল্যের ১,৫২৩টি দলবদল সম্পন্ন হয়েছে।
ম্যালকমের নাটকীয় সাইনিং, হ্যাজার্ডের মাদ্রিদে যোগ দেওয়ার গুঞ্জন, মদ্রিচের মাদ্রিদ ছেড়ে দেওয়ার খবর কিংবা রোনালদোর ইতালিতে পাড়ি জমানো, সবমিলিয়ে ঘটনাবহুল কেটেছে ২০১৮ সালের দলবদলের পরিক্রমা। বছরের প্রায় শেষের দিকে, ফুটবল ভক্তদের জন্য ২০১৮ সালের সেরা দলবদল নিয়ে সাজানো হয়েছে আজকের আয়োজন।
ম্যালকম: বোর্দো থেকে বার্সেলোনা
বছরের অন্যতম আলোচিত দলবদলের ঘটনা ছিল ব্রাজিলিয়ান তারকা ম্যালকমের বার্সেলোনায় পদার্পণ। প্রিমিয়ার লিগের বেশ কয়েকটি বড় দলে যোগ দেওয়ার গুঞ্জন ও গুজবের অবসান ঘটে, যখন ইতালিয়ান ক্লাব রোমা থেকে সরাসরি জানানো হয় স্বাস্থ্য পরীক্ষার জন্য রোমে আসছেন এই তরুণ ফুটবলার।
ম্যালকমের দলবদলের নাটকীয়তা তখনও শেষ হয়নি, বরং বার্সেলোনা সেখানে যোগ করে নতুন মাত্রা। ফরাসি ক্লাবটিকে কাতালান দলটি রোমার চেয়ে বেশি অর্থের প্রস্তাব দিলে শেষপর্যন্ত আর ইতালির বিমানে উঠা হয়নি ম্যালকমের। অনেকটা বিতর্কিত এই সাইনিং শেষপর্যন্ত চূড়ান্ত হয় বার্সার ৩৬.৫ মিলিয়ন পাউন্ডের বিনিময়ে। ম্যালকমের মতো প্রতিভাবান তরুণ খেলোয়াড়ের জন্য রোমার মতো ক্লাব হতে পারতো দারুণ সুযোগ। ন্যু ক্যাম্পে তারকা খেলোয়াড়দের ভিড়ে এখনও ম্যালকম নিজের প্রতিভা বিকাশ তো দূরের কথা, পর্যাপ্ত ম্যাচ মাঠেই নামতে পারেননি। যা-ই হোক, মাত্র ২১ বছর বয়সী ম্যালকমের বার্সায় যোগ দেওয়া কতটা ফলপ্রসূ হতে যাচ্ছে তা এখনই বলার সময় হয়নি।
থিবো কর্তোয়া: চেলসি থেকে রিয়াল মাদ্রিদ
রিয়াল মাদ্রিদের গোলরক্ষক হিসেবে ডেভিড ডি হেয়ার যোগ দেওয়া নিয়ে কম জল ঘোলা হয়নি। এরপরের বছরগুলোতে অবশ্য মাদ্রিদের গোলবারের নিচে কেইলর নাভাসের দুর্দান্ত পার্ফরম্যান্স নিয়ে কোনো প্রশ্ন তোলার সুযোগ না থাকলেও, এই বছর কর্তোয়ার মাদ্রিদে যোগ দেওয়ার ব্যাপারটি যেন অনেকটা নির্ধারিত ছিল।
বিশ্বকাপে অসাধারণ পারফরম্যান্স করা এই বেলজিয়ান বর্তমান বিশ্বসেরা গোলরক্ষকদের একজন এবং তার জন্য ৩৫ মিলিয়ন পাউন্ড খুব একটা বেশি নয়। যদিও, রিয়াল মাদ্রিদের জার্সি গায়ে তারকা এই গোলরক্ষক এখন পর্যন্ত নিজের নামের প্রতি সুবিচার করতে পারেননি। মাদ্রিদের রক্ষণভাগও যে বর্তমানে বিগত বছরগুলোর মতো শক্তিশালী, সেরকমও বলা যাচ্ছে না। তবুও রিয়াল সমর্থকরা তেমন একটা খুশি নয় তার পার্ফরম্যান্সে। তবে তার মতো পরীক্ষিত একজন গোলরক্ষকের ঘুরে দাঁড়ানো সময়ের ব্যাপার মাত্র।
স্টিভেন জনজি: সেভিয়া থেকে রোমা
ফ্রান্সের বিশ্বকাপজয়ী ফুটবলার জনজি সেভিয়া থেকে রোমায় যোগদান করেন ২৩.৭ মিলিয়ন পাউন্ডের বিনিময়ে। বলতে গেলে, অনেকটা ম্যালকম ও নাইনগোলানের শূন্যতা পূরণের জন্য। নাইনগোলান রোমা ছেড়ে ইন্টার মিলানে চলে যাওয়ার পর মাঝমাঠে হয়তো ম্যালকমকে নিয়ে পরিকল্পনা সাজিয়েছিল ক্লাবটি। বার্সার কাছে ম্যালকমকে হারিয়ে শেষপর্যন্ত ক্লাবটির স্পোর্টিং ডিরেক্টর এ বছর তাদের ১২তম নতুন খেলোয়াড় স্টিভেন জনজির দলবদল সম্পন্ন করেন। মজার ব্যাপার হলো, দায়িত্বে থাকাকালীন সময়ে ফরাসি এই খেলোয়াড়কে সেভিয়ায় নিয়ে এসেছিলেন রোমার বর্তমান এই স্পোর্টিং ডিরেক্টর মনচি।
কেপা আরিজাবালাগা: অ্যাথলেটিকো বিলবাও থেকে চেলসি
অ্যালিসন বেকারের দলবদলের পর চারদিকে একরকম হইচই পড়ে গিয়েছিল একজন গোলরক্ষকের এত চড়া দাম হওয়ায়। তবে তা বেশিদিন স্থায়ী হয়নি, কারণ কিছুদিন পরেই চেলসির নতুন গোলরক্ষকের দাম শুনে সবার চোখ কপালে উঠে গিয়েছিল। অ্যাথলেটিকো বিলবাও থেকে স্প্যানিশ গোলরক্ষক কেপা লন্ডনের ক্লাব চেলসিতে যোগ দেন ৭১.৫ মিলিয়ন পাউন্ডে (৯৫ মিলিয়ন ডলার), যা তাকে বিশ্বের সবচেয়ে দামী গোলরক্ষকে পরিণত করে রাতারাতি! কর্তোয়া রিয়াল মাদ্রিদে চলে যাওয়ার পর চেলসির একজন বিশ্বসেরা গোলরক্ষকের ভীষণ প্রয়োজন ছিল। কিন্তু তা যে কর্তোয়ার দামের প্রায় দ্বিগুণেরও বেশি অর্থের বিনিময়ে হতে যাচ্ছে, তা হয়তো কেউ কল্পনাও করেনি। ফুটবল ইতিহাসের সবচেয়ে দামী গোলরক্ষক শেষপর্যন্ত চেলসির হয়ে নিজেকে কতদূর প্রমাণ করতে পারেন, তা হয়তো সময়ই বলে দেবে। তবে, এই গোলরক্ষকের দিকে গোটা ফুটবল বিশ্বের আলাদা নজর থাকবে এবং ঠিক এই কারণে খানিকটাও চাপেও থাকবেন এই স্প্যানিশ।
থমাস লেমার: মোনাকো থেকে অ্যাটলেটিকো মাদ্রিদ
থমাস লেমারকে দলে ভেড়ানোর দৌড়ে অনেকটা এগিয়ে ছিল আর্সেনাল ও লিভারপুলের মতো ইংলিশ ক্লাবগুলো। কিন্তু, শেষপর্যন্ত বাজিমাত করেন দিয়েগো সিমিওনে। গ্রিজমান, কস্তা, মার্তিন্স, কোরেয়া, কালিনিচ ও সলের সাথে অ্যাটলেটিকোর আক্রমণভাগে লেমারের সংযোজন দলটিকে আরও শক্তিশালী করেছে। ফরাসি এই অ্যাটাকিং মিডফিল্ডার এখনও অবশ্য নতুন ক্লাবে নিজেকে মেলে ধরতে পারেননি। তবে, মোনাকো থেকে ৫২.৭ মিলিয়ন পাউন্ডে অ্যাটলেটিকো মাদ্রিদে যোগ দেওয়া মাত্র ২৩ বছর বয়সী প্রতিভাবান খেলোয়াড়ের দিকে তাকিয়ে থাকবে সবাই।
রিচার্লিসন: ওয়াটফোর্ড থেকে এভারটন
প্রিমিয়ার লিগ ক্লাব ওয়াটফোর্ডের তরুণ তারকা স্ট্রাইকার ৪০ মিলিয়ন পাউন্ডে এই বছর পাড়ি জমিয়েছেন একই লিগের এভারটনে। মার্সেসাইডের এই ক্লাবে নিজের প্রতিভার দুর্দান্ত প্রতিফলন ঘটিয়েছেন মাত্র ২১ বছর বয়সী এই ব্রাজিলিয়ান। নিয়মিত পারফরম্যান্সের দরুন জায়গা করে নিয়েছেন ব্রাজিল জাতীয় দলেও। এরই মধ্যে তার উপর নজর পড়েছে বিশ্বের অনেক নামীদামী ক্লাবের। এভারটনের হয়ে অসাধারণ সময় কাটাচ্ছেন এই খেলোয়াড়। এখন পর্যন্ত লিগে ৮ গোল করে দলের আক্রমণভাগকে সামনে থেকে নেতৃত্ব দিয়ে যাচ্ছেন এই তরুণ প্রতিভা।
জর্জিনহো: নাপোলি থেকে চেলসি
নাপোলি থেকে চেলসিতে এই বছর যোগ দিয়েছিলেন দলটির বর্তমান কোচ মাউরিজিও সারি। সারির চেলসিতে আসার পর অনেকেই ধারণা করেছিল, জর্জিনহোকেও দেখা যাবে স্ট্যামফোর্ড ব্রিজে। কারণ, নাপোলিতে সারির ফুটবলীয় কৌশলের অন্যতম চালিকা শক্তি ছিল এই ডিফেন্সিভ মিডফিল্ডার এবং চেলসিতেও যে কোচ তার প্রিয় শিষ্যকে একই ভূমিকায় দেখতে চাইবেন তা ছিল সহজেই অনুমেয়। ৫০.৪ মিলিয়ন পাউন্ডে চেলসিতে যোগ দেওয়া জর্জিনহো নিজের উপর অর্পিত দায়িত্ব সাফল্যের সাথে পালন করছেন। সেই সাথে অনেকে মনে করছেন, জর্জিনহোর কারণেই ক্লাবটির আরেক ডিফেন্সিভ মিডফিল্ডার বিশ্বকাপজয়ী কান্তেকে মাঠে তার নিয়মিত ও সহজাত পজিশনের বাইরে খেলতে হচ্ছে।
রিয়াদ মাহরেজ- লেস্টার সিটি থেকে ম্যানচেস্টার সিটি
লেস্টার সিটির প্রিমিয়ার লিগ জয়ের অন্যতম কারিগর ছিলেন আলজেরিয়ান এই মিডফিল্ডার। এরপর থেকেই অবশ্য ইউরোপের দলবদলের বাজারে তাকে নিয়ে গুজব ডালপালা ছড়ানো শুরু করে। ফুটবলে বড় দলগুলোর বিপুল অর্থ ও ঐতিহ্যের কাছে বরাবরই ছোট ক্লাবগুলো অসহায়।
মাহরেজ ও ম্যানচেস্টার সিটিকে ঘিরে শীতকালীন দলবদলের সময় অনেক গুঞ্জন শোনা গেলেও শেষপর্যন্ত তা বাস্তবে রূপ নেয়নি। চলতি বছরে মাহরেজকে শেষপর্যন্ত কিনে নেয় ইংলিশ ক্লাবটি এবং তা-ও আবার ৬০ মিলিয়ন পাউন্ডের বড় অংকের বিনিময়ে। সিটির মাঝমাঠে পর্যাপ্ত পরীক্ষিত ও তারকা খেলোয়াড় থাকা সত্ত্বেও এই মিডফিল্ডারকে দলে নেওয়ায় তখন যথেষ্ট সমালোচনাও হয়েছিল। ক্লাবটির মাঝমাঠের প্রাণ ভোমরা কেভিন ডি ব্রুইনা ইনজুরি আক্রান্ত হয়ে দীর্ঘ সময় মাঠের বাইরে গেলে সমালোচনার জবাবটা মাহরেজ তার পারফরম্যান্সের মাধ্যমেই দিয়ে যাচ্ছেন। এখন পর্যন্ত, চ্যাম্পিয়ন্স লিগে ৩ ম্যাচে ১ গোল ও ৪ অ্যাসিস্ট এবং প্রিমিয়ার লিগে ৯ ম্যাচে ৫ গোল ও ২ অ্যাসিস্টের পরিসংখ্যানই বলে দিচ্ছে, খরচটা খুব একটা বেশি হয়ে যায়নি।
অ্যালিসন বেকার: রোমা থেকে লিভারপুল
নির্দ্বিধায় এই বছর লিভারপুলের সেরা সংযোজন ব্রাজিলিয়ান গোলরক্ষক অ্যালিসন বেকার। চ্যাম্পিয়ন্স লিগ ফাইনালে লরিস কারিউসের কারণে লিভারপুলের ভরাডুবির পর অ্যানফিল্ডে ক্লপের দলে দরকার ছিল সেরা একজন গোলরক্ষকের। রেকর্ড ৭২.৫ মিলিয়ন ডলার বা ৬৫ মিলিয়ন পাউন্ডের বিনিময়ে লিভারপুল দলে ভিড়িয়েছে বিশ্বসেরা গোলরক্ষকদের একজনকে। চেলসিতে কেপা যোগ দেওয়ার পূর্বে তিনিই ছিলেন বিশ্বের সবচেয়ে দামী গোলরক্ষক। চলতি মৌসুমে প্রিমিয়ার লিগে এখন পর্যন্ত সবচেয়ে বেশি লক্ষ্যে থাকা শট সেভ করার হার এই ব্রাজিলিয়ানের। ইউরোপের অন্যতম সেরা ও দামী এই গোলরক্ষক দুর্দণ্ড প্রতাপে লিভারপুলের গোলবার সামলে তার পেছনে ব্যয় করা বিপুল অর্থের যথার্থ মূল্যায়ন করে যাচ্ছেন।
ক্রিস্টিয়ানো রোনালদো: জুভেন্টাস থেকে রিয়াল মাদ্রিদ
২০১৮ সালের সবচেয়ে আলোচিত কিংবা অনাকাঙ্ক্ষিত দলবদলটি ছিল পর্তুগিজ কিংবদন্তি ক্রিস্টিয়ানোর রোনালদোর। সেই সাথে নিঃসন্দেহে বছরের সেরা সাইনিং। ৩৩ বছর বয়সেও তার ফর্ম বিবেচনায়, কেউই হয়তো আশা করেননি রিয়াল মাদ্রিদের সাথে তার ৯ বছরের সম্পর্ক ছিন্ন হতে যাচ্ছে!
পাঁচবারের ব্যালন ডি অর জয়ী ফুটবলারকে নিজেদের দলে পাওয়ার জন্য মুখিয়ে ছিল অনেক দলই, কিন্তু সবাই তো আর রোনালদোকে ভেড়ানোর ক্ষমতা রাখে না। জল্পনা-কল্পনার খুব বেশি সুযোগ হয়নি, ৮৮.৫ মিলিয়ন পাউন্ডে (১০০ মিলিয়ন ডলার) জুভেন্টাসের কাছে রিয়াল মাদ্রিদ তাদের সেরা খেলোয়াড়কে বিক্রি করে দেয় খুব দ্রুতই। রোনালদো মাদ্রিদ ত্যাগ করার আগপর্যন্ত হয়তো ক্লাবটি ধারণাও করতে পারেনি, লিগে তাদের একজন গোলস্কোরারের জন্য এতটা ধুঁকতে হবে। একদিকে কোচ জিদান ও অন্যদিকে রোনালদোকে হারিয়ে মাদ্রিদ যে আপাতত গভীর সংকটে রয়েছে, তা বলা বাহুল্য। অন্যদিকে, সিরি আ’র মতো ডিফেন্সিভ লিগে গিয়েও এই কিংবদন্তির গোল উৎসবে কোনো ভাটা পড়েনি। ইতালিয়ান ক্লাবটির রোনালদোকে তুরিনে নিয়ে আসার অন্যতম লক্ষ্য অবশ্যই চ্যাম্পিয়ন্স লিগ এবং সেই লক্ষ্যে ক্লাবটি বেশ ভালোভাবেই এগিয়ে যাচ্ছে। রোনালদোও হয়তো মুখিয়ে রয়েছেন নতুন ক্লাবের হয়ে আরেকটি চ্যাম্পিয়ন্স লিগ ও সেরার মুকুট মাথায় তোলার।