Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website.
The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

জামদানি ও রসগোল্লা: জিআই তকমা নিয়ে টানাটানি পড়শিদের!

গত দুই-এক বছর থেকে শুরু করে সাম্প্রতিক সময়ের একটি আলোচিত শব্দগুচ্ছ হচ্ছে ‘জিআই নিবন্ধন’। ভৌগোলিক বুৎপত্তিগত পণ্যের স্বীকৃতি প্রদানের এ প্রক্রিয়ায় কিছুদিন আগে বাংলাদেশের জামদানি নিবন্ধিত হয়। ওদিকে ভারতেও দীর্ঘ লড়াইয়ের পর ওড়িশাকে হারিয়ে রসগোল্লার ভারতীয় জিআই নিবন্ধন পেয়েছে পশ্চিমবঙ্গ। এ নিবন্ধন আদায়কে ঘিরে প্রতিবেশী ভারত ও বাংলাদেশ এবং ভারতের অভ্যন্তরে প্রতিবেশী প্রদেশ পশ্চিমবঙ্গ ও ওড়িশার ভেতর এক রকম টানাটানিই দেখা গেছে। সেই জিআই নিবন্ধন ও পড়শিদের ‘নিবন্ধন যুদ্ধ’র হালহাকিকত নিয়েই আজকের লেখা।

জিআইজি অ্যাক্ট বা জিআই নিবন্ধন আসলে কী?

প্রথমত, জিআইজি অ্যাক্টের পূর্ণরূপ হচ্ছে জিওগ্রাফিক্যাল ইন্ডিকেটর্স অব গুডস অ্যাক্ট। শুনেই বোঝা যাচ্ছে, পণ্যের ভৌগোলিক পরিচয় নির্ধারণের জন্য এই আইন। এই পরিচয় নির্ধারণের উদ্দেশ্য হলো একধরনের স্বত্ত্বাধিকার আরোপ। অর্থাৎ জিআইজি এর দ্বারা কোনো দেশ বা তাদের অভ্যন্তরীণ অঞ্চলসমূহ তাদের নিজস্ব উৎপাদিত পণ্য, যা বৈশিষ্ট্যে অনন্য, তার স্বত্ত্ব লাভ করতে পারে। অনেকটা কপিরাইট, প্যাটেন্ট বা ট্রেডমার্কের মতোই বিষয়টি।

বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থা (WTO) এর অধীনে ১৯৯৯ সালের ‘ট্রেড রিলেটেড ইন্টেলেকচুয়াল প্রোপার্টি রাইট’ (TRIPS) চুক্তিতে স্বাক্ষরকারী সকল দেশ নথিপ্রমাণসহ আবেদনপূর্বক তাদের নিজস্ব পণ্য বা প্রাকৃতিক সম্পদের স্বত্ত্ব/প্যাটেন্ট লাভ করতে পারে; এটিই জিআই নিবন্ধন। ২০০৩ সালে ভারতে ও ২০১৫ সালে বাংলাদেশে এটি কার্যকর হয় ‘ডিপার্টমেন্ট অব ডিজাইন, প্যাটেন্ট অ্যান্ড ট্রেডমার্ক (ডিপিডিটি)’ গঠনের মাধ্যমে। তথ্য-প্রমাণ পর্যালোচনা করে নিবন্ধন প্রদানের কর্তৃপক্ষ তারাই। এ নিবন্ধন কর্তৃক এটাই সূচিত হয় যে, স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্যের প্রেক্ষিতে পণ্যটি উক্ত ভৌগোলিক অবস্থান বা আদি উৎপত্তিস্থলের নিজস্বতার দাবি রাখে। এর উদ্দেশ্য হলো উক্ত পণ্যটির একটি ব্র্যান্ড ভ্যালু তৈরি করা, যা বাণিজ্যিকভাবে অত্যন্ত সহায়ক। উদাহরণ হিসেবে বলা যেতে পারে, দার্জিলিংয়ের চা অথবা মরোক্কোর ফেজ টুপির কথা। ভারত নিজেদের প্রায় ২০০ এর অধিক পণ্যকে ইতোমধ্যে নিবন্ধিত করেছে।

মানচিত্রে ভারতের জিআই ট্যাগসমূহ; Source:clearias.com

জামদানির আদিস্থান কি বাংলাদেশ নয়?

আদি মসলিন সেই কবেই হারিয়ে গেছে। এখনো বাংলাদেশের তাঁতশিল্পের তথা পুরো দেশের গৌরব হয়ে টিকে আছে জামদানি। বাংলাদেশ তো বটেই, বিশ্বজুড়েই জামদানির খ্যাতি অতুলনীয়। এমনকি উৎসবে, পূজা-পার্বণে সাধারণ বাঙালির বিশেষ পোশাকসজ্জার অনুষঙ্গ হিসেবে পশ্চিমবঙ্গেও ঢাকাই জামদানির চাহিদা তুঙ্গে।

Source: craftsvilla.com

‘জামদানি’ শব্দটির মতো কাপড়টিতেও রয়েছে পারসিক ছোঁয়া। বাংলার তাঁতীদের সুনিপুণ হাতে নিজস্ব ও পারস্য ঘরানার মিশেলে জন্ম নেয় জামদানি। ঠিক কতকাল আগে জন্ম নিয়েছিলো, তার সুনির্দিষ্ট তথ্য না থাকলেও গুপ্ত সাম্রাজ্যের (৪র্থ-৬ষ্ঠ খ্রিস্টাব্দ) সংস্কৃত সাহিত্যেও এর অস্তিত্ব পাওয়া যায়। ১৪ শতকে মরোক্কীয় বিশ্ব পরিব্রাজক বাংলায় এসে ভূয়সী প্রশংসা করেছিলেন জামদানির। তার বর্ণনায় এর উৎপত্তিস্থল অবশ্য ছিলো নারায়ণগঞ্জের সোনারগাঁও। ওদিকে মোঘল আমলে সেরা জামদানি তৈরি হয়েছে ঢাকায়, এ মর্মেও আছে দলিল। এমনকি পশ্চিমবঙ্গ সহ বর্হির্বিশ্বে জামদানির একরকম সমার্থকই হলো ‘ঢাকাই জামদানি’।

২০১৩ সালে আজারবাইজানের বাকুতে অনুষ্ঠিত ইউনেস্কোর ইন্টারগভর্নমেন্টাল কমিটি ফর দ্য সেফগার্ডিং অব দ্য ইনট্যানজিবল কালচারাল হেরিটেজের অষ্টম সম্মেলনে ১০০টি দেশের প্রতিনিধিরা তাদের ঐতিহ্যবাহী পণ্য নিয়ে অংশগ্রহণ করে। প্রদর্শিত পণ্যগুলোর মধ্য থেকে ইউনেস্কোর জুরিবোর্ড ৭টি ঐতিহ্যবাহী পণ্যকে নির্বস্তুক বিশ্ব সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের তালিকাভুক্ত করে, যার মধ্যে ছিলো বাংলাদেশের জামদানি। এ থেকে সুস্পষ্টভাবে বোঝা যায়, জামদানির আদিভূমি এই পূর্ববঙ্গ এবং বাংলাদেশই এই জামদানির জিআই স্বত্ত্বের একক দাবিদার।

জামদানির জিআই স্বীকৃতি ও ভারতীয় জামদানি বিতর্ক

২০১৬ সালের ৫ আগস্ট জিআই নিবন্ধনের শর্ত হিসেবে জামদানির প্যাটেন্ট ডিজাইন ও ট্রেডমার্কস অধিদপ্তর তাদের নিজস্ব জার্নালে ২৬ পৃষ্ঠার একটি প্রবন্ধ প্রকাশ করে। অবশেষে সমস্ত আনুষ্ঠানিকতা শেষ হয় ২০১৬ সালের ১৭ নভেম্বর, যখন শিল্পমন্ত্রী আমির হোসেন আমু বাংলাদেশ ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প কর্পোরেশনের (বিসিক) হাতে জিআই নিবন্ধনের চূড়ান্ত সনদ তুলে দেন।

Source: dhakatribune.com

কিন্তু  বাংলাদেশের বেশ আগেই ভারত ‘উপ্পদ জামদানি‘ নামে এক বিশেষ জামদানির জিআই নিবন্ধন করিয়ে রেখেছিলো। উপ্পদ হচ্ছে অন্ধ্র প্রদেশের শহর কাকিনাদা থেকে প্রায় ২০ কিলোমিটার দূরবর্তী একটি সৈকত। কাকিনাদার তাঁতীরা রেশম ও সুতির সমন্বয়ে তৈরি করেন এই বিশেষ ‘জামদানি’। আন্তর্জাতিক খ্যাতিতে ঢাকাই জামদানির চেয়ে যোজন যোজন পিছিয়ে থাকলেও সস্তামূল্যের কারণে বাংলাদেশের বাজারে আবার সয়লাব এই ভারতীয় জামদানি। পূর্বে ‘উপ্পদ’ শব্দটি থাকলেও ‘জামদানি’ শব্দটির জন্যই মূলত বিভ্রান্ত হচ্ছেন দেশ ও দেশের বাইরের সাধারণ ক্রেতারা। এর দ্বারা অনাকাঙ্ক্ষিতভাবে জামদানির স্বত্ত্বাধিকার লঙ্ঘিত হচ্ছে বলে অনেকেই মনে করেন।

ট্রিপস (TRIPS) চুক্তির অধীনে যেকোনো দেশ অন্য দেশে তাদের জিআই নিবন্ধিত পণ্যের অযাচিত আরোপণ ও ব্যবহারের বিরুদ্ধে উৎস-মৌলিকত্বের তুলনামূলক প্রমাণ প্রদর্শনপূর্বক ‘ব্যবস্থা’ নিতে পারে। এমন ‘ব্যবস্থা’ নিয়ে বাংলাদেশ সফল হলে ভারতের নিজস্ব জিআই নিবন্ধনের পণ্যতালিকা থেকে নাম কাটা পড়তে পারে উপ্পদা জামদানির। এজন্য ভারতীয় জিআইজির ২৭তম ধারার অধীনে আবেদন করতে হবে বাংলাদেশকে। সে পথে বাংলাদেশ সরকার হাঁটবে কিনা কিংবা আলাদা একটি নামে বাংলাদেশের আগেই নিবন্ধিত হবার কারণে উপ্পদ জামদানির ব্যাপারে বাংলাদেশ সুবিধা করতে পারবে কিনা, তা সময়ই বলে দেবে। তবে অন্তত বাংলাদেশের বাজারে ‘উপ্পদ জামদানি’ ঢুকতে না দেওয়ার পরামর্শ এ দেশীয় জামদানি সংশ্লিষ্টদের।

রসগোল্লা তুমি কার, ওড়িশা না বাংলার?

দুই বাংলার প্রিয় রসগোল্লা নিয়ে এক চোট যুদ্ধ হয়ে গেছে ভারতবর্ষে। প্রায় দুই বছর প্রমাণাদি নিয়ে লড়াইয়ের পর গত বছরের ১৪ নভেম্বর ওড়িশার দাবিকে হটিয়ে পশ্চিমবঙ্গ জিতে নেয় রসগোল্লার জিআই সত্ত্ব।

Source: indianexpress.com

২০১৫ এর ১৫ মে ওড়িশার ক্ষুদ্র শিল্প মন্ত্রণালয়ের তরফ থেকেই প্রথম উত্থাপিত হয় এই দাবি। বলা হলো, রসগোল্লার উৎপত্তিস্থল ওড়িশার কটকের পাহালে। এ দাবির প্রেক্ষিতে তথ্য সংগ্রহও শুরু করে দেয় সেখানকার খাদ্য প্রক্রিয়াকরণ ও বিজ্ঞান-প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়। ২০১৬ সালে গবেষক অসিত মোহান্তি রসগোল্লার বুৎপত্তি নিয়ে প্রাদেশিক সরকারকে ১০০ ও ১৫০ পাতার দুটো নথি হস্তান্তর করে। সেখানে বলা হয়, ১৫ শতকে রচিত বাল্মীকির রামায়ণের ওড়িয়া সংস্করণ ‘দণ্ডি রামায়ণ’ ও পুরীর জগন্নাথ মন্দিরের আখ্যান ‘মডালা পঞ্জি’তে রসগোল্লার উল্লেখ রয়েছে। সেই সঙ্গে প্রতিবেদনটিতে এই দাবিও করা হয় যে, বাংলা সাহিত্যে যেখানে ১৮৯৬ অবধি ‘রসগোল্লা’ নামের উল্লেখ নেই, সেখানে ১৮৯৩ সালেই ওড়িয়া সাহিত্যে এর উল্লেখ আছে এবং ১২ শতক থেকেই জগন্নাথদেবের উল্টো রথযাত্রার দিন মন্দিরে রসগোল্লাই আপ্যায়ণের অনুষঙ্গ।

পুরীর জগন্নাথ দেবের রথযাত্রা; Source: boldsky.com

ওদিকে পশ্চিমবঙ্গ সরকার ওড়িশার তোড়জোড়ের ফাঁকা গলে ২০১৫ সালের ১৬ সেপ্টেম্বর ‘বাংলার রসগোল্লা’ শিরোনামে আবেদন করে জিআই তকমার জন্য। তাদের মূল বক্তব্য ছিলো, রসগোল্লার বয়স বেশি দিন নয়, মোটে ১৫০টি বছর। সপ্তদশ শতকে পর্তুগিজদের কাছে ছানার ব্যবহার শিখে বাঙালিরা। কিন্তু মিষ্টির নানান পদ তৈরি বাঙালিকে কারো শেখাতে হয়নি। ১৯৬০ সালের দিকে বাগবাজারের নবীন চন্দ্র দাস ও ফুলিয়ার হারাধন দাসের কৃতিত্বেই বাঙালি প্রথম মজে রসগোল্লায় রসনাতৃপ্তিতে। নবীন দাসের উত্তরপুরুষেরাই বর্তমানে চালাচ্ছেন কলকাতা তথা ভারতের সবচেয়ে বিখ্যাত রসগোল্লার দোকান ‘কে সি দাস’। এ সম্পর্কিত প্রমাণের পাশাপাশি পশ্চিমবঙ্গের অনেক ঐতিহাসিকের যুক্তি, ওড়িশার মন্দির সংক্রান্ত কোনো সরকারি নথিতে ‘রসগোল্লা’ শব্দটির অস্তিত্ব নেই, তবে ‘ক্ষীরমোহন’ বলে এক মিষ্টির অস্তিত্ব আছে। জগন্নাথের উল্টোরথে হয়তো সেটিই খাওয়া হতে পারে, যদিও সেটি পশ্চিমবঙ্গের রসগোল্লার মতো সাদা নয়, বরং বাদামী।

দ্রুতই জিআই নিবন্ধনের জন্য ওড়িশা আবেদন করবে জানিয়ে সেখানকার অর্থমন্ত্রী শশীভূষণ বেহেরা বলেছেন, “পশ্চিমবঙ্গের এ জয় আমাদের জন্য পরাজয় নয়, যেহেতু আমরা এখনো আবেদনই করিনি।’ রাজ্যটির ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প বিভাগের সচিব এলএন গুপ্ত জানিয়েছেন, প্রয়োজনীয় উপাত্ত সংগ্রহ ও জিআই আবেদনের জন্য কমিটি গঠন করা হয়েছে।

ওড়িশার সামনে এখন দুটো পথ খোলা।

  • জিআইজির ৩১তম ধারা অনুযায়ী রেজিস্টারের সিদ্ধান্তে অনাস্থা জানিয়ে আপিল করা। তাতেও প্রত্যাখ্যাত হলে সুপ্রিম কোর্টে বিশেষ লীভ পিটিশন দায়ের করা। সেখানে জিতলে বঙ্গের জিআই তকমা ওড়িশা নিয়ে নেবে।
  • এর বাইরে নিজস্ব বাদামী রসগোল্লাকে ‘ক্ষীরমোহন’ নাম দিয়ে জিআই নিবন্ধিত করতে পারে ওড়িশা। ক্ষীরমোহন নামকরণে রাজ্যটির খুব বেশি অভিমান করা উচিত নয়, কেননা এটিই ছিলো তাদের রসগোল্লার প্রাক্তন নাম!

এখন ওড়িশা কী করবে, তার ওপরেই নির্ভর করছে ভারতীয় প্রতিবেশী এই দুই প্রদেশের রসগোল্লা নিয়ে দ্বৈরথ কোথায় গিয়ে শেষ হয়।

শেষ কথা

ওদিকে এতক্ষণ ভারতের আভ্যন্তরীণ লড়াই নিয়ে পড়তে পড়তে বাংলাদেশী পাঠক হয়তো ভাবছেন উপসংহারে বাংলাদেশ কীভাবে আসতে পারে। নকশিকাঁথা ও ফজলি আমকে দুই বঙ্গের সাধারণ সংস্কৃতি হিসেবেই সকলে জানে। বাংলাদেশকে পিছনে ফেলে এই দুইয়ের জিআই স্বীকৃতি আগেই নিজের করে নিয়েছে ভারত। ওদিকে জামদানির পর গত বছরের ৮ আগস্ট ইলিশের জিআই স্বীকৃতি আবার আদায় করে নিয়েছে বাংলাদেশ। ‘বিল্ট বেটার বাংলাদেশ’ নামে একটি বেসরকারি সংগঠন ডিপিডিটিকে ৭০টি নামের তালিকা সুপারিশ করেছে। ইতোমধ্যে দেশীয় ২৪টি পণ্য প্রক্রিয়াধীন রয়েছে জিআই নিবন্ধনের জন্য। জামদানি ও রসগোল্লার জিআই নিবন্ধনের ফল ঘোষিত হলেও বিতর্ক যেমন শতভাগ নিষ্পন্ন হয়নি, তেমনই আসছে দিনগুলোয় নতুন সব নিবন্ধন নিয়ে বিতর্ক উঠলেও উঠতে পারে প্রতিবেশী দেশ দুটোয়- হয় নিজ দেশের অঞ্চলগুলোর মধ্যে, নতুবা আন্তর্জাতিক পর্যায়ে।

Related Articles