সাংবিধানিক সংশোধনীর মাধ্যমে সমাজের প্রান্তিক জনগোষ্ঠীদের (বাঙালি ও বিহারি) নাগরিকত্বের বৈধতা প্রদানের জন্য পাকিস্তান সরকারকে সুপারিশ করেছে দেশটির জাতীয় পুনঃনিরীক্ষণ কর্মসূচি সম্পর্কিত সংসদীয় বিশেষ কমিটি। ১১ অক্টোবর রাজধানী ইসলামাবাদে কমিটির এক বিশেষ সভা শেষে সর্বসম্মতিক্রমে একাত্তরের সময় রয়ে যাওয়া বা চলে আসা বাঙালি ও বিহারিদের বৈধকরণের এ সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়।
আলোচনার আদ্যোপান্ত ও বৈধতা প্রদানের সিদ্ধান্ত
এ বছরের জানুয়ারিতে জাতীয় সংসদের ডেপুটি স্পিকার মুরতাজা জাভেদ আব্বাসির সভাপতিত্বে ১৮ সদস্য বিশিষ্ট একটি কমিটি গঠিত হয়েছিলো। কমিটির কাজ ছিলো দুটো।
- বাঙালি ও বিহারি জনগোষ্ঠীর নাগরিকত্বের বৈধ মর্যাদা প্রদানের ব্যাপারে আলোচনা
- ব্লকড আটকে থাকা ১,০০,০০০ জাতীয় পরিচয়পত্রের (CNID) বৈধতা (Clearance) প্রদানে সাংবিধানিক ক্ষেত্র প্রস্তুত করা।
গত ১১ অক্টোবর ইসলামাবাদে জাতীয় ডেটাবেজ ও নিবন্ধন কর্তৃপক্ষের সদর দপ্তরে এই সংসদীয় কমিটি কয়েক দফা আলোচনায় বসে। এ আলোচনায়-
- জেলা পর্যায়ভিত্তিক কমিটি সমূহের কাজের অগ্রগতি মূল্যায়ন করা হয়।
- ‘ব্লকড’ জাতীয় পরিচয়পত্র সমূহের বৈধতা দেবার প্রাথমিক সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নের সম্ভাব্যতা যাচাই করা হয়।
বৈঠকে সংসদীয় কমিটি জেলা কমিটি সমূহের কাজের অগ্রগতিতে অসন্তোষ জ্ঞাপন করে দ্রুত কার্যসম্পাদনের আদেশ দেয়। আইনজ্ঞ খালিদ হুসেইন মাগসি, আবদুল কাহার খান ওয়াদান, আমীর জামান, গোলাম আহমেদ বিলৌর, শেখ সালাহউদ্দীন সহ এনএডিআরএ-এর কর্তাব্যক্তিরা উপস্থিত ছিলেন সে আলোচনায়। তারা আটকে থাকা পরিচয়পত্রের বৈধতা দিতে জেলা কমিটির কাজে সহায়তার জন্য সংশ্লিষ্ট প্রাদেশিক সরকারের হস্তক্ষেপ চাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। সেইসাথে ৩০ দিনের মধ্যে জেলা কমিটির তত্ত্বাবধানে ব্লকড পরিচয়পত্রের জটিল কেস সমূহ সমাধা করার সময়সীমা নির্ধারিত হয়। চূড়ান্ত সিদ্ধান্তে সংবিধানে সংশোধনী আনার মাধ্যমে বাঙালি-বিহারিদের নাগরিকত্ব প্রদানের সুপারিশও প্রস্তুত করা হয়।
বৈঠকে মুত্তাহিনে কওমি আন্দোলনের সাংসদ শেখ সালাহউদ্দীন বলেন, একাত্তরের সময় পাকিস্তানকে স্বেচ্ছায় বেছে নেওয়া বাঙালি ও বিহারিরা এতদিন নানা রাষ্ট্রীয় হয়রানির মধ্য দিয়ে গেছেন। তাদের যাবতীয় নাগরিক সুবিধা প্রদানের ব্যাপারে কমিটি ঐক্যমত্যে পৌঁছেছে।
এই বৈঠকের পর পাকিস্তানে বাঙালিদের রাজনৈতিক সংগঠন পাকিস্তান মুসলিম এলায়েন্সের নেতা খাজা সালমান নিজ দল ও মুসলিম লীগের কিছু নেতা-কর্মী সহ রাষ্ট্রপতি মামনুন হুসেইন ও নয়া স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর সাথে সাক্ষাৎ করেন। সেই সাক্ষাতে বাঙালিদের নাগরিকত্ব বিষয়ে দ্বিপাক্ষিক আলোচনা হয়। খাজা সালমান জানান, সরকার বাঙালিদের জন্য যথাসম্ভব উদ্যোগী হবার আশ্বাস দিয়েছে।
বাঙালি-বিহারিদেরকে ‘হ্যাঁ’, রোহিঙ্গা-আফগানদেরকে ‘না’
কাগজে-কলমে কমিটির সুপারিশে ‘প্রান্তিক’ জনগোষ্ঠীর কথা বলা হলেও করাচির অন্যান্য প্রান্তিক সংখ্যালঘু গোষ্ঠী, যেমন- আফগান, রোহিঙ্গারা নাগরিকত্বের এই সুযোগ পাবে না। বিশেষত রোহিঙ্গাদের ব্যাপারে পাকিস্তান বরাবরই সহমর্মী, এমনকি জাতিসংঘ কর্তৃক আখ্যায়িত মিয়ানমারের ‘জাতি নিধন’-এর ঘটনাতেও বিশ্বমঞ্চে বরাবর পাকিস্তান প্রতিবাদী কণ্ঠস্বর। তবে কেন তাদের নাগরিকত্ব প্রদান করা হবে না? জবাবটি দিলেন, NARDA এর নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন কর্মকর্তা।
“নাগরিকত্ব ইস্যুটি খুব স্পর্শকাতর। বাঙালিরা নিজেদের ‘পাকিস্তানি’ ভাবলেও সংবিধান তাদের এলিয়েন বানিয়ে রেখেছে। তাই এর একটা আশু সমাধান আমরা খুঁজছিলাম। আর রোহিঙ্গা-আফগানদের বিষয়টি সম্পূর্ণই আলাদা। বাঙালি-বিহারিদের সাথে তাদের গোলাবেন না যেন।”
কারা এবং কেন ‘অবৈধ’ বাঙালি
অন্তত তিন পুরুষ যাবত পাকিস্তানে বাস করে যাওয়া বাঙালিদেরও বলা হচ্ছে ‘অবৈধ’! কেন? কারণ, খুব অল্প সংখ্যক বাঙালিরই জাতীয় পরিচয়পত্র রয়েছে। আর বর্তমান নাগরিকত্ব আইনের গ্যাঁড়াকলে অধিকাংশ বাঙালিরই পাকিস্তানের বৈধ নাগরিকত্ব নেই। এমনকি জাতীয় পরিচয়পত্র পাওয়া অনেকের পরিচয়পত্র ব্লক করে রাখা হয়েছে। যার ফলে পাকিস্তানের বাঙালি জনগোষ্ঠীর নামের আগে একটি ‘অবৈধ’ ট্যাগ বসেছে অবধারিতভাবেই।
পাকিস্তানে বাঙালিদের বর্তমান সংখ্যা ধরা হয় প্রায় ২৮ লাখের মতো, যাদের সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশই থাকেন সিন্ধ প্রদেশের রাজধানী করাচিতে। প্রচলিত হিসাব অনুযায়ী করাচিতে বাঙালি জনসংখ্যা মোট জনসংখ্যার ৭.৫ ভাগ এবং সংখ্যায় তা প্রায় ১৫-২০ লাখের মতো। এরা আবার ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছেন করাচির ১০৫টি বসতিতে। ওরাঙ্গি টাউন, ইব্রাহিম হায়দারি কলোনি, বিলাল কলোনি, জিয়াউল হক কলোনি, মূসা কলোনি, মাচার কলোনি এবং ল্যারির বাঙালি পাড়ায় বাঙালি বসতি সবচেয়ে বেশি। স্থানীয় বাজারে সবজি, মুদি ও মাছের দোকান চালান তারা সকলে।
পাকিস্তানে এই বাঙালিরা মূলত এসেছিলেন কয়েকটি সময়ে, কয়েকভাবে।
- কেউ এসেছিলেন অখণ্ড পাকিস্তান থাকাকালে, যারা পরবর্তীতে আর ফেরতই যাননি। এদের অনেকেই অবশ্য নাগরিকত্ব পেয়ে পাকিস্তানে প্রতিষ্ঠিতও হয়েছেন বেশ। তাদেরই একজন হলেন পাকিস্তানের কিংবদন্তীতুল্য গায়ক আলমগীর।
- কেউ এসেছিলেন একাত্তরের যুদ্ধের ভয়াবহতা এবং যুদ্ধ পরবর্তী দেশে সম্ভাব্য অনিশ্চিত জীবনের ঝুঁকি থেকে বাঁচতে।
- কেউ এসেছিলেন মুক্তিযুদ্ধের অব্যবহিত পরে। এরা অধিকাংশই মুক্তিযুদ্ধের কট্টর বিরোধিতাকারী ছিলেন।
- আদম ব্যবসায়ীদের পাল্লায় পড়ে মধ্যপ্রাচ্যের নাম করে অনেকে পাচারের শিকার হয়ে আশির দশকে পাকিস্তান চলে আসেন, যাদের ঠাঁই হয়েছিলো করাচির বস্তি এলাকায়।
প্রথম প্রকরণটি ছাড়া অন্যরা যারা এসেছেন পাকিস্তানে, এরা প্রায় কেউই পাকিস্তানের মূলধারায় মিশে যেতে পারেননি এবং গুটিকয়েক ব্যতীত কেউই ন্যাশনাল অ্যালায়েন্স রেজিস্ট্রেশন অথরিটির সনদ নেননি বা নিতে পারেননি আভ্যন্তরীণ দুর্নীতি ও জটিলতার দরুন। এদেরই পরিচয় হয়েছে পাকিস্তানের ‘অবৈধ’ বা ‘আটকে পড়া’ বাঙালি হিসেবে। এদের অনেককে বাংলাদেশে ফেরত পাঠানো হলেও যারা মুক্তিযুদ্ধ বা তার আগে থেকে আছেন; কিংবা অন্তত তিন-চার পুরুষ যাবত পাকিস্তানে থাকছেন, তারা ‘অবৈধ’ তকমা থাকা সত্ত্বেও মনেপ্রাণে পাকিস্তানকেই স্বদেশ মনে করেন।
মূলধারায় এতদিনেও কেন মিশতে পারেনি বাঙালিরা?
দেশবিভাগের সময়ে বর্তমান পাকিস্তানের ভূখণ্ডের বাইরে থেকে যারা এসেছিলেন, তাদের বলা হয় মুহাজির। এই মুহাজিররা পাকিস্তানের জনসংখ্যার প্রায় ৮ ভাগ। রাজস্থানি, কনকানি, মারাঠী, হায়দরাবাদী বংশোদ্ভূত এই মুহাজিরদের বেশিরভাগেরই অবস্থান সিন্ধ প্রদেশে। সেই সিন্ধের রাজধানী করাচিতে অধিকাংশ বাঙালি থাকলেও তাদেরকে মুহাজির গণ্য না করে অনেকটা যেন ভিনগ্রহের বাসিন্দা ভাবা হয়। যার কারণ মূলত-
- মুহাজিররা মূলত উর্দুভাষী, শহুরে মধ্যবিত্ত। আর আটকে পড়া বাঙালিরা উর্দুতে বলতে পারলেও সেটি তাদের প্রথম ভাষা নয়, উপরন্তু তারা বস্তিবাসী নিম্নবিত্ত।
- পাকিস্তান পিপলস পার্টির দুর্গ বলা হয় সিন্ধ প্রদেশকে। সেই পিপলস পার্টির সাথে একাত্তরে বাঙালির বোঝাপড়ার ইতিহাসটা সবারই জানা। সেই থেকে সিন্ধ প্রদেশে ‘মুসলিম লীগ সমর্থক’ বাঙালিদের প্রতি আছে অনেক সিন্ধি জনগণের একটা বড় অংশের নাক সিঁটকানো আচরণ।
- সেই সাথে অখণ্ড পাকিস্তানকাল হতেই পাকিস্তানি বর্ণবাদী সংস্কৃতির সব থেকে বড় ভুক্তভোগী জনগোষ্ঠী বাঙালি।
এখান থেকে এটা স্পষ্ট যে, বাঙালিরা চাইলেও বরং তাদেরকেই মূল ধারায় মিশতে দেওয়া হয়নি।
জাতীয়তা ‘পাকিস্তানি’ বাঙালি!
পাকিস্তানের বাঙালিরা প্রায় সবাই হতে চান পাকিস্তানের নাগরিক। ‘আটকে পড়া’ বা ‘অবৈধ’ তকমা নিয়েও তারা পাকিস্তানকেই লালন করেন বুকে। বাংলাদেশে আটকে পড়া বিহারিদের ভেতর বাংলাদেশের নাগরিকত্ব গ্রহণ নিয়ে দ্বিধাবিভক্তি আছে ভালোরকম। সেই রকম দ্বিধাবিভক্তি আবার পাকিস্তানের এই ‘বাঙালি’দের নেই। নাগরিকত্ব কোনোরকম পেলেই তারা খুশি। এর উদাহরণ হিসেবে বলা যেতে পারে চলমান আদমশুমারির কথাই। সেখানে তথ্য সংগ্রহ ফর্মে মাতৃভাষা হিসেবে ‘বাংলা’ তালিকাভুক্ত নয়, তাই তথ্য সংগ্রাহকেরা বাঙালিদের কাছে এলে বাঙালিরা সকলেই ফর্মের ‘অন্যান্য’ অংশে টিক দেন জোটবদ্ধ সিদ্ধান্তে। সবথেকে গুরুত্বপূর্ণ হলো আদমশুমারিতে তারা তাদের জাতীয়তা হিসেবে উল্লেখ করেন ‘পাকিস্তানি’। পাকিস্তানের জাতীয় দিবস সহ ক্রিকেটের বিজয় উদযাপনেও রাজপথে সাদা-সবুজ গালে মেখে উর্দুতে-বাংলায় জয়োল্লাস করেন এই বাঙালিরা।
বাঙালিদের নাগরিকত্ব দেবার সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে করাচিতে আন্দোলন
সিন্ধি রাজনৈতিক দলগুলো আবার শুরু থেকেই বিরোধিতা করে আসছে এ ধরনের উদ্যোগের। গত বছরের ডিসেম্বরেও করাচিতে প্রেস ক্লাব অভিমুখে বিক্ষোভ র্যালি বের করেছিলো ‘জয় সিন্ধ মাহাজ’ নামে একটি দল।
দলটির প্রধান আবদুল খালিক জুনেজো বলেন,
“দেশের ভেতরে ও বাইরে ব্যাপক হারে স্থানান্তর-অভিবাসনের দ্বারা সিন্ধি জনগণকে যেন নিজ প্রদেশেই সংখ্যালঘু করে দেওয়া হচ্ছে।”
বিশেষত বাঙালিদের বৈধকরণের বিরুদ্ধে শক্ত অবস্থান নিয়ে তিনি বলেন,
“সরকারের উচিত এদের বাংলাদেশে পাঠিয়ে দেওয়া এবং তার আগে নিশ্চিত করা যে, তারা যেন ভোট দিতে বা রাষ্ট্রীয় অন্যান্য অধিকার ভোগ করতে না পারে।”
ফিচার ইমেজ: geo.tv