সম্প্রতি ইন্দোনেশিয়াতে বেশ কিছু সন্ত্রাসী হামলা সংঘটিত হচ্ছে যার পেছনে আইএসের সম্পৃক্ততা রয়েছে বলে দাবি করা হচ্ছে। বিশ্বের সবচেয়ে বড় মুসলিম প্রধান দেশ ইন্দোনেশিয়া দক্ষিণ এশিয়ার কয়েকটি দেশের মধ্যে একটি, যারা আইএসের সাথে যুক্ত কিছু সংগঠনের হামলার শিকার হচ্ছে। ২০১৬ সালের জানুয়ারিতে রাজধানী জাকার্তায় কয়েকটি ধারাবাহিক বোমা হামলা ও গোলাগুলিতে ৪ জন সাধারণ ব্যক্তি ও ৪ হামলাকারী নিহত হয়। এটিই ছিল আইএসের সম্পৃক্ততায় দেশটিতে হওয়া প্রথম হামলা। হামলাকারীদেরকে পরবর্তীতে আইএসের কাছে আনুগত্য প্রকাশ করা ইন্দোনেশিয়ার সংগঠন জিমাহ আনসারুত দৌলার সদস্য হিসেবে চিহ্নিত করা হয়।
সম্প্রতি আবারও পুলিশ ও গির্জায় হামলার মাধ্যমে নিজেদের উপস্থিতি জানান দিচ্ছে তারা। তবে কীভাবে তারা ইন্দোনেশিয়ায় প্রভাব বিস্তার করছে? হামলা চালাতেই বা কাদেরকে ব্যবহার করছে? চলুন এ বিষয়ে জেনে নেওয়া যাক।
সাম্প্রতিক কিছু হামলার ঘটনা
১৬ মে বুধবার সুমাত্রার রিয়াউ পুলিশ সদরদপ্তরে সামুরাই তলোয়ার নিয়ে কয়েকজন পুলিশের উপর হামলা চালালে পুলিশের গুলিতে ৪ জন হামলাকারী নিহত হয়। এ ঘটনায় একজন পুলিশ সদস্য নিহত ও দুজন আহত হয়। হামলাকারীদের শনাক্ত করতে না পারলেও পুলিশের ধারণা তারা আইএসের সাথে সম্পৃক্ত জিমাহ আনসারুত দৌলা দলটির সদস্য। এছাড়াও দেশটিতে বিগত কয়েকদিনে ৩টি ঘটনায় বেশকিছু মানুষের প্রাণহানি ঘটেছে।
কারাগারে পুলিশ হত্যা
গত ৯ মে দেশটির একটি কারাগারে বন্দিরা দাঙ্গা শুরু করে এবং অস্ত্র লুট করে, তারা ৫ জন পুলিশ অফিসারকে হত্যা করে ও একজন অফিসারকে জিম্মি করে। আইএস স্বীকার করে যে তাদের দলের সদস্যরা এই সহিংসতার সাথে জড়িত রয়েছে।
ঘটনার কিছুদিন আগে পুলিশের সদরদপ্তর ও পুলিশ স্টেশনে হামলার পরিকল্পনাকারী ৪ জন ব্যক্তিকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। ৮ মে, মঙ্গলবার রাতে নিজ পরিবার থেকে আসা খাবার দিতে দেরি হওয়ায় একজন কয়েদী দেয়ালে সজোরে আঘাত করে প্রতিবাদ করতে থাকে। এসময় অন্যান্য কয়েদীরা অস্ত্রাগারে ঢুকে অস্ত্র লুট করে। তারা সন্ত্রাস মোকাবেলাকারী বিশেষ পুলিশ সদস্যদের সাথে গুলি বিনিময় করে। এতে ৫ জন পুলিশ ও একজন কয়েদী নিহত হয়। তবে কয়েদীরা একজন পুলিশকে জিম্মি হিসেবে আটক করে। পরদিন সেই জিম্মিকে উদ্ধার করতে সক্ষম হয় ইন্দোনেশিয়ার পুলিশ। বিদ্রোহীরা সকলে আত্মসমর্পণ করে। সংবাদ সংস্থা আমাক থেকে জানানো হয়, তাদের সদস্যরা এই বিদ্রোহে অংশগ্রহণ করেছিল।
গির্জায় আত্মঘাতী বোমা হামলা
১৩ মে ইন্দোনেশিয়ার দ্বিতীয় বৃহত্তম শহর সুরাবায়াতে পরপর ৩টি গির্জায় আত্মঘাতী বোমা হামলা হয়। এতে ১১ জন নিহত ও প্রায় ৪০ জনেরও বেশি মানুষ আহত হয়। ২০০৫ সালের পর এটিই দেশটির সবচেয়ে প্রাণঘাতী ঘটনা। ইন্দোনেশিয়ার প্রায় ৯০% মানুষ সেখানে বেশ কিছু খ্রিস্টান, হিন্দু ও বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীর মানুষ রয়েছে।
প্রথম হামলাটি স্থানীয় সময় সকাল ৭.৩০টায় সান্তা মারিয়া ক্যাথলিক চার্চে হয়। দ্বিতীয় হামলাটি হয় আরেকটি গির্জার কার পার্কিংয়ে। প্রত্যক্ষদর্শীদের মতে, তৃতীয় হামলাটি একজন অথবা দুজন নেকাব পরিহিত মহিলার দ্বারা সংঘটিত হয়।
প্রকৃতপক্ষে একই পরিবারের সদস্যরাই ৩টি গির্জায় এই হামলা চালিয়েছে। ছয় সদস্যের সে পরিবারের দুই ছেলে মোটরবাইক চালিয়ে সকাল ৭.৩০টায় সান্তা মারিয়া ক্যাথলিক চার্চে আত্মঘাতী হামলা চালায়। তাদের বাবা ৭.৩৫টায় সুরাবায়া সেন্টার পেন্টাকোস্টাল চার্চে বোমাসহ একটি গাড়ি নিয়ে প্রবেশ করে এবং হামলা চালায়। এর কিছুক্ষণ পরেই অপর হামলাটি চালায় মা তার দুই কন্যা শিশুসন্তানসহ দিপোনেগোরো ইন্দোনেশিয়ান খ্রিস্টান চার্চে।
ইন্দোনেশিয়ার গোয়েন্দা সংস্থার পক্ষ থেকে জানানো হয়, এর পেছনেও তারা জিমাহ আনসারুত দৌলা দলটিকে সন্দেহ করছে। এর আগে কারাগারে ঘটে যাওয়া পুলিশের উপর হামলার সাথে এ ঘটনার যোগসূত্র থাকেতে পারে বলেও জানানো হয়।
এই হামলাটিই ইন্দোনেশিয়ায় প্রথম আত্মঘাতী নারীর হামলা যা সফল হয়েছে। তবে হামলার সময় শিশুদের ব্যবহার করাটাও দেশটিতে নতুন। বিশ্বজুড়ে শিশুদের এ ধরনের আত্মঘাতী হামলায় ব্যবহারের দৃষ্টান্ত দেখা গেছে। তবে বাবা-মা তাদের নিজের সন্তানকে এ ধরনের কাজে ব্যবহার করছে, এই দৃষ্টান্ত বিরল।
সুরাবায়া পুলিশ সদরদপ্তরে হামলা
গির্জায় হামলার পরের দিন অর্থাৎ ১৪ মে, সোমবার অপর একটি পরিবার মোটরবাইকে করে সুরাবায়া পুলিশ সদরদপ্তরে হামলা চালায়। এতে ৬ জন সাধারণ মানুষ ও দুজন পুলিশ আহত হয়। তবে আত্মঘাতী হামলার পরেও পরিবারটির ৮ বছর বয়সী কন্যা সন্তানটি বেঁচে যায়।
এছাড়াও রবিবার রাতে একটি অ্যাপার্টমেন্টে বোমা বিস্ফোরণের ঘটনায় একটি পরিবারের তিনজন সদস্য নিহত হয়। পুলিশের মতে, পরিবারটি কোথাও হামলার পরিকল্পনা করছিল এবং অন্যান্য হামলার সাথে তাদের যোগসূত্র থাকতে পারে।
জিমাহ আনসারুত দৌলা (জেএডি) সংগঠনটি আসলে কী?
এটি আইএসের আনুগত্য স্বীকার করা ইন্দোনেশিয়ার স্থানীয় সন্ত্রাসী দলগুলোর একটি নেটওয়ার্ক। ২০১৫ সালে এটি কয়েকটি সন্ত্রাসী দলের সমন্বয়ের ফলে সৃষ্টি হয়, যা আমান আব্দুর-রহমান নামে একজন প্রভাবশালী ব্যক্তির দ্বারা পরিচালিত। তিনি নয় বছরের কারাদণ্ড ভোগ করলেও তার অনুসারীদের নিয়ন্ত্রণ, নতুন সদস্য নিয়োগ ও আইএস প্রোপাগান্ডা ছড়াতে সক্ষম বলে মনে করা হয়। সংগঠনটি ইন্দোনেশিয়া খিলাফত ব্যবস্থা প্রচলনের জন্য প্রচারণা চালায়। তাদের মতে, এর জন্য সহিংসতার আশ্রয় নেওয়া ন্যায্য। ইন্দোনেশিয়ার ন্যাশনাল কাউন্টার টেররিজম এজেন্সির মতে, বর্তমানে এটি সেদেশের সবচেয়ে বিপজ্জনক সংগঠন।
আইএস কীভাবে ইন্দোনেশিয়ায় প্রভাব বিস্তার করছে?
২০১৬ সালে জাকার্তায় হামলার পরে আইএস দেশটিতে প্রথমে প্রোপাগান্ডা ছড়ানোর কাজ শুরু করে। সরকার ও পুলিশকে হুমকি দিতে এবং এর সমর্থনকারীদের তাগিদ দিতে তারা ভিডিওতে ইন্দোনেশীয়দের ব্যবহার করে। ২০১৭ সালে দেশটির সেনাপ্রধান জানান, আইএস প্রায় সেদেশের প্রতিটি রাজ্যেই পৌঁছে গেছে।
বর্তমানের উৎসাহী সদস্যরা হয় ইন্টারনেট ও জিহাদি সাইট থেকে তাদের দীক্ষা নিয়েছে অথবা তারা আগের কোনো আন্দোলনের সাথে সমর্থনকারী। যদিও আগের সেসব আন্দোলনে যোগদানকারীদের সাথে তাদের সেরকম কোনো যোগাযোগ নেই। তারা নিজেরাই ছোট ছোট দল গঠন করে সহিংসতার কাজ চালাতো।
দেশটির প্রায় ৩০টি দল সেখানে খিলাফত প্রতিষ্ঠা করার উদ্দেশ্যে আইএসের প্রতি আনুগত্য স্বীকার করে। ধারণা করা হয়, শত শত মানুষ ইরাক ও সিরিয়াতে আইএসের হয়ে যুদ্ধ করতে চলে গেছে। এরকম অনেক দলের প্রধান নেতাকে হত্যা অথবা আটক করা হলেও আইএসের প্রভাব চলমান রয়েছে। দেশ-বিদেশের নেতাদের প্রভাব ও অনুপ্রেরণায় তারা বর্তমানে দেশটির জন্য বড় আকারের হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে।
জিমাহ আনসারুত দৌলার নেতা আমান আবদুর-রহমান দেশে বিগত ১২ বছর ধরে আটক থাকার পরেও বেশ প্রভাবশালী। অনুগতদের সহিংস কর্মকাণ্ডে উৎসাহিত করার জন্য তিনি বিচারাধীন রয়েছেন। তাকে যেখানে আটক করে রাখা হয়েছে সেটিকেও বিশ্লেষকগণ আইএসের নতুন সদস্য তৈরির ক্ষেত্র হিসেবে বিবেচনা করছেন।
হামলায় কেন শিশুদের ব্যবহার করা হচ্ছে?
হামলায় শিশুদের ব্যবহার করার প্রধান কারণ হচ্ছে, তাদেরকে সন্দেহভাজন বলে মনে করা হয় না। সন্ত্রাসীদের কাছে এটি একটি বড় ধরনের সুবিধা যে নিরাপত্তাকর্মীরা সাধারণত শিশুদের কাছে বিস্ফোরক জাতীয় দ্রব্য আশা করে না এবং তাদের ক্ষেত্রে শিথিলতা দেখায়।
অধিকাংশ ক্ষেত্রেই নিরাপত্তাকর্মীরা পুরুষদের কাছে বোমা বা বিস্ফোরকের অনুসন্ধান করে থাকে। প্রথম দিকে এ ধরনের বোমা হামলার জন্য পুরুষদেরই ব্যব্যহার করা হতো। তবে তালেবান বা আইএস পরবর্তীতে আত্মঘাতী হিসেবে নারীদেরও ব্যবহার করা শুরু করে কেননা তাদেরকে কম সন্দেহ করা হয়।
বর্তমানে হামলার ক্ষেত্রে নারীরাও সন্দেহভাজনে পরিণত হওয়ায় পরবর্তী ধাপ হিসেবে শিশুদের ব্যবহার করছে তারা। ইন্দোনেশিয়ায় নারী ও শিশুদের ব্যবহার করে আত্মঘাতী হামলা এই প্রথম। নিরাপত্তাকর্মীদের দুর্বল দিকের সুযোগ ভালোভাবেই নিচ্ছে এই দলগুলো। তবে এখন থেকে শিশুদেরও সন্দেহের তালিকায় রাখা শুরু করবে নিরাপত্তাকর্মীরা।
ইন্দোনেশিয়ায় হওয়া আইএসের আগের হামলাগুলোয় অপেশাদারিত্বের ছাপ থাকলেও সাম্প্রতিক ঘটনাগুলো বেশ গুরুতর। তারা ধীরে ধীরে সংঘবদ্ধ ও শক্তিশালী হয়ে উঠছে। বিশেষ করে হামলায় নিজের শিশুদের ব্যবহার বেশ দুশ্চিন্তার উদ্রেককারী ঘটনা। এরকম হামলা ভবিষ্যতে আরও ঘটে পারে। তাই দেশটির নিরাপত্তাকর্মী, পুলিশ ও সরকারের তৎপর হওয়া বেশ প্রয়োজন বলেই মতামত বিশেষজ্ঞদের।
Featured Image Source: Twitter