গীতিকার মাজহারুল আনোয়ারের লেখা জনপ্রিয় গান ‘চোখ যে মনের কথা বলে’ গানটি কার না শোনা? কিন্তু প্রশ্ন হলো চোখের ভাষা দেখে আসলেই কী মনের কথা বোঝা যায়। তবে গীতিকারের ভাষায় চোখের ভাষা বুঝতে হলে চোখের মতো চোখ প্রয়োজন। চোখ নিয়ে এতটা আলোচনার মূল উদ্দেশ্য হলো, আজকের লেখায় চোখের বিভিন্ন ভঙ্গী থেকে মনের কথা কতোটা বোঝা যায় তা তুলে ধরার চেষ্টা করা হবে।
তবে চোখের ভাষা বা অভিব্যক্তির সাথে সাথে বয়সের ব্যাপারটাও মাথায় রাখতে হবে। কেননা ছোটবেলায় বাচ্চাদের মনের অবস্থা চোখ দেখে খুব সহজেই বোঝা যায়। তারা কী দেখে খুশি হয়? কী না পেলে কষ্ট পায়? কখন ক্ষুধা লাগে? কখন শরীর খারাপ হয়? এসব খুব সহজেই বাড়ির লোকে বুঝতে পারে। কেননা শিশু অবস্থায় বাচ্চাদের মন অনেকটাই সরল হয়। তারা কিছু লুকোতে চায় না। অন্যদিকে একজন প্রাপ্তবয়স্ক পুরুষ বা মহিলার অঙ্গভঙ্গি থাকে অনেকটাই নিয়ন্ত্রিত। সমাজের অনেক গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার নিয়ে তারা সবসময় শঙ্কিত থাকে। তাই চোখের ভাষার উপর যদি কাউকে বিচার করতে হয় তাহলে অবশ্যই মানুষটির লিঙ্গ এবং বয়স মাথায় রাখা উচিত। এবার আমরা দেখব চোখের বিভিন্ন অভিব্যক্তি থেকে কী কী বোঝা যেতে পারে।
ডানদিকে দেখা, দৃষ্টি ঊর্ধ্বগামী
মস্তিষ্কের ডানদিক হলো কল্পনাপ্রবণ। মানুষ যখন কল্পনার আশ্রয় নেয় সেই মুহুর্তে চোখ ডানদিকে সরে যায়। যেমন কোনো বাচ্চাকে যদি কোনো গল্প শোনানো হয় তখন বক্তার ডান চোখ স্বাভাবিক নিয়মে ডানদিকে উপরে দেখবে। আবার মিথ্যে কথা বলার সময়ও চোখ ডানদিকে সরে যেতে পারে। তাই কেউ যখন ডানদিকে ঊর্ধ্বগামী দৃষ্টিতে তাকায় তাহলে বুঝতে হবে সে লোক নিতান্তই মিথ্যে কথা বলছে।
ডানদিকে দেখা, দৃষ্টি নিম্নগামী
কোনো ব্যক্তি যদি কোনো বিষয়ে আত্মবিশ্বাসী না হয় সেক্ষেত্রে প্রতিনিয়ত নিজের মনে প্রশ্ন করতে থাকে। তাই বক্তা যদি ডানদিকে দৃষ্টি নিম্নগামী অবস্থায় থাকেন তাহলে বুঝতে হবে তার মনে কোনো বিষয়ে সন্দেহ রয়েছে, যার কারণে তিনি পুরো ব্যাপারটা খুলে বলতে পারছেন না।
বামদিকে দেখা, দৃষ্টি ঊর্ধবগামী
তবে বক্তা যদি ডানদিকে না তাকিয়ে বামদিকে তাকায় তাহলে কিন্তু পুরো ব্যাপারটি ভিন্ন। পুরনো কোনো ঘটনা মনে করতে গিয়ে অথবা অতীতের কোনো ঘটনায় লুকায়িত সত্যকে উদঘাটন করতে অনেক সময় চোখ বামদিকে সরে আসে আর দৃষ্টি থাকে ঊর্ধ্বগামী। তবে এই দৃষ্টিভঙ্গি কতটুকু নিরপেক্ষ বা ভালোর দিকে সেটি বিচারসাপেক্ষ।
বামদিকে দেখা, দৃষ্টি নিম্নগামী
কথা বলার সময় চোখ বামদিকে সরে গেলে এবং দৃষ্টি নিম্নগামী হলে বুঝতে হবে বক্তা নিজের মনে কথা বলার চেষ্টা করছেন, আর শ্রোতাকে তার কথিত বাক্য যথেষ্ট পরিমাণে যুক্তিগ্রাহ্য করে গড়ে তোলার চেষ্টা করছেন।
কথা বলার সময় সরাসরি চোখে তাকানো
চোখে চোখে তাকিয়ে কথা বললেই ভাবা হয় সত্য কথা বলা হচ্ছে। সেই আদিকাল হতে এই ভ্রান্ত ধারণা আমাদের মনে চলে আসছে। সেই কারণে কোনো প্রেমিক-প্রেমিকা যখন প্রেমের কথা বলতে যান তখন দুজনেরই প্রথম চাওয়া হয় চোখে চোখে চোখ রেখে প্রেমের কথা বলার। কিন্তু মানুষ যখন কোনো ব্যাপারে সচেষ্ট হয়ে পড়ে তখন খুব সহজেই সেই ব্যাপারগুলো নিজের আয়ত্তে এনে তার খারাপ ব্যবহার করতে পারে। আমরা এখানে আলোচনা করছি শুধুমাত্র অবচেতন মনে যে ধরনের শরীরি ভঙ্গিগুলো দেখা যায় তার ব্যাপারে। কথা বলার সময় যেহেতু মানুষের সচেতন মনে সরাসরি চোখের দিকে তাকানো ব্যাপারটি মাথায় থাকে, তাই বর্তমানে এই ব্যাপারটির তেমন বাস্তবিক সত্যতা নেই।
কথা শোনার সময় চোখের দিকে তাকানো
তবে কথা শোনার সময় যদি কেউ সরাসরি চোখের দিকে তাকায় সেক্ষেত্রে পুরো ব্যাপারটি ভিন্ন। কেননা শোনার সময় মানুষের মনোযোগ যদি কেন্দ্রীভূত না থাকে তবে চোখ এদিক ওদিক তাকাতে থাকে। আর সেই বিচারে শ্রোতা যদি কিছু শোনার সময় বক্তার চোখের দিকে তাকিয়ে থাকেন তাহলে বুঝতে হবে শ্রোতা খুব আগ্রহের সাথে শুনছেন।
বড় বড় চোখে তাকানো
বড় বড় চোখে তাকানো খুব পরিচিত একটি বাক্য। আমাদের প্রাত্যহিক জীবনে, বন্ধুদের সাথে আড্ডায়, এই প্রবাদ আমরা অনেক সময় ব্যবহার করে থাকি। এই বাক্যের খুব ভালো ব্যবহার চোখে পড়ে যখন কাউকে দেখে খুব ভালো লাগে বা অস্বাভাবিক কিছু চোখে পড়ে অথবা কোনো কিছুতে খুব হতভম্ব হয়ে পড়ি সেক্ষেত্রে। সাধারণত মেয়েদের ক্ষেত্রে এমনটা বেশি দেখা যায়।
চোখ কচলানো
অনেক সময় শ্রোতা বক্তার কথা শুনতে শুনতে হাত দিয়ে এক চোখ বা দু’চোখ কচলাতে থাকে। যদি এই চোখ কচলানো ইচ্ছাকৃত হয়ে থাকে তবে বুঝতে হবে শ্রোতা বক্তার কথা মোটেই বিশ্বাস করে উঠতে পারছেন না অথবা তার কথা শুনে ভীষণভাবে হতাশ হয়েছেন। অনেক সময় খুব বেশি পরিমাণ বিরক্ত হলেও এমনটা হয়ে থাকে।
ঘন ঘন চোখের পাতা পড়া
বিশেষজ্ঞদের মতে, একজন পূর্ণ বয়স্ক স্বাভাবিক মানুষের চোখের পাতা পড়ে সাধারণত মিনিটে ৬ থেকে ২০ বার। তবে বিশেষ কোনো পরিস্থিতিতে অথবা খুব বেশি উত্তেজিত হয়ে পড়লে চোখের পাতা এর চাইতেও বেশিবার পড়তে পারে। অনেকেই অত্যাধিক চোখের পাতা পড়াকে মিথ্যা কথা বলার সাথে তুলনা করেন। কিন্তু বাস্তবে ঘন ঘন চোখের পাতা পড়ার সাথে মিথ্যা বলার কোনো সম্পর্ক নেই বললেই চলে।
চোখের পাতা না পড়া
চোখের পাতা না পড়ার আসলে অনেক ধরনের মানে হয়ে থাকে। পরিবেশ ও পরিস্থিতির বিচারে ভিন্ন ভিন্ন সময় ভিন্ন ভিন্ন অর্থ দাঁড়ায়। যদি শ্রোতার চোখ বক্তার চোখের দিকে কেন্দ্রীভূত না হয় এবং চোখের পাতা খোলায় থাকে তবে বুঝতে হবে শ্রোতা ভীষণভাবে বিরক্ত হচ্ছেন। কিন্তু শ্রোতার চোখ যদি বক্তার চোখের দিকে নিবিষ্ট থাকে সেক্ষেত্রে বুঝতে হবে শ্রোতা খুব মনোযোগ দিয়েই শুনছেন। তবে চোখের পাতা না পড়াকে অনেক সময় খারাপ দৃষ্টিকোন থেকেও দেখা হয়ে থাকে। এই ধরনের পরিস্থিতি অনেক সময় শত্রুতার চিহ্নও বহন করে।
বড় বিচিত্র এই মানব সমাজ। প্রতিনিয়ত আমরা অন্যের উপর নির্ভরশীল। নিজেদের উপর অন্যের ধারণা বোঝার চেষ্টায় আমরা সর্বদাই সচেষ্ট। একটি ভালো সম্পর্ক যেমন গড়ে উঠতে পারে পরস্পর পরস্পরকে ভালোভাবে বুঝে ওঠার মাধ্যমে তেমনি এর অভাবে সম্পর্কে চিড়ও ধরতে পারে। চোখের ভাষা বুঝে এর সঠিক ব্যবহার নিশ্চিত করা উচিত। শ্রোতার চোখের অভিব্যক্তি বুঝে বক্তা যেমন নিজের অবস্থান জানতে পারে তেমনি বক্তার দৃষ্টিভঙ্গির উপর নির্ভর করতে পারে শ্রোতার অবস্থান।
ফিচার ইমেজ- youtube.com