হাসপাতালে মেডিসিন ওয়ার্ডে একটি দৃশ্য অতিমাত্রায় পরিচিত। অধিকাংশ সময় ডাক্তারদের গলায় টিউবের মতো পেঁচানো হাত দেড়েক লম্বা কি যেন একটা ঝুলতে থাকে। ঠিক যেন শিবঠাকুরের সর্পরজ্জু। সেই টিউবের একমাথা খানিকটা গোলমতো বস্তু। আরেক মাথা আবার দুই ভাগে ভাগ হয়ে গিয়েছে। মাঝে মাঝে দেখা যায়, ডাক্তার সাহেব সেই দুই মাথা দুই কানে পুরে দিয়ে গোলমতো জিনিসটা নানা কসরত করে বুকে পিঠে এবং পেটে লাগিয়ে গভীর মনোযোগ সহকারে কিছু শোনার চেষ্টা করছেন। কখনো হাসিমুখে বলছেন, ‘এই ছেলে, বলো তো তিন…তিন…তিন…” অথবা “বাবু, জোরে জোরে শ্বাস ছাড়ো তো দেখি”।
এতসব কাণ্ড ঐ ধুকপুকুনির জন্য। হৃৎপিণ্ড, ফুসফুস আর পাকস্থলী থেকে অবিরাম নানা রকম শব্দ ভেসে আসছে। কোনোটা বা ধ্বক ধ্বক, কোনোটা বাঁশির মতো সুরেলা, কোনোটা গুড়গুড়; যেন মেঘের মৃদু গম্ভীর আওয়াজ। এসব শব্দের মাঝে লুকিয়ে আছে হাজার রকম তথ্য। কোনোটি বলছে, “সবকিছু ঠিক আছে!” আবার কোনোটি ‘কোথাও একটা গড়বড় নিশ্চয় হচ্ছে’। ডাক্তাররা চোখ কান বুজে এই শব্দ শুনে বুঝে ফেলেন, কোথায় কি গণ্ডগোল। আর এই কাজ যে যন্ত্রটি ছাড়া প্রায় অসম্ভব, তার নাম স্টেথোস্কোপ।
কিন্তু একসময় তো এই স্টেথোস্কোপ ছিল না। তাহলে তখন কী উপায় ছিলো? সে বড় বিষম যন্ত্রণার ব্যাপার ছিল। ডাক্তার মশাইকে সরাসরি রোগীর বুকে কান পাততে হতো। একে বলা হতো Immediate Auscultation বা তাৎক্ষণিক শ্রবণ। এটি প্রায়শই একটি অস্বস্তিকর পরিস্থিতির জন্ম দিত। দেখা গেল এক পালোয়ান গোছের এক লোক এসেছেন তার সদ্য বিবাহিত স্ত্রীটিকে নিয়ে। স্ত্রীর শ্বাসকষ্টের ভীষণ সমস্যা। ডাক্তার বুঝলেন, সমস্যা ফুসফুসে। ঠিক কী সমস্যা, তা নিশ্চিত হওয়ার জন্য ফুসফুস এর শব্দ শুনতে হবে। তাহলে নিশ্চিত হওয়া যাবে ব্যাপারটা। আর ফুসফুসের অবস্থান বুক বরাবর। এসব ক্ষেত্রে রোগীর লোকজন অতিমাত্রায় রক্ষণশীল আচরণ করে। বুঝতে পারছেন, ডাক্তারদের কী রকম অসুবিধায় পড়তে হতো। তাছাড়া অতিরিক্ত মোটা লোকজনের ক্ষেত্রে ঠিকঠাক শব্দ শোনা যেত না।
ডাক্তার লেনেক (René-Théophile-Hyacinthe Laennec)-ও ঠিক এই অসুবিধায় পড়তেন। ১৮১৬ সালের কথা, তিনি তখন প্যারিসের ন্যাকার হাসপাতালের চীফ ফিজিশিয়ান হিসেবে কর্তব্যরত। একদিন তার কাছে এক যুবতী এলেন। হৃদরোগের সমস্যা। ধনী পরিবারের মেয়ে। স্বাস্থ্যের কমতি নেই। ডাক্তার পড়লেন ভারী বিপদে। একে তো তরুণী, তার উপর অতিরিক্ত স্বাস্থ্যবতী। অস্বস্তিকর অবস্থায় পড়লেন ডাক্তার লেনেক। কিন্তু এক্ষেত্রে হৃৎপিণ্ডের আওয়াজ শোনা জরুরি।
আচমকা তার কয়েকদিন আগের একটি স্মৃতি মনে পড়লো। একটি মাঠের পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় তিনি কয়েকটি ছেলেকে এক অদ্ভুত খেলা খেলতে দেখেছিলেন। একটি লম্বা ফাঁপা কাঠের একপ্রান্তে একজন কিশোর একটি পিন দিয়ে আঁচড় দিচ্ছে, অন্যপ্রান্তে তা কানে ঠেকিয়ে আরেকজন শোনার চেষ্টা করছে। ডাক্তার লেনেকের পদার্থবিজ্ঞানের সূত্র মনে পড়লো, কঠিন মাধ্যমে শব্দ দ্রুত পরিবাহিত হয়। যেই ভাবা সেই কাজ। পাশে একটি মোটা কাগজের তৈরি নোটপ্যাড ছিলো। তিনি দ্রুত তুলে নিলেন সেটি। তারপর গোল করে পাকিয়ে চোঙা তৈরি করে রোগিনীর বুকের উপর যেখানে হৃৎপিন্ড, যেখানে ধরলেন সেটি। আরেকপ্রান্ত কানে লাগালেন।
মুহুর্তে ডাক্তারের মুখে হাসি ফুটলো। সরাসরি কান পেতে শুনলে যেমন শব্দ পাওয়া যায়, তার চেয়ে অনেক স্পষ্ট আর নিখুঁত শব্দ শুনতে পেলেন তিনি। রোগ নির্ণয় হলো। রোগিনী বিদায় নিতেই ডাক্তার লেনেক ছুটলেন হাসপাতালের ওয়ার্ডে। একে একে সব রোগীকে তার বানানো চোঙা দিয়ে পরীক্ষা করে দেখতে লাগলেন। আশাতীত ভালো ফল পেলেন তিনি। এই পদ্ধতির নাম দেওয়া হয় Mediate Auscultation।
কিন্তু অন্যান্য প্রথাগত ধারণায় বিশ্বাসী ডাক্তারেরা ব্যাপারটিকে ভালোভাবে মেনে নিতে পারেনি। তারা এটিকে হাস্যকর ও অনির্ভরযোগ্য পদ্ধতি হিসেবে আখ্যা দেয়। ডাক্তার লেনেক দমে যাওয়ার পাত্র নন। ধীরে ধীরে এটি তার নেশা হয়ে উঠলো। হাজার হাজার রোগীকে পর্যবেক্ষণ করে তার ফলাফল লিপিবদ্ধ করতে থাকলেন। বিভিন্ন প্রকার শব্দের বৈশিষ্ট্য, কোন রোগে তাদের পাওয়া যায় এসব নিয়ে তিনি দীর্ঘ গবেষণা করেন। আজকে আধুনিক চিকিৎসা বিজ্ঞানে ব্যবহৃত অনেক টার্ম যেমন Rhonchi, Crepitance, Rales, Egophony প্রভৃতি ডাক্তার লেনেক দু’শো বছর আগে ব্যাখা করে গেছেন।
কাজের সুবিধার্তে তিনি পরে কাঠ দিয়ে একটি ফাঁপা নল তৈরি করে নিলেন। নতুন যন্ত্রটির নাম দিলেন স্টেথোস্কোপ। দুটি গ্রিক শব্দ, স্টেথো যার মানে বুক এবং স্কোপিন যার অর্থ পরীক্ষা করা, থেকে এসেছে স্টেথোস্কোপ শব্দটি।
অবশ্য সেদিনের স্টেথোস্কোপকে আজকের রূপ পেতে অপেক্ষা করতে হয়েছে দীর্ঘদিন। পাড়ি দিতে হয়েছে অনেক পথ। ১৮৪০ সালে গোল্ডিং বার্ড কাঠের পরিবর্তে নমনীয় প্লাস্টিকের ব্যবহার করেন। তবে তখনও তার ব্যবহার এক কানেই সীমাবদ্ধ ছিলো। দুই কানে ব্যবহারযোগ্য স্টেথোস্কোপ আসে আরেক আইরিশ ডাক্তার আর্থার লিয়ার্ডের হাত ধরে ১৮৫১ সালে। এর এক বছর পরে জর্জ ফিলিপ ক্যামান এই মডেলটিকে আরো উন্নত করেন। সেই হিসেবে বলতে গেলে আজকে আমরা যে মডেলটি ব্যবহার করি তা একশ পঁয়ষট্টি বছরের পুরনো।
১৮৬০ সালে হার্ভার্ড মেডিকেল স্কুলের শিক্ষক ডেভিড লিটম্যান একটি হালকা এবং উন্নতমানের স্টেথোস্কোপ তৈরি করেন। এটি ছিলো আরো অধিক হালকা এবং তুলনামূলক নিখুঁত শব্দ পরিবহন করতো। এখন পর্যন্ত তুমুল জনপ্রিয় এই স্টেথোস্কোপ। আমাদের দেশের প্রতিটি মেডিকেল স্টুডেন্ট কিংবা ডাক্তারের একটি শখের জিনিস এই লিটম্যান স্টেথোস্কোপ। সময় এগিয়েছে। সময়ের সাথে স্টেথোস্কোপও এগিয়েছে। বর্তমানে বিভিন্ন ধরনের স্টেথোস্কোপ পাওয়া যায়। এদের মধ্যে রয়েছে-
- অ্যাকুইস্টিক স্টেথোস্কোপ (Acoustic Stethoscope): আমাদের দেশের ডাক্তারেরা সচরাচর এ ধরনের স্টেথোস্কোপ ব্যবহার করে থাকেন। চেস্ট-পিসের মাধ্যমে গৃহীত শব্দ ফাঁপা টিউবের মাধ্যমে ডাক্তারের কানে পৌঁছে দেয় এরা।
- ইলেকট্রনিক স্টেথোস্কোপ (Electronic Stethoscope): অ্যাকুইস্টিক স্টেথোস্কোপে যে শব্দ পাওয়া যায় তা বেশ ক্ষীণ হয়ে থাকে। এ অসুবিধে থেকে বাঁচার জন্য ইলেকট্রনিক স্টেথোস্কোপের উদ্ভব। এই শ্রেণির স্টেথোস্কোপ শব্দ তরঙ্গকে প্রথমে বৈদ্যুতিক শক্তিতে রূপান্তরিত করে। তারপর সেটিকে বর্ধিত করে জোরালো ও পরিষ্কার শব্দে রূপান্তরিত করে।
- নয়েজ রিডাকশন স্টেথোস্কোপ (Noise Reduction Stethoscope): এ ধরনের স্টেথোস্কোপ চারপাশের অপ্রয়োজনীয় শব্দকে আলাদা করে কেবল কাংখিত শব্দটিকে শুনতে সাহায্য করে।
- রেকর্ডিং স্টেথোস্কোপ (Recording Stethoscope): নাম থেকেই এদের কাজ সুস্পষ্ট। এগুলোতে শ্রুত শব্দকে রেকর্ড করে রাখার ব্যবস্থা আছে। ফলে পরবর্তীতে রেকর্ডকৃত শব্দ বিশ্লেষণ করে রোগ নির্ণয় করা যায়।
- ফিটাল স্টেথোস্কোপ (Fetal Stethoscope): জরায়ুতে ভ্রুণের হৃৎদস্পন্দন শোনা যায় এই স্টেথোস্কোপের সাহায্যে।
ডাক্তার লেনেক তো স্টেথোস্কোপ আবিষ্কার করলেন। কিন্তু কী হলো তার? স্টেথোস্কোপ আবিষ্কারের সময়ই ডাক্তার লেনেক আরেকটি কাজে হাত দিয়েছিলেন। তিনি যক্ষ্মা নিয়ে গবেষণা করতেন। তখনকার সময়ে ইউরোপে সম্ভ্রান্ত পরিবারের কেউ হাসপাতালে ভর্তি হতো না। তাদের চিকিৎসা হতো বাড়িতে। হাসপাতাল ছিলো সমাজের নিচু তলার মানুষের জন্য। তারাও হাসপাতালে আসতো একেবারে চূড়ান্ত পর্যায়ে; যখন বিশেষ কিছু করার থাকতো না।
ডাক্তার লেনেক এ সমস্ত রোগীদের খুব কাছ থেকে দেখার সুযোগ পেয়েছিলেন। গভীর পর্যবেক্ষণের পর তিনি তাদের খুটিনাটি লিপিবদ্ধ করতেন। কোনো রোগী মৃত্যুবরণ করলে তিনি পোস্টমর্টেম করে তাদের দেহে রোগের উৎস সন্ধান করতেন। তখনকার সময়ে বিশ্বাস করা হতো, পেটের গোলমালই যক্ষ্মা রোগের কারণ। তিনি সর্বপ্রথম উল্লেখ করেন, যক্ষ্মা একটি ছোঁয়াচে রোগ। এবং এর পেছনে নির্দিষ্ট কোনো জীবাণুর হাত রয়েছে।
এছাড়া তিনি লিভার সিরোসিস নিয়েও অনেক কাজ করেছেন। ডাক্তার লেনেকই গ্রিক শব্দ kirrhos থেকে Cirrhosis (সিরোসিস) নামকরণ করেন। তাছাড়া তার লেখা বই ‘A Treatise on the Diseases of the Chest and on Mediate Auscultation’ সমাদৃত হয়।
যক্ষ্মা নিয়ে কাজ করতে করতে ডাক্তার লেনেক নিজেই যক্ষ্মা রোগে আক্রান্ত হয়ে পড়েন এবং মাত্র ৪৫ বছর বয়সে তিনি মৃত্যুবরণ করেন। তার স্মৃতিকে সম্মান জানিয়ে ‘Doctor Laennec’ নামে ১৯৪৯ সালে তার বায়োপিক বানানো হয়। তার কাজকে অনেকে ভিসেলিয়াস, হার্ভে বা হিপোক্রিটাসের কাজের সঙ্গে তুলনা করেন।
ফিচার ইমেজ- dnaindia.com