একটি ইতিহাসকে কয়েকটি দৃষ্টিকোণ থেকে দেখা যায়। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ ও একাত্তরের সামাজিক ও রাজনৈতিক ঘটনাবলীর বেলাতেও তা-ই। ভিন্ন ভিন্ন প্রেক্ষাপটের মানুষ একাত্তর ও মুক্তিযুদ্ধকে ভিন্ন ভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে দেখেছে। সকল দৃষ্টিকোণ সম্বন্ধেই অধ্যয়ন জরুরী। বাংলাদেশে ঘটে যাওয়া গণহত্যা নিয়ে কী ভেবেছিল তখনকার পাকিস্তানীরা? বাংলাদেশ প্রসঙ্গে কেমন ছিল তাদের দৃষ্টিভঙ্গি?
এ প্রশ্নগুলোর উত্তর পেতে কাজ করেন বাংলাদেশের দুজন গবেষক মুনতাসীর মামুন এবং মহিউদ্দিন আহমেদ। একাত্তর ও বাংলাদেশ প্রসঙ্গে তৎকালে পাকিস্তানের গুরুত্বপূর্ণ নীতি নির্ধারক পদে থাকা ব্যক্তিত্বদের সাক্ষাৎকার গ্রহণ করেছেন তারা। সেগুলো ১৯৯৯ সালে দৈনিক ভোরের কাগজ-এ প্রকাশিত হয়। পরবর্তীতে সেগুলো বই আকারেও প্রকাশিত হয় পাকিস্তানীদের দৃষ্টিতে একাত্তর নামে।
সেখানে বেশ কয়েকজন গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিত্বের মাঝে বেনজির ভুট্টোর সাক্ষাৎকারও ছিল। বেনজির ভুট্টো পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী ছিলেন এবং নিঃসন্দেহে পাকিস্তানের রাজনীতিতে অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিত্ব। কিন্তু প্রশ্ন হলো একাত্তরে তো তিনি ক্ষমতায় ছিলেন না কিংবা পাকিস্তানের আভ্যন্তরীণ সেরকম গুরুত্বপূর্ণ পদেও ছিলেন না। তাহলে তার সাক্ষাৎকার কেন গুরুত্বপূর্ণ?
বেনজির ভুট্টো ছিলেন জুলফিকার আলী ভুট্টোর কন্যা। এই জুলফিকার আলী ভুট্টো ছিলেন তৎকালীন পশ্চিম পাকিস্তানের (সামগ্রিক পাকিস্তানের নয়) নির্বাচিত প্রধানমন্ত্রী এবং একাত্তরের অন্যতম কুশীলব। তার পরিবারের সদস্য হিসেবে একাত্তর ও মুক্তিযুদ্ধ সম্পর্কিত পাকিস্তানী বিষয়াদিগুলো কাছ থেকে দেখেছেন বেনজির ভুট্টো।
বাংলাদেশ সম্পর্কে কী বলেছিলেন মুনতাসীর মামুন ও মহিউদ্দিন আহমেদের সাক্ষাৎকারে? ১৯৭১ সালে যা ঘটেছিল সে সম্পর্কে তার কোনোকিছু মনে পড়ে কিনা, এমন প্রশ্নের উত্তরে বেনজির ভুট্টো বলেন-
“বাবা বলেছিলেন ইয়াহিয়া খান শেখ মুজিবকে ফাঁসিতে ঝোলাতে চান। আর এরপর ক্ষমতা ছাড়ার পরিকল্পনা ছিল তার, যাতে নতুন সরকার সবকিছু ধোয়ামোছা তকতকে অবস্থায় কাজ শুরু করতে পারে। ইয়াহিয়া বলেছিলেন যে, শেখ মুজিব সবকিছুর মূল। তাকে যে তিনি আগেই হত্যা করেননি সেটিই ছিল তার সবচেয়ে বড় ভুল। তিনি যদি তখনই তা করতেন তাহলে এতকিছু ঘটত না। আমার বাবা (জুলফিকার আলী ভুট্টো) বলেছিলেন, না, ওটা করবেন না। কেননা বাংলাদেশের মানুষ তাকে তাদের নেতা হিসেবে গ্রহণ করেছে। আর আমরাও এখন (পাকিস্তানে) এক নতুন অধ্যায়ের সূচনা করতে চাই।”[1]
সত্তরের নির্বাচনে সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করে আওয়ামী লীগ। পশ্চিম পাকিস্তান অংশে জুলফিকার আলী ভুট্টো সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করলেও সামগ্রিক পাকিস্তানের সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করেননি। গণতান্ত্রিক দৃষ্টিকোণ থেকে দেখলে সামগ্রিক পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী ছিলেন শেখ মুজিবুর রহমান। কিন্তু কেন্দ্রীয় সরকার আওয়ামী লীগকে ক্ষমতা হস্তান্তর করেনি। পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ শরীফ একবার বলেছিলেন যে, সত্তরের নির্বাচনের ফলাফল যদি একাত্তরে বাস্তবায়িত হতো তাহলে পাকিস্তান আলাদা হয়ে যেতো না। কিন্তু এটি বাস্তবায়নের অন্যতম অন্তরায় ছিল পাকিস্তান পিপলস পার্টি বা পিপিপি (জুলফিকার আলী ভুট্টোর রাজনৈতিক দল)। এ প্রসঙ্গে প্রশ্ন করা হলে বেনজির ভুট্টো বলেন-
“শেখ মুজিব ৬ দফা চেয়েছিলেন যার আওতায় মাত্র ছয়টি বিষয় থাকবে কেন্দ্রের নিয়ন্ত্রণে। প্রতিটি প্রদেশের নিয়ন্ত্রণে থাকবে তাদের নিজ নিজ ব্যবসা-বাণিজ্য, প্রতিটি প্রদেশের থাকবে নিজ নিজ মুদ্রা ব্যবস্থা বা কারেন্সি। যদি তা-ই হয় তাহলে কেন্দ্রের প্রতিরক্ষা খাতের ব্যয় প্রদানের জন্য কে প্রদেশগুলোকে বাধ্য করবে?
আমরা বাস্তবিক পক্ষেই টের পাচ্ছিলাম এ হলো আসলে নেপথ্যে স্বাধীনতার দাবী, যে স্বাধীনতা শুধু বাংলাদেশের জন্যই নয়, বরং পশ্চিম পাকিস্তানের প্রদেশগুলোর জন্যও। … আমরা মনে করেছিলাম ৬ দফা বাস্তবায়নের অর্থ হবে ১৯৭১-এ পাকিস্তানের খণ্ড-বিখণ্ড হয়ে যাওয়া। এ কারণেই আমরা ৬ দফার বিরোধিতা করেছিলাম। ৬ দফা কায়েম হলে আজকের পাকিস্তানের অস্তিত্বও থাকতো না।
… দ্বিতীয়ত, ’৭০-এর নির্বাচনে তৎকালীন পাকিস্তানের দুটি অংশ ভিন্ন ভিন্ন রায় দিয়েছিল। পূর্বাঞ্চলের (বাংলাদেশের) রায় ছিল দেশ ভাঙার অনুকূলে। কেননা ৬ দফা কার্যত দেশ ভাঙারই শামিল। ওদিকে পশ্চিমাঞ্চলের (পশ্চিম পাকিস্তানের) রায় ছিল ৬ দফার বিরুদ্ধে। পশ্চিম পাকিস্তানের কেউ ৬ দফার পক্ষে ভোট দেয়নি, বরং পুরোপুরি প্রত্যাখ্যান করেছে। এ অবস্থায় একটি রায়কে মেনে নেয়া, অন্যটিকে অস্বীকার করা কারও পক্ষে সম্ভব নয়।
… তৃতীয়ত, ভুলে যাওয়া উচিত নয়, ১৯৭০-এর পূর্বাঞ্চলের নির্বাচনে সত্যিকার অর্থে প্রতিদ্বন্দ্বিতা হয়নি। মাওলানা ভাসানী নির্বাচন বয়কট করেছিলেন।”
আরেক প্রশ্নের উত্তরে পিতাকে নির্দোষের আসনে রেখে বাংলাদেশ ও পাকিস্তান প্রসঙ্গে পিতা জুলফিকার আলী ভুট্টোর অবস্থান সম্পর্কে বলেন-
“১৯৭১ এর সেপ্টেম্বরে আমার বাবা প্রকাশ্যে সামরিক অ্যাকশন অবসান ও সমস্যার রাজনৈতিক সমাধানের আহ্বান জানান। পাকিস্তানে তিনিই প্রথম রাজনৈতিক নেতা যিনি এ কাজটি করেন ও এ ধরনের বিবৃতি দেবার জন্য প্রবল সমালোচনার মুখে পড়েন। ফলত রাজনৈতিকভাবে সমস্যা সমাধানে তার এ আহ্বানে কেউ সেদিন কান দেয়নি।
একাত্তরের ডিসেম্বরে তিনি এক পাকিস্তানী প্রতিনিধিদলের নেতা হিসেবে নিউইয়র্কে আসেন। … একটা বিষয় ঐ সময়ে পরিষ্কার হয়ে ওঠে যে, বিশেষ করে সোভিয়েত প্রতিনিধি দলের লোকেরা তাদের ভাষণ ইচ্ছা করে লম্বা করার কৌশল অবলম্বন করে, কারণ তারা ঢাকার পতন দেখতে চায়। … তিনি বলেন “আপনারা এখানে সকলে ইচ্ছেমতো প্রলম্বিত বক্তৃতা করছেন, আপনারা ‘এখন কি লাঞ্চ করার জন্য বিরতি থাকবে, চায়ের জন্য সভা বন্ধ থাকবে? কিংবা বিশ্রাম নেয়া যাক’- এ ধরনের অনাবশ্যক কথাবার্তার তুবড়ি ছুটিয়ে চলেছেন যখন মানুষ মারা যাচ্ছে, ওদের হত্যা করা হচ্ছে। … আপনাদের এরকমটা প্রত্যাশিত নয়, কারণ বাস্তবতা বদলে যাচ্ছে।”
তিনি বক্তৃতা দেবার পর বেরিয়ে গেলেন, সামনের সারির আসনের লোকজন তার পিছু নিল। … এরপর তিনি একান্তে থাকতে চাইলেন।
বাবাকে অত্যন্ত বিচলিত ও বিমর্ষ মনে হলো। তিনি বললেন, মনে হলো ওরা সবাই অপেক্ষা করছে কখন ঢাকার পতন ঘটবে। আমরা বোধহয় এখন আমাদের ইতিহাসের এক ক্রান্তিলগ্ন তথা মোড়ে দাঁড়িয়ে আছি। ঐদিন তাকে খুবই বিমর্ষ মনে হলো…
তিনি এ কথাও উপলব্ধি করলেন, বাঙালীদের প্রতি যথেষ্ট অবিচার করা হয়েছে। আমরা যখন ছোট তখন ভাষা প্রশ্নে তার অভিমত ছিল, হয় সংখ্যাগরিষ্ঠের ভাষা গ্রহণ করুন কিংবা চারটি প্রদেশের কাছে গ্রহণযোগ্য এমন ভাষা সম্ভব হলে বেছে নিন। কেননা এদেশের মানুষ ইংরেজি বলতে ও তাদের দেশী ভাষা বলতে জানত। ঐ সময় কেমন করে উর্দুতে কথা বলতে হয় ওরা জানত না। এ অবস্থায় বাঙালীরা মনে করতে থাকে, ‘আমাদের ছেলেরা চাকরিবাকরি পাবে না, কেননা তারা পরীক্ষায় ভাষার কারণে পাস করতে পারবে না, কে-ইবা ওদের চাকরি দেবে, ওরা তো উর্দু জানে না। এ রকমই একটা অনুভূতি ছিল ভাষা গোলযোগের সময়টায়। তিনি এ-ও উপলব্ধি করেছিলেন, সংখ্যাগরিষ্ঠকে শাসন ক্ষমতা থেকে বঞ্চিত করাটাও খুবই অন্যায়। তার ধারণা, প্যারিটি বা দেশের দুই অংশের মধ্যে সমতা নীতির তত্ত্ব দিয়ে আমরা বাঙালীদের প্রতি যথেষ্ট অবিচার করেছিলাম। কেননা কার্যত আমরা বলতে চেয়েছিলাম “তোমাদেরকে আমরা পাকিস্তানী হিসেবে মানি না…।”
বিদ্যালয়গুলোতে… স্কুলের শিক্ষকরা বলতেন, পূর্বাঞ্চলের লোকেরা ভাত খায়, আকারে খাটো; পশ্চিমের লোকের খাদ্য গম, ওরা লম্বা-চওড়া। এগুলো সত্যিই অনেক স্থুল রকমের বিদ্বেষ। [তখন] শিশু হয়েও আমি অনুভব করতে পারতাম, ব্যাপারটা অন্যায়। বড় হয়ে বুঝলাম বাঙালীরা কী বলে, বলতে চায়। এটা আমি বুঝেছি বড় হয়ে প্রধানমন্ত্রী হবার পর। … আমি শৈশবে যা শুনেছি আর যা বুঝিনি তা এখন আমাকে তাড়িয়ে নিয়ে ফিরছে। আমি মনে করি, পাকিস্তান যদি ভাঙে সেজন্য পশ্চিমাঞ্চলের হঠকারীতাই দায়ী। আমরা ওদেরকে তা দিতে প্রস্তুত নই। আজকে আমি মনে করি একারণেই বাংলায় গোলযোগ শুরু হয়।”
সাধারণ মানুষ হোক আর প্রধানমন্ত্রী হোক, এটা স্বাভাবিক সে কোনো ঘটনায় কেউ একজন তার পিতার দোষ কম দেখবে এবং ভালো দিকগুলোকেই তুলে ধরবে। বেনজির ভুট্টোর ক্ষেত্রেও তা-ই হয়েছে। তবে তারপরেও এটা আশার কথা যে বাংলাদেশ সম্পর্কে পাকিস্তানীরা মাঝে মাঝে ইতিবাচক কথা বলছেন। পাশাপাশি এটা হতাশার যে পাকিস্তানের নতুন প্রজন্মকে বাংলাদেশ (পূর্ব পাকিস্তান) সম্পর্কে কিছুই জানতে দেয়া হয় না। তাদের পাঠ্যক্রমে নেই বাংলাদেশ সম্বন্ধে সত্যিকার ইতিহাস। তাদেরকে শেখানো বাংলাদেশ আগে পাকিস্তানের অংশ ছিল, পরে একসময় ভারতের সহায়তায় তারা বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়।
তথ্যসূত্র
- মুনতাসীর মামুন ও মহিউদ্দিন আহমেদ (২০১৮), পাকিস্তানীদের দৃষ্টিতে একাত্তর, পৃষ্ঠা ১ – ১৭, ইউনিভার্সিটি প্রেস লিমিটেড, ঢাকা
- মশিউল আলম, বঙ্গবন্ধুকে বাঁচিয়েছিল কে? প্রথম আলো, ১৭ ডিসেম্বর ২০১৫
- সোহরাব হাসান, মুজিবকে শান্তিতে থাকতে দেননি ভুট্টো, প্রথম আলো, ০৯ আগস্ট ২০১৫
ফুটনোট
[1] শেখ মুজিবুর রহমান সম্পর্কে জুলফিকার আলী ভুট্টোর অবস্থান সম্পর্কে বেনজির ভুট্টোর বক্তব্যকে চূড়ান্ত বলে বিবেচনা করলে ভুল হবে। কারণ ইয়াহিয়া খান তার দিনলিপিতে শেখ মুজিব প্রসঙ্গে ভুট্টোর অবস্থান সম্পর্কে বলছেন-
“(ভুট্টো) মুজিবুর রহমানকে এমন মাত্রায় ঘৃণা করতো যে ১৯৭১ সালের অক্টোবর মাসে আমি যখন ইরানি রাজতন্ত্রের রজতজয়ন্তী উৎসবে যোগ দিতে যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছিলাম, তখন সে আমাকে সামরিক আদালতে মুজিবের মামলার কার্যক্রম শেষ করে তাকে খতম করে দিতে বলে। আমি তাকে বলি, আদালতে মামলার চূড়ান্ত নিষ্পত্তি হওয়ার আগ পর্যন্ত আমি কোনো সিদ্ধান্ত নিতে পারি না। তখন সে আমাকে বলে, ইরানে বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্রপ্রধানেরা মুজিবকে মুক্তি দেওয়ার জন্য আমার ওপর সব ধরনের চাপ প্রয়োগ করবে। তাই আমার উচিত তাৎক্ষণিক পদক্ষেপ নেওয়া এবং মুজিবকে ঝুলিয়ে দেওয়া। আমাদের দেশের তথাকথিত রাজনৈতিক নেতা, যিনি নিজেকে গণতন্ত্রী বলে দাবি করেন, দাবি করেন যে তিনি জনগণের নেতা, তাঁর মুখে এ ধরনের কথা শুনে আমি স্তম্ভিত হয়ে যাই।” (প্রথম আলোতে প্রকাশিত অনুবাদ)
এখানে একটি বিষয় দ্রষ্টব্য। একদিকে ভুট্টো দোষ চাপাচ্ছেন ইয়াহিয়ার উপর, অন্যদিকে ইয়াহিয়া দোষ চাপাচ্ছেন ভুট্টোর উপর। উল্লেখ্য, একাত্তরের পূর্ববর্তী সময়ে তারা খুব ঘনিষ্ঠ থাকলেও একাত্তর পরবর্তী সময়ে তাদের মধ্যে চরম ঘৃণার জন্ম হয় এবং তারা একে অন্যের শত্রুতে পরিণত হয়।
Featured Image: Robert Nickelsberg/Getty Images