ভ্লাদিমির পুতিন, বিশ্বের ক্ষমতাধর নেতাদের মধ্যে একজন। এ পর্যায়ে আসতে পাড়ি দেয়া পথটা নেহায়েত ছোট ছিল না। রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট হবার আগে অনেক বছর তিনি রাশিয়ার গুপ্ত বার্তাসংস্থা ও স্থানীয় রাজনীতির সাথে জড়িত ছিলেন। তার কর্মজীবন সম্পর্কে বেশ বিস্তারিত জানা গেলেও ব্যক্তিগত জীবন সম্পর্কে খুব কমই জানা যায়। স্বাভাবিকভাবেই তার প্রথম স্ত্রী ল্যুদমিলা পুতিনের ব্যাপারেও তাই খুব বেশি খবর ফলাও করে প্রকাশ হয়নি, যতদিন পর্যন্ত না তারা আলাদা হবার সিদ্ধান্ত নেন।
ল্যুদমিলা পুতিন, ২০১৩ সালে প্রায় ত্রিশ বছরের বিবাহিত জীবন সমাপ্ত করার পর এখন ল্যুদমিলা ওকেরেত্নায়া নামে পরিচিত। পৃথিবীর অন্যতম ক্ষমতাধর ব্যক্তির সহধর্মিনী হলেও সে জীবন পছন্দ করতে পারেননি তিনি। থেকেছেন লোকচক্ষুর অন্তরালে। তাই তার জীবনটা সবসময় রহস্যের আড়ালেই থেকেছে জনসাধারণের কাছে।
ল্যুদমিলার শৈশব কাটে তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়নের লেনিনগ্রাদে। সেখানেই তার জন্ম। ফ্রেঞ্চ, জার্মান ও স্প্যানিশ ভাষায় অল্প বয়সেই দক্ষতা অর্জন করেন। পুতিনের সাথে দেখা হবার সময়টায় ফ্লাইট অ্যাটেনডেন্ট হিসেবে কাজ করতেন। সে সময়ে সোভিয়েত ইউনিয়নে এটি বেশ কাঙ্ক্ষিত চাকরি ছিল। ল্যুদমিলার সাথে পুতিনের দেখা হয় লেনিনগ্রাদে (বর্তমান সেইন্ট পিটার্সবার্গ)। পরিচিত এক বন্ধুর আমন্ত্রণে নাটক দেখতে গিয়ে তাদের পরিচয়। আরো কয়েকজন বান্ধবী ছিল সেখানে, তবে ল্যুদমিলা আর পুতিনের মধ্যে সখ্যতা বাকিদের চেয়ে আলাদাভাবেই গড়ে ওঠে। সে সময়ে পুতিন কেজিবির বেশ দক্ষ সদস্য ছিলেন। তার কাজের ধরনের জন্য প্রায় ৩ বছর নিজেদের প্রেম সম্পর্ক গোপন রাখতে হয়।
পুতিনের ব্যক্তিগত ওয়েবসাইটে তার এবং ল্যুদমিলার ব্যাপারে বেশ কিছু মন্তব্য পাওয়া যায়। ল্যুদমিলা বলেন, “ভ্লাদিমিরের মধ্যে কিছু একটা ছিল যা আমাকে আকর্ষণ করেছিল। তিন বা চার মাস পরেই আমি বুঝতে পারি এই সেই মানুষ যাকে আমি আমার জীবনে প্রয়োজন।” তাদের প্রথম দেখা হবার তিন বছর পর পুতিন ল্যুদমিলাকে বিয়ের প্রস্তাব করেন। এ ব্যাপারে পুতিনের বক্তব্য- “আমি জানতাম, যদি আর দুই তিন বছরের মাঝে আমি বিয়ে না করি, আমার আর কখনোই বিয়ে করা হবে না। এটা সত্য যে আমি অবিবাহিত জীবনেই বেশ অভ্যস্ত ছিলাম, কিন্তু ল্যুদমিলা সেই অভ্যস্ততায় আমূল পরিবর্তন এনেছিল।”
১৯৮৩ সালের ২৮ জুলাই তারা বিয়ে করেন। বিয়ের দুই বছর পর তাদের প্রথম কন্যাসন্তান জন্ম নেয়। তারও এক বছর পর দ্বিতীয় কন্যাসন্তানের জন্ম হয়। ল্যুদমিলা নিজেই বলেন, বাবা হিসেবে পুতিন ছিলেন অসাধারণ, সব বাবা তাদের সন্তানদের এত আদর করতে পারেন না যতটা পুতিন করতেন।
এতকিছুর পরেও কেন দীর্ঘ ত্রিশ বছর পর বিবাহিত জীবনের ইতি টানলেন দুজন? যদিও অনেক বছর পর সিদ্ধান্তটা নেয়া, কিন্তু এর বীজ বপন হয়েছিল আরো অনেক আগেই। ল্যুদমিলা সবসময় লোকচক্ষুর অন্তরালে থাকতেই পছন্দ করতেন। রাশিয়ার ফার্স্ট লেডির পদটাও তার কাছে লোভনীয় কিছু ছিল না বলেই বোঝা যায় তার বিভিন্ন বক্তব্যের মধ্যে। তার ব্যক্তিগত পোশাক ডিজাইনার স্লাভা যেইতসেভ বলেন, “ল্যুদমিলার ব্যক্তিত্ব প্রাণবন্ত ও অকৃত্রিম, উচ্চাকাঙ্ক্ষী ব্যক্তির সহজাত খামখেয়ালিপনা তার মধ্যে নেই। তিনি অত্যন্ত বিনয়ী একজন মানুষ।” যেইতসেভ আরো বলেন, “তখন তিনি আমাকে প্রায়ই বলতেন এত ভ্রমণ ও জনমানুষের সামনে উপস্থিত হওয়া তিনি পছন্দ করেন না। রাষ্ট্রপতির স্ত্রী হওয়ার ব্যাপারটা তার সামনে হুট করেই চলে আসে, তিনি এই ভূমিকার জন্য প্রস্তুত ছিলেন না।”
পুতিনের পেশাগত জীবনের কারণে ল্যুদমিলা ও তার সন্তানদের সবসময়ই একটু লোকচক্ষুর অন্তরালে থাকতে হতো, কেননা পুতিন তাদের নিরাপত্তা নিয়ে সবসময়েই চিন্তা করতেন। ১৯৯০ সালে জার্মানি থেকে রাশিয়ায় ফিরে তারা সেইন্ট পিটার্সবার্গেই বসবাস শুরু করেন। সে সময়ে এই ভবিষ্যৎ রাষ্ট্রপতি পৌর সরকারে তার স্থান দৃঢ় করছিল। ১৯৯০ এর দিকে ল্যুদমিলা বেশ আগ্রহীই ছিলেন সক্রিয় ভূমিকা পালন করতে, যেন স্বামীর সাথে সমানতালে এগিয়ে যাওয়া যায়। কিন্তু পুতিনই সেখানে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করেন। পুতিনের পরিচিত একজনের কাছ থেকেই জানা যায় যে, ল্যুদমিলা বেশ মর্মাহত হতেন, কারণ পুতিন তাকে নিজের সাথে কোথাও নিয়ে যেতেন না। স্ত্রী খুব বেশি স্পটলাইটে থাকলে সন্তানদের উপর নেতিবাচক প্রভাব পড়তে পারে এরকম চিন্তা থেকে তিনি এটি করতেন। তার চিন্তাভাবনা ছিল স্ত্রীদের একটু বিনয়ী ও নিভৃতচারিণীই হওয়া উচিৎ। ধীরে ধীরে ল্যুদমিলাও তাই লোকচক্ষুর অন্তরালে থাকা শুরু করেন। বিশ্বের অন্যতম ক্ষমতাধর রাষ্ট্রপতির স্ত্রী হতে গিয়ে তার নিজের আকাঙ্ক্ষাগুলো কোথাও চাপা পড়ে যায়।
ল্যুদমিলা ও পুতিনের মধ্যকার সম্পর্কের তিক্ততার আভাস পাওয়া যায় বিভিন্ন সময়ে। বিশেষ করে ২০০৮ সালে যখন রাশিয়ান জিমন্যাস্ট আলিনা কাবায়েভার সাথে সম্পর্কের গুজব ছড়ায় রাশিয়ান এক পত্রিকার মাধ্যমে। তবে এ খবর প্রকাশের কিছুদিনের মধ্যেই পত্রিকার মালিক ব্যবসা মন্দার অজুহাতে পত্রিকাটি বন্ধ করে দেয়। অনেকেই সন্দেহ প্রকাশ করেন যে ক্ষুদ্ধ পুতিনকে শান্ত করার জন্যেই এই উদ্যোগ নেয়া হয়। বিবাহ বিচ্ছেদের পর এই সম্পর্ক আরো প্রকাশ্যভাবেই অবশ্য গণমাধ্যমে প্রচার পাচ্ছে।
এই দম্পতিকে শেষবারের মতো একসাথে দেখা গিয়েছিল ২০১২ সালের মে মাসের ৭ তারিখ। তখন পুতিন তৃতীয়বারের মতো রাশিয়ার রাষ্ট্রপতি হিসেবে অভিষিক্ত হচ্ছিলেন। ২০০০ সালে রাশিয়ার ফার্স্ট লেডি হবার তেরো বছর পর ২০১৩ সালে এই দম্পতি জনসম্মুখে তাদের বিবাহ বিচ্ছেদের ঘোষণা দেন। কারণ হিসেবে ল্যুদমিলা বলেন, “আমাদের বিয়ের সমাপ্তি ঘটছে কারণ আমাদের একে অন্যের সাথে দেখা প্রায় হয় না বললেই চলে। ভ্লাদিমির সম্পূর্ণভাবে তার কাজেই ডুবে থাকে। আমাদের সন্তানেরাও এখন বড় হয়ে গেছে…আর আমি সত্যিই প্রচারণা পছন্দ করি না।”
ল্যুদমিলা তার কথায় অটল ছিলেন, তিনি মোটামুটি দৃষ্টির আড়ালেই ছিলেন। মাঝে তার সন্ন্যাসী আশ্রমে যোগদানের একটি গুজব রাশিয়ান সংবাদমাধ্যমে শোনা গিয়েছিল। তবে তা গুজব হিসেবেই রয়ে গেছে। বিচ্ছেদের পর ২০১৬ সালে ল্যুদমিলা পুনরায় খবরে আসেন তার পুনঃবিবাহের মাধ্যমে। এবার তার জীবনসঙ্গী তার চেয়ে ২১ বছরের ছোট আর্থার ওকেরেত্নি। তার নাম অনুযায়ী ল্যুদমিলা তার নামের শেষাংশ পরিবর্তন করেছেন।
আর্থার একটি অলাভজনক প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর দ্য ডেভেলপমেন্ট অফ ইন্টারপার্সোনাল কমিউনিকেশনস এর পরিচালক। শুধু পুনরায় বিয়ের জন্যই না, আর্থার-ল্যুদমিলা দম্পতি খবরে আসেন তাদের বিলাসবহুল ইউরোপীয় ধাঁচের ভিলার জন্যও। ফ্রান্সের দক্ষিণ-পশ্চিমে অবস্থির এংলেট নামক এ ভিলার সাথে এই দম্পতির যোগ খুঁজে পাওয়া যায় অর্গানাইজড ক্রাইম এন্ড করাপশান রিপোর্টিং প্রজেক্টের বিস্তারিত প্রবন্ধ প্রকাশের পর। তাতে বলা হয় ভিলাটির মূল্য ৭.৬ মিলিয়ন ডলার এবং এতে বেশ বিস্তৃতভাবে সংস্কার কাজ চলছে। ভিলাটির স্বত্বাধিকার আর্থার ওকেরেত্নির নামে। পুতিন ও তার বিবাহ বিচ্ছেদ ঘোষণার ছয় মাস পরেই ভিলাটি কেনা হয়।
এত বড় পরিসরে সম্পত্তি কেনার টাকা কোত্থেকে এলো এ ব্যাপারে প্রশ্ন থেকেই যায়। কেননা ল্যুদমিলার নতুন স্বামী অলাভজনক প্রতিষ্ঠানের পরিচালক হিসেবে খুব উচ্চ বেতন পাওয়ার কথা নয়। আর পাশাপাশি তার ব্যবসার অবস্থা পর্যবেক্ষণ করে ওসিসিআরপি এই সিদ্ধান্তে আসে যে তা থেকেও এ পরিমাণ অর্থ আসা সম্ভব নয়। এমনকি ল্যুদমিলাও সরকারিভাবে ধনী হিসেবে পরিচিত না। কেননা ফার্স্ট লেডি থাকাকালীন সময়ে তার উপার্জন ও সম্পদের একটা হিসাব বরাবরই দিতে হত। সে অনুযায়ী তাকে ৭.৬ মিলিয়ন ডলারের বাড়ি কেনার মতো ধনী কখনোই বলা যায় না।
সংবেদনশীল ল্যুদমিলার জন্য কঠোর পুতিনের সাথে তাল মিলিয়ে চলা খুব সহজ ছিল না। তাই এতকিছুর পরেও ল্যুদমিলার সাথে পুতিনের সম্পর্কের ইতিটাকে ল্যুদমিলার জন্য স্বস্তিদায়ক সমাপ্তিই বলা যায়।
ফিচার ইমেজঃ ft.com