যুক্তরাষ্ট্রের স্থানীয় সময় অনুযায়ী তখন ভোর ৪টা বাজে। নিউ ইয়র্কের মতো পৃথিবীর অন্যতম ব্যস্ত নগরীতেও তখন অধিকাংশ মানুষ নাক ডেকে ঘুমাচ্ছে। সারাদিনের অক্লান্ত পরিশ্রম শেষে সবার একটাই ইচ্ছে থাকে- শান্তির নিদ্রা। কিন্তু আপনি যদি জর্ডান বেলফোর্ট নামক এক পাগলাটে শেয়ার দালালের সেক্রেটারি হয়ে থাকেন, সেক্ষেত্রে নিদ্রার কথা বেমালুম ভুলে যান। ঠিক ৪টা বাজতেই কর্কশ কণ্ঠে বেজে উঠলো টেলিফোন। বেচারা সেক্রেটারি ঘুম থেকে উঠে রিসিভার কানে নিয়ে বললো, “হ্যালো।” ফোনের অপরপাশ থেকে তখন বেশ হাঁপিয়ে ওঠা কন্ঠে ‘হ্যালো’ বলে উঠলেন তার বস জর্ডান বেলফোর্ট।
“জর্ডান? ভোর চারটায়? কী প্রয়োজনে ফোন করেছো?” জর্ডান বেলফোর্ট কিছু সময় নিলেন নিজেকে গুছিয়ে নিতে। এরপর যা বললেন, তা শুনে সেক্রেটারি বাদে যে কারো মাথায় আকাশ ভেঙে পড়তো। জর্ডান তখন একটি বাণিজ্যিক সফরে আটলান্টিকের ওপারে লন্ডনে অবস্থান করছিলেন। তার এত রাত্রে তার ফোন করার প্রধান কারণ, লন্ডনে নিয়ে আসা কুয়েলুডস (একপ্রকার মাদক) একদম ফুরিয়ে গেছে। তাই এই মুহূর্তে যেন তাকে জরুরি ভিত্তিতে কুয়েলুডস পাঠিয়ে দেয়া হয়। যেমন মালিক, তেমন তার সেক্রেটারি। এই ঘটনা একদম নতুন নয় তার কাছে। সে-ও ত্রিশ মিনিটের মাথায় জর্ডানের ব্যক্তিগত কনকর্ড বিমানে করে লন্ডনের উদ্দেশ্যে পাঠিয়ে দিলেন কাঙ্ক্ষিত কুয়েলুডস। যেন এত রাত্রে কুয়েলুডস ব্যতীত অন্যকিছু চাইলে বেশ অবাক হতো তার সেক্রেটারি।
জর্ডানের জন্য সবই সম্ভব। নিজেকে ওয়াল স্ট্রিটের নেকড়ে ভাবা এই শেয়ার দালাল তার জীবনে আরো অদ্ভুত অদ্ভুত সব কাজ সম্পাদন করেছেন। একবার তো তিনি নেশা করার পর এক চোখ বন্ধ রেখে হেলিকপ্টার চালিয়ে নিজের বাসার উঠানে অবতরণ করে বসেন। তিনি নাকি সবকিছু ‘দ্বিগুণ’ দেখছিলেন। তাই বুদ্ধি খাটিয়ে এক চোখ দিয়েই পাইলট হওয়ার সিদ্ধান্ত নেন! ফোর্বস ম্যাগাজিনের দৃষ্টিতে জর্ডান ছিলেন রবিন হুডের বিকৃত সংস্করণ, যিনি কি না ধনীদের থেকে অর্থ চুরি করে নিজের কোষাগারে ভরতেন। ‘দ্য উলফ অফ ওয়াল স্ট্রিট’ খ্যাত এই জর্ডান বেলফোর্ট ছিলেন বিংশ শতাব্দীর অন্যতম সেরা প্রতারক।
কুইন্সের জর্ডান
৯ জুলাই, ১৯৬২ সাল। এদিন নিউ ইয়র্কের কুইন্সে জন্ম নেন জর্ডান রস বেলফোর্ট। জর্ডানের পিতা পেশায় ছিলেন একজন হিসাবরক্ষক। পিতার মাঝারি আকারের আয় রোজগারে বেশ স্বাচ্ছন্দ্যে কেটে যায় তার শৈশব। কুইন্সের নির্মল পরিবেশে দেখতে দেখতে শিশু জর্ডান বড় হয়ে উঠলো। স্থানীয় মাধ্যমিক বিদ্যালয় থেকে পাশ করে জর্ডান সিদ্ধান্ত নিলেন একজন ডেন্টিস্ট হিসেবে নিজেকে গড়ে তুলবেন। এই উদ্দেশ্যে বাল্টিমোরের ডেন্টাল কলেজে ভর্তি হলেন। কিন্তু কেন যেন বেশিদিন সেখানে মন বসলো না তার। ডেন্টাল কলেজের পড়া শেষ না করে তিনি নতুন করে ভর্তি হলেন আমেরিকান বিশ্ববিদ্যালয়ে। এখান থেকে সফলতার সাথে জীববিজ্ঞান বিভাগ থেকে ডিগ্রী অর্জন করেন তিনি। পড়াশোনার পালা শেষ, এবার জীবিকা অর্জনের পালা শুরু।
শেয়ার বাজারে হাতেখড়ি
জীববিজ্ঞানের ডিগ্রিধারী জর্ডান নিজেকে কোনো বিজ্ঞানী বা শিক্ষক হিসেবে দেখতে পছন্দ করলেন না। তাই ডিগ্রি সরিয়ে রেখে তিনি ব্যবসায় নামলেন। শুরুতে সামুদ্রিক খাবার নিয়ে ব্যবসা শুরু করলেন। জর্ডানের এই যাত্রায় প্রথম সঙ্গী হিসেবে যোগদান করেন বন্ধু কেনি গ্রিন ওরফে ব্লকহ্যাড। বয়স তখন তার মাত্র ১৮। ব্যবসা করার ইচ্ছে বোধহয় জর্ডানের সহজাত গুণ। কারণ, দ্রুত তার কোম্পানি লাভের মুখ দেখা শুরু করলো। তবে নিতান্ত অনভিজ্ঞতাবশত বেশিদিন এই লাভ ধরে রাখতে ব্যর্থ হলেন জর্ডান। তাই এক বছর পরে তার কোম্পানি বন্ধ করে দিতে হয়।
ব্যবসায় সাময়িকভাবে ব্যর্থ হলেও থেমে যাননি জর্ডান। অনেক ভেবে চিন্তে ঠিক করলেন, স্থানীয় খাবারের ব্যবসা আর করবেন না। এবার নতুন যাত্রা শুরু করা যাক। আর তার এই নতুন যাত্রার গন্তব্যস্থল ছিল বিশ্বের বৃহত্তম শেয়ার বাজার- ওয়াল স্ট্রিট। ১৯৮৭ সালে জর্ডান শেয়ারের দালাল হিসেবে কাজ করা শুরু করেন। কয়েকদিনের মাথায় শেয়ার বাজারের আদ্যোপান্ত জেনে নেন জর্ডান। শেয়ার দালালি যখন শুরুই করেছেন, একদম হুলুস্থুল কিছু না করে থামবেন না তিনি। ওয়াল স্ট্রিটে আগমনের দু’বছরের মাথায় জর্ডান বেলফোর্ট নিজ উদ্যোগে একটি শেয়ার বিনিয়োগকেন্দ্র খুলে বসেন। নিজের হাতে গড়া এই ছোট কোম্পানির নাম দেন ‘স্ট্রেটন ওকমন্ট’।
এক নেকড়ের আবির্ভাব
নতুন কোম্পানিতে ধীরে ধীরে লোকবল নিয়োগ করতে থাকেন জর্ডান। তার প্রধান কুশলী ডেনি পরুশকে সাথে নিয়ে শুরু করেন শেয়ার বেচা-কেনার যজ্ঞ। স্ট্রেটন ওকমন্টের প্রধান লক্ষ্য ছিল ‘পাম্প এন্ড ডাম্প’ পদ্ধতি অনুসরণ করে রাতারাতি অঢেল অর্থের মালিক বনে যাওয়া। এই পদ্ধতি অনুযায়ী জর্ডানরা প্রথমে ক্রেতা নির্বাচন করতেন। এমন একজনকে ক্রেতা হিসেবে বেছে নেওয়া হতো, যে জর্ডানদের শেয়ারের ফাঁকি ধরতে পারবে না। এরপর শুরু হতো দালালদের কেরামতি। ক্রেতাকে নানাভাবে মিথ্যে প্রলোভন দেখিয়ে বেশ কম মূল্যের শেয়ারকে চড়া দামে কিনতে বাধ্য করতো তারা। এভাবে কম পুঁজিতে অতি মাত্রায় লাভ করতে থাকে স্ট্রেটন ওকমন্ট। আর রাতারাতি ধনকুবের বনে যান জর্ডান বেলফোর্ট। সবার মুখে মুখে তখন বেলফোর্টের নাম। অনেকে তাকে ‘উলফ’ (wolf) হিসেবে ডাকা শুরু করলো। জর্ডান বনে গেলেন ওয়াল স্ট্রিটের এক ‘উলফ’।
জর্ডান তার সহকর্মীদের একটি মন্ত্র বাতলে দেন- “Don’t hang up until the customer buys or dies.” অর্থাৎ ক্রেতা শেয়ার কিনবে, না হয় মরে যাবে। কিন্তু কোনোভাবেই এর আগে ফোন কেটে দেয়া যাবে না। জর্ডান একবার নিউ ইয়র্ক পোস্টকে জানিয়েছিলেন, “ধনী হওয়া খুব সহজ, যদি নিয়ম নীতি না মেনে ধনী হতে চাও।” জর্ডান বেলফোর্ট তার কোম্পানিতে এমন কাউকে নিয়োগ দিতেন না, যারা ইতোমধ্যে দালাল হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছেন। তার পছন্দের প্রার্থী ছিল মাধ্যমিক ডিপ্লোমাধারী কিংবা উৎসাহী তরুণরা, যারা প্রচুর অর্থ উপার্জনের স্বপ্ন দেখতো। স্ট্রেটন ওকমন্ট শেয়ার বাজারীদের মাঝে একটি কাল্টে (Cult) রূপান্তরিত হলো। স্ট্রেটনিরা কাজ করতো মোষের মতো, আবার পার্টি করার সময় এদের উদযাপনের মাত্রা বাকি সবাইকে ছাড়িয়ে যেতো।
নেকড়ের বিলাসিতা
অর্থ উপার্জন করলেই হয় না, এর জন্য খরচ করা জানতে হয়- এ কথা মনেপ্রাণে বিশ্বাস করতেন জর্ডান বেলফোর্ট। শেয়ার দালালিতে উপার্জন করা লক্ষ লক্ষ ডলার তিনি বেপরোয়াভাবে খরচ করতে থাকেন। ম্যানহ্যাটনে আকাশচুম্বী অট্টালিকা গড়লেন জর্ডান। কিন্তু তাতেও মন ভরলো না। তাই নিউ ইয়র্কের লং দ্বীপে একটি প্রকাণ্ড প্রাসাদ কিনে ফেললেন। সাগরে ভেসে আনন্দ করার জন্য কেনা হলো ২৫৬ ফুট দীর্ঘ প্রমোদতরী। একটি ফেরারি টেস্টারোসা এবং হ্যাম্পটনের একটি বিলাসবহুল বাড়ি ছিল জর্ডানের অস্থায়ী খেলনার মতো। পছন্দ না হলে সোজা বদলে ফেলতেন সবকিছু। মিলিয়ন ডলারের আসবাবপত্র দিয়ে তার আবাসস্থল সাজানো হয়েছিলো, যা দেখলে চোখ ফেরানো যেত না।
বাড়ি, গাড়ি, প্রমোদতরী ছাড়াও জর্ডানের টাকা উড়ানোর আরেকটি সংস্থান ছিলো। আর তা হচ্ছে- মাদক। মারিজুয়ানা, কোকেইন, গাঁজা, কুয়েলুডস এগুলো ছিল জর্ডানের নিত্যদিনের সঙ্গী। কাজের ফাঁকে কিংবা কাজের শেষে বন্ধুবান্ধবের সাথে কিংবা একাকী কক্ষে মাদক নিয়ে মত্ত হতেন জর্ডান। জর্ডান তারা আত্মজীবনীতে তার অধঃপতনের জন্য মাদককে দায়ী করেছেন। প্রায়ই মাদক সেবনের পর জর্ডান গাড়ি চালাতেন, বিমানে চড়তেন। এমনকি একবার মাদকাসক্ত অবস্থায় নিজের স্ত্রী নাদিনকে লাথি পর্যন্ত মেরেছিলেন। নাদিন ছিলেন জর্ডানের দ্বিতীয় স্ত্রী। প্রথম স্ত্রী ডেনিসের সাথে বিবাহ বিচ্ছেদের পর তিনি মডেল নাদিনকে বিয়ে করেছিলেন। জর্ডান নারী, মাদক, পার্টি নিয়ে মেতে থাকলেও নাদিন কিছু বলতেন না। কিন্তু জর্ডান যেদিন তাকে লাথি মেরেছিলো, সেদিন তিনি জর্ডানকে ছেড়ে চলে যান। নাদিন শেষ পর্যন্ত এক উকিলকে বিয়ে করে ক্যালিফোর্নিয়া চলে যান। জর্ডানের দুই সন্তান নাদিনের সাথে চলে যায়।
নেকড়ে ধরার যজ্ঞ
জর্ডান বেলফোর্টের প্রতারণার কথা মার্কিন নিরাপত্তা ও বিনিময় কমিশনের কানে পৌঁছায়। ১৯৯২ সালে তারা জর্ডানের বিরুদ্ধে গুরুতর প্রতারণার অভিযোগ এনে মামলা দায়ের করেন। কিন্তু শুধু নিরাপত্তা কমিশনের কথা ভেবে নিশ্চিন্তে থাকলেই চলবে না। কারণ, তখন জর্ডানের পেছনে লেগেছে স্বয়ং এফবিআই। এফবিআই এজেন্ট কোলম্যান জর্ডান বেলফোর্টের প্রতিটি পদক্ষেপ পর্যবেক্ষণ করতে থাকেন। উন্মুক্ত নেকড়ে জর্ডানের আনন্দের দিন যেন শেষ হয়ে আসলো। মরার উপর খাড়ার ঘা হিসেবে জর্ডানের এক বন্ধু সুইজারল্যান্ডে অর্থ পাচার করতে গিয়ে ধরা পড়লো। জর্ডান একের পর এক দুঃসংবাদে নিজের উপর নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেললেন। তিনি এতটাই অস্থির হয়ে যান যে, একবার কুয়েলুডস সেবন করে গাড়ি চালিয়ে বাড়ি ফেরেন। বাড়ি ফেরার পর নাদিন যখন তাকে জিজ্ঞাসা করেন, “জর্ডান, তোমার গাড়ি এরকম ভেঙে আছে কেন?” তখন জর্ডান বুঝতে পারলেন, নেশার ঘোরে গাড়ি চালাতে গিয়ে তিনি বেশ কয়েকবার দুর্ঘটনার মুখে পড়েছেন। এই ঘটনার কয়েকদিনের মাথায় জর্ডানকে গ্রেফতার করা হয়।
আদালতে শুনানির পর জর্ডান বেলফোর্টকে ওয়াল স্ট্রিটে শেয়ার বিক্রি করার উপর আজীবন নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়। স্ট্রেটন ওকমন্ট কোম্পানিকে বেশ বড় অঙ্কের জরিমানাও গুণতে হয়েছিলো। জর্ডানের বিপদের মুখে ১৯৯৬ সালে কোম্পানিটি বন্ধ হয়ে যায়। আদালত কোম্পানিকে এখন পর্যন্ত অবৈধভাবে আত্মসাৎ করা ক্রেতাদের অর্থ ফিরিয়ে দেয়ার নির্দেশ দেয়। একের পর এক অভিযোগ প্রমাণিত হতে থাকলে ১৯৯৯ সালে জর্ডান বেলফোর্ট আদালতে নিজেকে দোষী দাবি করেন। ২০০৩ সালে জর্ডানকে ৪ বছর কারাদণ্ড প্রদান করা হয়। কারা ভোগ ছাড়াও মোট ১১০ মিলিয়ন ডলার পরিমাণ অর্থ জরিমানা করা হয়।
নেকড়ে যখন ইঁদুর
দীর্ঘ চার বছর কারাগারে থাকার শাস্তি জর্ডানের মতো বিলাসিতায় কাটানো মানুষের জন্য মারাত্মক কষ্টের ব্যাপার হয়ে দাঁড়ালো। এজেন্ট কোলম্যান এবং তৎকালীন সহকারী অ্যাটর্নি জেনারেল জুয়েল কোয়েন এক শর্তের বিনিময়ে নেকড়ে জর্ডানের শাস্তি কমিয়ে দেয়ার আশ্বাস দিলেন। সেটি হচ্ছে- জর্ডানকে এবার ওয়াল স্ট্রিটের ‘র্যাট’ বা ইঁদুর হতে হবে। ফাঁস করে দিতে হবে শেয়ার বাজারের অন্যান্য প্রতারক এবং অপরাধীদের নাম। ধরিয়ে দিতে হবে অর্থ যোগান দেয়া এবং পাচারের পেছনের মূল হোতাদের।
শুরুতে জর্ডান তার নিজের হিসাব রক্ষককে ধরিয়ে দেন। এরপর একে একে ১০০ জনের মতো প্রতারক ধরিয়ে দিতে সাহায্য করেন তিনি। যুক্তরাষ্ট্র সরকারের প্রতি সহযোগিতার পুরষ্কার স্বরূপ জর্ডান বেলফোর্টকে ৪ বছরের বদলে মাত্র ২২ মাস কারাবরণের পর মুক্তি প্রদান করা হয়। কারাগারে থাকা অবস্থায় তিনি একবারও মাদক সেবন করেননি, যা তার দেহকে মাদকাসক্ত থেকে দূরে রাখতে পরবর্তী জীবনে সহায়তা করেছে।
এক অন্য জর্ডানের গল্প
জেল থেকে ছাড়া পাওয়ার পর এককালের ওয়াল স্ট্রিট নেকড়ে ঠিক করলেন, এবার মানুষের মতো বাঁচবেন। কিন্তু জর্ডান তার অতীতকে ভুলে যেতে চান না। বরং অতীতের জর্ডান, ভবিষ্যতের জর্ডানের জন্য শিক্ষা ও নিদর্শন হিসেবে থাকুক, সেটা ছিল তার সংকল্প। তাই অতীত জর্ডানকে বাঁচিয়ে রাখতে তিনি লেখা শুরু করলেন আত্মজীবনী ‘দ্য উলফ অফ ওয়াল স্ট্রিট’। প্রকাশনার প্রথম বছরে বইটি নিউ ইয়র্ক বেস্ট সেলার হিসেবে নির্বাচিত হয়। সকলের মুখে মুখে তখন জর্ডান বেলফোর্টের নাম। তার এই রোমাঞ্চকর জীবনকে সিনেমায় রূপ দিতে এগিয়ে আসেন বিখ্যাত পরিচালক মার্টিন স্করসেসে। তার প্রিয় অভিনেতা লিওনার্দো ডি ক্যাপ্রিও’র জাদুকরি অভিনয়ে চিত্রায়িত হয় ‘নেকড়ে’ জর্ডানের গল্প। ২০১৩ সালে মুক্তি পায় সিনেমা ‘দ্য উলফ অফ ওয়াল স্ট্রিট’।
নতুন জীবনের জর্ডান আর আগের মতো ধনী নেই। কিন্তু তিনি এক সম্পূর্ণ ভিন্ন জীবনের সূচনা করেন। জর্ডান তার জীবনের গল্প নিয়ে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে প্রায় ৭টি সেমিনারের আয়োজন করেন। তাকে বর্তমান যুগের অন্যতম সেরা মোটিভেশনাল বক্তা হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়। ব্যবসাপ্রেমী জর্ডান মোট ৫০টি বাণিজ্যিক সংস্থা এবং কোম্পানির উপদেষ্টা হিসেবে কাজ করছেন। নামকরা ম্যাগাজিন এবং পত্রিকাগুলোতে জর্ডানের কলাম ছাপা হতে থাকে। এদের মধ্যে ‘নিউ ইয়র্ক টাইমস’, ‘দ্য লস এঞ্জেলস টাইমস’, ‘দ্য হেরাল্ড ট্রিবিউন’, ‘ফোর্বস’, ‘বিজনেস উইক’ প্রভৃতি ম্যাগাজিনের নাম উল্লেখযোগ্য।
জর্ডান বেলফোর্টের কিছু মজার তথ্য
জর্ডান বেলফোর্ট নিজেকে নেকড়ে ভাবতেন। তার সমগ্র জীবনে এমন কিছু ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র ঘটনা এবং ব্যাপার আছে, যেগুলো সম্পর্কে না জানলে তার নেকড়ে নামকরণের সার্থকতা সম্পর্কে বোঝা সম্ভব না। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য তথ্যগুলো হচ্ছে:
- একবার জর্ডান বেলফোর্ট তিন মিনিটের মাথায় প্রায় ১২ মিলিয়ন ডলার আয় করেছিলেন। সেবার তার বাৎসরিক আয় ছিল প্রায় ৫০ মিলিয়ন ডলার।
- এক হোটেল ত্যাগ করার সময় তার বিল উঠেছিলো প্রায় ৭ লাখ ডলার।
- তিনি ঝড়ের কবলে প্রমোদতরী চালিয়ে ভূমধ্যসাগর পাড়ি দেয়ার চেষ্টা করেছিলেন। সেবার ঝড়ের কারণে তার বিলাসবহুল ১৬৭ ফুট প্রমোদতরী একটি হেলিকপ্টারসহ সাগরে ডুবে যায়।
- যুক্তরাষ্ট্র থেকে অর্থ পাচারের জন্য তিনি তার স্ত্রীর চাচীকে ব্যবহার করতেন।
- জর্ডান এক জীবনে এত পরিমাণ মাদক সেবন করেছেন যে, তিনি দাবি করেন, সমপরিমাণ মাদক দিয়ে পুরো গুয়াতেমালা দ্বীপকে বেহুঁশ করে ফেলা যাবে।
- মাদকাসক্ত অবস্থায় গাড়ি চালিয়ে তিনি একরাতে সাতবার দুর্ঘটনায় পড়েছিলেন।
প্রতি বছর হাজার হাজার অপরাধী কারাগার থেকে মুক্তি পায়। কিন্তু এদের মাঝে কয়জন ঘুরে দাঁড়াতে পারে? সংখ্যাটা খুব বেশি হবার কথা নয়। জর্ডান বেলফোর্ট তার জীবনে অপরাধের নেশায় পড়ে সবকিছু হারিয়েছেন। পরিবারের সদস্যবৃন্দ তাকে পরিত্যাগ করার পর কারাগারে একাকী জীবনযাপন করেন তিনি। কিন্তু তিনি দমে যাননি। জেল থেকে বেরিয়ে তিনি নিজের জীবনকে সম্পূর্ণ ভিন্ন আঙ্গিকে সাজিয়ে তুলেছেন। ভুল থেকে শিক্ষা নিয়ে ভিন্ন মানুষ হিসেবে গড়ে উঠেছেন জর্ডান বেলফোর্ট। তার সামনের পথে কী আছে তা জানা নেই, তবে তার এই ঘুরে দাঁড়ানোর গল্প সবসময় তার নিজের এবং অন্যদের জন্য দৃষ্টান্ত হিসেবে বিবেচিত হবে।