কেউ বলেন সাই, কেউ বলেন পিএসওয়াই। ডাকনামে একেকজনের কাছে একেকভাবে পরিচিত হলেও সেই ডাকনামের সমার্থক যে শব্দটি, সেটির স্বীকৃতি বিশ্বময়। বলছি, বিশ্বকাঁপানো ‘গ্যাংনাম স্টাইল’ এর গায়কের কথাই। এই এক গান দিয়ে কোরিয়ান তারকার বিশ্বতারকা হবার ও ইউটিউবের রেকর্ডবইয়ে কালবৈশাখী বইয়ে দেবার গল্পটা আজও পুরনো হয়নি খুব একটা। গ্যাংনামের পর ‘জেন্টলম্যান’ দিয়ে কিছুটা সফল হলেও আস্তে আস্তে পূর্বের ক্ষুরধার চমক হারিয়ে ফেলেন সাই। তবু জনপ্রিয় এ গায়ককে ঘিরে ভক্তদের নেই আগ্রহের কমতি। আজ থাকছে সেই সাইয়ের গল্পই।
প্রাথমিক জীবন
পুরো নাম পার্ক জি-সাং। জন্ম ১৯৭৭ সালের ৩১ ডিসেম্বর দক্ষিণ কোরিয়ার সিউলে। ব্যবসায়ী বাবা পার্ক ওউন-হু ও মা রেস্টুরেন্ট ব্যবসায়ী কিম ইয়াং-হির একমাত্র দুলাল সাইয়ের বেড়ে ওঠা হান নদীর তীরবর্তী ধনাঢ্য গ্যাংনাম শহরে।
ব্যানপো এলিমেন্টারি ও সেহওয়া হাই স্কুলে পড়াশোনা করা সাই কৈশোরেই মার্কিন ‘কুইন’ ব্যান্ড দ্বারা প্রভাবিত হয়েছিলেন ব্যাপকভাবে। কিন্তু মিউজিশিয়ান হওয়ার স্বপ্নে বাগড়া দিয়ে পিতৃ-ঐতিহ্যের পদাঙ্ক অনুসরণ করার বাধ্যবাধকতায় ১৯৯৬ সালে উচ্চশিক্ষার্থে আমেরিকায় পাড়ি জমাতে হয় সাইকে। বোস্টন বিশ্ববিদ্যালয়ে ব্যবসায় শিক্ষার জন্য ভর্তি হলেও এক সেমিস্টার পড়বার পর ১৯৯৭ সালে তিনি এসে ভর্তি হন বার্কলি কলেজ অব মিউজিকে। সেখানেও পড়ার পাঠ চুকোননি সাই। ২০০০ সালে দেশে ফিরে মিউজিক ইন্ডাস্ট্রিতে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে পূর্ণ উদ্যমে মাঠে নামলেন তিনি।
সঙ্গীতের ভুবনে যাত্রা
নিজের একটু পাগলাটে স্বভাব আর গানের মাঝে পাগুলে ব্যাপারটাকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দিতে তিনি নতুন নাম গ্রহণ করলেন “PSY”; ওদিকে অ্যালবামের নাম দিলেন “PSY from PSYcho World”। সেই থেকে পার্ক জি-সাং হলেন পিএসওয়াই বা সাই। স্পষ্টবাদী ও স্থূল লিরিকে থাকা বিতর্ককে ব্যক্তিজীবনেও বহন করে সেই বছরই মারিজুয়ানা সেবনের দায়ে জেলে যান সাই। ২৫ দিনের কারাবাস শেষে পরের বছরই সাই মুক্তি দেন নিজের দুই অ্যালবাম ‘Ssa2’ ও ‘3 Mi’, বিতর্কিত কনটেন্টের দায়ে দ্বিতীয়টির গায়ে তো ‘অ্যাডাল্ট’ তকমাই সেঁটে যায়; সেই অ্যালবাম থেকে ‘চ্যাম্পিয়ন’ গানটি তুমুল জনপ্রিয় হয় এবং জিতে নেয় সিউল মিউজিক অ্যাওয়ার্ড।
২০০৩-০৫ অবধি বাধ্যতামূলক রাষ্ট্রীয় সেনা প্রশিক্ষণের শেষভাগে শৃঙ্খলাভঙ্গের দায়ে ছাঁটাই হন সাই। তারপরের বছরেই আসে নতুন অ্যালবাম ‘Ssa Jip/Cheap House’। এটিই তাকে দেশজুড়ে এনে দেয় অপরিমেয় সুনাম। ২০০৬ সালে তিনি বিয়ে করেন চার বছর ধরে প্রেমের সম্পর্ক থাকা ইয়ু হি-ইয়েনকে। অনিবার্য রাষ্ট্রীয় কারণবশত ২০০৭ এ সিঙ্গেলম্যান হিসেবে সামরিক বাহিনীতে দুই বছর চাকরি করেন সাই। ২০০৯ সালে তিনি চুক্তিবদ্ধ হন দেশটির সর্ববৃহৎ ট্যালেন্ট এজেন্সি ‘ওয়াইজি এন্টারটেনমেন্ট’র সাথে।
গ্যাংনাম স্টাইলের আবির্ভাব!
ওয়াইজিতে যোগদানের তিন বছর বাদে তাদের পরিবেশনাতেই আসে ‘PSY 6’ নামের অ্যালবামটি, যেখানে ছিলো কেবল একটি গান- গ্যাংনাম স্টাইল! তাতেই বাজিমাত। এক গান খানখান করে ভেঙে দিতে লাগলো সকল রেকর্ড। ছোটবেলা থেকেই অন্যদের নিয়ে মজা করে, ক্ষেপিয়ে শিক্ষকদের নাভিশ্বাস তুলতেন ‘ক্লাস ক্লাউন’ সাই। জাপানি টেলিভিশনেও বিয়ন্সি ও লেডি গাগাকে নিয়ে খিল্লি করে বেশ নাম কামিয়েছিলেন। সেই বিদ্রুপ করবার প্রকৃতিপ্রদত্ত ক্ষমতাকে কাজে লাগিয়েই সাই নিয়ে এলেন ‘গ্যাংনাম স্টাইল’কে।
দুই হাতে পয়সা ওড়ানো, জবড়জং কেতাদুরস্তি চলন-বলন, আমুদে ও অতিমাত্রায় বস্তুবাদী মোহাচ্ছন্ন গ্যাংনাম শহর ও তার বাসিন্দাদের নিয়ে একরকম পরিভাষাই চালু হয়ে গিয়েছিলো – ‘গ্যাংনাম স্টাইল’, যে ‘স্টাইল’ আসলে বল্গাহীন ভোগবিলাসী জীবনযাপনের পদ্ধতিকেই সূচিত করতো। গ্যাংনামের এই ধরনটিকেই কৌতুক করে দেখিয়েছেন সাই; কখনো বাথ টাবে, কখনো হট ক্লাবে, কখনো মেট্রোরেলে নেচে-গেয়ে বিদ্রুপাত্মক লিরিকে নিজের সেন্স অব হিউমারের চূড়ান্ত পরিচয় দিয়েছেন তিনি।
লিরিকে কৌতুকভরা গানটির শিরোনাম নিয়েই হয়েছে একচোট কৌতুক। অনভ্যস্ত ইংরেজিভাষী শ্রোতাদের কাছে কোরিয়ান উচ্চারণে ‘ওপ্পান গ্যাংনাম স্টাইল’ শ্রুত হয়েছিলো ‘ওপেন কনডম স্টাইল’! জাতিসংঘ সে বছর সাইকে ‘আন্তর্জাতিক সেনসেশন’ অভিধায় ভূষিত করে।
আলোচনায় যখন গ্যাংনামের নাচ
মিউজিক ভিডিওটি জনপ্রিয় হবার সবচেয়ে বড় কারণটি সম্ভবত ছিলো এর নাচের মুদ্রাগুলো। ‘অ্যালেন ডিজেনারেস শো’-তে “অদৃশ্য ঘোড়ার পিঠে সওয়ার হয়ে লাফানোর মুদ্রা” হিসেবে নাচটিকে সংজ্ঞায়িত করেছিলেন সাই নিজেই। উদ্ভট গায়কি আর বিচিত্র নাচের জন্য আগেই ‘বিদঘুটে গায়ক’ এর তকমা জুটেছিলো সাইয়ের। সেই বিদঘুটের চমক দিয়েই গ্যাংনাম স্টাইল ভেঙে দিলো ইউটিউবের সকল রেকর্ড। মাঠে-ঘাটে, রাজনীতির রাজপথে, অডিটোরিয়ামে, স্টেডিয়ামে সর্বত্র উদযাপনের সমার্থক হয়ে গেলো ‘গ্যাংনাম স্টাইল’! সহজ হওয়ায় আমজনতা যেন লুফে নিলো গ্যাংনামের ঘোড়সওয়ারসহ প্রতিটি মুদ্রাকে। এক মাস ধরে গ্যাংনামের নাচের মুদ্রা আয়ত্ত করা সাই শুধু নিজেই নাচেননি, জাতিসংঘের মহাসচিব বান কি মুনসহ অনেক নামকরা ব্যক্তিকে শিখিয়েছেনও বটে।
ওদিকে নিজ দায়িত্বে শিখে নিয়ে খেলার বিশ্বমঞ্চে গ্যাংনাম নেচেছিলেন ফিলিপিনো বক্সার ম্যানি প্যাকিয়াও, সার্বিয়ান টেনিস সেনসেশন নোভাক জকোভিচ, উরুগুইয়ান ফুটবলার এডিসন কাভানি, উইন্ডিজ ক্রিকেটার ক্রিস গেইলের মতো তারকারা। মোদ্দাকথা, ২০১২-১৩ অবধি বিশ্ব যেন বুঁদ ছিলো গ্যাংনাম জ্বরে।
তিব্বতীয় স্বাধীনতা সংগ্রামের সমর্থকেরা এই গানকে কাজে লাগিয়েই চিনা প্রেসিডেন্ট শি চিনপিং-এর বিরুদ্ধে তৈরি করেছিলেন প্যারোডি। ২০১২ সালের সেপ্টেম্বরে ক্যালিফোর্নিয়ার ১৪ সমুদ্ররক্ষীর চাকরি গিয়েছিলো ‘লাইফগার্ড স্টাইল’ শিরোনামে গ্যাংনাম স্টাইলের প্যারোডির দায়ে। ঠিক তারপরই থাইল্যান্ডের নৌবাহিনীর একদল সদস্যও উর্দি পরিহিত অবস্থায় গ্যাংনাম নেচে ব্যাপক সমালোচিত হয়েছিলেন! হার্ভাড বিজনেস রিভিউয়ের মতে গানটির জনপ্রিয়তার কারণ যথাযথ কপিরাইট না থাকা, যে কারণে বিশ্বব্যাপী প্রায় ১,০০০ প্যারোডি নির্মিত হয়েছিলো গানটির।
যত রেকর্ড গ্যাংনামের
২০১২ সালের ১৫ জুলাই গ্যাংনাম স্টাইল ইউটিউবে আপলোড করা হয়েছিলো। দু’মাসের মাথায় সেপ্টেম্বরের ২০ তারিখ কার্লি রে জেসপেনের ‘কল মি মেইবি’কে টপকে ইউটিউবে সর্বোচ্চ লাইকপ্রাপ্তির গিনেজ রেকর্ড ও ৪ অক্টোবরে জাস্টিন বিবারের ‘বেবি’কে টপকে সর্বোচ্চ ভিউপ্রাপ্তির ইউটিউব রেকর্ড বাগিয়ে নেয় গ্যাংনাম স্টাইল। আর ইউটিউবের প্রথম ভিডিও হিসেবে ডিসেম্বরের ২১ তারিখেই ১ বিলিয়ন ভিউয়ের কোঠা স্পর্শ করবার পর ২০১৪ সালের জুনে তা ২ বিলিয়ন ভিউ অতিক্রম করে। ২০১৫ সালের জুন পর্যন্ত গ্যাংনাম স্টাইল ও জাস্টিন বিবারের ‘বেবি’ ছাড়া অন্য কোনো গান বিলিয়নের গৌরব অর্জন করতে পারেনি। কিন্তু তার ঠিক সাড়ে তিন মাসের মাথায় অক্টোবরের ৭ তারিখ নাগাদ ১০টি মিউজিক ভিডিও বিলিয়ন ভিউয়ের রেকর্ড স্পর্শ করে।
প্রায় ৫ বছর (দিনের হিসেবে ১৬৮৯ দিন) ধরে সর্বোচ্চ ভিউয়ের রেকর্ড অক্ষুণ্ণ রাখবার পর ২০১৭ সালের ১০ জুলাই উইজ খলিফার ‘সি ইউ এগেইন’ এর কাছে শীর্ষস্থান খোয়াতে হয় গ্যাংনাম স্টাইলকে। দ্রুততম সময়ে বিলিয়ন ভিউ ছোঁবার রেকর্ডও অ্যাডেলের ‘হ্যালো’র কাছে হারাবার পর বেশ পেছনেই পড়ে যায় গ্যাংনাম স্টাইল। তবে দ্রুততর সময়ে তিন বিলিয়ন ছোঁবার রেকর্ডে এখনও লুইস ফন্সির ‘দেসপাসিতো’ ও এড শীরানের ‘শেইপ অব ইউ’ এর পরের নামটিই গ্যাংনাম স্টাইলের। সেই সঙ্গে ইউটিউবের সর্বকালের সর্বোচ্চ ভিউসমৃদ্ধ ভিডিওর তালিকায় বর্তমানে চার নম্বরে গ্যাংনাম স্টাইল! দেশটির অডিও সেক্টর ১৩.৪ মিলিয়ন ডলার আয় করেছিলো শুধু এই গানটি দিয়েই।
জেন্টলম্যানের ঝলক
২০১৩ সালের মার্চ মাসে হুট করে গুঞ্জন ওঠে সাইয়ের আসছে গানটিতে ‘আসারাবিয়া’ নামের একটি শব্দ ব্যবহার করা হয়েছে। কোরিয়ান ভাষায় উত্তেজক প্রফুল্লতা প্রকাশক গালি হিসেবে শব্দটি ব্যবহার করা হয়। কিন্তু কাকতালীয়ভাবে আরবি ভাষায় শব্দটির একটি বুৎপত্তিগত রাজনৈতিক অর্থ থাকায় শব্দটিকে ঘিরে তৈরি হয় নতুন বিতর্ক। ‘আমেরিকাজ গট ট্যালেন্ট’ নামক রিয়েলিটি শোতে তখন সাই জানান, গানটি সংশোধনী প্রক্রিয়ার ভেতর আছে। লিরিকে বিতর্কিত শব্দ থাকবে কিনা, এই জল্পনা কল্পনার মাঝেই মূলত গ্যাংনাম স্টাইলের পর সাইয়ের পরবর্তী একক মিউজিক ভিডিওর মূল প্রচারণাটার ফাটকাটা কাজে দেয়। পরবর্তীতে লিরিক বদলে গানটির শিরোনাম দেওয়া হয় ‘জেন্টলম্যান’, যথারীতি আবারও বিদ্রুপাত্মক কে-পপ জনরার গান, সাথে ‘বিদঘুটে’ নাচ। এসবের সাথে সাইয়ের নিজস্ব কারিশমায় মিশেলে ‘জেন্টলম্যান’ও ছুঁতে সক্ষম হয় এক বিলিয়নের চূড়া! মুক্তির প্রথম দিনেই ৩৮ মিলিয়ন ভিউ নিয়ে নতুন রেকর্ড গড়ে জেন্টলম্যান।
তবে কি ভাটা পড়লো জনপ্রিয়তায়?
এরই ধারাবাহিকতায় ২০১৪ সালে মার্কিন মিউজিশিয়ান স্নুপ ডগের সাথে মিলে বাজারে আসে সাইয়ের গান ‘হ্যাংওভার’, যা মার্কিন বাজারে সাইয়ের স্থায়ী জনপ্রিয়তা তৈরি করে দেয়। ২০১৫ সালে বের হয় সাইয়ের সপ্তম অ্যালবাম ‘চিলজিপ সাই-দা’। এর মধ্যে ড্যাডি, ন্যাপাল বাজি, আই রিমেম্বার ইউ, ড্যান্স জকি- এর মিউজিক ভিডিওতে উইল আই অ্যাম, ব্লাক আইড পাইয়ের মতো তারকার ক্যামিও উপস্থিতির কারণে সেগুলো বেশ জনপ্রিয় হয়। সর্বশেষ অ্যালবাম ‘ফোর ইন্টু টু ইকুয়ালটু এইট’ এর নিউ ফেইস, আই লাভ ইট, ফ্যাক্ট, লাভ, ল্যাস্ট সীন – এই গানগুলো বাজারে ভালো চললেও ঠিক ‘সাই’সুলভ ‘হিট’ হতে পারেনি। এ কারণে জেন্টলম্যানের পর সাইয়ের প্রায় এক ডজন গান এলেও কোনোটিই আর বিলিয়ন ভিউয়ের গৌরব অর্জন করতে পারেনি!
নিজের জনরা বা পূর্ব ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়াতে জনপ্রিয়তা পুরোদমে ধরে রাখলেও বৈশ্বিক জনপ্রিয়তার দিক থেকে খানিকটা যেন মিইয়ে গেছেন সাই। তারপরও ২৫ মিলিয়ন ডলারের সম্পত্তি নিয়ে এশিয়ার ধনাঢ্য সঙ্গীতশিল্পীর তালিকায় এখনো বহাল তবিয়তেই টিকে আছেন এই ‘গ্যাংনাম তারকা’। দুই যমজ কন্যা ও স্ত্রীকে নিয়ে বর্তমানে সিউলেই থাকছেন এই শিল্পী।
ফিচার ইমেজ: soompi.com