রবীন্দ্র-নজরুলোত্তর বাংলা সাহিত্যের প্রতিটি শাখাই অনেক সমৃদ্ধ ছিল। ছড়া, কবিতা, ছোটগল্প, উপন্যাস, প্রবন্ধ কিংবা গান- বাংলা ভাষায় রচিত শিল্প-সাহিত্যের প্রায় সব শাখাতেই চিরায়ত বাংলা ও বাঙালির ঐতিহ্য ও জীবনবোধের পরিচয় ছিল প্রকট। কিন্তু শুধু নাটকেই ছিল না এর উপস্থিতি। রবীন্দ্র-নজরুল ছাড়া যারাই বাংলায় নাটক লিখেছেন, তাদের প্রায় সবাই ছিলেন পাশ্চাত্যের অন্ধ অনুগামী। তাদের নাটকের দৃশ্যান্তরে পাশ্চাত্যের প্রভাব ছিল প্রবল। সে প্রভাব কাটিয়ে বাংলা নাটককে ঘরে ফেরানোর জন্য যার অবদান সবচেয়ে বেশি, তিনি নাট্যাচার্য সেলিম আল দীন। তাকে কেউ বলেন ‘বাংলা নাটকের মহাকবি’, আবার কেউ বলেন ‘বাংলা নাটকের বাঁকবদলের কারিগর’।
সাতচল্লিশের দেশভাগ-পরবর্তী সময়ে বেশিরভাগ নাট্যকারই ঔপনিবেশিক নাট্যরীতিকে তাদের রচনায় প্রয়োগ ঘটান। ফলে দেশভাগ-পরবর্তী সময় থেকে বাংলাদেশেও ইউরোপীয় রীতির আদলে বহমান থাকে বাঙালির নাট্যচর্চা। সেলিম আল দীন শুরুর দিকে যে নাটকগুলো রচনা করেন, সেগুলোতেও সে চর্চা কিছুটা দেখা যায়। কিন্তু একসময় তিনি অনুধাবন করেন, বাংলা ভাষায় নাটক রচনা করতে হলে বাঙালির নিজস্ব রীতিতেই করতে হবে। বাংলা নাটক নিয়ে গবেষণা করতে গিয়ে হাজার বছরের বাঙালি সংস্কৃতিতেও নাট্যচর্চার উপস্থিতি খুঁজে পান তিনি। ফলে বাংলা নাটকে সেই চর্চা শুরু করেন, ইউরোপীয় ধারাকে একপাশে সরিয়ে নিজস্ব ধারার দিকে ধাবিত করেন বাংলা নাটককে।
সেলিম আল দীনের নাটকগুলোতে বাঙালির নাট্য-সংস্কৃতির কথা (বর্ণনা ও সংলাপ)-নৃত্য-গীত ও আপাত চরিত্রাভিনয়ের রূপ সম্পূর্ণ নতুনভাবে বিকশিত হয়। বিশেষ করে, ঐতিহ্যবাহী বাংলা নাটকে যেখানে গীতের প্রভাব মুখ্য হয়ে ওঠে, সেখানে তার নাটকে বর্ণনাকেই দেওয়া হয় প্রাধান্য, বর্ণনাই হয়ে ওঠে নাটকের প্রাণ। সেইসাথে ঐতিহ্যবাহী নাট্য-পরিবেশনায় ব্যবহৃত সংলাপাত্মক অভিনয়েরও বিস্তৃত ক্ষেত্র তৈরি হয় তার নাটকে। সেলিম আল দীন প্রবর্তিত নতুন এই নাট্যকৌশল একটি স্বকীয় ধারার সৃষ্টি করে। ফলে আশির দশক থেকে বাংলা নাটকে দুটো ধারা শুরু হয়। একটি ইউরোপীয় ঔপনিবেশিকতা ও পাশ্চাত্যমুখী শৃঙ্খলিত ধারা, অন্যটি দেশজ ধারায় প্রবর্তিত আধুনিক নাট্যধারা। যদিও স্বকীয় নাট্যধারার কথা-নৃত্য-গীত ত্রয়ীর বন্ধনে সৃষ্ট কথানাট্য, আখ্যান, পাঁচালিই একসময় তরুণদের নিকট নাট্যচর্চার প্রধান হাতিয়ার হয়ে ওঠে।
সেলিম আল দীনের দেশজ ধারার নাটকগুলো পাঠ করলে কিংবা মঞ্চায়ন দেখলে খুব সহজেই বোঝা যায়, গ্রামীণ জনগোষ্ঠীর বৈচিত্রময় ও বহুমাত্রিক জীবনধারাই শৈল্পিকভাবে উঠে এসেছে। নাটকে অসংখ্য চরিত্রের দৃশ্যলোক তৈরি করেছেন তিনি। সেসব বিচিত্র চরিত্রের মধ্যে কৃষক, শ্রমিক, কামার, কুমার, গাড়োয়ান, জেলে, রিকশাওয়ালা, পালকি নৃত্যক, বেহারা বা কাহার, কবিয়াল, ডোম, কসবি, যাত্রাশিল্পী, কাঠমিস্ত্রি, মাইটাল, খেতমজুর, সারেং, মাঝি, মাল্লা, মুচি, গৃহিণী, বায়েন, হাড়-কুড়ানো, বয়াতি, তাঁতিসহ আরও অসংখ্য তৃণমূল মানুষের উপস্থিতি প্রবলভাবে লক্ষ করা যায়। নাটকের গল্পগুলোতে এই বিচিত্র চরিত্রগুলোর বেশিরভাগেরই বিকাশ ঘটেছে ‘সামাজিক রূপান্তর’-এর ধারাবাহিকতায়; অর্থাৎ, বাংলাদেশের আর্থসামাজিক অবস্থাকে স্বীকার করে উত্থান-পতনের ধারায় গ্রামীণ মানুষের মধ্যে নিরন্তর যে পেশাবদলের প্রক্রিয়া চলে, সেটি নাট্যচর্চার শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত তুলে এনেছেন তিনি।
সেলিম আল দীন অনেক নাটক লিখেছেন। তার নাটকগুলোকে যদি দুটো পর্বে ভাগ করা হয়, তাহলে প্রথম পর্বে পাশ্চাত্যধারার নাটকগুলো থাকবে, দ্বিতীয় পর্বে থাকবে পরিণত সময়ে লেখা নাটকগুলো। আমরা মূলত দ্বিতীয় পর্ব, তথা পরিণত সময়ের নাটকগুলো নিয়ে আলোকপাত করব। কারণ এই নাটকগুলোই সেলিম আল দীনকে নাট্যকার হিসেবে নিয়ে গেছে অনন্য উচ্চতায়, বাংলা নাটককে দেখিয়েছে নতুন পথের দিশা। আবহমান বাংলার জীবনালেখ্য ও সংস্কৃতিকে তুলে ধরে তিনি করেছেন শেকড়ের সন্ধান। এই শেকড়সন্ধানী নাট্যকার পরিণত সময়ে লেখেন কিত্তণখোলা, শকুন্তলা, কেরামতমঙ্গল, হাত হদাই, চাকা, যৈবতী কন্যার মন, হরগজ, প্রাচ্য, বনপাংশুল, নিমজ্জন, ধাবমান, স্বর্ণবোয়াল, ঊষা উৎসব ও সর্বশেষ পুত্র। যে নাটকগুলো বাংলা নাটককে দিয়েছে নিজস্বতা, ধাবমান করেছে ঐতিহ্যের দিকে।
কিত্তনখোলায় সেলিম আল দীন বাঙালির নিজস্ব নাট্যশৈলী নির্মাণের পথ খুঁজে পান। ‘কিত্তনখোলা’ নাটকে বর্ণনাত্মক নাট্যরীতির সূত্রপাত করেন। যে নাটকটির প্রায় সবগুলো চরিত্রের মধ্যেই নৃ-তাত্ত্বিক, সামাজিক, রাজনৈতিক, ধর্মীয় ও অর্থনৈতিক জীবনচিত্র ফুটে উঠেছে। খ্যাতিমান চলচ্চিত্র পরিচালক আবু সাইয়ীদ এই নাটকটি নিয়ে ২০০০ সালে ‘কিত্তনখোলা’ নামে চলচ্চিত্র নির্মাণ করেন।
নোয়াখালি উপকূলের বৃদ্ধ নাবিক আনার ভাণ্ডারিকে নিয়ে রচিত ‘হাত হদাই’ নাটকটিতে ওঠে এসেছে ঐ অঞ্চলের মানুষের জীবন-সংগ্রাম, জীবিকা, ভাবনা ও প্রকৃতির সঙ্গে যুদ্ধ করে টিকে থাকার আখ্যান। উপকূলীয় অঞ্চলের শব্দ ‘হাত হদাই’ এর আক্ষরিক অর্থ- সাত সওদা বা সপ্তবাণিজ্য। এই নাটকটি রচনা করে সেলিম আল দীন তার নিজের প্রবর্তিত কথানাট্যের ধারাকে সমৃদ্ধ করেন।
বিস্তৃত পটভূমিতে নির্মিত ‘কেরামতমঙ্গল’ সেলিম আল দীনের মহাকাব্যিক ব্যাপ্তির মহা-আখ্যান। মহাকাব্যের মতোই বিস্তার, স্বর্গ-মর্ত্য-পাতালের মতো এর পটভূমি বিস্তৃত। এই নাট্যাখ্যানে রাজনীতিবিদ, কৃষক, মাঝি, জমিদার-প্রজা, মুক্তিযোদ্ধা-রাজাকার, হিন্দু-মুসলিম-খ্রিস্টান, আদিবাসী, হাজং-গারো ও সাধারণ শ্রমজীবী মানুষের চালচিত্র উপস্থাপিত হয়েছে। প্রধান চরিত্র ‘কেরামত’ মূলত এই মহাকাব্যিক আখ্যানের একজন কথক ছাড়া কিছুই নয়।
নব্বইয়ের গণ-অভ্যুত্থানে স্বৈরাচারী সরকারের পতন ও গণতন্ত্রের ফিরে আসাকে কেন্দ্র করে রচিত নাটক ‘চাকা’। গরুর গাড়িতে একটি লাশ যায় গ্রামের বাড়িতে। কিন্তু ঠিকানা খুঁজে না পেয়ে সেটি ঘুরতেই থাকে। লোকনাট্য ধারায় রচিত কথানাট্যটিকে অবিরাম পথচলার এক অপূর্ব আখ্যান বলা যায়। ১৯৯৩ সালে এই নাটকটি নিয়ে পরিচালক মোরশেদুল ইসলাম সিনেমা নির্মাণ করেন।
দুটি আলাদা সময়ের দু’জন নারীর একই পরিণতি নিয়ে রচিত আখ্যানকাব্য হলো ‘যৈবতী কন্যার মন’। এই নাটকটিতে সেলিম আল দীন গদ্য ও পদ্যের চমৎকার সংমিশ্রণ ঘটিয়েছেন।
১৯৮৯ সালে মানিকগঞ্জের হরগজ গ্রামের এক প্রলয়ঙ্করী ঘূর্ণিঝড় ও তৎপরবর্তী একদল শহুরে ত্রাণকর্মীর উদ্ধারকাজে অংশগ্রহণ সম্পর্কিত প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতার আলোকে ‘হরগজ’ নাট্যকাহিনীটি নির্মাণ করেছেন সেলিম আল দীন। প্রকৃতির বিরূপতায় মানুষের অসহায়ত্ব এই নাট্যোপাখ্যানের মূল কথা। ‘বনপাংশুল’ নাটকে সেলিম আল দীন ক্ষুদ্র নৃ-তাত্ত্বিক জনগোষ্ঠীর অজানা কথামালা বিবৃত করেছেন। বিপন্ন হয়ে আসা এসব জনগোষ্ঠীর প্রতি বাঙালির শোষণ-নির্যাতনের উপাখ্যানপর্ব উঠে এসেছে নাটকটিতে। ‘প্রাচ্য’ নাটকে উঠে এসেছে বেহুলা-লখিন্দরের বর্তমান সময়ের চিত্র। নব-আঙ্গিকে নাট্যকার এ যুগের বেহুলা আর লখিন্দরদের তুলে ধরেছেন সমাজের সামনে। একটি বিয়ে ও সেই বিয়ের পর সমাজের ‘ইমপ্যাক্ট’ নিয়ে বেহুলা-লখিন্দরের কাহিনির পুনর্নির্মাণ করেছেন সেলিম আল দীন।
২০০৫-২০০৬ প্রায় দু’ বছর ধরে লেখা নাটক ‘ধাবমান’। সোমেশ্বরী নদীর পূর্বপাড়ের সাধুটিয়া গ্রামের নহবত ও তার নিঃসন্তান দ্বিতীয় স্ত্রী সুবতীর জীবনের নানা-ঘাত-প্রতিঘাত, একটি নিরীহ পশুর প্রতি নিজের সন্তানের মতোই বিরল ভালোবাসা ও অমোঘ মৃত্যুর এক কাহিনীচিত্রের নাম ‘ধাবমান’। ‘নিমজ্জন’ নাটকে নাট্যকার দেখিয়েছেন পৃথিবীব্যাপী চলে আসা গণহত্যার ইতিহাস ও ইতিবৃত্ত। প্রাচীন কাল, মধ্যযুগ আর আধুনিককালের সকল গণহত্যার বয়ান তিনি তুলে ধরেছেন অভিনব এক কাব্যিক অভিজ্ঞতায়।
সেলিম আল দীন ২০০৬ সালে ‘স্বর্ণবোয়াল’ রচনা করেন। মাত্র ২০ দিনে রচিত বর্ণনাত্মক ধারার নাটকটিতে ‘স্বর্ণবোয়াল’ চরিত্রটি রূপকথা থেকে এসেছে। কিন্তু নাটকের পরিণামে এসে মর্মান্তিক বাস্তবতায় খুন হয় সে। গল্পটি মূলত মাছ নিয়ে। নাট্যকার উপাখ্যানের কাহিনী বড়শিতে গাঁথা মাছটির মতো ওলট-পালট করেছেন।
২০০৭ সালে লেখা ‘পুত্র’ সেলিম আল দীনের সর্বশেষ পূর্ণাঙ্গ রচনা। মাত্র সাত-আট দিনের মধ্যে এই নাটকটি লিখে ফেলেন তিনি। যমুনাপাড়ের এক মাইট্যাল দম্পতির পুত্রহারা বেদনাকে অপূর্ব মহিমায় নাটকটিতে তিনি প্রকাশ করেছেন। ‘পুত্র’ নাটকের নামকরণে যে পুত্রসন্তান, তার নাম মানিক; সে আমগাছের ডালে ফাঁস লাগিয়ে আত্মহত্যা করেছিল। তাই তাকে জানাজা ছাড়াই চিরনিদ্রায় মাটির গভীরে রেখে আসতে হয়। এই সত্য ঘটনাটিই নাট্যকার অনন্য মহিমায় ও সুনিপুণ বর্ণনায় গর্ভজাত পুত্রের জন্য চিরায়ত বাংলার পিতা-মাতার অবিশ্রান্ত ভীতি ও উদ্বেগকে উপস্থাপন করেছেন।
সেলিম আল দীন নাটক রচনা শুরু করেছিলেন পাশ্চাত্য অনুপ্রাণিত নিরীক্ষার ওপর ভর করে, কিন্তু খুব দ্রুতই তা বর্জন করে বাংলা নাটকের মধ্যযুগীয় নাট্যরীতির অনুপ্রেরণায় তিনি গড়ে তোলেন নিজের আলাদা একটি জগৎ। পাশ্চাত্য-আবর্তিত নাট্যশিল্পের সকল বিভাজনকে বাঙালির হাজার বছরের নন্দনতত্ত্বের আলোকে অস্বীকার করে এক নতুন শিল্পরীতি প্রবর্তন করেন তিনি। তিনি এ রীতির নাম দেন ‘দ্বৈতাদ্বৈতরীতি শিল্পতত্ত্ব’। বর্ণনাত্মক নাট্যরীতিতে লেখা তার নাটকগুলোতে সমাজের অবহেলিত ও নিম্নপেশার মানুষের নৃতাত্ত্বিক পটে তাদের বহুস্তর জীবনযাত্রার বাস্তবতাই উঠে আসে। ‘জন্ডিস ও বিবিধ বেলুন’, ‘মুনতাসীর’, ‘শকুন্তলা’, ‘কিত্তনখোলা’, ‘কেরামতমঙ্গল’, ‘হাতহদাই’, ‘যৈবতী কন্যার মন’, ‘চাকা’, ‘হরগজ’, ‘বনপাংশুল’, ‘প্রাচ্য’, ‘নিমজ্জন’, ‘ধাবমান’, ‘স্বর্ণবোয়াল’ ইত্যাদি মঞ্চসফল ও পাঠকনন্দিত নাটক রচনা করে তিনি ক্রমেই নিজেকে অতিক্রম করে যেতে থাকেন।
অবশ্য তার সৃষ্ট শিল্পকর্মের কোনো নাম দেননি তিনি, দিতেও চাননি। তার ভাষায়
“আমি চাই আমার শিল্পকর্মগুলো নাটকের অভিধা ভেঙে অন্যসব শিল্পতীর্থগামী হয়ে উঠুক।”
‘বনপাংশুল’ নাটকের ভূমিকা লিখতে গিয়ে তিনি সেখানে স্পষ্টভাবেই তার রচনাটিকে— উপাখ্যান, নাটক, গাথাকাব্য যেকোনো নামেই গ্রহণের স্বাধীনতা পাঠককে দিয়েছেন। দ্বৈতাদ্বৈতবাদ শিল্পরীতির ব্যাখ্যায় তিনি বলেন-
“গ্রিক রিচুয়াল থেকে যদি গ্রিক ট্র্যাজেডির জন্ম হতে পারে এবং তা নিয়ে উত্তরকালে শিল্পতত্ত্ব রচিত হয়, তবে প্রাচ্যেও ধর্মতত্ত্ব থেকে কেন শিল্পতত্ত্ব অনুসৃত হবে না বা হতে বাধা কোথায়? তুরস্ক, ইরাক, ইরানের সুফি তত্ত্বের ধারায় বাংলায় চৈতন্যদেব ‘অচিন্ত্য দ্বৈতাদ্বৈতবাদ’ নামে যে বৈষ্ণব ধর্মতত্ত্বের প্রচলন করেন, আমি তাকেই আধুনিককালের করে তুলেছি।…বস্তুতপক্ষে দ্বৈতাদ্বৈতবাদী শিল্পতত্ত্বের আবিষ্কারের পরে বা ওই শিল্পতত্ত্বের প্রতি প্রগাঢ় বিশ্বাস জন্মানোর ফলে আমি চলতি অর্থে নাটক লিখি না। আমার লেখাগুলো ঐতিহ্যবাহী বাংলা পাঁচালি ও কথকতার ধারায় সমকালীন প্রয়াস।”
তার নব-আঙ্গিকের ‘চাকা’ নাটকটি সম্পর্কে যেমন সব্যসাচী লেখক সৈয়দ শামসুল হক লিখেছিলেন-
“সেলিম আল দীন এই কথানাট্যের রচয়িতা, বাংলা নাটকের এক প্রধান পুরুষ; সেলিম অনবরত সন্ধান করে চলেন প্রকাশের নতুনতর মার্গ; নতুন, কিন্তু বাংলা ভাষার সৃষ্টি এবং হাজার বছরের ধারাবাহিকতার অন্তর্গত অবশ্যই।”
নাটকের মাধ্যমে বাঙালির আত্মপরিচয়ের সন্ধান করা সেলিম আল দীন নাটক রচনার ক্ষেত্রে বিশ্বাস করতেন, বাঙালি জীবন এবং সামাজিক রীতিনীতি এবং সংস্কৃতির মধ্যেই নাট্যোপাদান রয়েছে। হাজার বছরের বাংলা সাহিত্য নিয়ে গবেষণা করতে গিয়ে তিনিই প্রথম আবিষ্কার করেন, ঊনিশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধে বেলগাছিয়ার ইউরোপীয় থিয়েটার আসার অনেক আগে থেকেই বাঙালির চেতনাজগতে নাট্যোপাদান ছিল এবং সে উপাদানের সংমিশ্রণে সাহিত্যও আছে। পাশ্চাত্যের নাট্যরীতি বর্জন করা নিয়ে এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন-
“আমাদের নাগরিক জীবনের অনুষঙ্গ তো পাশ্চাত্যের অপঘাতের আলো। এটাকে অবলম্বন করে যদি শিল্পচর্চা করি, তাহলে সেটা নিশ্চিতভাবেই ভুল দিকে ধাবিত হবে। কারণ, ইউরোপে রিয়েলিজম-কিউবিজম ছাড়া আর কোনো আন্দোলন পজিটিভ কিছুর জন্ম দেয়নি। এক্সপ্রেশিনিজম, ইম্প্রেশানিজম, দাদাইজম— ক্ষয়িষ্ণু সমাজ থেকে উঠে আসা এইসব শিল্পতত্ত্ব আমাদেরকে যেন গ্রাস না করে।”
বাংলা নাটকে সম্পূর্ণ নতুন ধরনের প্রকরণ ব্যবহার প্রসঙ্গে তিনি লিখেছেন-
“আমার কাছে সব সময় মনে হয়েছে, বাংলা কবিতার চেয়ে নাটকের যে দীনতা, উপন্যাসের চেয়ে নাটকের যে সীমাবদ্ধতা, সেটাকে ঘোচাতে হবে। সেটা ঘোচাতে যদি যাই, তাহলে আমাকে নতুন ভূমি, নতুন মানুষ, নতুন শিল্প দর্শন আবিষ্কার করতে হবে। এই ভূমি আবিষ্কার করতে গিয়ে আমার কাছে প্রচলিত কাঠামোগুলোকে কঠোরভাবে বর্জন করতে হয়েছে। ফলে আমার লেখা পড়ে হুট করে নাটক মনে হয় না। কিন্তু এটাও তো সত্য যে, মূলত আমি নাটকই লিখতে চেয়েছি।”
বাংলা নাটকের খোলনলচে পাল্টে দেওয়া নাট্যকার সেলিম আল দীন ১৯৪৯ সালের ১৮ আগস্ট ফেনীর সোনাগাজীর সেনেরখিল গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। মফিজউদ্দিন আহমেদ ও ফিরোজা খাতুনের তৃতীয় সন্তান ছিলেন তিনি। বাবার চাকরিসূত্রে তিনি দেশের বিভিন্ন জায়গায় ঘুরে বেড়ান শৈশব থেকে। ফলে তার স্কুলজীবন কাটে ফেনী, চট্টগ্রাম, সিলেট, ব্রাহ্মণবাড়িয়া ও রংপুরের বিভিন্ন স্কুলে। ১৯৬৪ সালে ফেনীর সেনেরখিলের মঙ্গলকান্দি মাধ্যমিক বিদ্যালয় থেকে মাধ্যমিক ও ১৯৬৬ সালে ফেনী কলেজ থেকে উচ্চ-মাধ্যমিকে উত্তীর্ণ হন। ১৯৬৭ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগে ভর্তি হলেও দ্বিতীয় বর্ষে উঠেই সেখান থেকে চলে যান টাঙ্গাইল; গিয়ে ভর্তি হন টাঙ্গাইলের করোটিয়ার সাদত কলেজে। সেখান থেকে স্নাতক সম্পন্ন করার পর ১৯৭৩ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগ থেকে স্নাতকোত্তর সম্পন্ন করেন। ১৯৯৫ সালে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ‘মধ্যযুগের বাংলা নাট্যরীতি’ নিয়ে গবেষণা করে পিএইচডি ডিগ্রি লাভ করেন।
স্নাতকোত্তর পর্বে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগে ভর্তি হওয়ার পরই মূলত লেখক হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেন সেলিম আল দীন। শুরুতে কবিতার প্রতি টান ছিল ব্যাপক। এরপর সেখান থেকে চলে যান নাটকে। ১৯৬৮ সালে কবি আহসান হাবিব সম্পাদিত দৈনিক পাকিস্তানে (পরবর্তী সময়ে দৈনিক বাংলা) তার প্রথম প্রবন্ধ ছাপা হয়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে এমএ পড়ার সময়ই তিনি রেডিও এবং টেলিভিশনের জন্য নাটক লিখতে শুরু করেন। তখনই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় নাট্যচক্র’র সঙ্গে যুক্ত হন। সাথে ছিলেন নাসিরউদ্দিন ইউসুফ, সালেক খান, রাইসুল ইসলাম আসাদ এবং খ্যাতিমান আরো অনেকে।
সেলিম আল দীন রচিত নাটকের প্রথম মঞ্চায়ন হয় ১৯৭২ সালে; নাটকটি প্রযোজনায় ছিল বহুবচন, নাটকের নাম ছিল ‘সর্পবিষয়ক গল্প’। ১৯৭২ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র সংসদ মঞ্চায়ন করে তার লেখা ‘জন্ডিস ও বিবিধ বেলুন’। পরের বছর নাট্যচক্র মঞ্চায়ন করে তার লেখা ‘এক্সপ্লোসিভ ও মূল সমস্যা’। নাট্যদল বহুবচন ও নাট্যচক্র’র পর বাংলাদেশের নাট্য আন্দোলনের বাঁক পরিবর্তনের প্রয়োজনে ১৯৭৩ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় ‘ঢাকা থিয়েটার’। রেডিওতে তার প্রথম নাটক ‘বিপরীত তমসায়’ (১৯৬৯) ও টেলিভিশনে তার প্রথম নাটক ‘ঘুম নেই’ (১৯৭০) প্রচারিত হয়। পড়াশোনা শেষে কপি-রাইটার হিসেবে বিজ্ঞাপনী সংস্থা বিটপীতে যোগ দেন তিনি।
১৯৭৪ সালে সেলিম আল দীন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগে প্রভাষক হিসেবে যোগ দেন। সেখানে যোগ দিয়ে তিনি নাটক ও নাট্যচর্চায় আরও উদ্যমী হয়ে ওঠেন। গবেষণায় মনোযোগ দেন প্রবলভাবে। ১৯৮৬ সালে তার হাত ধরেই জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে দেশের প্রথম নাটক ও নাট্যতত্ত্ব বিভাগ প্রতিষ্ঠা হয়। শুরু হয় নাটকের প্রাতিষ্ঠানিক উচ্চশিক্ষা। এই নবতর অধ্যায় সংযোজনের মাধ্যমে গবেষণার দ্বার উন্মুক্ত হয়। বর্তমানে এ বিভাগে স্নাতক, স্নাতকোত্তর, এমফিল ও পিএচডি করার সুবিধা রয়েছে। জাহাঙ্গীরনগরের ধারাবাহিকতায়, ঢাকা, রাজশাহী, চট্রগ্রাম, জগন্নাথ ও কবি নজরুল বিশ্ববিদ্যালয়েও যাত্রা শুরু হয় নাটক ও নাট্যতত্ত্ব বিভাগের।
নাট্যশিল্পকে বাংলাদেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলের মানুষের কাছে পৌঁছে দেবার লক্ষ্যে ১৯৮১-৮২ সালের দিকে তিনি ও নাট্যনির্দেশক নাসিরউদ্দিন ইউসুফ গড়ে তোলেন ‘বাংলাদেশ গ্রাম থিয়েটার’। সেলিম আল দীন বিভিন্ন মেয়াদে এই সংগঠনের সাধারণ সম্পাদক, সভাপতি এবং প্রধান উপদেষ্টা হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। তার অবর্তমানে গ্রাম থিয়েটারকে চালিয়ে নিয়ে যাচ্ছেন নাসিরউদ্দিন ইউসুফ। সারা দেশে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে এর শাখা-প্রশাখাগুলো।
সেলিম আল দীনের বেশিরভাগ নাটকই মঞ্চায়ন করে ঢাকা থিয়েটার। তার নাট্যরীতির সার্থক রূপায়ন ঘটায় এই নাট্যদলটি। এক্ষেত্রে নাসিরউদ্দিন ইউসুফের চিত্রনাট্য রাখে বড় ভূমিকা। বাংলাদেশে সেলিম আল দীনের নাটকের মঞ্চায়ন মানেই নাসিরউদ্দিন ইউসুফ বাচ্চুর চিত্রনাট্য। দীর্ঘদিনের সহকর্মী না হলে তিনিও হয়তো সাহস করতেন না সেলিম আল দীনের রচনায় হাত দেয়ার। মঞ্চ ছাড়াও তার বেশকিছু জনপ্রিয় টিভি নাটকও আছে। ‘রক্তের আঙুরলতা’, ‘অশ্রুত গান্ধার’, ‘গ্রন্থিকগণ কহে’, ‘ভাঙনের শব্দ শুনি’, ‘অনৃত রাত্রি’, ‘ছায়াশিকারী’, ‘রঙের মানুষ’, ‘নকশীপাড়ের মানুষেরা’, ‘প্রত্ননারী’, ‘হীরাফুল’সহ আরও অনেক জনপ্রিয় টিভি নাটকের রচয়িতা তিনি। ১৯৯৯ সালের শেষের দিকে গড়ে তোলেন গানের দল ‘কহনকথা’।
বাংলা ভাষার একমাত্র নাট্যবিষয়ক কোষগ্রন্থ ‘বাংলা নাট্যকোষ’ সংগ্রহ, সঙ্কলন, প্রণয়ন ও সম্পাদনা করেছেন সেলিম আল দীন। আদিবাসী জনগোষ্ঠীর জীবনাচরণকে কেন্দ্র করে গঠিত ‘এথনিক থিয়েটার’ও উদ্ভাবন করেন তিনি। তার নাটক ‘চাকা’ থেকে নির্মিত আবু সাইয়ীদের চলচ্চিত্রটি আন্তর্জাতিকভাবে একাধিক পুরস্কার লাভ করে। তার রচিত কথানাট্য ‘হরগজ’ সুইডিশ ভাষায় অনূদিত হয় এবং ভারতের নাট্যদল ‘রঙ্গকর্মী’ হিন্দি ভাষায় তা মঞ্চস্থ করে। তার সৃজনশীলতা দেশকে জয় করে ভারতবর্ষ ছাড়িয়ে ইউরোপ পর্যন্ত বিস্তৃত হয়েছে, এটা বলাই যায়।
অসংখ্য পুরস্কারে ভূষিত হয়েছেন সেলিম আল দীন। এরমধ্যে বাংলা একাডেমি (১৯৮৪), জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার (১৯৯৩ ও ১৯৯৪), একুশে পদক (২০০৭) বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। বাংলা নাটকের এই কিংবদন্তি ও যুগস্রষ্টা ২০০৮ সালের ১৪ই জানুয়ারি, ৫৯ বছর বয়সে মারা যান।
ক্ষণজন্মা নাট্যকার সেলিম আল দীন এ অল্প সময়েই নিজের মেধা, মনন, গবেষণা, পরিশ্রম আর সৃজনশীলতা দিয়ে বাংলাকে ছাড়িয়ে বিশ্বজয় করে গেছেন। যে জীবন সৃজনশীল কাজে ব্যয় হয় না, মানুষ, দেশ, জাতিকে কিছু দিয়ে যেতে পারে না, সে জীবনের সার্থকতা খুব সামান্যই। এক্ষেত্রে সেলিম আল দীন এক সার্থক জীবনের প্রতিচ্ছবি। তিনি বাংলা সাহিত্যের সবচেয়ে পিছিয়ে পড়া একটি শাখাকে দিয়েছেন তার আত্ম-পরিচয়ের সন্ধান, করে গেছেন সমৃদ্ধ। বাংলা ভাষা ও সাহিত্য যতদিন বেঁচে থাকবে, ততদিন সেলিম আল দীনও বেঁচে থাকবেন বাংলা নাটকের মহাকবি, বাঁকবদলের কারিগর কিংবা আমাদের প্রিয় নাট্যাচার্য হয়ে।
দেখুন- সেলিম আল দীন এর বই সমূহ