যখন আপনার বয়স ছিলো এগারো বছর, ভাবুন তো একবার, তখন আপনি আসলে সারাদিন কী করতেন? সকাল ১০টায় স্কুলে যেতেন, ক্লাস শেষে ফিরতেন বাসায়, এরপর হয় ঘুমাতেন বা গেম খেলতেন কিংবা খেলতে বের হতেন মাঠে। রাতে নিয়মমাফিক পড়াশোনার পর ঘুম, তারপর আবার সকাল থেকে একই চক্রে ঘোরা। প্রায় সবার মধ্যেই এই শৃঙ্খলিত লুপ মেনে চলার একধরনের প্রবৃত্তি দেখা যায়। কিন্তু এসব সাধারণ মানুষের মধ্যে থেকেই একজন-দুজন লুপ ভেঙে বের হয়ে আসার চেষ্টা করে। তারা হয়ে যান ব্যতিক্রম। যেহেতু ব্যতিক্রম কখনোই উদাহরণ হতে পারে না, কাজেই আমরা আর সেদিকে কথা না ঘোরাই।
তো এগারো বছরের কথা বলার একটাই উদ্দেশ্য ছিলো, নাইজেরিয়ার এক এগারো বছর বয়সী বালকের হাইপাররিয়ালিস্টিক আর্টিস্ট হয়ে ওঠার গল্প বলা। যদিও তার খ্যাতি ছড়াতে শুরু করেছে এগারো বছর বয়সে, কিন্তু তার এই শিল্পচর্চার শুরু হয়েছে ৬-৭ বছর বয়সের মধ্যে। এই বালকের নামই করিম ওয়ারিস ওলামিলেকান। ওয়াস্পা নামেও সে পরিচিত। এই এগারো বছর বয়সেই সে হাইপাররিয়ালিস্টিক আর্টিস্ট বা অধিবাস্তববাদী শিল্পী হিসেবে আস্তে আস্তে খ্যাতি পাওয়া শুরু করেছে। বেশ কিছু আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে তার এই সম্ভাবনাময় প্রতিভার সমালোচনাও হচ্ছে। এই নাইজেরিয়ান বালককে নিয়েই আজকের এ লেখা।
করিম ওয়ারিস ওলামিলেকান নাইজেরিয়ার লাগোস অঞ্চলের এক মধ্যবিত্ত পরিবারের সন্তান। নাইজেরিয়ার এই অঞ্চলে আরো এরকম কয়েকজন খুদে রিয়ালিস্টিক আর্টিস্টের অর্থাৎ অধিবাস্তববাদী শিল্পীর দেখা পাওয়া যায়। খুব ভালোভাবে বলতে গেলে, একটি রিয়ালিস্টিক আর্টিস্ট গ্রুপের দেখা পাওয়া যাবে এই এলাকায়। তাদের মধ্যে করিম খুব সম্ভবত কনিষ্ঠতম চিত্রশিল্পী।
চিত্রশিল্পে ‘হাইপাররিয়ালিস্টিক আর্ট’ নামের এই শাখাটি যেমন জটিল, ঠিক তেমনই মোহময়। সাধারণত শিল্পের এই শাখাটি বিশেষ ধরনের ভাস্কর্য বা চিত্রশিল্পকে নির্দেশ করে, যা হাতে তৈরি, কিন্তু হাই রেজ্যুলেশন ফটোগ্রাফের মতোই নিখুঁত হয়ে থাকে। হাতে তৈরি শিল্প কিংবা ভাস্কর্য, কিন্তু দেখে মনে হবে যেন ক্যামেরায় তোলা ছবি। মূলত গ্রাফাইট কিংবা চারকোল (কার্বন) পেন্সিল দিয়েই এই ‘ফটোরিয়ালিস্টিক’ শিল্পকর্মগুলো তৈরি করা হয়ে থাকে। অন্যান্য মাধ্যমের মধ্যে আছে কালার পেইন্টিং, প্যাস্টেলসহ আরো কিছু মাধ্যম। এই শিল্পকর্মগুলো তৈরি করতে একদিকে সময় যেমন অনেক বেশি লাগে, ঠিক ততটাই জটিল এর পদ্ধতি। কারণ ছবির প্রতিটি বিবরণ নিখুঁত হওয়া চাই।
করিমের শিল্পচর্চায় ফিরে আসি। করিম নিজেকে একজন ‘ক্ষুদে শিল্পী’ হিসেবে বর্ণনা করে থাকে। শিল্পের প্রতি তার এই আকর্ষণ ছোটবেলা থেকেই ছিলো। এই সূত্র ধরেই সে শুরু করে পোর্ট্রেট আঁকা। যদিও কেবল পোর্ট্রেট এঁকেই সে বসে নেই। সে কার্টুন, কমিকও এঁকে থাকে। এত অল্প বয়সে তার এই বিশেষ প্রতিভার কারণে এই ক্ষুদে শিল্পীকে বিভিন্ন পত্রপত্রিকা ‘গিফটেড’ বা জন্মগত প্রতিভা হিসেবে আখ্যায়িত করেছে বা করছে। কিন্তু আসলেই কি সে গিফটেড শিশু? নাকি এই বয়সে তার শিল্পের প্রতি আকর্ষণ, পরিশ্রম ও চর্চার কারণেই সে এগারো বছর বয়সে আন্তর্জাতিক খ্যাতি পাওয়া শুরু করেছে? আমরা সেই আলোচনাকে বিতর্কিত করতে না যাই।
করিমের বর্ণনানুসারে, সে অধিবাস্তববাদী শিল্পের প্রতি আকৃষ্ট ও অনুপ্রাণিত হয়েছে দুজন আর্টিস্টের শিল্পকর্ম দেখে। প্রথমজন ইতালীয় রেনেসাঁর মাস্টার মাইকেলেঞ্জেলো এবং দ্বিতীয়জন নাইজেরিয়ান শিল্পী আরিঞ্জে স্ট্যানলি। স্ট্যানলির অধিকাংশ পোর্ট্রেটই পেন্সিল দিয়ে আঁকা। করিমও তার অধিকাংশ অধিবাস্তববাদী পোর্ট্রেটগুলো এঁকেছে শুধুমাত্র পেন্সিল দিয়েই। তবে কেবল পেন্সিলেই তার শিল্পকর্ম সীমাবদ্ধ নেই। চিত্রকর্মের আরো কিছু মাধ্যম, যেমন কালার পেইন্ট, প্যাস্টেল, এমনকি বলপয়েন্ট কলমেও তার প্রতিভার প্রমাণ পাওয়া যায় খুব ভালোভাবে।
করিমের এই অধিবাস্তব ছবির মডেল হিসেবে সে কখনো বেছে নিয়েছে তার পরিবারে সদস্যদেরকে, কখনো বা বন্ধুবান্ধব, আত্মীয়-স্বজনদের। আর তারাও খুব আগ্রহের সাথে ক্ষুদে এই শিল্পীর মডেল হয়ে যান। তার প্রতিটি ছবিই সূক্ষ্ম বিবরণে পরিপূর্ণ। এই পোর্ট্রেটগুলোতে ব্যক্তির ব্যক্তিত্ব যেমন ফুটে উঠেছে, তেমনি ফুটে উঠেছে করিমের অসাধারণ প্রতিভা।
তবে করিমের তাক লাগানো কাজ ছিলো যখন ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল ম্যাক্রন দু’দিনের এক সফরে নাইজেরিয়া যান। সেখানে ‘নিউ আফ্রিকা শ্রাইন’ এর মঞ্চে এক সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে যোগ দেয়ার জন্য ম্যক্রনকে আমন্ত্রণ করা হয়। করিমকেও সেখানে ডাকা হয়। মূলত নাইজেরিয়ার একটি ব্যাংক করিমের প্রতিভার কথা জানতে পারে এবং তাকে আমন্ত্রণ জানায়। এই অনুষ্ঠানে আরো কিছু শিল্পীকে আমন্ত্রণ করা হয়।
প্রেসিডেন্ট ম্যাক্রনের আসতে কিছুটা দেরি হচ্ছিলো। এই সময়টায় করিম তার শিল্পচর্চায় মনোনিবেশ করে। প্রায় দু’ঘন্টা সময়ের মধ্যে সে প্রেসিডেন্ট ম্যাক্রনের একটি পোর্ট্রেট তৈরি করে ফেলে। অনুষ্ঠানে আগমন উপলক্ষ্যে এই পোর্ট্রেটটিই প্রেসিডেন্ট ম্যাক্রনকে উপহার দেয়া হয়। ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট এটা দেখে এতটাই অভিভূত হন যে, তিনি তার টুইটার একাউন্টে এর একটি ভিডিওসহ করিমের কাজের প্রশংসা করে একটি পোস্ট দেন। এর পরপরই করিমের প্রতিভার কথা আন্তর্জাতিক মাধ্যমগুলোতে ছড়িয়ে পড়া শুরু করেছে।
করিমের আরো কিছু হাইপাররিয়ালিস্টিক পোর্ট্রেট দেখে নেয়া যাক-
যখন করিমকে প্রশ্ন করা হয় যে, এতসব অসাধারণ পোর্ট্রেটের মধ্যে কোন পোর্ট্রেটটি তার নিজের কাছেই গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে হয়। এই প্রশ্নের জবাবে সে তার সমসাময়িক একটি পোর্ট্রেটের কথা বলে। এর নাম সে দিয়েছে ‘ডেইলি ব্রেড’ (Daily Bread)। যেখানে দেখা যায় একটি ক্ষুধার্ত, ঘর্মাক্ত নাইজেরিয়ান শিশু চামচে করে খাবার মুখে নিচ্ছে। এই শিশুটির মুখচ্ছবি মূলত করিমের নিজের মুখচ্ছবি। কিন্তু এর মাধ্যমে নাইজেরিয়ার সেসব শিশুমুখের প্রতিকৃতি নির্দেশ করা হয়, যারা প্রচন্ড পরিশ্রমের পরেই তাদের প্রাত্যহিক আহার অর্জন করে।
বিবিসি নিউজ-কে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে করিম নিজের অধিবাস্তববাদী শিল্প সম্পর্কে জানায়,
“আমার আর্ট করার পেছনে আমার চারপাশের পরিবেশ, বিশেষ করে আমার পরিবার বিশেষ অনুপ্রেরণা যুগিয়েছে। আমি আরিঞ্জে কিংবা মাইকেলেঞ্জেলোর মতো শিল্পী হতে চাই। চাই শিল্প জাদুঘরে মহান শিল্পীদের চিত্রকর্মের মাঝে আমার ছবিও থাকবে।”
তার সেরা ছবি অর্থাৎ এই ‘Daily Bread’ সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করা হলে সে জানায়,
“আমার সেরা শিল্পকর্ম হচ্ছে এটি, এর শিরোনাম দিয়েছি Daily Bread। এখানে দেখা যাচ্ছে ঘাম এবং অশ্রু। প্রতিদিন খাবার উপার্জনের জন্য আমার পরিবার, আমরা কঠোর পরিশ্রম করি। এটিই আমাকে এই পোর্ট্রেটের জন্য অনুপ্রাণিত করেছে। এখানে মুখের উপর ঘাম কঠোর পরিশ্রম নির্দেশ করে আর চামচ নির্দেশ করছে খাবার। আমার সমাজের প্রত্যেকেরই সম্পদ স্বল্প এবং স্থানীয় মানুষেরা কঠোর পরিশ্রম করে, ঘাম ঝরিয়ে উপার্জন করে খাবারের জন্য।”
করিমের এই শিল্পচর্চা শুরু হয়েছে মূলত ছয় বছর বয়সে। তখন সে স্কুলে বন্ধুদের সাথে বসেই ছবি আঁকাআঁকি করতো। এই ছবিগুলো ছিলো কার্টুন, কমিক্স কিংবা বইয়ের কোনো ছবি। পরে আট বছর বয়সে সে ভর্তি হয় একটি আর্ট একাডেমিতে। এখানেই মূলত সে তার শিল্পপ্রতিভার চর্চা ও বিকাশের শুরু করে।
করিম নিজেকে দাবি করে একজন ‘ক্ষুদে শিল্পী’ হিসেবে। চিত্রশিল্পের প্রতি তার যে আকর্ষণ সেটা তার প্রতিটি শিল্পকর্ম দেখে সহজেই অনুমান করা যায়। কিন্তু নিজেকে ক্ষুদে শিল্পী হিসেবে অভিহিত করলেও তার স্বপ্ন কিন্তু মোটেও তার মতো ক্ষুদে নয়। যার আদর্শ মাইকেলেঞ্জেলো কিংবা আরিঞ্জের মতো শিল্পী, তার ভবিষ্যত স্বপ্নও এঁদের মত মহান কিছু। কিন্তু সময়ের প্রবাহে কতটা সফল হতে পারবে করিম সেটা এখনই বলা অসম্ভব।
ফিচার ইমেজ: mymodernmet.com