মৃত্যু অবধারিত এবং যেকোনো মৃত্যুই কষ্টদায়ক। কিন্তু তারপরেও মানুষের মৃত্যু নিয়ে কৌতুহলের শেষ নেই। এরকমই একজন হলেন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সান ফ্রান্সিসকো এক্সপ্লোরাটোরিয়ামের একজন পদার্থবিজ্ঞানী পল ডুহার্টি। তিনি এবং একজন সহ-লেখক কোডি ক্যাসিডি দীর্ঘ দুই বছর ধরে গবেষণা করেছেন, কী কী অদ্ভুত এবং ভয়ংকর পরিস্থিতিতে মানুষের মৃত্যু হতে পারে। তাদের গবেষণালব্ধ ফলাফল তারা প্রকাশ করেছেন And Then You’re Dead শিরোনামের একটি বইয়ে, যেখানে স্থান পেয়েছে মৃত্যুবরণ করার ৪৫টি অদ্ভুত পদ্ধতি।
বইটি প্রকাশের পর তারা জনপ্রিয় ওয়েবসাইট রেডিটের প্রশ্নোত্তর বিভাগ Ask Us Anything-এ একটি প্রশ্নোত্তর পর্বের আয়োজন করেন, যেখানে পাঠকরা তাদেরকে মৃত্যুর পদ্ধতি সম্পর্কে বিভিন্ন প্রশ্ন করে এবং তারা সেগুলোর উত্তর দেন। অধিকাংশ পরিস্থিতিই বাস্তবে সম্ভব না, সেগুলো নিছকই তত্ত্বীয় ধারণা। কিন্তু তারপরেও লেখকদ্বয় বিজ্ঞানের দৃষ্টিকোণ থেকে চমৎকারভাবে ব্যাখ্যা করেন, অমন পরিস্থিতিতে পড়লে মানুষের কী পরিণতি হতে পারে এবং কীরকম ভয়ংকর মৃত্যু হতে পারে। চলুন জেনে নিই তাদের আলোচনায় উঠে আসা মৃত্যুবরণের পাঁচটি ভয়ংকর পরিস্থিতি এবং সেগুলোর বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা।
বিশ্বের গভীরতম স্থানে গেলে
প্রশান্ত মহাসাগরের নিচে অবস্থিত মারিয়ানা ট্রেঞ্চ হচ্ছে সমুদ্র তলদেশের গভীরতম স্থান। এর গভীরতম বিন্দুর অবস্থান সমুদ্র পৃষ্ঠ থেকে প্রায় ১১ কিলোমিটার নিচে। স্বাভাবিক অবস্থায় কোনো মানুষের পক্ষে সমুদ্রের নিচে এত গভীরে যাওয়া সম্ভব না। কিন্তু যদি সাবমেরিনে করে কাউকে মারিয়ানা ট্রেঞ্চের তলদেশে নিয়ে ছেড়ে দেওয়া হয়, তাহলে কী ঘটবে?
ডুহার্টি এবং ক্যাসিডির মতে, কেউ যদি সাঁতরে মারিয়ানা ট্রেঞ্চে পৌঁছানোর চেষ্টা করে, তাহলে সেখানে পৌঁছার অনেক আগেই তার মৃত্যু ঘটবে। কিন্তু কেউ যদি সত্যিই এর তলদেশে পৌঁছাতে চায়, তাহলে তাকে পরিচালক জেমস ক্যামেরনের ব্যবহৃত ভার্টিক্যাল টর্পেডোর মতো কোনো যানে চড়ে সমুদ্রের তলদেশে গিয়ে এরপর সেখান থেকে বের হতে হবে।
তাদের মতে, মানবদেহের অধিকাংশই পানি হওয়ার কারণে এত গভীরেও মানবদেহের আকার মোটামুটি একই রকম থাকবে। কারণ পানি অসংকোচনযোগ্য পদার্থ। কিন্তু মানবদেহের বায়ুপূর্ণ বিভিন্ন ফাঁপা অঙ্গসমূহ, যেমন নাসিকা গহ্বর, গলদেশ, বক্ষ প্রভৃতি গভীর সমুদ্রের প্রচন্ড চাপে ভেঙ্গে পড়বে এবং ভেতরের দিকে ঢুকে যাবে। ফলে মৃত্যু হবে খুবই কম সময়ের মধ্যে এবং অত্যন্ত যন্ত্রণাদায়ক পদ্ধতিতে।
এ পদ্ধতিতে মৃত্যুবরণ করলে যেহেতু শরীরের অভ্যন্তরে কোনো বায়ুর অস্তিত্ব থাকবে না, তাই মৃতদেহ কখনোই পানির উপরে ভেসে উঠবে না। সমুদ্রের তলদেশেই তা ধীরে ধীরে জৈব পদার্থে পরিণত হবে। অথবা পরিণত হবে স্নট ফ্লাওয়ার (Osdax) নামে একধরনের হাড় খাদক কীটের খাদ্যে, যারা সাধারণত তিমি সহ অন্যান্য মাছের হাড় খেয়ে থাকে, কিন্তু এক্ষেত্রে হয়তো তারা ব্যতিক্রম ঘটিয়ে মানব দেহের হাড়ও পরখ করে দেখতে পারে।
পার্টিকেল এক্সেলারেটরে মাথা প্রবেশ করালে
বিজ্ঞানীরা বিভিন্ন সময়ই গবেষণার জন্য বিভিন্ন কণিকাকে প্রচন্ড ত্বরণে গতিশীল করে বিভিন্ন পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালিয়ে থাকেন। তড়িৎ চুম্বকীয় ক্ষেত্র ব্যবহার করে আহিত কণিকাকে আলোর কাছাকাছি গতিতে চালনা করার এসব যন্ত্রকে বলা হয় পার্টিকেল এক্সেলারেটর। কী হবে যদি ভুলক্রমে কেউ এরকম একটি যন্ত্রের ভেতরে প্রবেশ করে?
১৯৭৮ সালে রাশিয়ান বিজ্ঞানী আনাতোলি বুগোরস্কির মাথা দুর্ঘটনাক্রমে এরকম একটি যন্ত্রের মধ্যে খুব অল্প সময়ের জন্য আটকে গিয়েছিল, যেখানে প্রচন্ড ত্বরণে গতিশীল প্রোটনের বিম যাতায়াত করছিল। বুগোরস্কি সে সময় বলেছিলেন, তিনি কোনো ব্যথা অনুভব করেননি, কিন্তু এত উজ্জ্বল আলোকচ্ছটা দেখেছিলেন যে, সেটাকে তিনি হাজারটা সূর্যের চেয়েও উজ্জ্বল হিসেবে বর্ণনা করেছিলেন। সেই যাত্রায় বেঁচে গেলেও বুগোরস্কি তার বাম কানের শ্রবণশক্তি হারিয়ে ফেলেছিলেন। এছাড়াও তার মুখের একাংশ সম্পূর্ণ অসাড় হয়ে গিয়েছিল, এবং প্রায়ই তিনি মস্তিষ্কে তীব্র ব্যথা অনুভব করতেন।
তবে বুগোরস্কিকে ভাগ্যবানই বলতে হবে। কারণ তার যন্ত্রটি ছিল বর্তমানে সুইজারল্যান্ডে অবস্থিত CERN এর Large Hadron Collider এর তুলনায় মাত্র ১০০ ভাগের ১ ভাগ শক্তিশালী। তীব্র রেডিয়েশনের কারণে যেখানে দুর্বল যন্ত্রেই বুগোরস্কির মৃত্যুর উপক্রম হয়েছিল, সেখানে তার চেয়ে শতগুণ শক্তিশালী যন্ত্রে মাথা প্রবেশ করালে কী হবে, তা সহজেই অনুমেয়।
এলিভেটরের তার ছিঁড়ে গেলে
বিল্ডিং কোড মেনে ভবন তৈরি করলে এবং এলিভেটর স্থাপন করলে তা ভেঙ্গে বা ছিঁড়ে পড়ার কথা না। কিন্তু দুর্ঘটনা তো যেকোনো সময়ই ঘটতে পারে। দুর্ঘটনাবশত যদি কেবল ছিঁড়ে কোনো বহুল ভবনের এলিভেটর পড়ে যেতে শুরু করে, তাহলে কী ঘটবে এর আরোহীদের ভাগ্যে? প্রথমত, এলিভেটর এবং এবং এতে থাকা যাত্রীরা সবাই মুক্তভাবে নিচের দিকে পড়তে থাকবে, কিন্তু এলিভেটরটি যখন মাটিতে আঘাত করবে, তখনই সৃষ্টি হবে ভয়াবহ বিপর্যয়ের। এরকম অবস্থায় মানুষ যদি দাঁড়িয়ে থাকে, তাহলে তার শরীর থেমে থাকলেও শরীরের অঙ্গপ্রত্যঙ্গগুলো নিচের দিকে নেমে যেতে পারে।
অনেকের ধারণা, লিফটটি ভূমিতে আঘাত করার ঠিক পূর্ব মুহূর্তে লাফ দিলে হয়তো এ ধরনের পরিণতি এড়ানো যেতে পারে। কিন্তু এটি সম্পূর্ণ ভুল একটি ধারণা। আবদ্ধ লিফট ঠিক কখন মাটিতে আঘাত করবে, সেটি বুঝতে পেরে তার পূর্ব মুহূর্তে লাফ দেওয়া প্রায় অসম্ভব একটি কাজ। আর লাফ দিলেও কোনো লাভ নেই, প্রচন্ড ত্বরণে গতিশীল থাকার পর হঠাৎ করে থেমে যাওয়া লিফটের সাথে শেষ পর্যন্ত সংঘর্ষ হবেই। এরকম ক্ষেত্রে সবচেয়ে ভালো বুদ্ধি হচ্ছে, লিফটের মেঝেতে শুয়ে পড়ে শরীরের ভর সম্পূর্ণ ছড়িয়ে দেওয়া।
অবশ্য এলিভেটর কার এবং এলিভেটর রুমের আকারের উপর নির্ভর করে এ ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ কমবেশি হতে পারে। যদি এলিভেটর কার এবং রুমের মধ্যে ফাঁকা জায়গার পরিমাণ খুবই কম হয়, তাহলে নিচে আটকে থাকা বাতাসের প্রতিরোধে পতনের বেগ কিছুটা হ্রাস পেতে পারে। এছাড়াও এলিভেটরের ছিঁড়ে যাওয়া ক্যাবল নিচে পড়ে থাকলে সেটাও শক্ত আঘাত থেকে এলিভেটরকে রক্ষা করতে পারে। ফলে এলিভেটরের তার ছিঁড়ে পড়লেই যে মৃত্যু নিশ্চিত, এমনটা না-ও হতে পারে।
পৃথিবীর কেন্দ্রের মধ্য দিয়ে তৈরি গর্তে লাফ দিলে
যদি পৃথিবীর একপ্রান্ত থেকে কেন্দ্রের মধ্য দিয়ে অন্য প্রান্ত পর্যন্ত একটি গর্ত তৈরি করা হয় এবং সেই গর্ত দিয়ে কেউ লাফ দেয়, তাহলে কী ঘটবে? সরলীকৃত অংক করে দেখানো যায় যে, এরকম একটি গর্তের মধ্য দিয়ে লাফ দিলে অন্য প্রান্ত পর্যন্ত পৌঁছতে মোটামুটি ৪২ মিনিট সময় লাগবে। কিন্তু বাস্তবতা এত সরল না। বাস্তবে এরকম পরিস্থিতিতে বিভিন্ন ধরনের জটিলতার সৃষ্টি হবে।
নিজ অক্ষের উপর ক্রমাগত পশ্চিম থেকে পূর্ব দিকে আবর্তনের কারণে বিষুবীয় অঞ্চলে পৃথিবীর পৃষ্ঠের গতিবেগ সর্বোচ্চ, কিন্তু ভূ-অভ্যন্তরে যত গভীরে প্রবেশ করা হয়, এই বেগ তত কমতে থাকে। কাজেই কেউ যদি আমেরিকা থেকে একটি গর্ত করে বাংলাদেশ দিয়ে বের হওয়ার চেষ্টা করে, তাহলে দেখা যাবে কেন্দ্রে পৌঁছানোর আগেই তার গতিবেগ প্রায় ১,২০০ কিলোমিটার হ্রাস করতে গিয়ে তাকে গর্তের দেয়ালে পিষে যেতে হবে।
শুধু এটাই একমাত্র সমস্যা হবে না। ভূ-অভ্যন্তরে যত গভীরে প্রবেশ করা হয়, তাপমাত্রা তত বাড়তে থাকে। বিজ্ঞানীদের ধারণা অনুযায়ী, পৃথিবীর কেন্দ্রের তাপমাত্রা সূর্যের পৃষ্ঠের তাপমাত্রার চেয়েও বেশি। এত উচ্চ তাপমাত্রার জন্য সেই গর্ত দিয়ে খুব বেশিদূর পর্যন্ত যাওয়া সম্ভব হবে না, তার আগেই ভস্মীভূত হয়ে যেতে হবে। আরেকটা সমস্যা হবে, ভূ-অভ্যন্তরের বায়ুর ঘনত্ব। পৃথিবীর অভ্যন্তরে মোটামুটি প্রতি সাড়ে চার কিলোমিটার পরপর বায়ুচাপ এবং ঘনত্ব দ্বিগুণ হয়ে যায়। সুতরাং ৪৫ কিলোমিটার পর্যন্ত পৌঁছতে না পৌঁছতেই বায়ুর ঘনত্ব দশগুণ বৃদ্ধি পেয়ে এরকম অবস্থা হবে যে, আর নিচে যাওয়াই যাবে না।
নিউট্রন স্টারের কাছাকাছি গেলে
নিউট্রন স্টার হচ্ছে আকারে ছোট, কিন্তু অত্যাধিক ঘনত্ববিশিষ্ট নক্ষত্র। বিশালাকৃতির নক্ষত্রের মৃত্যুর মধ্য দিয়ে এদের সৃষ্টি হয়। এদের ব্যাস সাধারণত ১০-২০ কিলোমিটার পর্যন্ত হয়ে থাকে, কিন্তু এদের ভর হয় সূর্যের ভরের তুলনায় দেড় থেকে দুই গুণ বেশি। অর্থাৎ মাত্র এক চা চামচ পরিমাণ নিউট্রন স্টারের পদার্থ নেওয়া হলে তার ভরই হবে কয়েক বিলিয়ন টন! কী ঘটবে কেউ যদি এই প্রচন্ড ঘনত্ব এবং আকর্ষণশক্তি বিশিষ্ট নিউট্রন স্টারের ১ মাইলের কাছাকাছি যায়?
প্রথমত, নিউট্রন স্টারের কাছাকাছি পৌঁছার আগেই প্রচন্ড বিকিরণের কারণে মানুষের মৃত্যু ঘটবে। কিন্তু যদি ধরে নেওয়া হয়, নিউট্রন স্টার থেকে কোনো তাপ বা তেজস্ক্রিয় বিকিরণ নির্গত হচ্ছে না, তাহলেও বেঁচে থাকার কোনো উপায় নেই। প্রচন্ড অভিকর্ষের কারণে কারো মাথা যদি নিউট্রন স্টারের দিকে পায়ের তুলনায় একটু ঝুঁকে থাকে, তাহলেই পায়ের তুলনায় তার মাথা নিউট্রন স্টারের দিকে প্রচন্ড গতিতে আকৃষ্ট হতে থাকবে। ফলে শরীরের আকারের বিকৃতি ঘটা শুরু হবে এবং ঘুরতে ঘুরতে নিউট্রন স্টারের দিকে এগিয়ে যাওয়ার সময় একপর্যায়ে শরীরের অঙ্গপ্রত্যঙ্গ ছিন্ন-বিচ্ছিন্ন হয়ে যাবে।
যদি আকর্ষণ শক্তিকেও অগ্রাহ্য করা হয়, তারপরেও নিউট্রন স্টারের কাছাকাছি গেলে মানুষের মৃত্যু ঘটবে তার প্রচন্ড চৌম্বকত্বের কারণে। নিউট্রন স্টারের চৌম্বকত্ব পৃথিবীর সবচেয়ে শক্তশালী চুম্বকের চেয়েও কয়েকশো কোটি গুণ বেশি। এই প্রবল চৌম্বকত্বের প্রভাবে মানবদেহের প্রতিটি পরমাণুর মধ্যকার বন্ধন ভেঙ্গে যাবে। ফলে মানুষ পরিণত হবে প্লাজমা আকৃতির বস্তুতে, যা নিউট্রন স্টারের দিকে ছুটে যাবে এবং নক্ষত্রটির সাথে সংঘর্ষের পর গামা রশ্মি বিকিরণ করবে।
ফিচার ইমেজ- Doctor Strange (Marvel Studios)