আপনি জানেন কি একটি পূর্ণবয়স্ক মানব দেহে প্রায় ৭ অক্টিলিয়ন পরমাণু থাকে? যা কিনা ৭,০০,০০,০০,০০,০০,০০,০০,০০,০০,০০,০০,০০,০০০টি পরমাণু। অদ্ভুত রহস্যময় আমাদের এই মানব শরীর। এর রহস্যের অনেক কিছুই আমরা জানি না। আমাদের একেকজনের শরীরে রয়েছে একেক রকম বৈশিষ্ট্য। এসব বৈশিষ্ট্য একজনকে অন্যজনের থেকে আলাদা করেছে। কারো চুল কোঁকড়া, কারো সোজা, কারো ত্বক সাদা, কারো কালো।
এসব সাধারণ বৈশিষ্ট্যের বাইরেও কিন্তু মানবদেহের এমন কিছু বৈশিষ্ট্য রয়েছে, যা অতি দুর্লভ। পৃথিবীর মোট জনসংখ্যার খুব অল্প সংখ্যক মানুষের শরীরে এমন কিছু বৈশিষ্ট্য খুঁজে পাওয়া যায়। এসব বৈশিষ্ট্যগুলো যেমন বিরল, তেমনি চমকপ্রদ। মানবদেহের এসব বৈশিষ্ট্য দেখলে হয়তো সুপারহিউম্যানরাও হিংসা করবে। চলুন তাহলে জেনে নিই মানবদেহের এমনই ১০টি বিরল শারীরিক বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে।
১. অবিশ্বাস্য ঘনত্বযুক্ত হাড়
আমাদের মাঝে এমন কিছু মানুষ রয়েছে, যাদের শরীরের হাড়ের ঘনত্ব স্বাভাবিক মানুষের থেকে অনেক বেশি। ফলে তাদের হাড় একজন সাধারণ মানুষের থেকে অনেক বেশি শক্ত। দুর্লভ এই শারীরিক বৈশিষ্ট্যের পেছনে রয়েছে একটি জিনের ভূমিকা। সেটি হলো LRP5। এই জিন মানবদেহে হাড়ের ঘনত্ব কেমন হবে, তা নিয়ন্ত্রণ করে। এর অভাবে মানবদেহের হাড় দুর্বল ও ভঙ্গুর হয়ে যেতে পারে। জিনটির মিউটেশন বা পরিব্যাপ্তির ফলে মানবদেহের হাড়ের ঘনত্ব অত্যধিক বেশি হয়। ফলে সেই মানবদেহের হাড় এতটাই শক্ত হয়, যা ভাঙা প্রায় অসম্ভব। এছাড়াও এই জিনের পরিব্যাপ্তির ফলে চামড়ার উপর বয়সের প্রভাবও কম পড়ে। ফলে বৃদ্ধ বয়সেও ত্বক অনেক সতেজ থাকে।
শুনতে অনেক চমকপ্রদ হলেও এর একটি নেতিবাচক দিকও রয়েছে। যার শরীরে এই বৈশিষ্ট্য রয়েছে, বৃদ্ধ বয়সে তার যদি হাড়ের জয়েন্ট রিপ্লেসমেন্টের প্রয়োজন হয়, তবে তা করাও প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়ে কারণ এ ধরনের হাড় ভাঙা বা কাটা প্রায় অসম্ভব।
২. সোনালী রক্ত
না, নামে সোনালী হলেও এই রক্ত আসলে দেখতে সোনালী নয়। ১৯৬১ সালে ডাক্তাররা এমন একধরনের দুর্লভ রক্ত খুজে পান, যার নাম ‘Rh-null’। এই রক্তে কোনো অ্যান্টিজেন নেই। ফলে এই রক্ত যে কেউ গ্রহণ করতে পারে। অর্থাৎ যেকোনো গ্রুপের গ্রাহক এই রক্ত শরীরে গ্রহণ করতে পারে। এছাড়াও এ রক্তের আরোগ্য ক্ষমতাও স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি। এজন্য এই রক্তকে বলা হয় গোল্ডেন ব্লাড বা সোনালী রক্ত।
এই রক্ত এতটাই দুর্লভ যে বর্তমানে গোটা বিশ্বে মাত্র ৪০ জন মানুষের দেহে এই রক্ত রয়েছে। এই ৪০ জনের মধ্যে ৯ জন নিয়মিত রক্তদান করেন।
৩. কানের কাছে বাড়তি ফুটো
আপনি হয়তো কখনো এমন কাউকে দেখে থাকবেন, যার কানের পাশে একটি বাড়তি ফুটো রয়েছে। এই ফুটোকে বলা হয় ‘প্রিওরিকুলার সাইনাস’। পৃথিবীর মাত্র ৫ শতাংশ মানুষের কানের কাছে এমন ফুটো থাকে।
বলা হয়ে থাকে, সকল প্রাণীর দেহেই যে একসময় ফুলকা ছিল, এটি তার প্রমাণ। এটিই সেই ফুলকা বা কানকোর বিবর্তিত রূপ। ভ্রুণ গঠনের সময় এর সৃষ্টি হয়। এটি একটি জেনেটিক বৈশিষ্ট্য। কারো একটি কানে, কারো আবার দু’কানেই এমন ফুটো থাকতে পারে। মানবদেহের কোনো কাজেই এটি লাগে না। কোনো ক্ষতিকর দিকও নেই। তবে কেউ চাইলে সার্জিক্যাল অপারেশনের মাধ্যমে এটি সরিয়ে ফেলতে পারে।
৪. তালুর লম্বা পেশী
‘পালমারিস লংগাস’ নামে পরিচিত এই পেশীটি আমাদের অনেকের মধ্যেই দেখতে পাওয়া যায়। বিজ্ঞানীদের মতে, এটি আমাদের পূর্বপুরুষ থেকে পাওয়া। আদিমযুগে যখন মানুষের বেশি বেশি গাছে চড়ার প্রয়োজন হতো, তখন এই পেশীটি কাজে লাগতো। তবে বর্তমানে এই পেশীটি কোনো কাজেই লাগে না। পৃথিবীর মোট জনসংখ্যার প্রায় ১৫ শতাংশ মানুষের দেহে এটি থাকে না।
আপনার শরীরে এই পেশীটি আছে কিনা দেখতে চান? আপনার হাতটি ছবির মতো করে কোনো সমতল স্থানে রাখুন। এবার হাতের বৃদ্ধাঙ্গুল দিয়ে কনিষ্ঠ আঙ্গুলকে স্পর্শ করুন। যদি ছবির মতো লিগামেন্টটি উঁচু হয়ে ওঠে, তবে বুঝবেন আপনার দেহে এই পেশীটি রয়েছে।
৫. দুটি ভিন্ন রঙের চোখ
পৃথিবীতে এমন কিছু মানুষ আছে, যাদের দুই চোখের রঙ দু’রকম। তবে খুব কমসংখ্যক মানুষের মধ্যেই এই বৈশিষ্ট্য দেখতে পাওয়া যায়। এ ধরনের বৈশিষ্ট্যকে বলা হয় কাইমেরিজম (Chimerism)। প্রাচীন গ্রীক পুরাণ অনুসারে, কাইমেরা হলো একধরনের প্রাণী, যার মাথা ও ঘাড় সিংহের মতো, পিঠে ছাগলের মতো আরেকটি মাথা এবং লেজ সাপের মতো।
মানবদেহের কাইমেরিজম হয় তখন, যখন কারো দেহে একটি বাড়তি ডিএনএ সেট থাকে। এর ফলে ‘মোজাইক ত্বক’ অথবা হেটেরোক্রমিয়া হয়ে থাকে। এ ধরনের শারীরিক বৈশিষ্ট্য ক্ষতিকর নয়, তবে কখনো কখনো এর ফলে পারিবারিক সমস্যা হতে পারে।
৬. দ্বিগুণ চোখের পাঁপড়ি
এই বিরল জেনেটিক বৈশিষ্ট্যটিকে বলা হয় ‘ডিস্টিকিয়াসিস’। এর ফলে চোখের পাতায় দ্বিতীয় আরেক সারির পাঁপড়ি থাকে। অর্থাৎ দ্বিগুণ পাঁপড়ি থাকে চোখের পাতায়। বিখ্যাত হলিউড চিত্রনায়িকা এলিজাবেথ টেইলরের এমন চোখের পাতা ছিল।
এর ফলে সাধারণত চোখের কোনো সমস্যা হয় না। বরং ঠিকমতো পরিচর্যা করা গেলে চোখ দেখতে আরো সুন্দর দেখায়। তবে কোনো কোনো ক্ষেত্রে দ্বিতীয় সারির পাঁপড়িগুলো অনেক সময় চোখের অস্বস্তির কারণ হতে পারে।
৭. বাড়তি পাঁজর
সাধারণত নারীদের মধ্যেই এই বৈশিষ্ট্যটি বেশি দেখা যায়। এর ফলে পাঁজরের উপরের দিকে একটি বাড়তি পাঁজরের হাড় থাকে। একে বলা হয় সার্ভিক্যাল।
বিভিন্ন আকারের হতে পারে এই হাড়টি। আকারে ছোট হলে এটি সাধারণত কোনো সমস্যার সৃষ্টি করে না। তবে আকারে বেড়ে গেলে এটি অস্বস্তিকর হয়ে উঠতে পারে।
৮. অদৃশ্য রঙ দেখার ক্ষমতা
নারীদের মধ্যে দেখতে পাওয়া আরেকটি বৈশিষ্ট্য হলো ‘টেট্রাক্রোমাসি’। এটি হলো বিভিন্ন রঙের মাত্রা আলাদা করে বোঝার একটি বিশেষ ক্ষমতা।
একজন সাধারণ মানুষ একটি গাঁদাফুল দেখে হয়তো বলবে এর রঙ হলুদ। তবে একজন টেট্রাক্রোমাসি যুক্ত মানুষ সেই একই ফুলটিতে হলুদ রঙের অনেকগুলো আলাদা আলাদা মাত্রা দেখতে পাবে। ‘এক্স’ ক্রোমোজোমের মিউটেশনের ফলেই মানবদেহে এমন বৈশিষ্ট্য দেখা যায়। যেখানে একজন সাধারণ মানুষ দেখতে পায় মাত্র ১ মিলিয়ন রঙ, সেখানে এই বৈশিষ্ট্যের ফলে একজন ৯৯ মিলিয়নেরও বেশি রঙ দেখতে পায়।
৯. ঘুমের কম চাহিদা
আমাদের মধ্যে কিছু কিছু মানুষ আছে, যারা খুব অল্প সময় ঘুমিয়েই সম্পূর্ণ বিশ্রাম নিয়ে নিতে পারে। একজন সাধারণ মানুষ যতক্ষণ ঘুমায়, তার চেয়ে অনেক কম ঘুমালেই তাদের ঘুমের চাহিদা পূরণ হয়ে যায়। মার্গারেট থ্যাচার, সালভাদর ডালি, উইনস্টন চার্চিল, নিকোলা টেসলা সহ ইতিহাসের অনেক বিখ্যাত মানুষ এই বৈশিষ্ট্যের অধিকারী ছিলেন।
মানবদেহে DEC2 নামের একটি জিনের মিউটেশনের ফলেই এই বৈশিষ্ট্যটি দেখা যায়।
১০. হৃদরোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা
পৃথিবীতে এমন কিছু ভাগ্যবান মানুষ আছে, যারা জন্মগতভাবেই হৃদরোগের প্রতিরোধ ক্ষমতা নিয়ে জন্মায়। তাদের শরীরে কোলেস্টেরল তৈরি হয় না। তারা যতই তৈলাক্ত খাবার খান না কেন, তাদের দেহের কোলেস্টেরলের মাত্রার কোনো পরিবর্তন হয় না। ফলে তাদের ক্ষেত্রে হৃদরোগের ঝুঁকি ৯০ শতাংশ কমে যায়।
আমাদের সবার দেহেই PCSK9 নামের একটি জিন থাকে। তবে এ ধরনের মানুষের দেহে এই জিনের পরিমাণ থাকে খুবই কম। ফলে তাদের দেহে কোলেস্টেরল তৈরি হয় না। তাই তারা কোলেস্টেরলের চিন্তা না করেই যা খুশি তা-ই খেতে পারে!