১৯৬০ সালের দিকে রবার্ট ম্যাকআর্থার এবং এডওয়ার্ড উইলসন একটি গবেষণা শুরু করেন, যার উদ্দেশ্য ছিল একটু অন্যরকম। তারা বিভিন্ন দ্বীপে প্রাণীদের বসবাস নিয়ে গবেষণা করছিলেন। একসময় তারা লক্ষ্য করলেন, বেশিরভাগ ভিন্ন ভিন্ন প্রজাতির প্রাণীদের অবস্থান বড় দ্বীপগুলোতে বেশি দেখা যায়। তারা এটা নিয়ে বেশ কিছু সমীক্ষা চালালেন এবং ব্যাপারটি বুঝতে পেরে একটু অবাকই হলেন।
সারা পৃথিবীতে এত জায়গা থাকতে দ্বীপগুলোতেই কেন এমনটি হচ্ছে? তারা দেখলেন, পোকামাকড়, পাখি ইত্যাদি প্রাণীর সমাহার দ্বীপগুলোতেই বেশি দেখা যায়। তবে আরেকটু বিস্তারিতভাবে ব্যাপারটি যখন গবেষণা করলেন তখন দেখা গেলো, প্রাণীদের প্রাচুর্যতা দ্বীপের আকারের উপর নির্ভর করছে। দ্বীপের ছোট-বড় আকৃতির উপর প্রাণীদের সংখ্যা এবং প্রাচুর্যতা নির্ভর করছে। তখন তারা দুজন ভাবলেন, এ ব্যাপারটি নিয়ে গাণিতিক মডেল দাঁড় করানো উচিত। এটা মনে হওয়ার সাথে সাথেই তারা একটি মডেল দাঁড়া করালেন, যার নাম দেয়া হয় “Species Equilibrium Model” বা “Theory of Island Biogeography”।
পরে এই তত্ত্বটি অত্যন্ত জনপ্রিয়তা লাভ করে। যদি একটি দ্বীপে বা অন্য যেকোনো প্রাকৃতিক স্থানে ভিন্ন ভিন্ন প্রজাতির প্রাণী বসবাস করে, তখন সেই পুরো জায়গাটিতে প্রজাতির প্রাচুর্যতা বেড়ে যায় এবং সেই জায়গাকে প্রজাতি প্রাচুর্যসম্পন্ন স্থান বলা হয়। দুই বিজ্ঞানী গাণিতিক মডেল দাঁড় করানো যখন শুরু করলেন, তখন দুটি ভিন্ন ভিন্ন দিক বের হয়ে আসে যেগুলোর উপর যেকোনো দ্বীপে প্রাণীদের অবস্থান নির্ভর করে। একটি হচ্ছে প্রাণীদের সেই দ্বীপে অভিবাসনের হার এবং অপরটি সেই দ্বীপে প্রাণীদের অধুনালুপ্তের হার। এখানে উল্লেখ্য, এই হারের পরিমাণ একেক প্রজাতির প্রাণীর বেলায় একেক রকম হয়ে থাকে। মডেল থেকে দেখা যায়, এমন একটি গাণিতিক রাশি সমীকরণে চলে এসেছে যেটা বলছে যে এমন একটি সময় আসবে যখন অভিবাসন এবং বিলুপ্তির হার সাম্যাবস্থায় চলে আসবে। এ সময়কে বলা হচ্ছে সাম্যাবস্থা বিন্দু। কোনো দ্বীপে গড়ে কয়টি প্রাণী বসবাস করছে সেটি এই বিন্দু থেকে নির্ণয় করা যায়।
এবার মডেল সম্পর্কে একটু আলোচনা করা যাক। দ্বীপের আকার এখানে একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ। ছোট দ্বীপগুলোতে স্বাভাবিকভাবেই বড় দ্বীপগুলো থেকে কম প্রজাতির প্রাণী এবং উদ্ভিদ দেখতে পাওয়া যাবে। এর পেছনে একটি কারণ কাজ করে। প্রাণীরা একটি দ্বীপে হয় উড়ে না হয় জলে ভেসে যেতে পারে। সেখানে গিয়ে তারা একটি কলোনি তৈরি করে নেয়। ছোট দ্বীপে এই কলোনি তৈরির সুযোগ কম হয়। যেকোনো ছোট দ্বীপে অভিবাসনের হার কম হলেও সেখানকার প্রাণী প্রজাতির বিলুপ্তির হার অনেক বেশি। কারণ দ্বীপের ক্ষেত্রফল ছোট হলে বেঁচে থাকার জন্য যেসব প্রাকৃতিক উপাদান থাকা উচিত সেগুলোর পরিমাণ থাকে কম। অর্থাৎ বেঁচে থাকার জন্য প্রয়োজনীয় প্রাকৃতিক সম্পদ কম হওয়ার কারণে খুব বেশি সময় ধরে সেখানে প্রাণীদের বংশবৃদ্ধির সুযোগ কম।
জনবসতিপূর্ণ এলাকা থেকে কোন দ্বীপ কত দূরে অবস্থিত সেটাও সেই দ্বীপে প্রাণীদের অস্তিত্ব এবং টিকে থাকার উপর প্রভাব ফেলে। আমরা ধরে নিই, দুটি দ্বীপের আকার একই রকম। সেই দ্বীপ দুটির বৈশিষ্ট্যও একই রকম। এই দুটি দ্বীপের মধ্যে যেটা জনবসতিপূর্ণ এলাকার কাছাকাছি থাকবে সেই দ্বীপে প্রাণী প্রজাতির হার বেশি হবে। এর পেছনের প্রধান কারণ হচ্ছে যেসব প্রাণী এক অঞ্চল থেকে অন্য অঞ্চলে বসবাস করার জন্য যায়, খুব স্বাভাবিকভাবেই এরা কাছাকাছি অঞ্চলেই নিজের বসতি গড়বে, যদি সেখানে বেঁচে থাকার জন্য সবধরনের উপাদান তারা খুঁজে পায়।
উপরের আলোচনা থেকে একটা বিষয় বোঝা যাচ্ছে, যদি বড় কোনো দ্বীপ জনবসতিপূর্ণ এলাকার কাছাকাছি থাকে, তাহলে সেখানে বৈচিত্র্যময় প্রজাতি পাওয়া যাবে। কিন্তু ছোট দ্বীপ যদি এরকম জায়গা থেকে দূরে অবস্থান করে, তাহলে সেখানে কম প্রজাতির প্রাণী পাওয়া যাবে, এমনকি না-ও পাওয়া যেতে পারে। রবার্ট ম্যাকআর্থার এবং এডওয়ার্ড উইলসন এ বিষয়টি নিয়ে গবেষণা করে উপরে বর্ণনা করা দুটি সম্ভাব্য কারণ প্রস্তাব করেছেন। পরবর্তীতে আরও জটিল বৈজ্ঞানিক অনুসন্ধানের মাধ্যমে এই ব্যাপারটি যুক্তির সাহায্যে প্রমাণ করা গিয়েছে।
এই দুই বিজ্ঞানীর এরকম গবেষণা করার কারণে পরবর্তীতে বেশ কিছু ঘটনাকে আগে আগে বোঝা গিয়েছিলো। যেমন- কোনো পাহাড়ি উপত্যকার মাঝখানে কিংবা কোনো দেশের জাতীয় উদ্যানে যদি কৃত্রিম বন তৈরি করা হয় এবং সেখানে যদি বিভিন্ন প্রজাতির প্রাণী সংরক্ষণ করার চেষ্টা করা হয়, তাহলে পরবর্তীতে সেখানে কী ধরনের পশুপাখির জনবসতি গড়ে উঠবে কিংবা কী ধরনের পরিবেশে এই প্রাণীগুলোকে ঠিকভাবে সংরক্ষণ করা যাবে। তাই দ্বীপে বসবাসরত পশুপাখিদের অবস্থান নিয়ে যে গবেষণা করা হয়েছে এবং সেই গবেষণা থেকে যে তত্ত্ব গঠন করা হয়েছে সেটা সারা বিশ্বের বিজ্ঞানীরা সাদরে গ্রহণ করেছেন।
যেকোনো জায়গায় যত বেশি প্রজাতির জীববৈচিত্র্য থাকে, সেই জায়গা তত বেশি সমৃদ্ধশালী, কারণ বিভিন্ন প্রজাতির বৈচিত্র্যের জন্য সেখানকার ইকোসিস্টেম বা বাস্তুসংস্থানের দৃঢ়তা বজায় থাকে। তাছাড়া প্রাণীদের নিয়ে এ ধরনের গবেষণা শুধু দ্বীপগুলোতেই করা সম্ভব। কারণ দ্বীপগুলো অন্য সব জায়গা থেকে একদম বিচ্ছিন্ন, যে কারণে প্রাণীদের আনাগোনা এবং সেখান থেকে বিলুপ্ত হওয়ার ব্যাপারটি খুব সহজেই লক্ষ্য করা যায়।
একটি দ্বীপে গাছপালা এবং অন্যান্য প্রজাতির উদ্ভিজ্জ কী পরিমাণ আছে সেটি একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। কারণ এই উদ্ভিদগুলো দ্বীপের ইকোসিস্টেমে উৎপাদক হিসেবে কাজ করে। যত বেশি উৎপাদক থাকে এবং যত বেশি করে গাছপালা জন্ম নেয়, প্রাণীদের জন্য খাবারের যোগান তত বেশি হয়, যে কারণে প্রাণী বৈচিত্র্যের আবির্ভাব ঘটে। উৎপাদক-গ্রাহকের এরকম মিশেলের কারণে দ্বীপটি বসবাসের জন্য আদর্শ জায়গা হিসেবে পরিগণিত হয়।
ভিন্ন ভিন্ন প্রজাতির প্রাণীর মিশেল থাকলে জীব মিথস্ক্রিয়া বেশি হয়। উদ্ভিদ এবং প্রাণীদের মধ্যকার যে খাদ্যজাল তৈরি হয় সেটি মজবুত এবং দৃঢ় হয়। বিভিন্ন সময়ে পরিবেশে অনেক রকমের বৈরিভাব চলে আসে, যেমন- খরা, পোকামাকড়ের উপস্থিতি ইত্যাদি। গবেষণায় দেখা গিয়েছে, একটি এলাকা যত বেশি জীববৈচিত্র্যে সমৃদ্ধ হয়, সেই এলাকার প্রজাতিদের যেকোনো বৈরিভাব মোকাবেলা করার ক্ষমতা তত বেশি হয়। উদ্ভিদ-প্রাণীদের মিথস্ক্রিয়ার ফলে যেকোনো পরিস্থিতির জন্য তারা নিজেদেরকে গঠন এবং পরিবর্তন করে ফেলতে পারে। সুতরাং একটি আদর্শ ইকোসিস্টেমের কারণে জনবসতি এলাকা একদম বিচ্ছিন্ন হওয়া সত্ত্বেও দ্বীপগুলো নিজেদের মতো করে টিকে থাকতে পারে।
তথ্যসূত্র
[১] Miller, G.T and Spoolman, S.E. (2012). Living in the Environment, 17th Edition, Brooks/Cole, Cengage Learning.
[২] Miller, G.T and Spoolman, S.E. (2016). Environmental Science, 15th Edition, Brooks/Cole, Cengage Learning.
[৩] Miller, G.T and Spoolman, S.E. (2009). Essentials of Ecology, 5th Edition, Brooks/Cole, Cengage Learning.
ফিচার ইমেজ সোর্স: samuivillaretreat.com